বাংলাদেশের এই দিকে তার মাতামহ নিখিলচন্দ্র ঘোষ একা একা মারা গিয়েছিলেন। ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে। অঘ্রান মাস, এই উত্তরদেশে তখন কঠিন শীত। বিমলেশ বাংলাদেশের সেই উত্তরে এসেছে ছিটমহল বুঝতে। কুড়িগ্রাম থেকে দুপুরে তারা বাসে রওনা হলো রঙ্গপুর। কুড়িগ্রাম চায়না বাজারের হানিফ মিঞার ছেলে হাসুর সঙ্গে ফেরার সময় দেখা হয়নি আর বিমলেশের। বছর তিরিশের সেই হাসু, মানসিক প্রতিবন্ধী। হাসু ওষুধের ঘোরে ঘুমোচ্ছে। হানিফ মিঞার চোখে জল এসেছিল তারা অটোয় ওঠার সময়। হাসুর মুখখানি বিমলেশ মনের ভিতরে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল দীর্ঘ সেই বাসযাত্রায়। রঙ্গপুর পৌঁছে বিমলেশের সঙ্গী ছিট আন্দোলনের ভুবনের বন্ধুর সঙ্গে তাদের দেখা হয়। বুবলিন ও পারভেজ অপেক্ষা করছিল ভুবনের জন্য। বাস স্ট্যান্ডের অপর দিকে বৈশাখী নামের মস্ত রেস্তোরায় তারা বসেছিল। তাদের ছিটমহল বোঝাল ভুবন, তারপর জিজ্ঞেস করল, অমুকে কেমন আছে, তমুকে কেমন আছে? ভুবনের স্মৃতি শক্তি অবাক করার মতো। একবার দেখেছিল কাউকে এই শহরে এসে, তার নাম থেকে পুরো বায়োডাটাই যেন মনে আছে তার। অথচ শহরের মানুষ বুবলিন বা পারভেজ তাদের সেই ভাবে চিনে উঠতেই পারে না। একজন সম্পর্কে পারভেজ বলল, এবার বুঝতে পেরেসি ভুবনদা, ও লোক আমাদের শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে লিখেসিল, হি ইজ এগেইন্সট মুক্তিযুদ্ধ কনন্সেপ্ট। লোককে চেনা যায় না।
তারপর পারভেজ নামের সেই উজ্জ্বল চক্ষুর যুবক বিমলেশকে জিজ্ঞেস করল, রঙ্গপুরে তো আগে আসেননি দাদা?
বিমলেশ মাথা নাড়তে সে জিজ্ঞেস করল, এখানে তাহলে আমি আর বুবলিন আপা আপনার চেনা হলাম?
বিমলেশ হাসে। সে রঙ্গপুরের কথা কিছু জানে, ইতিহাসে পড়েছে। আচমকা জিজ্ঞেস করল, একজনকে চেন তুমি পারভেজ, নিখিলচন্দ্র ঘোষ?
বুবলিন আর ভুবন তাদের কথোপকথন শুনতে পায় না। পারভেজ নড়ে বসে বিমলেশের কথায়, বলল, নামটা জানা মনে হচ্ছে, কী রকম বয়স বলুন দেখি।
বিমলেশ বলল, অ্যারাউন্ড ফোরটিফাইভ।
কেমন দেখতে বলুন দেখি। জিজ্ঞেস করে পারভেজ।
বিমলেশ আন্দাজে সেই আবছা দেখা, মাথায় কম্ফর্টার মোড়া মানুষটিকে বর্ণনা করতে লাগল, শুনতে শুনতে পারভেজ হোসেন মাথা দোলাতে লাগল, বলল, হু, শাহবাগের ধর্না এখানেও শহীদ মিনারের নিচে হয়েছিল, সেখানে ছিলেন মনে হচ্ছে, নামটা আমার জানা।
বিমলেশ শিহরিত হলো। পারভেজ বলতে লাগল, রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে ধর্নায় সে উপস্থিতি নোট করেছিল কয়েকদিন। তখন এই নামটি এসেছিল মনে হয়। যখন আলো পড়ে আসত, সেই গোধূলিবেলায় তিনি আসতেন। একদম পেছন দিকে বসে থাকতেন। এখেনে মার্চেও শীত থাকে। তখনো বেলা ছোটই। সেই মানুষটি ডিসেম্বর থেকেই আসতে আরম্ভ করেছিলেন। ওই ঠান্ডায় বসে থাকতেন। সেই ধর্নায় তো সকলেই তরুণ, বয়স্করা এসে চলে যেতেন, সন্ধের পর তারা থাকতেন না, কিন্তু তিনি বুঝি সমস্ত রাত ছায়ার মতো ছুঁয়ে থাকতেন শহীদ মিনারের ছায়া, তারপর সেই রাত ফুরিয়ে আসত যখন, মিলিয়ে যেতেন কখন তা টের পেত না কেউ। পারভেজের মুখে এই শহরে সেই ধর্নার কথা শুনছিল বিমলেশ।
তারপর তারা রঙ্গপুর থেকে পঞ্চগড় রওনা হলো আবার বাসে। অনেকটা সেই পথ। এই হাইওয়ে সীমান্ত ধরে উত্তর থেকে উত্তরপুবের দিকে গেছে। ঠাকুর গাঁ, রানির বন্দর, দিনাজপুরের পথ ধরে বাস পঞ্চগড়ের দিকে ছুটছে। বিমলেশ জানে যে মাটির উপর দিয়ে যাচ্ছে সে, সেই মাটি কৈবর্ত বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, রায়ত বিদ্রোহ, আধিয়ার বিদ্রোহ আর তেভাগা আন্দোলনের জননীক্ষেত্র। রঙ্গপুরকে এক সময় লাল রঙ্গপুর বলা হত। পুরো উত্তরদেশই তাই। বাসে জানালার ধারে বসে বিমলেশ যে কথা শুনছিল পেছনের যাত্রীদের, সেই কথায় যে সব জায়গা উঠে আসছিল, সেই সব জায়গা অচেনা কিন্তু মনে হয় যেন স্বপ্নের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা। ভুবন ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিমলেশের মনে হচ্ছিল রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, মৈমনসিং, যমুনাব্রিজ, টাঙাইল, ঢাকা, নাটোর, বাগেরহাট, ফরিদপুর, চিটাগাং......সব পার হয়ে যাচ্ছে সে অযুত অন্ধকারে। তখন সেই মানুষটির কথা মনে পড়ল। সেই লোকটি কি ভুবনের পরে বসে আছে, চাদর মুড়ি দিয়ে এতসময় যেন ঘুমোচ্ছিল। ভুবন ঘুমোতে সে জেগে উঠল। বাস অন্ধকার। মানুষের গুনগুন ছাড়া তেমন শব্দ নেই। সেই গুনগুনও থেমে গেল ধীরে ধীরে। এক অখন্ড নিস্তব্ধতার ভিতরে বাস ছুটছিল অন্ধকার ভেদ করে। ভুবনের ওপাশের মানুষটি বললেন, আপনি বলুন দেখি অন্ধকারে কি কিছু বুঝা যায়?
কী করে বুঝব? বিমলেশ বলে।
আমার কিছু বুঝার আছে।
বিমলেশ বলল, জানি।
কী জানেন?
আমার সন্দেহ হচ্ছে। বিমলেশ বলে।
সন্দেহে কোনো লাভ নেই। তিনি বলেন।
আপনি ফিরবেন না কপোতাক্ষ ধারে? বিমলেশ বলল।
সে তো আর নেই। তিনি বললেন।
নেই মানে? বিমলেশ ঘোরের ভিতর জিজ্ঞেস করে।
শুকিয়ে শ্মশান, উত্তরের সব নদী, দক্ষিণের সব নদী শুকিয়ে গেল প্রায়, যাব কোথায়, সব নদীর ভিতরে বড় বড় চর, পদ্মা মেঘনা থেকে সমস্ত নদী মরে যাচ্ছে।
বিমলেশ বলল, আপনার একটা চিঠি আছে আমার কাছে।
কার চিঠি, অনিতার?
ইয়েস স্যার, আপনি ঠিক বুঝেছেন।
পড়ুন দেখি।
আমি দিয়ে যাব, আপনি পড়ে নেবেন স্যার।
আচ্ছা, আপনার কী করা হয়, লেখা হয়?
ইয়েস মিঃ ঘোষ, আমি জারনালিস্ট।
এই সব কথা লিখতে পারবেন, আমি যা বলব?
বিমলেশ বলল, কী কথা মাস্টারবাবু?
আমি গিয়েছিলাম, শেষ ট্রেনে ফিরেছিলাম, তারপর ইস্টবেঙ্গল রেল, ই,বি,আর, বন্ধ হয়ে গেল, আর যাওয়ার পথ নেই।
গিয়েছিলেন তো ফিরলেন কেন?
কেউ নেই, বাড়ি ঘরদোরে অন্যলোকে বাসা বেঁধেছে, আমারে চিনল না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ল, বিড়বিড় করে মাস্টারবাবু, কবে গেল, কোথায় গেল সব কেডা জানে।
বিমলেশ চুপ করে থাকে। তিনি একটু থেমে আবার বিষণ্ণ গলায় বললেন, কপোতাক্ষ মরে গেছে , স্টিমার নেই অনেককাল।
বিমলেশ বলল, আপনার কেউ নেই সেই ধুরোল আর বাঁকায়?
বললাম তো, পরে শুনলাম কত লোক কলকাতার দিকে চলে গেছে, ইন্ডিয়া, এদিকটা পাকিস্তান থেকে এখন বাংলাদেশ।
আপনি তাই আবার ফিরে এলেন এদিকে?
ওদিকে কেউ চিনল না যে।
এদিকে চেনে? জিজ্ঞেস করল বিমলেশ।
দীর্ঘশ্বাস শুনল বিমলেশ, মনে হয় তো, আপনি ইন্ডিয়া গিয়ে এই লোকটার কথাগুলো জানাবেন একটু।
ছিটমহলের কথা তো?
মাস্টারবাবু বললেন, শুধু কি ছিট, আরো কথা আছে।
আমি কাকে জানাব?
আমার যদি কেউ থাকে, তাদের, আর অন্যদের।
অন্যরা মানে?
ওই দেশের বড় বড় যারা আছেন। মাস্টারবাবু বলল, প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার, দেশের মানুষ, সবাই জানুক, আমাদের সব নদীও মরে যাচ্ছে।
আঁজ্ঞে? বিমলেশ বলল, আমি তিস্তা দেখলাম, জল নেই, ধু ধু বালির চর।
তিস্তা কেন, যমুনা, ধরলা, ঘাঘট, দুধকুমার, করতোয়া, সংকোশ, হলহলিয়া, সোনাভরি, জিঞ্জিরাম, ডাহুক, চাওয়াই, কুড়ুম, ছোট তিস্তা, তালমা, ঘোড়ামারা, আমাদের কত নদী, কীর্তনখোলা, রূপসা, ভৈরব, ইছামতী, মধুমতী, চিত্রা, গড়ুই, কপোতাক্ষ...সব মরে যাচ্ছে। তিনি মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন।
আমি সামান্য মানুষ, আমার কথায় কী হবে? বিনীত গলায় বলল বিমলেশ।
হবে, হবে, আমি শুধু এই কথাটা বলতেই আপনার পিছে পিছে ঘুরছি কদিন, নদীর উজানে বাঁধ বেঁধে জল আটকে দিয়েছে ওপারের মানুষ, আমরা এক ছিলাম, এক নেই, আমাদের নদী যদি চলে যায়, শ্মশান হয়ে যাবে সব, আপনি বলুন গিয়ে।
বিমলেশ বলল, বলব।
শুনুন, তিস্তার কথা আপনি কী জানেন?
কিছুই জানি না, আমি তো দক্ষিণের মানুষ, কলকাতায় থাকি, উত্তর আমাদের থেকে অনেক দূর হয়ে গেছে পার্টিশনে।
জানি, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এপারে, রানাঘাট দিয়ে পোড়াদহ, পাকশি জংশনের ট্রেন নেই।
বিমলেশ বলল, তিস্তার কথা আপনি জানেন?
তিনি বললেন, তিস্তা আর আমাদের রঙ্গপুর এক, মানে তিস্তা যেখেনে জন্মেছে, সেখেনে তার নাম রঙ্গপু, ওই নদীর নামে আমাদের শহরের নাম।
আমি জানিনে। বলল বিমলেশ।
আমাদের এই সব জায়গা তিস্তার আনা পলি দিয়ে গড়া, বলে তিস্তার প্লাবনভূমি, রঙ্গপুরের চার সাবেক মহকুমা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা দিয়েই এই তিস্তা নদী গেছে, আমাদের কি তিস্তার জলের অধিকার নেই?
আঁজ্ঞে আছে। বলল বিমলেশ, কিন্তু আমি কাদের বলব এইসব কথা?
বললেই হবে, আমার মেয়ে জামাই, ছেলে ছেলের বউ, আমার ভাই বোন, কাকা, জেঠার বংশ, আমার বেয়াই বেয়ান, নাতি পুতি, তাদের সন্তান-সন্ততি, ............নদীর মতো বয়ে যায় কি না বংশধারা, তারাই তো সব ওপারের মানুষ, আমাদের জল চলে গেলে, কাঁদতেও পারব না গো। চাপা গলায় বলতে থাকে স্টেশন মাস্টার, আমার রক্তরে কহিও আমার চোখের জল না শুকায় যেন, দুঃখে কষ্টে, আনন্দে যেন চোখের পানি ফেলতে পারি, পদ্মা মেঘনার জল আমার চোখের পানি, সেই জল আনন্দে যেমন ঝরে, দুঃখেও ঝরে। এই দ্যাখো বাবু, তোমারে কি আমি চিনিনি, চিনেছি, এলে সেই অঘ্রানের শেষে, অঘ্রান ফুরায়ে এল, ধান কাটা হয়েছে শেষ, রাত জেগে নবান্নের আয়োজন, কিন্তু কপোতাক্ষ শুকায়েছে বলে, ঘরের মানুষ ঘরে ফেরে নাই, করতোয়া, তিস্তা, যমুনা, ধরলা ডাকে, জল দাও জল দাও।
আহা! অন্ধকারে বিমলেশের চোখে জল এসে যায়। চোখের জল নদীর জল, যমুনা, তিস্তা, পদ্মার জল, চোখের জল হয়ে অন্ধকারে গড়িয়ে যেতে থাকে। বিমলেশ বলল, আমি একটি চিঠি নিয়ে এসেছি, আপনার হতে পারে মাস্টারবাবু।
তিনি বললেন, পড়ে শুনাও।
কতবার পড়েছে সেই চিঠি, মায়ের লেখা চিঠি, বাংলা দুয়ার রেলের মাস্টার নিখিলচন্দ্র ঘোষকে লেখা, ঠিকানা লালমনিরহাট জংশন স্টেশন,
শ্রীচরণেষু বাবা,
সেই যে গেলে, বলে গেলে শীতটা এবারও কাটাতে হবে ওই দেশে, শীগগির বদলি হয়ে যাবে, তখন শীত চলে যাবে, ফেরার সময় দুই টুকরি কমলালেবু আনবে, এক টুকরি বাঁকার জন্য, এক টুকরি ধূলিহরের জন্য, কিন্তু ফের নাই। পরের পরের বছর মন্বন্তর এল, তারপর হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা লাগল, বাবা তুমি ওই দেশে একা থেকে গেলে। অনু, মনু, চিনু, তিনু, তোমার মেয়েদের কথা মনেও পড়ে না তোমার। তোমার শিবু ছিল দুই বছর, এখন সে এপারে এসে বড় চাকুরিয়া, চন্দন রেলে চাকরি নিয়ে দেশে দেশে ঘোরে। আর আমাদের দাদা, তোমার বড় ছেলে, বিনয় তার ভাই বোনেদের বড় করতে করতে, বোনেদের বিয়ে দিতে দিতে বুড়ো হয়ে গেল। তার আর বিবাহ করা হয় নাই। ভাই বোন নিয়েই তার সংসার হলো এপারে। দাদা আর নাই। শেষের দিকে দাদা ভাই, বোনদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়াত। তাকে দেখত গ্রামের এক পরিবার। গড়িয়ার দিকে দাদা একটা ফ্ল্যাট কিনে আলাদা ছিল সকলের থেকে। দাদা আর নাই। দাদার সঙ্গে কি তোমার দেখা হইয়াছে? দাদা কতবার উত্তরবঙ্গে গিয়াছে সেই ডামডিম, মেটেলি দোমোহনি স্টেশনে। কিন্তু তুষভান্ডার, লালমনিরহাট, তিস্তা জংশন ইত্যাদি স্টেশনে যাওয়া হয় নাই। সে এখন অন্য দেশ। টেলিগ্রাম আসিলে দাদা আর তোমার জামাই ছুটিল সেই তুষভান্ডার না তিস্তা জংশন, না ডিমলা, কোন স্টেশনের দিকে। বাবা, তুমি সমস্ত রাত জলের জন্য ছটফট করেছিলে যে তা শুনে এসেছিল দাদা। কেউ ছিল না রাতে। তুমি জল জল জল করে ডেকে যাচ্ছিলে, তখন সেই আমগাছের সিপাই, সাড়া দিয়েছিল, ইতনা রাত মে তুমকো কৌন পানি দেগা মাস্টারবাবু?
বাবা জল তেষ্টা নিয়ে হারিয়ে গেলে। ওরা কেউ তোমাকে দেখতে পায়নি। দাদা কী করে জানল সেই রাতের কথা? না দাদাকে বলেছিল তোমার রেলের গ্যাঙ্ম্যান গুণধর। গুণধর কাঁদছে আর মাটিতে মাথা ঠুকছে। দাদা তাকে থামাতে পারে না। সেই রাতে সে কোয়ার্টারে ছিল না। রংপুরের পার্টি পালা করতে এসেছিল। সে ছিল সেখানে। সকালে ফিরে দ্যাখে তুমি পড়ে আছ। তোমার শেষ সময়ের কথা সিপাই তাকে জানিয়েছিল। সেও নাকি কেঁদেছিল সব কথা শুনাতে শুনাতে।
আপনি বলে দেবেন তৃষ্ণার জল নেই। বললেন তিনি।
শ্রীচরণেষু বাবা, তোমার তৃষ্ণা মিটিয়াছে...? কপোতাক্ষর ধারের মানুষ তুমি, আর আছে বেতনা, রূপসা, ভৈরব, চিত্রা, মধুমতী, তখন সেই সব নদ নদীতে কত জল, অথচ তুমি নাকি এক ফোটা জল পাওনি। কী আর দুঃখের কথা লিখি তোমাকে, এখন নাকি ওই সব নদীতে আর জল নেই। আমাদের গাঙের স্টিমার বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু বালি ওড়ে কপোতাক্ষর বুক থেকে। যত শুনি বুক হিম হয়ে যায়। আকন্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে মানুষ ঘুরছে নদীর পাড়ে পাড়ে। বাবা তোমার তৃষ্ণা কি মিটেছিল সেই উত্তরের দেশের তিস্তা, করতোয়া, যমুনা, ডাহুক, তালমা, চাওয়াই......এই সমস্ত নদীর জলে। সেই সব নদী কি জল দেয়?
তিনি বললেন, এই চিঠির উত্তর আপনি লিখে দেবেন।
বিমলেশ বলল, চিঠি শেষ হয়নি।
পড়ুন, আমি শুনি, আমাদের কথাই তো অনিতা লিখে গেছে।
বিমলেশ পড়তে থাকে, তোমার তেষ্টা মিটেছে কি না কে বলবে? বাবা, মনু নেই, দাদা নেই, তিনু নেই...তোমার সঙ্গে কি তাদের দেখা হয়েছে? মনু খুব কষ্ট পেয়ে গেছে। অভাব এবং অসুখ দুই-ই এপারে তাকে খেয়েছিল। তার সেই মা দুগগার মতো রূপে পোকা ধরেছিল। তুমি আর মা তাকে শান্তি দিও। মায়ের সঙ্গে নিশ্চয় তোমার দেখা হয়েছে। শেষবারের মতো যেবার তুমি গেলে, মা চেয়েছিল তোমার সঙ্গে যায়। তুমি বলে গেলে, বদলি হয়ে যাবে খুব শীগগির। এখনো সেই বদলি হয়নি। মা তো তোমার জন্য আমাদের ফেলে চলে গেল কোথায়? শিবু জিজ্ঞেস করলে বলতাম, বাবাকে আনতে গেছে মা।
বিমলেশ মায়ের চিঠি পড়ে যাচ্ছিল মনে মনে। বাস অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে একসময় দাঁড়ায়। রানির বন্দর। বিমলেশ চুপ করে ঘাড় ঘুরতে দ্যাখে বন্দরের যাত্রীরা সবাই নামছে। জানালা খুলতে হিমেল বাতাস। বাইরে জবুথবু এক গঞ্জ। আলো অন্ধকারে সঞ্চরণশীল কিছু মানুষ। ভুবনের পাশে কেউ নেই। তিনি নেমে গেছেন রানির বন্দরে।
২
তিনি নেমে গিয়েছিলেন কি না রানির বন্দরে তা সঠিক জানে না। রানির বন্দরে বাস অনেকটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি নেমে যাননি যে তা বিমলেশ টের পেতে লাগল বাকি পথ, ঘুমন্ত সব জনপদ রেখে তাদের গাড়ি ছুটছিল পঞ্চগড়ের দিকে। হুহু শীতের নির্জন পথ। কুয়াশার ঘেরাটোপে সব কিছু আড়ালে চলে গেছে। যেখানে অন্ধকারে দাঁড়ায় গাড়ি, বাইরে টিমটিমে আলো শীত কুয়াশায় সব কিছু ঘুম আর তন্দ্রায় ঢাকা। মফস্বলী বাংলাদেশ। সেই দেশের ভিতরে ভেসে থাকে সেই প্রায় অচেনা দেশের কথা আর কথা। সীমান্ত আর কাঁটাতার কথা বদলে দেয়। ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, দিনাজপুর, ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সাতক্ষীরা আসে, কলকাতা, বসিরহাট, শিলিগুড়ি, আসানসোল, মুম্বই, দিল্লি আসে না। সেই সব নগরী মুছে গেছে বুঝি স্মৃতি থেকে। তার মাথার ভিতরে কেউ অশ্রুপাত করে যাচ্ছিল। সে অশ্রুতে জল ছিল না, বালি ঝরছিল, শীতের বাতাসে অন্ধকারে বালি উড়ছিল। বিমলেশ শুনতে পাচ্ছিল বালির ঝরে যাচ্ছে শূন্য থেকে, তার শব্দ। এর ভিতরেই কে যেন ফজরের নমাজের মতো অতিপ্রত্যুষে গেয়ে যাচ্ছে পবিত্র স্তব, তন্দ্রার ভিতরে তা শুনতে পাচ্ছিল বিমলেশ।
মনে রেখ আমাদের নদী ছিল
নদীজলে সুখ
নীলকুমার, লালকুমার, কালজানি
তোরসা, ডাহুক,
আমাদের ধরলা ছিল, ছিল তিস্তা আত্রেয়ী আর যমুনার জল,
চিত্রা মধুমতী কপোতাক্ষ আর মানুষের ঢল
নেমেছিল নদীঘাটে নদী হয়ে
মানচিত্র ছিঁড়ে গেলে।
আমাদের নদী ছিল পদ্মা মেঘনা
আর কীর্তনখোলা থৈ থৈ
এখনো তারা আছে জল নাই
বালুচর ধু ধু, মনে পড়ে সই
কেমন সে নদী ছিল, নাইওরের নদী,
মনে পড়ে কত ছিল চোখের জল আনন্দে আর শোকে,
না, সই এখন সে পানি নাই, তোমার চোখের জল,
শুখা নদী কী করে কাঁদে, জল নাই বুকে,
দিনভর নদী দেখি ধূলায় এঁকে,
আমাদের নদী ছিল আমাদের চোখে।
বিমলেশকে নিয়ে গাড়ি বাংলাদেশের ভিতরে আরো ভিতরে প্রবেশ করতে লাগল। সে ভাবছিল, মা কি কোনোদিন বলেছিল, তার বাবা মানুষটার ভিতরে এত ভালবাসা ছিল! বেঁচে থাকলে হয় তো হতোই না পার্টিশন। এমন কি হতে পারে, সে যা ভাবছে তা হতে পারে? যা হয়নি, তা হতো? সেই মানুষটা তো দাঙ্গায় মরেনি, তৃষ্ণার্ত হয়ে একা একা মরে পড়ে ছিল স্টেশন সংলগ্ন কোয়ার্টারে । তখন ছিল এপার ওপার মিলিয়ে বাংলার মাটি বাংলার জল......। নিখিলচন্দ্র যদি বেঁচে থাকতেন অত ভালবাসা নিয়ে, তাহলে এই উপমহাদেশের ইতিহাসই আলাদা হয়ে যেত। কী করে হতো তা? হতো হতো, অত ভালবাসার স্রোতে ভেসে যেত যত বিদ্বেষ আর যত হিংস্রতা। বিমলেশের মনে পড়ল কে যেন বলেছিল, মা হয়তো, সেই তার ছেলেবেলায় তাকে গল্প করে বলেছিল, ফুল ছিড়ো না, পাখিকে খাঁচায় রেখো না, পাখির দিকে ঢিল মেরো না, প্রজাপতি ফড়িঙের ডানা ছিড় না...... কোনটার ভিতরে এই পৃথিবীর প্রাণভোমরা আছে তা কি আমরা জানি? একটি হলুদ ফুল, নীল পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং আর ভালমানুষের মৃত্যু নিয়ে আসতে পারে ভীষণ বিপযর্য়। বন্যা, খরা, ঝড়, বজ্রপাত, ফসলহানি থেকে দাঙ্গা আর দেশভাগ। বিমলেশের মনে পড়ে, মা যেন বলত, খোকন আমার বাবার মৃত্যুর পর ভাত-কাপড়ের অভাব আর মন্বন্তর হলো। তারপর দাঙ্গা আর দেশ ভাগ। বিমলেশের মনে হয় তার মা অনিতাই এমন কথা বলেছিল যেন। বাউন্ডারি কমিশন, Radcliff রোয়েদাদ আর দাঙ্গায় সম্পূর্ণ হয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ। এর ফলেই দেশের ভিতরে বিদেশের জন্ম, কারাগার, বন্দীদশা। স্বজনের ভিতরে অন্যজন, দুর্জন। আসলে এই জগতজুড়ে যে স্নিগ্ধতার শৃঙ্খলা, যে ভালবাসা আর রূপের সঞ্চয় তার ব্যত্যয় ঘটলেই এই সব ঘটে যেতে পারে। তাইই হয়েছিল হয় তো। তাইই, তাই। তার চোখে কতকাল বাদে কপোতাক্ষর জল উঠে এল। নদীর জল।
( প্রকাশিতব্য উপন্যাস কুমারী মেঘের দেশ চাই-থেকে এই গল্প )