মর্নিং ডিউটি শেষ করলাম কিছুক্ষন আগে। আজ সকালেই বাড়ি থেকে চলে এসেছি হাসপাতালে। আপাতত এটাই আমার ঠিকানা। কবে ফিরবো জানি না।
আমি সার্জারি ওয়ার্ডে ডিউটি করি। রোগীদের অপরেশান চলছে, যেমন চলে। তবে প্রচুর পেশেন্ট অন রিকোয়েস্ট ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। সে এক বিতিকিচ্চিরি কান্ড। সবাই চাইছে আগে বাড়ি যেতে। বোঝাতে পারছি না যে, ছুটি দেওয়ার কিছু নিয়ম আছে। সেগুলো মেনটেন করতে একটা মিনিমাম সময় লাগে। কে শুনবে সেসব কথা। সবাই লকডাউনের আগো বাড়ি যেতে চায়। সেই লড়াই সামলে অবশেষে ছুটি হলো প্রায় চব্বিশ জনের।সবাই বাড়ি যেতে চায়। বিকেলে হয়তো আরো ছুটি হবে।
ডাক্তারবাবুদের কাছ থেকে যা জানতে পারলাম , ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য হেল্থ ওয়ার্কারদের ছোট ছোট টিম তৈরী করা হচ্ছে। যাতে সবাই একসাথে এক্সপোস্ড না হয়ে যায়। একটা একটা টিম এক্সপোস্ড হলেও লড়াইয়ের সৈনিক কম হবে না।এছাড়া আউটডোর বন্ধ হওয়ার কথা শুনলাম। কবে থেকে তা হবে, সেটা এখনো জানি না । জানতে পারলে জানাবো। ইমার্জেন্সি খোলা আছে। তবে পিজিতে কোনো রোগী জ্বর নিয়ে এলেই শম্ভুনাথে পাঠানো হচ্ছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, শম্ভুনাথ এখন পিজিরই অংশ। ওখানে স্পেশাল ফিভার ক্লিনিক খোলা হয়েছে। সম্ভাব্য করোনা রোগীদের ভীড় থেকে দূরে রাখতেই এই ব্যবস্থা।
আপাতত এটুকুই বলার । বাকি কথা পরে বলবো। শেষ করার আগে তিন চারটে ইনফরমেশান দিয়ে দিই।
এক নম্বর, সকালে যখন অফিসে সাইন করতে গিয়েছিলাম তখন অফিসে বারবার বলেছে শুধু নাক মুখ নয়, মাথাও চাপা দিতে। শরীরের যতোটা অংশকে এক্সপোস্ড হওয়া থেকে বাঁচানো সম্ভব , সেটা করতে। কারন, এখন বাতাসে বহিছে করনা।
দুই ও তিন নম্বর, ডক্টর কিংশুক বসু দাদার প্রোফাইল থেকে প্রাপ্ত খবর, আমাদের দেশ সম্ভবত তৃতীয় স্টেজে ঢুকতে চলেছে, এবং WHO থেকে প্রাপ্ত শেষ খবর, করোনা ভাইরাস বাতাসে আট ঘন্টা বাঁচতে পারে।
আর চার নম্বর, সৌম্যদীপের পোস্ট দেখে জানতে পারলাম। কলকাতায় করোনার প্রথম মৃত্যুর থাবা পড়লো আজ।
কাজেই ,
ওরে গৃহবাসী নাহি খোল দ্বার।
কারন,
বিষ বিশের আতঙ্কে ভরাএই যে চৈত্রমাস–করনার জন্য দেখছিসবার সর্বনাশ।।
গৃহবন্দী থাকুন। ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
হসপিটালে থাকার আজ দ্বিতীয় রাত। গ্রুপ ডি দাদা দিদিরা খুব খেয়াল রাখছে আমার। সিস্টার ইন চার্জও বারবার খোঁজ নিচ্ছেন। এসবের মাঝেই ইভনিং ডিউটি শেষ করার পরই খবর পেলাম ২১ দিনের লকডাউনের । মাস্কটা খোলার মতো শক্তি অবশিষ্ট ছিলো না। মেয়ে আর প্রিয় মানুষটির মুখটা ভেসে উঠছিলো বারবার। নিজেকে সামলাতে সময় লাগলো বেশ কিছুক্ষন। তারপর ভাবতে বসলাম । নিজের কথা, সবার কথা। বুঝতে পারছিলাম লকডাউনের প্রয়োজনিয়তা। রেগে যাচ্ছিলাম অবাধ্য জনগনের উপর। কষ্ট হচ্ছিলো দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর জন্য । তারপর মনে হলো, হয়তো এটাই ভবিতব্য।রোগ, ভোগ, শোক, যন্ত্রনা সব পার করে পড়ে থাকবে যেটুকু সেটুকুই খাঁটি সোনা। কঠিন সময়ও একটা সময় পার হয়ে যায়। তবে জীবনকে নতুন করে চিনতে শেখায় , জানতে শেখায়। আপাতত নিজেকে শান্ত করেছি। তবে মন ভালো নেই। শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে রাস্তার আলোতে আলোকিত পলাশ ফুল দেখছি আর ভাবছি, একুশ দিন!!!! তারপর?!!!!!
শুভ রাত্রি। ঘুমানোর চেষ্টা করি।
তৃতীয় দিন.... মধ্যাহ্নভোজ শেষ করে ডিউটিতে যাচ্ছি। রাতে বলবো আজকের দিনের গল্প।
~~~
তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় পর্যায়ের লেখা এটা। এটা বেশ ঘটনাবহুল পর্যায় ছিলো। সবটাই বলার চেষ্টা করবো।
ওয়ার্ডে পেশেন্ট কমানো হবে বলে শুনেছিলাম। কিন্তু করোনার চক্করে তো আর অন্য রোগেরা বিলুপ্ত হয়ে যায় নি, বিশেষতঃ যাদের অপরেশানের খুবই প্রয়োজন। তাদের তো ভর্তি করতে হচ্ছে। তাই আমাদের ওয়ার্ডে পেশেন্ট তুলনামূলকভাবে কম হলেও খুব কম নয়। সেই ক্রমাগত হসপিটালে থেকে ডিউটি করে যাওয়া গ্রুপ ডি দাদা দিদিদের মনোবল ও কর্মক্ষমতা একটু কম। অ্যাম্বুলেন্সের টাইমিংর চক্করে নার্সিং স্টাফরাও আসছেন আগে পরে। ডাক্তারবাবুরাও অল্প সময়ের জন্য এসে একসাথে প্রচুর অ্যাডভাইস, রেফার ,রিকুইজিশান দিয়ে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ওয়ার্ডে চাপ বেশ ভালোই আছে। ওসবের মাঝেই একটি পেশেন্টের বাড়ির লোক ব্লাড নিয়ে এসেছেন। হাতের কাজটা শেষ করেই ব্লাডটা রিসিভ করবো বলে ওনাকে দাঁড়াতে বলেছি। উনি ক্রমাগত হাসতে হাসতে নানান কথা বলে যাচ্ছেন। যেন আমি ওনার ইয়ার দোস্ত। ভদ্রভাবে সাবধান করলাম একবার। তাতে পাত্তা দিলেন না। বাধ্য হয়ো সিকিউরিটি দাদাকে ডেকে বের করে দিতে হলো ওয়ার্ড থেকে। এই যে লোকো বলে নার্সরা মেজাজ করে। মাঝে মাঝে মনে হয় এদের জন্য মেজাজ করাই উচিত। এরা ভালো কথা ভালোভাবে বোঝার পাবলিক নয়।
যাই হোক, এরপর কাজ চলছিলো আপন গতিতে। ইতি মধ্যে পুরনো ওয়ার্ড থেকে পিঙ্কির ফোন। কি ব্যাপার?!! চা খাওয়ার আমন্ত্রন। তবে যেতে হবে ক্যান্টিনে। কারন দোকানপাট বন্ধ তাই চা দুধ চিনির স্টক বাড়ন্ত। আর পিঙ্কির সৌজন্যে আমি হলাম হবু মাসিমনী । কাজেই না বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা দুই ,সাথে তনুশ্রী। এই তিন মিলে গেলাম ক্যান্টিনে। এই প্রথমবার আমরা ইউনিফর্ম পরে ক্যান্টিনে গেলাম।লকআউটের বাজারে এটুকু তো হতেই পারে। ক্যান্টিনের ভিতরে স্টাফদের আলাদা বসার ব্যবস্থা । সেখানো গিয়ে দেখা পুরনো ডক্টরদের সাথে। স্যারেদের সাথে। কথা হলো বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। ভালো লাগে যখন পুরনো ওয়ার্ড ছেড়ে চলে আসার পরেও স্যারেরা চিনতে পারেন, কুশল সংবাদ জানতে চান।যাই হোক, ক্যান্টিনের স্টকও তলানির দিকে। শুধু চা বিস্কুট আর চিপস ছাড়া আমাদের বিকেলের জলযোগের কিছু পেলাম না। খাওয়া প্রায় শেষের পথে, তখন ফোন এসো সরমাদির। দিদিও হসপিটালেই থাকছে। নাইট ডিউটি চলছে দিদির। দিদির খুব মনখারাপ করছে। বললাম চলে এসো ক্যান্টিনে। দিদি এলো, কথা হলো, ছবি তোলা হলো, মন ভালো রাখার উদ্দেশ্যে। তারপর আবার ফেরা হলো যে যার ওয়ার্ডে।
ওয়ার্ডে ফেরার পথে লিফট থেকে নামার পরেই পিছনে ছোট্ট ডাক ,"দিদি"। ঘুরে তাকালাম। অচেনা একজন মহিলা। আমার কৌতূহলী দৃষ্টিকে আরো কৌতূহলী করে তুললো তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে আমার জন্য ধরে থাকা ক্যান্ডিটা। আমার কৌতূহল মেটানোর জন্যই সে নিজেই বললো, "আমি কচির মা"। আমি তো অনেক ভেবেও কোনো কচির কথা মনে করতে পারলাম না। সেটা বুঝেই সে তার কচির পরিচয় দিলো। ক্যান্টিনে চা খেতে যাওয়ার সময় ইমার্জেন্সি ওটির সামনে ট্রলিতে একটা মিষ্টি দেখতে বাচ্চা ছেলে গালে একটা হাত দিয়ে আরেক হাতে প্লাস্টার নিয়ে চিন্তিত মুখে আধা শোয়া হয়ে আছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে। কি হয়েছে জানতে চাইতে সে বছর তিনেকোর পুচকু হিঁ হিঁ করে নাকি রান্না কেঁদে যা বোঝালো, তার সারমর্ম হলো খেলতে গিয়ে হাত ভেঙেছে। বললাম এসো। দুজনে ছবি তুলি। তো সেই লুক কন্সাস ছোঁড়া ঐ প্লাস্টার হাত নিয়ে ছবি তুলতে চায় নি। আমিও আর জোর করি নি। তো পরে হয়তো তার মনে হয়েছে আমি কষ্ট পেয়েছি। তাই তার প্রত্যাখ্যানের বদলে আমাকে এই ক্যান্ডি পাঠিয়েছে। যেহেতু আমরা তিনজন ছিলাম ,তাই কচির মা আমি একা হওয়া পর্যন্ত আমার পিছু পিছু আসছিলো। কি উত্তর দেবো বুঝতে না পেরে ক্যান্ডিটা হাতে নিয়ে ওয়ার্ডে চলে এলাম। ধন্যবাদ দিয়ে এই ভালোবাসাকে অপমান করতে পারি নি। পুচকুর জন্য পকেটের পেনটা পাঠিয়ে দিলাম ওর মা কে দিয়ে।
তারপর ডিউটি শেষে ডিনার করতে যাওয়া। লম্বা লাইন। সিস্টার, ব্রাদার, গ্রুপডি দাদা দিদি, সিকিউরিটি দাদা, টেকনিশিয়ান দাদা সবাই একসাথে খাবারের লাইনে।ওরাও সবাই আমাদের মতো হসপিটালেই দিন রাত পড়ে আছে। আজ রাতের মেনু ছিলো খিচুড়ি আর পাপড় ভাজা। খিচুড়িটা খুবই সুস্বাদু ছিলো। অনেকদিন পর খাওয়ার লাইনে মহাদেবের সাথে দেখা। সেও বাড়ি ঘর ছেড়ে হাসপাতালে পড়ে আছে ।
খেয়ে দেয়ে ওয়ার্ডে ফেরার পথে দেখলাম মশারি খাটিয়ে পেশেন্টের বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করছে। ওটা খুব চেনা ছবি আমাদের কাছে। তবে চেনার মাঝে অচেনা ছবি ছিলো তাঁবু। হ্যাঁ টেন্ট খাটিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে বাড়ির লোক। আহা!!! রোগ বড়ো বালাই। করোনা ত্রাস আছে ঠিকই। তাই বলে কি আর রোগীকে ফেলে চলে যাওয়া যায়?!!
আপাতত আজকের গল্প এখানেই শেষ। ঘুমাতে যাবো এবার। শরীরটা খুব ক্লান্ত। বিকেল থেকে মাথা যন্ত্রনা, মাথা ভার। ডাক্তার দিদিকে বললাম, বললেন ওনারও একই অবস্থা। সর্বক্ষণ মাস্ক পরে থাকায় নিজের শরীর নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড আবার শরীরে ঢুকে অক্সিজেনের ঘাটতি ঘটার জন্যই এই বিপত্তি। আরো দুই একজন দিদিরও একই অভিজ্ঞতা। লড়াই এখনো বাকি। সুস্থ থাকার প্রয়াস করছি। শরীর মন ভালো রাখার চেষ্টা করছি।
হাসপাতালে কাটছে দিনরাত। রাতে ঘুম ঐ ছেঁড়া ছেঁড়া । এলোমেলো । আধো জাগা আধো ঘুমের মধ্যে স্বপ্নই দেখছিলাম মনে হয়, আমি ক্রমাগত দরজা খুঁজে যাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। এসবের মধ্যেই ফোন এলো। আননোন নম্বর। ফোনটা রিসিভ করার পরেই ওপার থেকে একটা কান্নার শব্দে ঘুমটা পুরোপুরি ছেড়ে গেলো। ডিপ্রেসানে কাঁদছে ছোটো বোনটা। কিছু দিন আগে মিসক্যারেজ হওয়া বোনটাকে তার স্বামী আর শাশুড়ি বাড়ি ফিরতে বারন করেছে করোনার ভয়ে।হাসপাতালে ডিউটি করে সো যদি তার স্বামী শাশুড়িকে অসুস্থ করে ফেলে!!! কি অদ্ভূত না?!!!
গতকালই এক কলিগ বলছিলো, ফেসবুক খুললেই মানুষের কতো আনন্দ। কতো রান্না , কতো ফূর্তি। আর কতো দেখনদারি। ভালো থাক মানুষ। তাদের ভালো থাকার জন্যই তো আমরা এখানে।কিন্তু এতো দেখানোর কি আছে?!! সত্যিই তো , আমরা মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আর ফেসবুকে কতো আনন্দ। যেনো করোনা কার্নিভাল চলছে।
হয়তো বাড়ি বসে আপনারাও বিরক্ত হচ্ছেন, বোর হচ্ছেন। আমরা হয়তো সেটা বুঝছি না। আসলে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে এ অনুভূতি আসে না। শুধু দুর্বল মুহূর্তে প্রিয় মানুষ, তার মুখ, তার সান্নিধ্যের প্রত্যাশাটুকুই জন্মায়।
মন ভালো নেই। চার দিন কেটে গেলো। সকালে ক্যান্টিনের সামনে গোল গোল দাগ করে দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা দেখে ভালো লাগলেও দুপুরে দেখেছিলাম লোক ঘাড়ের উপর উঠে লাইন দিয়েছে। সকালেই ক্যান্টিনে দুধ চা নেই । লিকার চা। দুধের স্টক শেষ। ক্যান্টিনের দাদা বললেন যা বিস্কুট নেওয়ার নিয়ে নিন। আর নেই। চার প্যাকেট নিয়েও দুই প্যাকেট রেখে দিলাম। অন্যদেরও তো খিদে পাবে। দুপুরে ডিউটির মাঝে অসহায় পেশেন্ট পার্টি পেশেন্টকে পরীক্ষায় নিয়ে যাওয়ার আগে খেতে যেতে চাইলেন। গতকাল ক্যান্টিনে খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় খেতে পান নি। কোমন অসহায় লাগছে নিজেকে।
মর্নিং ডিউটি শেষ করে এক ছুটে খেতে গেলাম। ডিমের ঝোল, ডাল , ভাত। খিদের থেকে বড়ো স্বাদবর্ধনকারী আর কিছু হয় না। দুপুরে খেতে যাওয়ার সময় হঠাত্ দেখি একদল কাক একটা পেঁচাকে তাড়া করেছে। সে ভয়ের চোটে একটা গাড়ির নীচে আশ্রয় নিয়েছে। তারপর কি হলো জানি না। হয়তো হেরে যাবে ও। কিম্বা জিতে যাবে।
আমরাও তো এমনই টানাপোড়েনে বেঁচে আছি। আজ মনটা বড়োই বিক্ষিপ্ত। মন ভালো নেই। আপনারা নিজের মানুষদের সাথে থেকে বোর হয়ে যাচ্ছেন। আর আমি তাকে শুধু একটু দেখার আশায়, একটু ছুঁতে পারার আশায় একটা একটা করে দিন গুনছি।
আজ পঞ্চম দিন......
সবাই বলে আমি একা মানুষ। আমার সংসার নেই। মেয়ে আছে নিরাপদেই। তাকে নিয়েও আমি চিন্তিত নই। জানি আমার কিছু হয়ে গেলেও সে নিরাপদেই থাকবে, ভালোভাবেই মানুষ হবে। তার জন্য তার আন্টি, দিদি, বেস্টফ্রেন্ড এরা আছে। সবাই এটুকু পড়ে রে রে করে তেড়ে আসবেন না প্লিজ। আমি যতোই ভাবনার জগতে ডুবে থাকি না কেন, বাস্তবটাকে ভালোই চিনি এবং জানি।
একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে। আসলে আমরা কি চাই। আপনারা যারা গৃহবন্দী তারা নিজেদের পার্টনারকে নিয়ে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন(অন্তত ফেসবুকে তেমনই বলছেন)। পার্টনার মানে শুধু স্বামী স্ত্রী নয়, সব সম্পর্কের কথাই বলেছি। আবার আমরা যারা এখানে বন্দী তারা আপনজনদের সামান্য চোখে দেখার জন্য, একটু ছোঁয়ার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমাদের যারা বাড়ি থেকে কষ্ট করে যাতায়াত করছেন তারা বাড়ি গিয়েও অসহায়ের মতো প্রিয়জনকে চোখে দেখেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। বাচ্চা কাঁদছে মায়ের কাছে আসবে বলে, তাও তাকে না ছুঁয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছে। কি যে অসহায় লাগছে। করোনা তো একটা রোগ মাত্র। কিন্তু এই সামাজিক টানাপোড়েনকে কি আপনারা নতুন করে উপলব্ধি করতে পারছেন?!! আমি পারছি। আসলে একা মানুষ তো!!! তাই মানুষকে পর্যবেক্ষণ করাটা বেশ সময় কাটিয়ে দেয়। আর আমরা যারা ঘরে বাইরের লড়াইটা করছি তারা মানসিক চাপেই অর্ধেক হয়ে যাচ্ছি।
আজ আমার অফ ডে। পুরনো ওয়ার্ডে পুরনো সঙ্গীরাও থাকছে শুনে সেখানে গেছিলাম। শুনলাম অফিস থেকে আমাদের কম স্টাফে ডিউটি করতে বলছে। কারন লকআউট ওঠার পর যে প্রচন্ড রাশ আসতে চলেছে তার জন্য ম্যান পাওয়ার সেভ করতে চাইছে। জানি না এটা কতোটা সম্ভব। কারন আমাদের ডিউটির লোড কমে তো নি বরম বেড়ে গেছে। দেখা যাক কি হয়। আপাতত রুম্পাদির লেখা চিঠি রইলো এখানে। আমার মতো যারা সবাই এই নির্বাসন জীবনে আছি তাদের সবার মনের কথা-----
"যাচ্ছি হেঁটে অনিশ্চতের পথে,
পিছুটান আর রাখতে নেই তা জানি,
কালকে যখন মিশবো ছাঁই আর ধোঁয়ায়,
পৌঁছে দিও শেষের এ পত্রখানি..."
শ্রীচরণেষু, মা/বাবা,
জানি,এখন তোমরা আমায় নিয়ে খুব চিন্তা করছো।আমিও সারাদিন দুঃশ্চিন্তায় আছি তোমাদের নিয়ে।বাবাকে যেন বাড়ি থেকে বেরোতে দিওনা।তোমরা খুব সাবধানে থেকো।জানো..আজ সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ছে, যেদিন প্রথম salary পেয়েছিলাম।বছর দুই আগের কথা....।তোমরা সেদিন খুব খুশি হয়েছিলে,আর গর্ব ও করেছিলে আমায় নিয়ে,তোমাদের মেয়ে/ছেলে স্বাবলম্বী হয়েছে।কিন্তু night duty গুলোর সময় তোমাদের চিন্তা দ্বিগুন হয়ে যেতো, আর তার জন্য অনেক বকুনিও খেতে আমার কাছে।
আর তো মাত্র কয়েকদিন...আমায় নিয়ে আর দুঃশ্চিন্তা করতে হবেনা তোমাদের,জানতো,আমাদের সরকার সব স্বাস্থ্য কর্মীর জন্য মোট ৫৫ লক্ষ টাকার বিমা ঘোষণা করেছেন।আমি যখন "নেই" হয়ে যাবো, তখন তোমরা পাবে।জানি ও টাকা তোমাদের কোনো কাজে লাগবেনা।এক কাজ কোরো,সেই টাকাটা আরো অনেক দুর্ভাগা মা/বাবার মতন তোমরাও কোনো সরকারি হাস্পাতালে দান কোরো।তা দিয়ে অদূর ভবিষ্যৎ এ স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা যাবে।এই আমার শেষ ইচ্ছে।এ চিঠি যখন তোমরা পাবে তখন আমি ধীরে ধীরে ধোঁয়ায় মিশে যাচ্ছি হয়তো।ভালো থেকো তোমরা।
ইতি
তোমাদের আদরের সন্তান।
~~~
আমার প্রিয় মানুষ,
খুব কষ্ট হচ্ছে কি!কষ্ট পেওনা,এই পরিস্থিতিতে আমাকে আমার কর্তব্য পালন করতেই হবে।তুমি তো আমার শক্তি,তুমিই তো আমায় সাহস দিয়ে আসছো প্রথম থেকে।কিন্তু জানতো!সাহস টা যেন দিন দিন মরে যাচ্ছে, বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে,শুধু মনে হচ্ছে,আমি যখন থাকবোনা,তুমি কি পারবে নিজের আর আমাদের ছোট্ট সোনাটার দেখভাল একা একা করতে!পারবেকি সবটা একার হাতে সাম্লে নিতে!জানি.....তুমি পারবে।তোমার উপর ভরসা আছে গো!পারবে তুমি, একা মা/বাবা হয়ে আমাদের সন্তানকে ঠিকমতো মানুষ করতে।
জানোতো,বেঁচে থাকার স্বপ্ন টা হয়তো দেখতে পারতাম,আশার আলো হয়তো দেখা দিতো,যদি সঠিক সময়ে হাস্পাতালে নিজেদের সুরক্ষার জিনিসপত্র গুলো পেতাম!কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেছে গো।কিন্তু আমাদের সরকার সব স্বাস্থ্য কর্মীর জন্য মোট ৫৫ লাখ টাকার বীমা ঘোষণা করেছেন।তুমি কিন্তু ওই টাকাটা কোনো হাস্পাতালকেই দিয়ে দিও কেমন!তালে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো সঠিক সুরক্ষা নিয়ে তাদের duty করতে পারবে।বেঁচে থাকতে পারবে।আমার অন্যান্য colleague দেরও একই শেষ ইচ্ছে।চললাম গো...আমার কপালে শেষ চুমুটা এই চিঠিতেই ছুঁয়ে দিও দূর থেকে,আমি পেয়ে যাবো।
ইতি,
তোমার হতভাগ্য স্বামী/স্ত্রী।
~~~
আমার প্রিয় সন্তান,
এ চিঠি যখন তোর কাছে পৌঁছবে,তখন আমি ছাই হয়ে গেছি হয়তো।তোর হাতের শেষ জলটুকু পাবার অধিকার আমার আর নেই রে!ভালোবেসে তোর মাথায় হাত রাখতে পারবোনা আর কখনো।যাক, দুঃশ্চিন্তা করিসনা,তোর মা/বাবা কে নিয়ে।এখনো অনেক শক্ত আছি রে,এখনো লড়াই করছি,তবে জানি আর বেশি সময় নেই।মানসিক শক্তি আর অবশিষ্ট নেই।শুধু শেষের দিন গোনা।তুই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে এটুকুই শান্তি।তোর বাবা/মা কে দেখে রাখিস কিন্তু।
জানিস তো,সরকার সব স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য মোট ৫৫ লক্ষ টাকার বিমা ঘোষণা করেছেন,প্রথমে খুব অপমানজনক লেগেছিলো,মনে হয়েছিলো এর থেকে যদি আমাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের ব্যবস্থা করতেন তালে হয়তো তোদের সাথে আরও কয়েক বছর বেশি কাটাতে পারতাম।কিন্তু তাঁরা যা ভালো বুঝেছেন করেছেন।যাই হোক আমার মৃত্যুর পর ওই টাকাটা কোনো হাস্পাতালে দিয়ে দিস,কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষার সরঞ্জাম জোগাড় করতে অসুবিধে হবেনা আর।
ভালো থাকিস তোরা,সুস্থ থাকিস।
ইতি,
যুদ্ধে প্রায় হেরে যাওয়া তোর
মা/বাবা।
আজ হাসপাতালে ঠিকানার ষষ্ঠ দিন। ষষ্ঠীতেই তো বোধন হয় । তাই না!!!!
মন ভালো নেই। অহেতুক বিতর্ক। অনেকেরই মনে হচ্ছে আমার এই রোজকার পোস্ট তাদের আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। তারা ভীত হচ্ছেন নানা ভাবে। আমি দুঃখিত। কি আর নতুন করে বলবো?!! বাড়িতে বসে টিভিতে খবরে সবই জানতে পারছেন। তাই ভাবছি, আজ থেকে এসব বলা বন্ধ করে দেবো। এমনিতেও আর কতোদিন লেখার মতো পরিস্থিতি থাকবে জানি না। আজ একটু ভালোবাসার কথা বলি। কেমন!!!
করোনা ক্যারিয়ার ,কিম্বা করোনা এফেক্টেড এটা জেনেও যে মানুষটি আপনাকে মিশিয়ে নিতে পারবে নিজের সাথে ।জানবেন, সেই আপনাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসে ।
এমনটা ভেবে থাকলে ভুল ভাবছেন । হতেও তো পারে তার বিনা পয়সায় অথচ মজা করে সুইসাইড করার সাধ হয়েছে। !!!
ভালোবাসা তো শর্তহীন। করোনা থাকা বা না থাকাটাও তো একটা শর্তই বটে!!! ভালোবাসায় থাকুন। ভালোবাসাকে ভালো রাখুন। কেয়া পাতা "কাল হো না হো"!!!!
সংখ্যাটা 1036।
আমার হসপিটালের ঠিকানায় সপ্তম দিন।
কি বলবো?!!!
কি বলা উচিত?!!!
জানি না।
কাল রাতে শুনলাম অন্য হাসপাতালের এক কলিগকে তার বাবারবাড়ির লোকজন বাড়িতে থাকতে বারন করেছে করোনার ভয়ে। যতো দেখছি ,শুনছি ততো অবাক হচ্ছি। মুখোশে মুখ ঢাকতে গিয়ে সম্পর্কের মুখোশ খুলে যাচ্ছে। বারবার রত্নাকরের কথা মনে পড়ছে। আমি তো পরিবার থেকে বিচ্যুত বহুকাল। তাই এই কষ্টগুলো উপলব্ধি করতে পারছি।
সবার সুস্থতা কামনা করি। বেশি কথা লিখতে ইচ্ছা করছে না। ভালো থাকবেন সবাই।
নীললোহিতের লেখা পছন্দের একটা কবিতার একটা অংশ দিলাম......
" ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে ঘরে,
প্রচন্ড যুদ্ধে তুমিও অংশীদার,
শত্রুবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর
এমন সময় পাশে বসে পাগলিনী আমি তোমায়
জিজ্ঞেস করলাম-
ভালবাসো?
ক্রুদ্ধস্বরে তুমি কি বলবে যাও….
নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস দেবে, বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি……."
এক্ষেত্রে যুদ্ধে অংশীদার আমি, আমরা। আর আমাদের প্রতিটা প্রিয়জনের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইছি......"ভালোবাসো?"
বহু ক্ষেত্রেই আশ্বাসের বদলে মিলছে উত্তর....."যাও"!!!
আট দিন পার করলাম হাসপাতালে। বিশেষ কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না।
আজ নবম দিন। হাসপাতালই আপাতত ঠিকানা। নবম বলতে মনে পড়লো। এখন মনে হয় নবরাত্রি চলছে। সারামাদি এই অবস্থাতেও নবরাত্রির নিয়ম পালন করে ডিউটি করে চলেছে হাসপাতালে থেকেই। জানি না, বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে দেবতা এই নিষ্ঠা ভক্তি দেখতে পাচ্ছে কিনা।
আমি ক্রমশ অপ্রিয় হয়ে উঠছি অনেকের কাছে। আমি আমার ভয় ভীতি কষ্ট আশঙ্কা প্রকাশ করছি আমার লেখায়। সেসব পড়ে তারা আতঙ্কিত হচ্ছেন বলেই অভিযোগ করছেন। এমনিতেই তো নাক মুখ ঢেকে আতঙ্কবাদী জীবন কাটাচ্ছি। আপনারা টিভিতে খবর দেখে স্কোরবোর্ডের মতো করোনার নম্বর গুনে দুপুরে খেয়ে দেয়ে বরের সাথে বউয়ের সাথে ঝগড়া খুনসুটি করে ,বাচ্চা কাচ্চা সব প্রিয়জনদের সাথে বহুরবিবাসরীয় জীবনে হাঁফিয়ে উঠছেন। আর আমরা প্রিয় মানুষদের না দেখে না ছুঁয়ে যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাচ্ছি।
আমি মোটামুটি ভয় জয় করেছি। ভাবছি মোবাইল রিচার্জটা কতোদিনের করবো। কম করলে ব্যাঙ্ক লাভবান হবে। আর বেশি করলে কোম্পানি লাভবান হবো। আর আমার কি হবে?!!! সে তো শুধু "করোনা"জানে। কিন্তু কষ্ট বাড়ছে। প্রিয় মানুষকে না দেখতে পাওয়ার যন্ত্রনা নিয়েও কিছু বলবো না। সেটা আবার ন্যাকামি মনে হচ্ছে অনেকেরই। বলছি, এই আতঙ্ক, ন্যাকামি যখন এতোটাই ভালো পারি যে তারা ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন, তবে বাংলা সিরিয়াল সিনেমায় আমার কোনো চান্স আছে কিনা ভাবছি। যদিও চিকনি চামেলি নই,তবুও কুমড়োপটাশ তো বটে!!!
যাক গিয়ে, অন্য কথায় আসি। আপনারা সবাই খুব সতর্কিত জীবন কাটাচ্ছেন জানি। কিন্তু তাই বলে কেউ যে বাড়িতে আসা গ্যাস সিলিন্ডারকে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে মাজবে, এটা আমি সত্যি ভাবি নি। একটা কথা বলি, শাকসব্জি, খাবার জিনিস তো বরাবরই সতর্কতার সাথে ধুয়ে পরিষ্কার করতে বলা হয়, করা উচিত, আর করছেনও নিশ্চয়ই। বাইরে বেরোলে সেসব জামা জুতো ঘরের অন্য কিছুর সংস্পর্শে আনবেন না। সবরকম সতর্কতা মেনে চলুন । তবে সেই রবিঠাকুরের ভাষায় বলি........
"তখন ধীরে চামার-কুলপতি
কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
'বলিতে পারি করিলে অনুমতি,
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।
নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।'"
কাজেই গোটা বিশ্বকে ধুয়ে জীবানুমুক্ত করার মতো অসাধারন ভাবনা সত্যিই ভালো। তবে তারথেকেও বেশি ভালো নিজের দুটি হাত জীবানুমুক্ত রাখা। বারে বারে সাবান আর জল দিয়ে ঘষে ঘষে হাত ধুয়ে ফেলুন। জলের উত্স কাছাকাছি থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার নয়, সাবানই শ্রেয়। অযথা নাকে চোখে হাত দেবেন না। আর হাঁচি কাশির সময় কনুইয়ের খাঁজে মুখ ঢাকুন। হাত পরিষ্কার রাখুন। সাথে মনও।
হসপিটালে আজ আমার নবমী নিশিযাপন। শরীর মন ক্লান্ত। মেয়ে আর প্রিয় মানুষটির জন্য মন উচাটন। সারাক্ষন মাস্ক বাঁধার জন্য শ্বাসকষ্ট। ইনহেলারেও কষ্ট মিটছে না সবসময়। কাল বাদ পরশু থেকে নাইট ডিউটি শুরু। তারপর...... সব ঠিক থাকলে "বাড়ি" যাবো।
আজ দিনটা সব মিলিয়ে ঘেঁটে ঘ। শরীর মন ভালো নেই তবুও প্রিয় মানুষটিকে এপ্রিলফুল করতে গিয়ে পুরো ছড়িয়ে ফেলেছি। আসলে ঐ যে আমি যা নই, তেমনই কিছু করার চেষ্টা করার ফল আর কি!!! । সেসব ভুল বোঝাবুঝির অবসানের পর লিখতে বসা। আসলে বুঝতে পারছি সবাই বড়ো অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছি ও পড়েছে। করোনা যে আর কি কি করবে আমাদের তা সেই জানে।
শেষ করার আগে একটা ঘটনা বলে শেষ করবো। আজ আমাদের ওয়ার্ডে ওক পেমেন্ট ও তার স্বামীর কথা। ফিমেল ওয়ার্ডে বারবার আসতে বারন করা সত্ত্বেও ভদ্রলোকটি আসছেন। আর নানা প্রশ্ন করছেন। একটা সময়ে একটু বিরক্ত হয়েই বললাম আপনার স্ত্রী তো ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারবেন। ডাক্তার যখন যাবে, তখন জেনে নিতে বলবেন যা জানার। তারপরেও একই অবস্থা। অবশেষে বলেই ফেললেন, "আমার হোম মিনিস্টার খুব স্ট্রং। আমি কিছু বলতে পারবো না। " আমরা সবাই হেসে ফেলেছি। তারপর বললাম, আপনি আপাতত ওনার হেল্থ মিনিস্টার। তাই ভয় পাবেন না। মাস্কের আড়ালে ভদ্রলোকের মুখের কি অবস্থা হয়েছিলো জানি না!!!
আজ হাসপাতাল জীবনের দশম রাত। সকাল থেকে কিছু লিখি নি। লিখতে পারি নি। শরীর খুব খারাপ ছিলো। এমনিতেই আমার শ্বাসকষ্ট হয়। তার জন্য ইনহেলার নিতে হয়। আর আজ সেটাই একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিলো আর কি। এখন ঠিক আছি। তবে খেতে ইচ্ছা করছে না একদমই। এসবের মধ্যেই ডিউটিও করেছি। তবে শরীর মন জানান দিচ্ছে তারা একটু ঘরের আদর, ঘরের আরাম পেতে চায়। কাল থেকে নাইট ডিউটি শুরু। সব মিলিয়ে চারটে রাত পার করলেই আমি "বাড়ি"যাবো। "নিজের মানুষ"দের কাছে যাবো। আমি অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছি সোমবার সকালের।
আজকের লেখাটি একটু বড়ো। তবু পড়ার অনুরোধ রইলো। কিছুটা নিজের কথা। কিছুটা সংগৃহীত।
আগামী দিনগুলোতে কি হবে জানি না। তবুও যা আছে ,যা নেই তা ভাবার সময় আর নেই। আমরা লড়ছি। আমরা পালাবো না। আপনজনদের কথা ভাবলে চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার। তবু আমরা লড়ছি। লড়বো।
আরেকটু পরেই নাইট ডিউটি শুরু হবে। হাসপাতালে থাকা এগারোতম দিবস এবং এই নাইট শুরুর সাথে সাথে কাউন্টডাউন শুরু। তিনটে রাত পরেই বাড়ি যাবো।
বাড়ি যাওয়ার আনন্দ ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে। আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরতে চাই । কিন্তু আমার ফেরাটা কতোটা সুরক্ষিত তাদের জন্য?!! আমি জানি না সেটা। যদিও আমার নিজের মানুষেরা আমার জন্য সমস্ত রকম হোম কোয়ারেনটাইনের ব্যবস্থা করছে। তবুও আমি ভয় পাচ্ছি। নিজেকে শুধু অচ্ছুত নয়, অপরাধীও মনে হচ্ছে। জানি, বহু স্বাস্থ্যকর্মীই নিয়মিত বাড়ি থেকে যাতায়াত করছেন। তারাও নিজেকে পরিবার থেকে বিচ্যুতই রেখেছেন। তবুও ভয় পাচ্ছি, চিন্তা হচ্ছে ।
ওয়ালেশ হার্টলে একজন ইংরেজ বেহালাবাদক। ৩৩ বছর ১০ মাস ১৮ দিন বয়সে তিনি মারা যান।
যেটা আশ্চর্যের সেটা হচ্ছে ৩৩ বছর ১০ মাস ১৭ দিন বয়স পর্যন্ত ভদ্রলোক ছিলেন জনতার একজন। জীবনের শেষদিনে বিখ্যাত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভয়ঙ্কর এক ট্রাজেডি তাঁকে দিয়েছিল বিখ্যাত হবার সুযোগ।
হার্টলে মারা গিয়েছিলেন ১৫ এপ্রিল, ১৯১২। যেদিন আর.এম.এস. টাইটানিক ডুবেছিল, সেদিন। টাইটানিকের সঙ্গে শেষ যে ক’জন ডুবেছিলেন, হার্টলে তাঁদের মধ্যে একজন।
ওয়ালেশ হার্টলে ছিলেন টাইটানিকের মিউজিশিয়ান- ট্রুপের প্রধান। জেমস ক্যামেরন পরিচালিত ছায়াছবিতে হার্টলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জোনাথন ইভান্স জোনস। আপনাদের সকলের নিশ্চয়ই মনে পড়ছে সেই অনুপম দৃশ্য। জাহাজ ফুটো করে যখন প্রচণ্ড গতিতে আটলান্টিকের হিমশীতল জল ঢুকছে, আর ততোধিক দ্রুতগতিতে মানুষের বুক ফুটো করে ঢুকে পড়ছে মৃত্যুভয়; যাত্রীরা কেউ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে, বাকিরা এ ওকে পায়ে মাড়িয়ে ছুটছে লাইফবোটে জায়গা করে নেবে বলে; আর যেসব তৃতীয় শ্রেণির যাত্রী মায়েরা জানেন তাঁরা লাইফবোটে জায়গা পাবেন না, তাঁরা তাঁদের শিশুদের কপালে চুমু খেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন রূপকথার গল্প বলতে বলতে, ঠিক সেই সময় বেহালা হাতে জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়ালেন তিনি। শ্বাস নিলেন একটা। তারপর চোখ বুজলেন। অপার্থিব আঙুলে বেজে উঠল স্কটিশ হাইমের সুর - ‘Nearer, my God, to Thee’।
হার্টলেকে দেখে বেহালা হাতে এগিয়ে এলেন আরও একজন সহকর্মী। তারপর আরও একজন, হার্প হাতে। তারপর আরও একজন। সবাই মিলে সুর মেলালেন।
ত্রস্ত যাত্রীরা শুনলেন। তারপর দেখলেন। চারটি মানুষ জাহাজের ডেকে মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে স্বধর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। যাত্রীরা দাঁড়িয়ে পড়লেন কেউ কেউ। চোখে জল। ক্যাপ্টেন স্মিথ লাইফবোটে উঠতে অস্বীকার করেছেন। সেই অসম্ভব অতিপ্রাকৃত সুরকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে নিজের কেবিনে দাঁড়িয়ে তিনি শান্তভাবে দেখছেন জলের বেড়ে ওঠা। জাহাজের প্রধান স্থপতি টমাস অ্যান্দ্রুজ পরম মমতায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন গ্র্যান্ড ডাইনিং রুমের এক- একটা ভাস্কর্য। দুর্দম আরব দস্যুর মতো জল ভাসিয়ে নিচ্ছে জাহাজের একটা দিক। পপকর্নের মতো ভেসে যাচ্ছে মানুষ। আর একদিকে চারটি অলৌকিক মানুষ অচঞ্চল সুরে বাজিয়ে চলেছেন ‘Nearer, my God, to Thee’। ‘প্রভু, তোমার নিকটে আরও...।’
টাইটানিকে লাইফবোট ছিল যাত্রীসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। আমাদেরও জনসংখ্যার তুলনায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিতান্ত অপ্রতুল। তাই নিয়েই এক ভয়াবহ মহামারির মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এ এমন এক দেশ যার অর্ধেক জনতা হয়তো জানেও না কতটা ভয়াবহ হতে পারে এই বিপদ। যারা জানি তারা আতঙ্কিত প্রহর গুণছি। হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছি। ভিতর থেকে জান্তব বৃত্তিগুলোও উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। কিলো কিলো চাল ডাল আলু সব্জি কিনে ঘর ভরাচ্ছি। অন্যে কী পাবে সেটা ভেবেও দেখার প্রয়োজন বোধ করছি না। প্যানডেমিক আর জাহাজডুবির মধ্যে এটাই মিল। দুটোই শরীরের আগে মনকে খায়।
এটাই সময়। আপনার ভিতরেও একটা ওয়ালেশ হার্টলে আছে। আপনার সঙ্গে আলাপ নেই হয়তো, কিন্তু আছে। লোকটাকে খুঁজে বের করুন। হাতে ধরিয়ে দিন আয়ুধ। বলুন, বাজান মায়েস্ত্রো, বাজান।
তারপর চুপ করে শুনুন।
লড়াইটা সবে শুরু হয়েছে। এখনই হেরে যাবেন না। নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন না। ভালো থাকুন। যেভাবে পারেন ভালো থাকুন। ভালো থাকার কোনও নির্দিষ্ট সময় হয় না। এই দুর্দিনে ভালো থাকাটাই সবচেয়ে বড় স্টেটমেন্ট।
#সংগৃহীত
হাসপাতালে থাকার দ্বাদশ দিবস আজ। আর দুটো নাইট ডিউটি। তারপর "বাড়ি"।
জানি না উচ্ছ্বাস কেন এতো স্মিত। হয়তো বাড়ির মানুষগুলোর যদি কোনো অসুবিধা হয়, এই আশঙ্কায় আশঙ্কিত। তবুও এই মুহূর্তে ঠিক ঐ ছবিটার মতো, এভাবেই নিজের মানুষদের ছুঁয়ে আছি। আপনারা আগুনের তাপ পাচ্ছেন। কেউ ছ্যাঁকা খাচ্ছেন, কেউ আঁচ পোহাচ্ছেন। আর আমরা ঐ আগুনে দাঁড়িয়ে আছি।
আমরা যারা ঘর সংসার বাচ্চা ,শিফটিং ডিউটি সব সামাল দিই একা হাতে। আমাদের জন্য এ এক কঠিন যুদ্ধ। শুধুমাত্র আমাদের পরিবারের মানুষরাই হয়তো বুঝতে পারছেন আমাদের কথা। আমাদের অসহায়তার কথা, আমাদের যন্ত্রনার কথা। আমাদের অসহিষ্ণুতা, মানসিক টানৈপোড়েন সোসবও ঐ পরিবার পরিজনের উপরেই আছড়ে পড়ছে পরম নির্ভরতার বিশ্বাসের সাথো। তারপরেও বহু ক্ষেত্রেই শুনছি ভাঙনের গল্প। আমরা ভয় পাচ্ছি। মৃত্যুভয়কে আর পাত্তা দিচ্ছি না বিশেষ। যা হবার হবে। কিন্তু আপনজনদের হারানোর ভয় গ্রাস করছে অনেককেই।
কি বলবো বলুন, সকাল সকাল মনকেমন করা কথা শুনতে কারোরই ভালো লাগে না। তবে এটুকুই বলা আমাদের পরিবার প্রিয়জনদের উদ্দেশ্যে........
"হো চাঁদনি যব তক রাত
দেতা হ্যায় হার কোই সাথ
তুম মাগার অন্ধেরো মে
না ছোড়না মেরা হাত
যব কোই বাত বিগড় যায়ে
যব কোই মুস্কিল পড় যায়ে
তুম দেনা সাথ মেরা
ও হামনওয়াজ"
ভালো থাকবেন। ভালো রাখবেন। আমরা এক কঠিন সময়ে আছি। পরিবার পরিজনদের দূরত্ব আমাদের আরো অসহায় করে তুলছে।
লোকে কেন তেরোকে আনলাকি বলে জানি না। এসব বিশেষ মানিও না। আজ হাসপাতালে থাকার ত্রয়োদশ দিবস। আর মাত্র আজকের রাতটা। কাল সকাল হলেই বাড়ির পথে রওনা দেবো।বাড়ি মানে তো শুধু ইট কাঠ পাথরের কাঠামো নয়। কিছু আপনজন, নিজের মানুষ। শান্তি, স্বস্তি।বিশ্বাস, ভালোবাসা, নিরাপত্তা। আর তার সাথে জুড়ে গেছে আমার আর আপনজনের একে অন্যকে কাছে পাওয়ার অপেক্ষা। আর সেই অপেক্ষা, আশা, রূপকথা , আর কিছু এলোমেলো গল্প গাথা। এই তো জীবন!!!!
শিমুল, পলাশ, রঙিন দোল ক্রমশ ফিকে হয়ে গেছে করোনা কার্নিভালে।কোকিলের সুরেও মনকেমন ব্যাকুলতা ততোটা নেই যতোটা আমার ঘরে ফেরার তাড়ায় আছে।। এই চৈত্রে কে যে কার চোখে সর্বনাশ দেখছে তা জানি না। তবে, পড়ন্ত বসন্তের মনকেমনের সুর যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে এই স্বজনহীন পক্ষকালে। ভালো না লাগা তো আমার চিরকালীন রোগ, তার সাথে এই বুক মোচড়ানো মনকেমনের সঙ্গতে কেমন যেন এলোমেলো সবকিছু। যে রূপকথার অপেক্ষায় থোড় বড়ি খাড়া জীবনের সব জটিলতা সহ্য করেও ভালো থাকার চেষ্টা, সে অপেক্ষা যে ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রত্যাশা নেই কিছু, তবুও আশায় তো বেঁচে থাকা!!!! সে আশাও যে মাঝে মাঝে বড়ো অবুঝ হয়ে যায়। পরিস্থিতিও এমন যে হাত পা মেলার উপায় নেই। কুঁকড়ে গুটিয়ে চাপা দেওয়া চাদরের মতো টায় টায় চলে যাওয়া জীবন। এপাশ থেকে ওপাশ হলেই চলনসই আবরন সরে নগ্ন বাস্তব বেরিয়ে আসে। তাই ঐ কুন্ডলী হয়েই চাদর চাপা দিয়ে স্বপ্ন দেখায় কাটে জীবন। "জানি স্বপ্ন সত্যি হয় না, তবু মন মানতে চায় না".......থমকে যাওয়া গৃহবন্দী জীবনে তো এই স্বপ্নই সম্বল। তাই ধূসর জীবনের ক্যানভাসে রঙিন স্বপ্ন আঁকি সবসময়। স্বপ্নের রঙ কখনো কখনো চোখের জলে ধুয়ে গেলেও মনের আশাটুকু সম্বল করে আবার চেষ্টা করি স্বপ্ন আঁকার। হাসি কান্না সব রঙের প্রলেপে সে প্রতিমুহুর্তে তার রূপ বদল করে। কখনো উচ্ছলতায় ভরা, কখনো গভীরতায় গড়া। কখনো বা নেহাতই এলোমেলো। হয়তো ভাবা যেতেই পারতো,"এমনি করে যায় যদি দিন যাক না!!"। কিন্তু ভাবতে গিয়ে মনের সাথে নিজের দ্বন্দ লেগেছে বারবার। মন শুনতেই চায় না কোনো বাস্তবের কথা। সে শুধু স্বপ্ন দেখে রূপকথা ছোঁয়ার।এমন করেই তো দিন কাটে মরচে পড়া জীবনের , একটা রঙিন রূপকথার অপেক্ষায়।
চোদ্দতম রাত। এবং শেষ নাইট ডিউটি। কাল সকালে পাড়ি দেবো বাড়ির পথে। আজ ঐ নটার সময় মোমবাতি জ্বালবেন কি জ্বালবেন না আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা বহুদিন আগে হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে যে শপথ নিয়েছি, এই কঠিন সময়ে সেই শপথ রক্ষার্থে আমরা কর্তব্যে অবিচল। আজ রাতে টর্চ, মোমবাতি জ্বালানো হলে তাতে কি ভালো হবে কি মন্দ হবে এই দুই পক্ষের মতামতে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জার উপচে যাচ্ছে। আপনাদের যা ভালো মনে হয় করুন। শুধু দয়া করে এমন কিছু করবেন না যাতে করোনা নামক অদৃশ্য দানব আমাদের হারিয়ে দেয়।
আজ আর বেশি কথা লিখবো না। গোছগাছ বাকি আছে । সেসব সেরে ফেলি। সাথে রইলো আমাদের হসপিটালবাসের যাপনচিত্রের কোলাজ।
সাত দিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছি। নিজের মানুষদের সান্নিধ্য একটা আলাদা অনুভূতি। যদিও আছি হোম কোয়ারেনটাইনে। মেয়ের থেকে দূরেই আছি। ওকে দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারবো না। কিন্তু ওকে ছুঁতে চাইছি না এখন। তবুও সবাই সবার মন ছুঁয়ে আছি।
বিগত দিনগুলোতে রোজ নিজের কথা লিখছি। আপনারা পড়েছেন। ভালোবাসা দিয়েছেন। চিন্তা করেছেন। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। প্রার্থনা করেছেন। কিছু মানুষ আবার আতঙ্কিত হয়ে আমাকে ত্যাগও করেছেন।
সকাল থেকে ইনবক্সে মেসেজ এসেছে প্রচুর। আমি বাড়ি ফিরেছি কিনা। ঠিক আছি কিনা।
হ্যাঁ আমি ফিরেছি। কিন্তু আমার সহযোদ্ধারা এখনো কঠিন যুদ্ধে ব্যস্ত। যুদ্ধটা একটা অদৃশ্য শত্রুর বিরূদ্ধে অসম লড়াই। জানি না কি হবে। সব শুভেচ্ছা শুভকামনা ভালোবাসা প্রার্থনা উপচে পড়ুক ওদের জন্য। আমি আবার লড়াইয়ে ফিরবো সাত দিন পর। ততোদিন আপনজন, প্রিয়জনদের সাথে বিনি সুতোর মালার মতো না ছুঁয়েও ছুঁয়ে থাকি ।
আপনারা ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। ঘরে থাকুন।
এই দুর্দিনে আপনার লেখাই আপনার পাথেয়। আপনি রোজ এক লাইন হলেও লিখুন বাকি দিঙ্গুলোর মত। আমরা আপনার অনুভূতি গুলোর সাথে সাক্ষী হতে চাই।
"আমি কোনোদিন নার্স হবো এমন ভাবনা নিয়ে বড়ো হই নি। ভাবিও নি। আসলে ঠিক পেশা সংক্রান্ত ফোকাস আমার জীবনে ছিলো না। নাচ ,গান, গল্পের বই, পুতুল খেলা আর মায়ের ছত্র ছায়া এটাই জীবনের সবটুকু বলে মনে হতো। আজকাল যখন আমার অকারণ ঘ্যানঘ্যান করা কারোর কাছে খুব বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে, তখন ভাবি ওই মহিলা কি অসীম ধৈর্য্য সহকারে আমার এতো বকবক সহ্য করতো। যে কথা বলছিলাম, মা অসুস্থ হলো। মেডিকেল কলেজ, পিজি, সিলভার লাইন আই হসপিটালে আসতে হয়েছিল কয়েকবার। বাড়ি ফিরে বলতো, কিভাবে ডাক্তার নার্স মায়ের ভয় দূর করেছে, মায়ের সাথে কথা বলেছে।শুনতাম। তারপর একদিন আমার সব অত্যাচার জ্বালাতন সহ্য করার মানুষটা চিরতরে চলে গেলো। আমার চারপাশের রঙিন পৃথিবীটা কেমন করে যেনো এক লহমায় পাল্টে গেলো।
দিন থামলো না, চলতে লাগলো। কলেজ শেষ করে এলাম নার্সিং পড়তে। নাহ, ওই সেবা, মহান ব্রত, এসব ভাবনা নিয়ে আসিনি। সাবলম্বী হবো। এটাই ছিলো লক্ষ্য। কিন্তু ট্রেনিংটা নিতে নিতে কেমন করে যেনো ভালোবেসে ফেললাম পেশাটাকে।রোগীদের সাথে গল্প করতে করতে বুঝতে পারতাম ওষুধ, পথ্য এসবের পাশাপাশি একটা ভরসা সহমর্মিতা তারা খোঁজেন। আমার ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে এমন অনেকেই আছেন যারা কোনো না কোনো সময়ে আমার ওয়ার্ডে রোগী বা রোগীর বাড়ির লোক হিসাবে ছিলেন। এক সময় আমি আমার সেই সব অভিজ্ঞতাও নিয়মিত লিখতাম ফেইসবুকে। আজকাল আর লিখি না। আসলে পরিস্থিতি আখন জীবনকে এতটা কঠিন করে দিয়েছে যে আর কিছু লিখতে ইচ্ছা করে না। তবুও মনের এলোমেলো কথাগুলো এখানে লিখি। একটু হালকা লাগে।
2004 সালে ট্রেনিং নিতে এসেছিলাম। এটা 2021। এতগুলো বছর ধরে এই পেশায় অনেক কিছু দেখলাম। সম্মান পেয়েছি যেমন। মানুষের কটূক্তি অপমান এসবও পেয়েছি। কিন্তু সব কিছু পার করেও আমি আমার পেশাকে ভীষণ ভাবে ভালোবেসে ফেলেছি। যারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে বা জানে , তারা জানে আমি ভালোবাসলে কিভাবে জড়িয়ে ধরি। আমি গুণগত দিক থেকে কত ভালো নার্স সে মূল্যায়ন আমি করার ক্ষমতা রাখি না। কিন্তু নার্সিং আমাকে মানুষ হিসাবে উন্নত করেছে বহুগুণে। দৈনন্দিন জীবনের নানান চাপ, মানসিক টানাপোড়েন, শারীরিক কষ্ট সব পার করে আমি যখন আমার ইউনিফর্ম পরি, আমি একটা অন্য মানুষ। অনেক সময় অনেক প্রতিকূলতা পার করেও চেষ্টা করি নিজেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত নিয়ে যেতে। ইউনিফর্ম পরার পর আমি ঠিক নিজেকে সামলে নেবো। হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর সাথে কথা বলে কত সময় নিজেকে জীবন যুধ্যে সামলে নিতে শিখেছি, সে একমাত্র আমি জানি।
আমি জানি না, আমাকে এই পেশায় দেখে আমার মা কতটা খুশি হতো। আমি সদ্য চাকরিতে জয়েন করার পর একসময় আমার কোনো এক বন্ধুকে শিক্ষকতা পেশায় থাকার খবর পেয়ে আমার বাবা খুব আফসোস করেছিলো আমার এই পেশার জন্য। কেনো সেই আফসোস , আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে গর্বের ত বটেই, সাথে অনেক ভালোবাসা আমার পেশা। আমি একজন নার্স। আমি গর্বিত।
আগামীকাল নার্সেস ডে। ইচ্ছা হলে আবার কিছু কথা হয় তো লিখবো আগামীকাল। তবে আজ এই লেখা শেষ করার আগে একটা স্বপ্নের কথা লিখে যাই। আমার একটা স্বপ্ন আছে..... আমাদের ঘরে বাচ্চারা বড়ো হওয়ার সময় স্বপ্ন দেখে, তাদের স্বপ্ন দেখানো হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,পুলিশ, শিক্ষক, পাইলট.... আরো অনেক কিছু হওয়ার। কিন্তু কখনো আমি শুনি নি, দেখি নি, কেউ তার সন্তানকে বড়ো হয়ে নার্স হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন শিশুরা নার্স হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। তাদের বাবা মা তাদের নার্স হওয়ার স্বপ্ন দেখাবে। খুব অলীক কল্পনা কি? জানি না।
ছবিটা 2004 সালের। নার্সিং ট্রেনিং শুরুর দিনগুলো। তখনও নার্সেস ক্যাপ পরার যোগ্যতা পাই নি। এরকম কোনো একটা দিন, ওয়ার্ডে ডিউটি যাওয়ার সময় রুম থেকে বেরোনোর মুহূর্তে তোলা ছবি। এই ইউনিফর্মে তোলা আমার প্রথম ছবি।"
- অপরাজিতা স্বর্ণালী কাল লিখেছিলেন।
এই অতিমারীর ক্রান্তিকালে যে অপরিহার্য সেবা ওঁরা দিচ্ছেন , এবার কি মা বাবা চাইবেন, সন্তান নার্স হোক?
অপরাজিতা স্বর্ণালী, স্যালুট। আপনাকে, আপনাদের। সুস্থ্য হয়ে উঠুন। অনেক ভালোবাসা রইলো।
লেখা হিসেবেও, এই লেখা খুব সুন্দর লাগলো। আরো পড়ার আশায় থাকলাম।
পাইয়ের শেষ পোস্টটা পড়ে মনে এলো -- আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন। ছোটবেলায় বারবার জিজ্ঞেস করতাম "বাবা, আমিও বড় হয়ে তোমার মত ডাক্তার হবো তো?" বাবা প্রতিবারই বলতেন "না, ডাক্তার কেন? তুই তো নার্স হবি।" আমি ডাক্তারও হইনি, নার্সও না। কিছুই হইনি। তবু বাবার কথাগুলো আজ মনে পড়ে গেলো।
বাহুল্য বর্জিত, নির্মেদ লেখা। মনটা কেমন ভিজে উঠছে।