১
হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে, যেখানে পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ঝরনাটা গত দু-বছর ধরে শুকিয়ে গিয়ে শেষে সাদা ক্ষতের মতো ছোট্ট গুহাটার সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে চাষি আর চাষিবউ এসে দাঁড়াল। চাষিবউয়ের ছোট্ট শরীরটা তখন পথচলার ক্লান্তিতে ও গর্ভভারে থিরথির করে কাঁপছে। সে শুকনো খরখরে ঠোঁট ও আড়ষ্ট জিভ নাড়িয়ে নাড়িয়ে কোনোরকমে বলল—জল।
চাষিও যথেষ্ট ক্লান্ত। তবু সে পুরুষমানুষ। এত সহজে ভেঙে পড়লে তার চলে না। তাই সে চাপা কণ্ঠে হিস-হিস করে বউকে ধমক দেয়—“চুপ করো, রাজা শুনতে পাবে।”
মাত্র দু-বছর আগেও এই রাজ্যের সবথেকে বিস্ময়কর জায়গা ছিল রাজার ফুলের বাগান। তখন ঋতুবদলের সঙ্গে সঙ্গে মরশুমি ফুলের বাহার ও সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে থাকত বাগানটা। পাখি ও ভ্রমরের গুঞ্জনে জানা যেত দিন বদলের দিন। বাগানের মালি যখন তার সুদৃশ্য বড়ো কাঁচিটা দিয়ে ঘাসেদের মাথা ছেঁটে কেটে সমান করে দিত, তখন ঘাসেরা কিন্তু একটুও আপত্তি করত না। নিজের সৌন্দর্যকে অন্যের সামনে মেলে ধরতে কে না চায়! এই এত্ত বড়ো বড়ো গোলাপগুলো যখন সমস্ত পাপড়ি মেলে নিজেদের ভঙ্গিমায় নিজেরাই হেসে কুটোপাটি, তখন রানিও বাগানে বেড়াতে বেড়াতে রাজাকে কাছে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন। সরোবরের দিঘির বুক জুড়ে শিকারায় যেতে যেতে রাজা পদ্মের মৃণাল ভেঙে সযত্নে তুলে দিতেন রানির হাতে। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় রজনিগন্ধা আর বেলফুলের শ্বেতশুভ্র স্নিগ্ধতায় শরীরে চন্দন তেল মাখতে মাখতে রানি হুকুম করতেন—“দাসী, দক্ষিণের দরজা খুলে দে।”
বর্ষার কদমফুলের ম’ ম’ করা উত্তাল গন্ধে আস্তাবলের ঘোড়া হাতিশালের হাতিরাও চঞ্চল হয়ে উঠত। আর যখন শিউলির মন-কেমন-করা গন্ধে রাজ্যবাসীর হৃদয় বিষণ্ণ হয়ে বেদনায় বিধুর হয়ে ওঠে তখন বছরে একটি দিন ও একবারের জন্য রাজা উদ্যানের দরজা খুলে দেন। অপূর্ব সৌন্দর্যে রাজ্যবাসীর হৃদয় জুড়োত, আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত—“আহা! আমাদের রাজা না-জানি কত সৌভাগ্যবান! এমন নন্দনকাননের মতো উদ্যান যার প্রাসাদ ঘিরে আছে তাঁর প্রাণে তো সবসময় আমোদের বান ডাকবেই।”
হেমন্তের শেষ থেকে গোটা শীতকালটা গাঁদাফুলের হলুদ বাগিচায় প্রজাপতির মেলা বসে। এত রং তাদের শরীরে যে, একবার যে দেখবে তার চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। আর চৈত্র? সে তো আগুনঝরা লালের দিন। পলাশের পাপড়ির উপর দিয়ে হেঁটে রাজা-রানি ঘুরে বেড়াতেন আর নিজেদের মধ্যে প্রেমালাপ করতেন। বৃক্ষের শাখায় কোকিলের ভূপালির আরোহ-অবরোহ স্বরের কুহু-কুহু ডাকে রাজা মোহাবিষ্ট হয়ে থাকতেন।
বড়ো পাথরের চাঁইটার উপর চাষিবউ আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে। তার শরীর এতটাই অবসন্ন যে, চাষির কথাগুলো শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়েই পড়ল। চাষির সেদিকে খেয়াল নেই। সে আপন মনে বিড়বিড় করে চলেছে—“দাদু কিন্তু ঠিক বুঝেছিল, গত পাঁচ সন ধরে জলের জোগান কম। এখন যদি বাঁধ না-দেওয়া যায়, খরা আসবে। আকাশগঙ্গা শুকিয়ে যাবে। এই পাঁচ বছর ধরে সমস্ত জলকপাটের জল রাজার বাগানে গাছেদের জন্য সরবরাহ হয়েছে। রানির মন ভালো রাখার জন্য যে মস্ত বড়ো অ্যাকোয়ারিয়ামটা, যেখানে দু-দুটো পুকুর-সমান জল ধরে, সেখানকার লাল-নীল শৌখিন মাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দু-দিন অন্তর জল সরবরাহ তো চলছেই। সুতরাং জলের আর দোষ কী!”
মুখ ঘুরিয়ে বউয়ের দিকে তাকায় চাষি। মায়া হয়। ইশ্, ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারি!
গত দু-বছর একটানা চলছে খরালি। বৃষ্টি নেই, বৃষ্টি নেই। চাষি ভাবে, এই এত বছর বয়স পর্যন্ত এমন আগুনঝরা দিন আর দেখিনি। চাষি আরও ভাবে, রাজা যদি ঠিক ঠিক সময়ে আমাদের কথা ভাবতেন, তাহলে আজ এই অবস্থা হত না।
ঠিক সেইসময় অনেক দূর থেকে বালিখালি নদীটার ওপারের দক্ষিণ কিনারের পণ্ডিত মশাইয়ের টোল-বাড়িটার পাশের বিশাল হরিতকি গাছটার বাঁধানো বেদিটা থেকে ভেসে আসে—
“ডুম - ডুম – ডুম - ডুম...
শোনো – শোনো - শোনো! সমস্ত রাজ্যবাসীগণকে জানানো যাইতেছে যে, রাজ্যে পরপর পাঁচ বছর কম বৃষ্টি এবং দুই বছর অনাবৃষ্টির ফলে জলের আকাল দেখা দিয়াছে। রাজ্যের সমস্ত নদী, সরোবর, পুকুর, ডোবার জল শুকাইয়া গিয়াছে। মহারানির সাধের অ্যাকোয়ারিয়ামের শৌখিন মাছেরা মারা যাইতেছে। মহারাজের উদ্যানের ফুলেরা বিবর্ণ। সেইজন্য রাজার আদেশ—বৃষ্টি না-হওয়া পর্যন্ত রাজ্যে লোকসংখ্যা বাড়ানো যাইবে না। বুড়োর দলকে কেউ একফোঁটা জল দেবে না। তাহাদের মৃত্যুই রাজার কাম্য। আর, জনসংখ্যা কমাইতে যেখানে যত গর্ভবতী মায়েরা আছে, এই মুহূর্তে তাহাদের গর্ভপাত ঘটাইতে হইবে। নতুন কোনো শিশু যেন পৃথিবীর আলো না দেখিতে পায়। তাহা না হইলে জনসংখ্যা বাড়িয়া যাইবে।
ডুম - ডুম - ডুম - ডুম...”
কান খাড়া করে আর-একবার কথাগুলো শোনে চাষি। ঘরে বসে প্রতিবেশী ছুতোরদাদার কাছে মাঠের ফুটিফাটা মাটির হা-মুখের দিকে চেয়ে প্রথমবার শুনেছিল কথাগুলো। চাষিবউও শুনেছিল, কিন্তু মন তাদের কোনোমতেই সায় দেয়নি। তাই তারা রাতের অন্ধকারে পাহাড়মুখো হাঁটতে শুরু করে। ধ্রুবতারা তাদের দিক ঠিক করতে সাহায্য করেছে। পিউকাঁহা পাখিটা তাদের সঙ্গে নদী পর্যন্ত এল। এতসব ভাবতে ভাবতে চাষি একটু ঝিমিয়ে পড়েছে, ঠিক সেইসময় চাষিবউয়ের রোদে-ঝলসানো, অনেকদিন আধপেটা খেয়ে থাকা, শুকিয়ে যাওয়া মুখটা কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে! চাষি ঝাঁকুনি দেয় বউকে। চাষিবউ চোখ মেলে। তার দু-চোখের কোল বেয়ে নেমে আসে বড়ো বেদনার অশ্রু। তবু মুখে হাসি এনে বলে—“খুব দেরি নেই। সে আসছে গো।”
২
একমাথা ঝাঁকড়া চুল, দুটো দীঘল কালো চোখ, দুধে-আলতা রঙের বাচ্চাটা মানুষের শব্দে কেঁদে ওঠে। কেঁদে উঠে নিজের অস্তিত্বের কথা জানান দেয়। তখন চাষিবউয়ের বুক জুড়ে আসে দুধের ফেনা। সে ডান কাতে শুয়ে বাচ্চাটার মুখে নিজের স্তন ধরে। আর গুহা থেকে একটু দূরে, দেবদারু আর ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতাঝরা শুকনো জঙ্গলটায় এসে একটু জল আর খাবারের চিন্তায় কপালে ভাঁজ ফেলে দাঁড়ায় চাষি। ঠিক সেইসময় একটা ঠান্ডা বাতাস শাঁ-শাঁ করে চাষিকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। চাষি ভয় পেয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, এ নিশ্চয়ই কোনো অশুভ শক্তির প্রভাব। ইষ্টদেবতার নাম নিয়ে চোখ বন্ধ করে সে। ভয়ে তার জীবনীশক্তি লোপ পাওয়ার উপক্রম। পাহাড়ের গুহাটার দিকে সে ঊর্ধ্বমুখে ছুটতে শুরু করে। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। চোখের সামনে কালো কালো ছায়া-ছায়া অন্ধকার। চাষি চিৎকার করে বউকে ডাকে।
ঠিক সেইসময়ে আকাশের শরীর চিরে একটা আগুনের তিরের ফলা উত্তর থেকে দক্ষিণে নিমেষে ছুটে চলে যায়। আর তারপর ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি নামে গাঁ জুড়ে। বৃষ্টি নামে শহর জুড়ে। বৃষ্টি নামে রাজ্য জুড়ে। বৃষ্টি নামে হৃদয় জুড়ে। চাষি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। তারপর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে না-পেরে আকাশমুখো হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। মুখের ভিতর বৃষ্টির মিষ্টি জল। দু-হাত আঁজলা পেতে জল ধরে চাষি। জল খায়, যত খায় তত তেষ্টা বাড়ে, দু-বছরের তেষ্টা এত সহজে কি মেটে! জল ধরার খেলায় ন্যাংটাপুটো বাচ্চাছেলের মতো খুশিতে মেতে ওঠে চাষি।
চাষিবউ তার ছোট্ট সোনামণিকে নিয়ে গুহার পেটের ভিতরে সেঁধিয়ে রয়েছে। চোখেমুখে তার অকপট ভয় খেলা করে। এতদিনের অনাবৃষ্টিতে বেচারি যেন জলের চেহারাটাই ভুলে গেছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকায় সে। একরত্তি মাংসের পিণ্ড, কিন্তু এত রূপ তার এই ক্ষুদ্র শরীরকে ঘিরে আছে যে ভাবা যায় না! রূপের ছটায় অন্ধকার গুহার ভিতরেও যেন বিদ্যুতের আলো খেলা করে।
আর ওদিকে রাজপ্রাসাদে সে এক মহাকাণ্ড ঘটেছে। মহারানির সাধের অ্যাকোয়ারিয়ামের সবথেকে বড়ো এবং অহংকারি গোল্ডেন ফিশ, যার লেজটা ‘ভি’ আকৃতি করে ছাঁটা এবং চার-চারটে ঝিনুক বসানো, সেই ঢঙি মাছটা, যে কিনা পরিষ্কার জলের অভাবে প্রায় মরতে বসেছিল—সেই মাছটা বৃষ্টির জল পেয়ে নেচে ওঠে। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য মাছগুলোও তালে তালে নাচতে থাকে। প্রাসাদের ভিতর দাস-দাসী-মন্ত্রী-সান্ত্রীদের ছুটোছুটি পড়ে যায়। রাজা ছিলেন দিবানিদ্রায়। খোলা জানালা দিয়ে এক পশলা বৃষ্টি তার মুখে ঝাপটা দিয়ে যায়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে বসেন রাজা। সাদা বৃষ্টির ঝালরে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মহারানি নিজের পদমর্যাদা ভুলে নিজের প্রাসাদ থেকে ছুটতে ছুটতে রাজার ঘরে আসেন। শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে গেয়ে ওঠেন,
“আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেব মেপে।”
রাজার ধাঁধা কেটে যায়। অস্ফুটে কোনোরকমে তিনি উচ্চারণ করেন—“বৃষ্টি! রাজ্যে বৃষ্টি নেমেছে! এই আকালে, এই অসময়ে বৃষ্টি! তাও কি সম্ভব!”
রাজা তড়িঘড়ি ছোটেন রাজজ্যোতিষীর কাছে। হুকুম দেন—“এক্ষুনি গণনায় বসুন। এ কী করে সম্ভব?”
অন্যদিকে রাজ্যবাসী তো আনন্দে আত্মহারা। ঘরের কোটর থেকে সকলেই ছুটে এসেছে খোলা রাস্তায়। কোলের শিশুকে বৃষ্টির জলে স্নান করানোর জন্য নিয়ে এসেছে তার মা। খরালির সময়কার মরা গাছগুলো কচি কচি পাতায় ভরে যায়। ফলহীন গাছেদের শরীর নধর-টসটসে ফলে ভরে যায়। ফুলেদের সৌরভে মাতোয়ারা চারদিকে মানুষ যেন আত্মহারা। গবাদি পশুগুলো মাঠে ছুটোছুটি শুরু করে। আর বুড়োর দল, যাদের কিনা রাজার আদেশে জলবন্ধের নোটিশ পড়েছিল, তারা দু-হাঁটু জোড়া করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে আকাশমুখো হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের দু-চোখে জলের ধারা।
সবথেকে মজার কাণ্ড করে নাসিমা আর অসীম। ওরা একে-অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু রাজার আদেশে হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে, ভালোবাসা একেবারেই ‘নৈব নৈব চ’।
আইন করে এ রাজ্যে হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে বন্ধ, তাই ওদের খুব কষ্ট। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ওরা একে-অপরের কাছাকাছি আসত। ওরা সব ভুলে অদ্ভুত আবেগে প্রকাশ্য রাজপথে একে-অপরকে চুমু খেয়ে ফেলল।
৩
চাষির কানেই কোতোয়ালের এবারের ঢেড়া পেটানোর শব্দটা প্রথম যায়। কেন-না, সে গাবফল আর বুনো পেয়ারা জোগাড়ের জন্য নদীর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিল। রাজ্যের উত্তরাঞ্চল থেকে সে শুনতে পায়—
“ডুম - ডুম - ডুম - ডুম...
শোনো – শোনো - শোনো! রাজ্যবাসীগণকে জানানো যাইতেছে যে, রাজজ্যোতিষী গণনা করিয়া দেখিয়াছেন, এই রাজ্যে গোপনে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হইয়াছে। সেই শিশুকন্যার ভাগ্যে সূর্য-চন্দ্রের মিলন যোগে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটিবে। রাজা এই মুহূর্তে সেই শিশুকে লইয়া প্রাসাদে আসিতে নির্দেশ দিয়াছেন। রাজা সেই দম্পতিকে পুরস্কৃত করিবেন...
ডুম - ডুম - ডুম - ডুম...”
চাষি তো আনন্দে কাঁপতে থাকে। তার হাত থেকে গাবফল আর বুনো পেয়ারাগুলো মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যায়।
রাজপ্রাসাদের মূল ফটক পার হয়ে চাষি আর চাষিবউ যখন প্রধান ফটকে পা দিল, তখন ওদের কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। প্রহরী বর্শা তুলে ওদের অভিবাদন জানায়। এমন আতিথেয়তা-সম্মান পাওয়া তো দূরের কথা, তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তাদের পা-দুটো মন্থর গতিতে চলতে থাকে। চাষিবউ একবার তার কোলের পুঁটুলিতে ধরা ছোট্ট সোনামণির দিকে চেয়ে দ্যাখে। মনে হয় যেন পারিজাত ফুল। চাষিবউয়ের চোখ থেকে আশিস ঝরে পড়ে।
শত হলেও চাষি পুরুষমানুষ, এমন আতিথেয়তায় তার একটু লজ্জা করে বই-কি। কিন্তু এ রাজ্যে পুরুষের লজ্জা পাওয়াটা অপরাধ বলে গণ্য হয়। তাই সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চারদিক চেয়ে চেয়ে ভালো করে দেখে নেয়। না, কেউ কিছু বোঝেনি। রাজসভায় পা দিতেই চারটে লোক দড়ি টেনে রাজামশাইয়ের দাদাঠাকুরের আমলের বিশাল পেটাই ঘণ্টাটা ঢং ঢং করে বাজাতে লাগল। রাজার পেছনে পাখাওয়ালা দুজন জোরে জোরে পাখা টানে। চাষিবউ কেমন যেন ঘাবড়ে যায়। আর চাষি ভাবে, রাজা মানেই কি সব বড়ো বড়ো কাণ্ডকারখানা! ওই বিকট ধরনের ঢং ঢং শব্দে ছোট্ট খুকু ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে।
আর রাজা তখনই বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে ওঠেন—
“এই মেয়েটা ভেলভেলেটা
বৃষ্টি পেলি কোথায়?
বার কর মোর তলোয়ারটা
শূলে চরাব সেথায়।”
চাষিবউ এত ভয় পেয়ে যায় যে, আর একটু হলে সোনামণি হয়তো তার হাত ফসকে পড়েই যেত। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে সে বাছাকে। চাষির তো কাঁপতে কাঁপতে মূর্ছা যাবার জোগাড়।
এ কেমন প্রহসন! পুরস্কার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাছে ডেকে এনে এ কী তিরস্কার! পড়িমরি করে চাষি আর চাষিবউ দুজনেই রাজার পায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে। করুণ স্বরে বিলাপ করে—“ক্ষমা করুন রাজামশাই! যা শাস্তি হয় আমাদের দিন! ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুকে মারবেন না! যা শাস্তি হয় আমাদের দিন!”
রাজা চোখ বুজে চিন্তা করেন। তারপর হাতে তালি দিয়ে প্রাসাদের সবথেকে কুৎসিত, খোঁড়া, মাথাভরতি উকুন সেই দাসীকে ডেকে পাঠান। হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠেন রাজা। চাষির দিকে তাকিয়ে বলেন—“আজ থেকে এই দাসীকে বিয়ে করে তোকে আস্তাবলের বিষ্ঠা পরিষ্কারের কাজ করতে হবে। আমার আদেশ অমান্য করার এটাই শাস্তি।”
চোখের জলে বুক ভাসিয়ে চাষিবউ ঘরে ফেরে। ফেরার পথে সে বালিখালি নদীর তীরে দাঁড়ায়। মনে মনে ভাবে, এ কী সর্বনাশ হল তার! চাষিকে সে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসে। সেই চাষি কিনা ওই কুৎসিত দাসীকে বিয়ে করে আস্তাবলের নোংরা পরিষ্কার করবে! মেয়ের উপর অসম্ভব ক্রোধে জ্বলতে থাকে চাষিবউ। সে ভাবে, সব এই অপয়া মেয়ের জন্য। এই মেয়ের জন্মের জন্যেই সে তার অমন শক্ত জোয়ান ভালো মনের স্বামীকে হারাল।
আর-একবার কেঁদে বুক ভাসায় চাষিবউ। নদীর কিনারে এসে খুকুকে জলে ফেলে দেবে বলে মনস্থির করে। নদীর বাঁ-পাশের ঘাটে শ্যাওড়া গাছের উপর থেকে রাজবন্ধু শকুনটা, রাজার মনোবাসনা পূর্ণ হচ্ছে দেখে বিশ্রীভাবে খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে ওঠে। নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে পণ্ডিতমশাই তখন গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি ছুটে এসে চাষিবউয়ের হাত চেপে ধরেন—
“করো কী করো কী চাষিবউ –
এই মেয়েটা নয় গো মোটেই ভেলভেলেটা
লিখবে দেখো এই মেয়েটাই
দিনবদলের সেই গানটা।”
৪
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, গাছেদের পুরানো পাতা ঝরে গিয়ে নতুন পাতা জন্মায়। বৃষ্টির জল পেয়ে পেয়ে নদীর বুক টইটম্বুর হয়ে ওঠে। পুকুর, দিঘি আর ঝোরাগুলো কী চমৎকার ঠান্ডা জলে ভরে যায়। মহারানির সাধের অ্যাকোয়ারিয়ামে নতুন দুটো গোল্ডেন ফিশ আনা হয়েছে।
গ্রীষ্মকাল চলছে, মাঠে মাঠে ধানগুলো হেলেদুলে শিস দিয়ে দিয়ে গাইছে। গম পেকে হলুদ, যবের রং সবুজ, সবুজ মাঠের ধারে খড়ের গাদা। লাল লম্বা ঠ্যাং নিয়ে সারস মহাশয় চারদিক টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, আর মায়ের কাছ থেকে শেখা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটা গাইছে।
পাড়াগাঁ এত যে সুন্দর, যে নিজের চোখে দেখেনি সে ভাবতেই পারবে না। রাজপ্রাসাদের স্ফটিক স্তম্ভের উপর উষুম উষুম রোদ পড়েছে। বালিখালি নদী এক বুক জল নিয়ে যৌবনবতী মেয়ের মতো যেন আবেগের শ্বাস ফেলছে। নদীর কিনারে লাল সাদা পদ্মের ফুল ও বড়ো বড়ো পাতা এমন উঁচু হয়ে উঠেছে যে তার মধ্যে একটা ছোটো ছেলেকে অনায়াসেই লুকিয়ে রাখা যায়। হাঁসেদের দল প্যাঁক প্যাঁক করে মেয়েটারই গল্প করছে। মা-হাঁসটা বাছাদের ধমক দেয়—“চুপ করো, রাজা শুনতে পেলে এক্ষুনি ধরে নিয়ে গিয়ে রোস্ট করে খেয়ে ফেলবে।”
শুধু সুখ নেই চাষি আর চাষিবউয়ের মনে। ছোট্ট খুকু এখন একটু বড়ো হয়েছে। তার ডাগর চোখ, মাথাভরতি চুল, কাঁচা হলুদ রং। যে দ্যাখে সে-ই মুগ্ধ হয়ে তাকায়। সবসময় সে কী যেন ভাবে। চাষিবউ এমন সুন্দর সোনার পুতুল মেয়ে পেয়েও প্রাণ খুলে আদর করতে পারে না। মেয়ের দিকে বেশিক্ষণ তাকালেই চাষিকে মনে পড়ে যায়। সে হলুদ ছোপে সবুজ শাড়িটা পরলে চাষি তাকে জোর করে সর্ষেখেতে নিয়ে যেতে চাইত। হলুদ সর্ষেফুলের খেতে বউকে দাঁড় করিয়ে চাষির সে কী স্ফূর্তি! চাষিবউ রাজি হত না, বলত—“সরষে খেতে মেয়েমানুষ নামলে মা-লক্ষ্মী রাগ করবেন।” চাষিবউ দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে—সেসব দিন কি আর আসবে!
রাজপ্রাসাদের আস্তাবলে ঘোড়ার বিষ্ঠা পরিষ্কার করতে করতে চাষি নিজের নোংরা হাত-দুটোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে—এই হাত-দুটো দিয়ে সে একদিন বিলান জমিকেও দো-ফসলি জমিতে পরিণত করত। তবে তার নতুন বউ দাসী, দেখতে খারাপ হলে কী হবে, মনটা তার খুব ভালো। চাষিকে সে সান্ত্বনা দিত—“তুমি মনখারাপ কোরো না। গাঁয়ে গিয়ে আমি ওদের খবর এনে তোমাকে দেব, আর তোমার খবর ওদের দিয়ে আসব। আমার তো কোনো দোষ নেই। বিনিময়ে তুমি আমাকে একটু ভালোবাসবে।”
ছোট্ট সোনামণি নদীর তীরে একলা একলা খেলা করে। মাছেদের সঙ্গে গল্প করে। খরগোশকে দানা খাওয়ায়। পিউকাঁহা পাখিটা তাকে গান শোনায়। ছোট্ট বুকটাতে তার খুব কষ্ট, যন্ত্রণা। কেউ তাকে ভালোবাসে না। বাবাকে সে কোনোদিন চোখেই দেখেনি। মা তাকে একটুও পছন্দ করে না। তার উপর রাজার কোপ থাকায় প্রতিবেশীরা কেউ তাদের বাচ্চাকে তার সঙ্গে খেলতে দেয় না। সে একা। ভীষণ একা। এত একা যে নিজের সঙ্গে মাঝেমাঝে কথা বলতে গিয়েও ভয় পেয়ে চমকে ওঠে। শুধু পণ্ডিতমশাই যাওয়া-আসার পথে দু-দণ্ড দাঁড়ান তার কাছে। তাকে অ্যানা ফ্রাঙ্কের গল্প বলেন, মাতঙ্গিনীর গল্প বলেন, ঝাঁসির রানির, ঈশ্বরচন্দ্রের গল্প বলেন। মুগ্ধ হয়ে শোনে মেয়েটা। শোনে আর ভাবে। ভাবতে ভাবতে তার ভিতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। কিন্তু সে তো একা ছোট্ট মেয়ে। অত বড়ো রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করবে কীভাবে?
চাষিবউ জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে আনে। দুর্গতির তার শেষ নেই। ছোট্ট মেয়েটা মটরশুঁটি খেতে মায়ের জন্য অপেক্ষা করে। নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়। পাখপাখালি আর গাছগাছালির সঙ্গে কথা বলে।
এমন একদিন। মেয়েটা নদীতে নাইতে গেছে। যেই-না জলে ডুব দিয়েছে, পা পিছলে জলের অনেকখানি গভীরে চলে যায়। জলের তলার রং কী গাঢ় নীল! সেই নীলের মধ্যে একটা সাদা ধবধবে ঝিনুক মেয়েটার বুকের কাছে এসে আটকে যায়। দু’হাতে ঝিনুকটা আঁকড়ে ধরে মেয়েটা। জলের উপর ভুস্ করে ভেসে ওঠে। ঘাটে উঠে অবাক ও মুগ্ধ চোখে জিনিসটাকে সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দ্যাখে। এমন সুন্দর জিনিস সে আগে কখনও দেখেনি। জিনিসটার নামও সে জানে না।
এই দেশে ঝিনুকরা রাজার ভয়ে কেউ জলের উপরে আসত না। ঝিনুকদের যখন অসুখ করে তখন তাদের পেটের ভিতর এক ধরনের ঘা হয়। সেই ঘা থেকে রস গড়িয়ে গড়িয়ে বিন্দুর মতো জমা হয়, শুকিয়ে গেলে মানুষ তাকে বলে মুক্তো। সেই মুক্তো নাকি খুব দামি জিনিস। রাজা ঝিনুকদের পেট উপড়ে সেই মুক্তো বার করে নিতেন। আর বিশাল এক চৌবাচ্চা বানিয়ে বাচ্চা বাচ্চা ঝিনুকগুলোকে তার মধ্যে ছেড়ে দিয়ে তাতে এক ধরনের বিষ মিশিয়ে দিতেন। সেই বিষক্রিয়ায় ঝিনুকদের শরীরে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টদায়ক ঘা হত। রাজা তখন ঝিনুকদের শরীর খুলে খুলে গা থেকে গড়ানো রসের মুক্তো বার করে নিয়ে বাজারে বিক্রি করতেন।
ঝিনুকটাকে পেয়ে মেয়েটার আহ্লাদের সীমা ধরে না। সে আকাশমণি গাছটার গায়ে চুল শুকানোর জন্য হেলান দিয়ে বসে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে জিনিসটাকে। আর ওদিকে, শ্যাওড়াগাছের ডালে বসে থাকা রাজার সুহৃদ শকুনটা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে—মেয়েটার হাতে ওটা কী?
চাষিবউ এখন কাঠকুড়ুনি-বউতে পরিণত হয়েছে। রোজ রোজ জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে যেতে হয় তাকে। জঙ্গলের পথেই একদিন এক কাঠুরের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। লোকটা খুব মন দিয়ে চাষিবউয়ের দুঃখের কথা শোনে। শুনতে শুনতে কাঠুরের মনে চাষিবউয়ের জন্য করুণা ও ভালোবাসা দুটোরই উদ্রেক হয়। সে চাষিবউয়ের হাত চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে বলে—“এমন নরম হাতে কুড়ুল দিয়ে শক্ত কাঠ কাটা তোমাকে শোভা পায় না। তুমি আমার বউ হবে?”
সেদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে অনেক দিন পর চাষিবউয়ের ভিতর খুশির জোয়ার আসে। লালমাটি দিয়ে ঘষে ঘষে সে নদীতে স্নান করে। গুগলি ভেঙে ভেঙে চমৎকার ঝোল রান্না করে। সঙ্গে মাসুরি চালের ভাত। মাকে এমন হাসিখুশি প্রাণবন্ত দেখে মেয়েটার খুব আনন্দ হয়। সে মায়ের কাছে গিয়ে ঝিনুকটি দেখায়। চাষিবউয়ের তো চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।
—ওমা, এ তো ঝিনুক! এ তুই কোথায় পেলি? ঝিনুকরা তো রাজার ভয়ে এখন নদীতে জলের নীচে লুকিয়ে থাকে।
মেয়েটা হাসিমুখে বলে—“হ্যাঁ গো মা, নদীতে নাইতে নাইতে জলের তলায় ওকে পেলাম।”
কিছুদিন পর একটা শুভদিন দেখে সেই কাঠুরের সঙ্গে চাষিবউয়ের বিয়ে হয়ে যায়। মা ভালো থাকবে এই ভেবে মেয়েটা সাগ্রহে গ্রহণ করে নেয় নতুন বাবাকে। তখন শীতকাল। আশপাশের ঝোপঝাড়গুলো মিষ্টি মিষ্টি টোপা টোপা কুলে ভরে ওঠে, আর সেগুলো খেতে বিভিন্ন দেশ থেকে কত যে পাখিরা আসে তা বলার নয়। সে এক দেখার মতো দৃশ্য।
এদিকে হল কী, কাঠুরিয়া তার নতুন বউকে মুহূর্তের জন্য কাছছাড়া করতে চায় না। এর মধ্যে মেয়ের জন্য নিয়ম করে রাঁধা, ফাইফরমাশ খাটা—এসব কাঠুরিয়ার একেবারেই ভালো লাগে না। কিছুদিনের মধ্যেই দু-চোখের বিষ হয়ে যায় মেয়েটা। আর চাষিবউ, এই মেয়ের জন্য পুনরায় নতুন বরকে হারাতে হবে ভেবে, মেয়েকে দূরে রাখে। মেয়েটা একা একা নদীর ধারে হেঁটে বেড়ায়, আর ঝিনুকের সঙ্গে মনের দুঃখের কথা বলে।
—বল ঝিনুক, আমি কী অন্যায় করেছি যে আমাকে কেউ ভালোবাসে না? কেউ চায় না!
৫
সেই ছোট্ট খুকু সোনামণি এখন রূপবতী যৌবনবতী কিশোরী। সমস্ত শরীর জুড়ে সৌন্দর্যের ঢল নেমেছে। তবু কেউ নেই যে ফিরে দ্যাখে, কাছে টানে, ভালোবেসে সোহাগ করে দুটো মিষ্টি কথা বলে।
সেবছর হেমন্তের কিছু পরে একদিন বিকেলবেলায় সূর্যটা লাল হয়ে নদীর জলে মিশে যাচ্ছে। এক ঝাঁক পায়রা, চাঁদিমাছ তাদের চকচকে শরীর ভাসিয়ে মুখ তুলে তুলে মেয়েটাকে দেখছে। আর একটা বড়োসড়ো রাজহাঁস আড়চোখে মেয়েটাকে দেখে ভাবছে—ইশ্ ও যদি মেয়ে-হাঁস হত তাহলে এখনই আমি ওকে বিয়ে করতাম।
এমন সময় পণ্ডিতমশাই ওই পথ দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে যায়। তাঁর হঠাৎ করে মনে হয়—আরে মেয়েটা তো অনেক বড়ো হয়ে গেছে! তিনি ধীরে ধীরে মেয়েটির কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
—এই মেয়েটা, তুই তো অনেক বড়ো হয়ে গেছিস! তা, তুই কি সমস্ত জীবনভর মূর্খই থেকে যাবি? লেখাপড়া কিছুই করবি না?
মেয়েটা পায়ের নখ দিয়ে নদীর মাটি খুঁটতে থাকে।
পণ্ডিতমশাই বলেন—“ঠিক আছে, যাতায়াতের পথে আমি তোকে রোজ অক্ষরজ্ঞান শেখাব।”
আবেগে ভেসে গিয়ে মেয়েটা কেঁদে ওঠে।
সস্নেহে পণ্ডিতমশাই মেয়েটাকে বুকে টেনে নিয়ে হাসিমুখে বলেন—
“বোকা মেয়েটা—ভেলভেলেটা
ফেলতে নেই রে - চোখের জলটা
মস্ত বড়ো এই দেশটা—
গাইবি না তুই? দিনবদলের সেই গানটা!”
দিন যায়, দিন যায়—ঝিনুকটাকে মুহূর্তের জন্য কাছছাড়া করে না মেয়েটা। ঝিনুকটা তার প্রাণ। সারাক্ষণ হাতের মুঠোয় রেখে দেয়। শুধু ঘুমোতে যায় যখন, বুকের ভাঁজে রেখে দেয়।
আবার দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে যায়। মেয়েটা আরও বড়ো হয়। আরও সুন্দর হয়। কাঠুরিয়া আর চাষিবউয়ের এক ছেলে হয়েছে। ছেলেটা অবশ্য মেয়েটার মতো সুন্দর না। তবু তো ছেলে। ভাই পেয়ে মেয়েটারও খুব আনন্দ। ভাইকে সে নদীর ধারে বেড়াতে নিয়ে যায়। গাছের কোটর থেকে দোয়েলপাখির বাচ্চা এনে দেয়। ধনেশপাখির গান শোনায়। টিয়াপাখির সবুজ মখমলের মতো শরীরে হাত বুলিয়ে গান ধরে। একদিন ছোট্ট ভাইয়ের হঠাৎ নজরে পড়ে, তার দিদির হাতে সাদা ধবধবে ঝিনুকটির দিকে। সে বায়না জুড়ে দেয় ওই ঝিনুকটি তার চাই। মেয়েটার কাউকে কিছুই অদেয় নেই। শুধু এই ঝিনুকটির ক্ষেত্রে সে রাজি হয় না। ঝিনুকটি তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। কিন্তু তার সৎভাই জিউ কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যায়। কাঠুরিয়া আর চাষিবউ ভাবে—এ কী নিষ্ঠুর মেয়ে রে বাবা! একটা সামান্য ঝিনুকের জন্য নিজের ভাইকে কেউ এত কষ্ট দেয়!
তবু মেয়েটা তার সিদ্ধান্তে অনড়, ঝিনুকটা সে কিছুতেই দেবে না। কাঠুরিয়া তখন একটা শিরীষ গাছের ডাল ভেঙে এনে বেদম প্রহার করে মেয়েটাকে। মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দেয় তাকে। মেয়েটা মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে নদীর ধারে এসে বসে। তার এত কষ্ট হয় যে মনে হয় নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে এ জীবন শেষ করে দেয়।
পিউকাঁহা পাখিটার বয়স হয়েছে। শ্লেষ্মা ও টানের কষ্টে রাতে ভালো ঘুম হয় না তার। মেয়েটার কান্না শুনে সে তার পাশে এসে বসে। মেয়েটা পিউকাঁহাকে বলে—“বল বুড়িপাখি, কী দোষ করেছি আমি? কেন আমার উপর এত নির্যাতন? তাই আমি ঠিক করেছি এ জীবন আর রাখব না।”
এই কথা শুনে বুড়িপাখির চোখে জল আসে। সে সান্ত্বনা দিয়ে বলে—“ছিঃ বাছা, অমন অলক্ষুণে কথা বলতে নেই।”
বুকের ভাঁজে ঝিনুকটা নিয়ে নদীর ধারে বালির উপর কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা। বুড়ি পিউকাঁহা ঝিমোতে ঝিমোতে মেয়েটাকে পাহারা দেয়।
৬
রাজপ্রাসাদের রাজার মনে সুখ নেই। সমস্ত প্রাসাদের আনাচেকানাচে তিনি যেন ফিশফিশানি, হিস্হিসানি শুনতে পান—বিদ্রোহ বিদ্রোহ।
রাজা বড়ো আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে মুকুটটা ঠিকঠাক করে এঁটেসেঁটে বসিয়ে দেন। তার হাবভাব দেখে মনে হয়, যেন ওই মুকুট মাথায় থাকলেই রাজার আসন টলবে না।
ভোরবেলা কুসুম কুসুম আলো যখন নদীর জলে ঝিলমিলিয়ে খেলা করছে, পায়রা আর চাঁদামাছগুলো ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে সাদা ফেনা তুলে প্রভাতী সংগীত গাইছে, রাজহাঁসের দল সাদা পাখনা ছড়িয়ে প্যাঁক প্যাঁক করে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টাইয়ার্কি করতে ব্যস্ত, তখন একটা বনমুরগি ডিমে তা দিতে দিতে সর্ষেখেতের ফুলগুলোর কথা ভাবছে। ভোরবেলার ঠান্ডা বাতাসে পিউকাঁহার চোখ বুজে আসছিল, এমন সময় রাজার মিত্র শয়তান শকুন ঘাড় লম্বা করে ঝিনুকটা দেখে ছোঁ মারতে আসে।
আর ঠিক সেইসময় পণ্ডিতমশাই ওই পথ দিয়ে প্রাতঃভ্রমণে যাচ্ছিলেন, তিনি মেয়েটির এই করুণ অবস্থা দেখে ছুটে আসেন। তাঁর চোখে জল এসে যায়। নদীর জল এনে মেয়েটার চোখেমুখে ছিটিয়ে দেন তিনি। মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। খিদে-তৃষ্ণায় তার মুখের সেই গোলাপি বর্ণ মিলিয়ে গেছে। পণ্ডিতমশাই ধীরে ধীরে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিজের আশ্রমে নিয়ে আসেন। এমন একটা হৃদয়বিদারক দৃশ্যে পিউকাঁহা কাঁদে, রাজহাঁস কাঁদে, মাছেরা নিজেদের মধ্যে মেয়েটার দুঃখের কথা বলাবলি করে। শুধু রাজার বন্ধু শয়তান শকুন চোখ পাকিয়ে, ঠোঁট উঁচিয়ে ভাবতে থাকে—রাজাকে খবরটা দিতে হবে।
পণ্ডিতমশাইয়ের আশ্রমে গিয়ে মেয়েটার জীবনে সত্যিকারের আলোর দেখা মেলে। এখানে এসে মেয়েটা নতুন ঈশ্বরকে পায়। এ তাদের কুলুঙ্গিতে টাঙানো কোনো দেবদেবীর পট নয়, এ মানুষের ছবি। তার নাম বিদ্যাসাগর। মেয়েটা পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে উদাত্ত কণ্ঠে আশ্রমের প্রার্থনা সংগীত গায়—
“অসদো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মা অমৃতম্ গময়
আবীরাবীর্ম এধি”
একদিন বিকেলবেলায় মেয়েটা পণ্ডিতমশাইয়ের ঘরের পেছনে, ফল ও ফুলের ছোট্ট বাগানটায় জল দিচ্ছে, এমন সময় পণ্ডিতমশাই ছুটতে ছুটতে এসে খবর দেন—“এই মেয়েটা, রাজপ্রাসাদের দাসমহলে তোর বাবা মৃত্যুশয্যায়। তোকে একবার শেষ দেখা দেখতে চেয়েছে।”
মেয়েটা দৌড়োতে দৌড়োতে রাজপ্রাসাদে এসে হাজির হয়। চাষি তখন শেষ নিশ্বাস ফেলার মুহূর্তের যন্ত্রণা সহ্য করছে। সেই দাসীবউ পাশে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছে। মেয়েটাকে দেখে তাড়াতাড়ি চাষির কাছে তাকে নিয়ে আসে সে। চাষি তার অসুস্থ কম্পিত হাত তুলে মেয়েটার মাথায় রেখে কোনোরকমে বলে—“বাবা হয়ে তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না রে মা!”
বাবার বুকে আছাড় খেয়ে কাঁদতে থাকে মেয়ে। উঃ সে কী কষ্টের দৃশ্য, যে না চোখে দেখেছে সে ভাবতে পারবে না। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার হাত থেকে ঝিনুকটা বাবার গায়ের উপর পড়ে যায়। চাষি অবাক হয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে কোনোরকমে বলে—“ওমা, এ তো ঝিনুক! এটা তুই কোথায় পেলি?”
এই কথাটুকু বলার পরেই ঝিনুকটার দিকে একবার তাকিয়েই চাষি শেষ নিশ্বাস ফেলল। দাসীবউ কান্নায় ভেঙে পড়ে। পুরো দাসমহলে শোকের ঘণ্টা বাজে। আর মেয়েটা কান্না ভুলে অবাক হয়ে দ্যাখে ঝিনুকের পেটের ভিতর টলটলে চোখের জলের মতো একটা পুঁতি। তার থেকে অদ্ভুত একটা জ্যোতি বের হচ্ছে। মেয়েটা তাড়াতাড়ি হাতের মুঠোয় ভরে নেয় ঝিনুকটা। তারপর সকলের অলক্ষ্যে প্রাসাদের বাইরে এসে ছুটতে থাকে। শোকের বাড়ি, তাই কেউ তাকে খেয়ালও করল না।
রাজা ভাবেন, দাসদাসীদের আলো-বাতাসের প্রয়োজন হয় না। তাই তাদের জানালাগুলো অদ্ভুত ধরনের, আর ছোটো ছোটো। সেই জানালার একটা কুঠুরি দিয়ে একটা চোখ লাগিয়ে শকুন সেই দৃশ্যটা দেখে ফেলল। এবং একটুও কালবিলম্ব না-করে রাজার কাছে খবরটা সে পৌঁছে দেয়।
৭
সেবছর এত ভালো ফসল হয়েছিল যে, প্রজাদের এবং রাজপ্রাসাদের তিনশো কুড়িটা খামারবাড়ি ভরেও মাঠে মাঠে ফসল উপচে পড়ছে। কৃষকদের হাতে-পায়ে বাত ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা।
রাজা দু-আঙুল কপালে টিপে বিশেষ মুদ্রায় ভাবতে বসেন। রানি দেয়ালজোড়া আয়নার সামনে বক্ষকাঁচুলিতে নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেন। তার নখ থেকে চুল পর্যন্ত হরেকরকম চুনি-পান্নায় ঢাকা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে তিনি ভাবেন—সবই ঠিক আছে, শুধু নাভিমূলে যদি একটা মুক্তো গাঁথতে পারতাম তবে বেশ লাগত।
রাজামশাইয়ের গলা জড়িয়ে, ঠোঁট ফুলিয়ে রানি আবদার করেন—“আমার একটি মুক্তো চাই।”
আসলে রানির অ্যাকোয়ারিয়ামের ওই পুরুষ গোল্ডেন ফিশটা আসার পর থেকেই রানির সাজগোজের মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। রানির আবদার এবং অভিমান কোনোটাই রাজার নজরে এল না। তিনি শুধু কপাল টিপে ভাবতে লাগলেন—একটা মহামূল্যবান মুক্তো সেই মেয়েটা ভেলভেলেটার কাছে থাকবে, এটা ঠিক নয়। তা ছাড়া এই যে কৃষকের গোলাভরা ফসল, শ্রমিকের পেট-ভরতি ভাত—এতে তো প্রজারা সুখে থাকবে। তাহলে তো দেশে আর রাজার প্রয়োজনই থাকবে না। রাজা ভাবতে ভাবতে কুলকিনারা পান না। রানি বসে থাকতে থাকতে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠেন। রাজার কাছে অভিমানের স্বরে বলেন—তাঁর একটি মুক্তো চাই।
রানিকে রাজা আশ্বাস দেন—খুব তাড়াতাড়ি তিনি মুক্তোর ব্যবস্থা করে দেবেন।
ওদিকে মেয়েটা ঝিনুক নিয়ে ছুটতে ছুটতে হাজির হয় পণ্ডিতমশাইয়ের আশ্রমে। হাঁপাতে হাঁপাতে তার চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। পণ্ডিতমশাই ভয় পেয়ে যান। ভাবেন, হয়তো জ্ঞান হওয়ার পর এই প্রথম বাবাকে দেখল, তাও মৃত্যুশয্যায়, সেইজন্যই হয়তো বেচারি শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। তিনি মেয়েটার ঘাম মুছিয়ে সান্ত্বনা দেন—
“সোনা মেয়েটা ভেলভেলেটা
সহজ নয় গো বেঁচে থাকাটা।
সামনের দিন জোর লড়াই,
তোমার পাশে আমরা সবাই।”
মেয়েটা হাতের মুঠি খুলে পণ্ডিতমশাইয়ের সামনে মেলে ধরে। পণ্ডিতমশাইয়ের বয়স্ক কিন্তু ঋজু শরীরে সময়ের ভাঁজ পড়া কপাল আর বাঁশির মতো নাকটির দু-পাশে তীক্ষ্ণ চোখ-দুটি জলে ভরে যায়। তিনি শান্ত গলায় বলেন—“এ তো মুক্তো রে! এ তুই কোথায় পেলি? এটা কখনও কাছছাড়া করিস না। এই মুক্তো যার কাছে থাকবে জীবনে সে কোনো বিপদে পড়বে না। জয় তার অবশ্যম্ভাবী। এটা তুই যোগ্য মানুষ ছাড়া কক্ষনো কাউকে দিবি না।”
যেই-না এই কথা বলা, সেইমাত্র আকাশে কালো মেঘ করে, মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোর ঝলকানিতে চারদিক সাদা হয়ে যায়। পৃথিবী যেন চমকে ওঠে। আর সেই তীরের ফলার মতো আলোটা পণ্ডিতমশাইয়ের বুক চিরে এমাথা-ওমাথা হয়ে বেরিয়ে যায়। অসময়ের সূর্যগ্রহণের মতো সকলে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মেয়েটা কিছু বুঝতে না-পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে যখন বুঝতে পারে মানুষটা আর নেই, তখন বুকফাটানো আর্তনাদে আকাশবাতাস তোলপাড় করে পণ্ডিতমশাইয়ের বুকের উপর আছড়ে পড়ে। তার সবথেকে ভালো বন্ধু, অভিভাবক, আজ তাকে সত্যিকারের একা করে দিয়ে চলে গেলেন।
কাঁদতে কাঁদতে বেলা গড়িয়ে যায়। তার নাওয়া-খাওয়া নেই। জন্মের পর থেকে সে বহু দুঃখ পেয়েছে, অপরিসীম লাঞ্ছনা চরম অপমান অবজ্ঞা পেয়েছে—কিন্তু এত নিঃস্ব কখনও মনে হয়নি। একে একে প্রতিবেশীরা আসে, তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কেউ কেউ মেয়েটার মাথায় হাত রাখে, সান্ত্বনা দেয়—‘বেচারি মেয়েটা’।
তারপর বিকেলবেলা আশ্রমের পেছনে একচিলতে বাগানটার উত্তরপাশে তাঁর ইচ্ছানুসারে পণ্ডিতমশাইকে সমাধি দেওয়া হয়। পুরোনো প্রতিবেশী ছুতোর একটা শিশুকাঠের সুদৃশ্য কফিন বানিয়ে নিয়ে আসে। মেয়েটাই প্রথম মাটি দেয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে সূর্য তখন বালিখালি নদীতে নেমে গিয়ে জলের রং লাল করে দিয়ে মিশে যাচ্ছে। মেয়েটা লুকিয়ে একটা স্বর্ণচাঁপার চারা এনে সমাধির উপর পুঁতে দিয়ে সমাধির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। বুকের ভেতরটা তার হু-হু করে। একা একা ছায়ামূর্তির মতো বসে বসে কাঁদতে থাকে সে। চোখের জলে ভিজে যায় সবকিছু। ঠিক সেইসময় উঠোনে মাধবীলতার মাচান করা বেতের দরজাটা ক্যাঁচ্-কুঁচ্ আওয়াজ করে, আর দুটো ছায়ামানুষ নারী-পুরুষ কণ্ঠে ডাক দেয়—“এই মেয়েটা, এই মেয়েটা।”
মেয়েটা ভয় পেয়ে যায়। ঝিনুকটা শক্ত মুঠির মধ্যে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ছায়ামানুষ দুটো স্পষ্ট হয়। মেয়েটা বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে যায়। নাসিমা আর অসীম। ওরা দুজনেই মুখে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ করতে বলে। চারপাশে সাবধানী দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে এসে নাসিমা বলে—“এই মেয়েটা, আজ থেকে আমরা তোর বন্ধু। তুই কক্ষনো নিজেকে একা ভাববি না।”
মেয়েটা অবাক চোখে নাসিমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন কথা সে জন্মেও শোনেনি।
অসীম এগিয়ে এসে মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বলে—“তুই পারবি, দেখিস। শুধু মনের জোরটা হারাস না। আমরা তোর সঙ্গে আছি। তবে আজকে আমি আর থাকতে পারব না। নাসিমা আজ থেকে রাতে তোর সঙ্গে থাকবে। ও তোর খোঁজখবর রাখবে।”
মেয়েটা সত্যিসত্যিই বোকার মতোই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
অসীম মেয়েটার গাল টিপে বলে—“ঝিনুকটা যোগ্য মানুষ ছাড়া হাতছাড়া করিস না। চলি ‘কমরেড’!”
অসীমের ছায়া অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার পরও মেয়েটা প্রদীপ হাতে সেদিকে চেয়ে থাকে। সে যেন নিজের চোখ-কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। সে ভাবতে পারে না যে, কেউ বলছে, ‘তোর জন্য আমরা আছি’।
মেয়েটাকে নাসিমা আলতো করে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। নাসিমার কোচড়ে আনা চিড়ে-মুড়ি-নাড়ু দিয়ে রাতের খাবার সারে ওরা। নিজের নরম বুকের মাঝে মেয়েটাকে কাছে টেনে নেয় নাসিমা। নাসিমার বুকের মাঝে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে—“আমাকে কেউ চায় না কেন নাসিমা দিদি?”
৮
দিন যায়, দিন যায়। সমস্ত রাজ্যে লোকমুখে ছড়িয়ে যায়, মেয়েটার কাছে নাকি অসম্ভব দুর্লভ একটা মূল্যবান মুক্তো আছে। মেয়েটার মা আর তার দ্বিতীয় স্বামী কাঠুরিয়াও শোনে ব্যাপারটা। কাঠরিয়া খুব আপশোশ করে—ইশ্! মেয়েটাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে না দিলেই ভালো হত।
চাষিবউ মনে মনে ভাবে—কী যেন খেতে ভালোবাসতো মেয়েটা? অনেক ভেবে মনে করল—তেলে ভাজা আতপচালের গুড়পিঠে।
পিউকাঁহার অনেক বয়স হয়েছে। তবু, সে সব দ্যাখে, সব বোঝে। খুব মনখারাপ করে তার। মানুষের এই অদ্ভুত নিষ্ঠুরতায় তার ছানিপড়া ঝাপসা চোখে জল আসে। তাদের, পাখিদের জগতে আর যা-ই হোক, এমন নিষ্ঠুরতা নেই।
পথে যেতে যেতে চাষিবউয়ের একটু মনখারাপ হয়। কতদিন পর মেয়েটাকে দেখবে। লোকমুখে শুনেছে, সে নাকি সেরা পুতুলের মতো সুন্দর দেখতে হয়েছে।
বালিখালি নদী পার হয়ে যাওয়ার সময় তাকে দেখতে পেয়ে শকুন চাষিবউয়ের পেছনে পেছনে উড়তে শুরু করে।
সূর্য তখন আড়াআড়ি মাথার উপর থেকে হেলে পড়েছে। চাষিবউ হাঁপিয়ে ওঠে। কিন্তু গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সূর্যের আলো জ্বলজ্বল করে। চাষিবউয়ের মনে হয় সে যেন কোনো চুল্লির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে।
পণ্ডিতমশাইয়ের টোলে যখন চাষিবউ পৌঁছালো, মেয়েটা তখন পুরোনো তোরঙ্গ থেকে ধুলোপড়া বইগুলো ঝেড়ে মুছে সাফ করছে। উঠোনের দরজা ঠেলে তার মা যখন ভেতরে ঢোকে, প্রথমটা তো সে চিনতেই পারেনি। অপলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মা এসেছে তার কাছে, মা এসেছে! দাওয়া থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে পা মচকে পড়ে আর কী!
শকুনের শয়তানি চোখ তখন তালগাছের উপর থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে দেখতে থাকে।
—এ কী, মেয়েটা তাহলে মুক্তোটা মাকে দিয়ে দেবে নাকি?
মা এসে মেয়ের হাতে হাত রাখে। আনন্দে, অভিমানে, কষ্টে হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকে মেয়েটা। সেইসময় হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে জল থেকে উঠে ঘরের দিকে রওনা দিয়েছে। তারা এমন দৃশ্য এর আগে কখনও দেখেনি। মুহূর্তের জন্য থমকে যায় তারা।
চাষিবউ অনুযোগ জানায়—“হ্যাঁ রে, মাকে কি একটুও মনে পড়ে না তোর?”
মেয়েটা মুখ নীচু করে থাকে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে উঠোনের মাটি খোঁটে।
চাষিবউ কোঁচড় থেকে পিঠে বার করে খাওয়ায় মেয়েকে, নিজের মেয়ের এমন ভরন্ত রূপ দেখে একটু গর্ব হলেও মনে মনে ভাবে—ওর একটা বিয়ে দিতে হবে।
যেই-না ভাবা, অমনি ফস্ করে মুখ থেকে আচমকা বেরিয়ে যায় কথাটা। মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় মেয়েটা।
মেয়ের ঝাঁকড়া চুলে বিলি কেটে দিয়ে মা বলে—“তোর কাছে একটা মুক্তো আছে না?”
মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। এই উঠে দাঁড়ানোর মধ্যে একটা দর্প কাজ করে। হাতে ধরে থাকা আধখাওয়া তেলের-পিঠে উঠোনের ধুলোয় ছুড়ে ফেলে দেয়।
তালগাছের মাথার উপর শয়তান শকুন মজা পেয়ে ডানা ঝাঁপটিয়ে নড়েচড়ে বসে। ডানা ঝাঁপটানিতে তার দুটো পালক খসে পড়ে।
মেয়েটা ফুঁপিয়ে ওঠে। ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ভেতর থেকে বলে—“মা তুমি আমার কাছে আসোনি। আমার মুক্তোর কাছে এসেছ।”
চাষিবউ রেগে ওঠে—“জন্ম থেকেই তুই অপয়া, কী কুক্ষণে যে তোকে পেটে ধরেছিলাম! কেন যে তখন মুখে নুন দিয়ে টিপে মারিনি তোকে! শুনে রাখ, আমি তোর বিয়ে দেব। চাষির মেয়ে চাষির ঘরে বিয়ে দেব। দেখব, তখন তাকে তুই মুক্তোটা না দিয়ে কেমন থাকতে পারিস।”
মেয়েটা দাঁতে দাঁত চাপে। এত মনের জোর সে কোথায় পায় নিজেও জানে না। তবে নিজেকেই নিজে বলে—“কক্ষনো না, যোগ্য মানুষ না পেলে এ মুক্তো আমি কাউকে দেব না।”
শেষ বর্ষার কদমের পাপড়িগুলো মাটিতে পড়ে পচে পচে যখন গন্ধ ছড়াচ্ছে, বেলা ছোটো হয়ে আসায় অন্ধকার গোপনে কবুতরের ডিম ফোটার উষ্ণতায় শিউলি ফুলগুলো যখন তাদের সুগন্ধে রাজ্যবাসীকে মাতোয়ারা করে রেখেছে, তখন মেয়েটা একসঙ্গে দুটো খবর পেল। দুটো খবরই এসেছে নাসিমা মারফত। এখন মেয়েটা নাসিমা আর অসীমের কাজকর্ম কিছু কিছু বোঝে। ওরা রাজার ধ্বংস চায়। ওরা চায় সাঁওতাল তার নিজের ভাষায় কথা বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে। ওরা দিনবদলের স্বপ্ন দ্যাখে, ভালোবাসার আগুনে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়ে গেছে ওরা। নাসিমার আনা খবর দুটোর মধ্যে একটা হল—মেয়েটার মা কোনো-এক চাষির সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে ঠিক করেছে। নাসিমা তাকে বোঝায়—“বিয়েটা তুই করিস না। তোকে এখনও অনেক পথ যেতে হবে।”
মেয়েটা শোনে, চুপচাপ মাথা নীচু করে শোনে, আর ভাবে—কী করবে সে।
সমাধিতে সাঁঝবাতি দিতে গিয়ে সে শুকতারার দিকে চেয়ে সেই ঝিনুককেই জিজ্ঞাসা করে—“তুই বলে দে ঝিনুক, তোর এ মুক্তো আমি কাকে দেব? তোর যন্ত্রণার কান্না জমা স্পর্শ আমি কাকে দেব? এ ভার যে আমি আর বইতে পারছি না।”
সন্ধ্যা নামে। গাঢ় হয়। রাত আসে, রাত ঢলে আরও রাত নামে। মেয়েটা ঘুম জলে ওই সমাধির পাশে ভেসে যায়। ভাসতে ভাসতে সে তারাদের দেশে, পরিদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সেখানে অনেক অদ্ভুত সুন্দর পরিদের হাতে হাতে একটা একটা স্বচ্ছ ঝিনুক। ঝিনুকদের পেটের ভিতর টলটলে এক-একটা মুক্তো। প্রত্যেকেই সার বেঁধে যেন কার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়েটা জানতে চায়—“তোমরা কার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছ?”
পরিরা সমস্বরে উত্তর করে—“ফুলকুমারী, আমাদের সকলের কাছে একটা একটা করে অসম্ভব মূল্যবান মুক্তো আছে। এই মুক্তো যার কাছে থাকবে, জীবনে সবক্ষেত্রেই সে জয়ী হবে। একদিন এক সওদাগর এ পথে বাণিজ্যে যাবে, তার হাতেই এ মুক্তোটা তুলে দেব আমরা। তার অপেক্ষাতেই দিন গুনছি।”
৯
আকাশের উত্তর কোণে শুকতারাটা জ্বলজ্বল করছে। নিভু নিভু সময় আর-একবার সে নিজের অস্তিত্বের কথা জানাতে চাইছে। বয়সের ভারে সারারাত অনিদ্রায় কাটিয়ে ভোরের শীতল বাতাসে যখন পিউকাঁহার চোখ বুজে আসে তখন মেয়েটা কোতোয়ালের ঘোষণা শুনতে পায়। শুনতে পেয়ে জেগে যায়। জেগে গিয়ে চমকে ওকে।
“ডুম – ডুম – ডুম – ডুম…
শোনো, শোনো, শোনো। সমস্ত রাজ্যবাসীগণকে জানানো যাইতেছে যে, পণ্ডিতমশাইয়ের আশ্রমে যে মেয়েটি থাকে তার কাছে মহামূল্যবান একটি মুক্তো আছে। যে ওই মুক্তোটি আনিয়া দিতে পারিবে রাজামহাশয় তাহাকে বহু অর্থমূল্যে পুরস্কৃত করিবেন।
ডুম – ডুম – ডুম – ডুম…”
ব্যাস, যেই-না ঘোষণা—অমনি কাতারে কাতারে লোক জড়ো হয়। মন্ত্রী, সান্ত্রী, কারিগর, চিকিৎসক, পুরোহিত, কেউ বাদ গেল না। কেউ ভয় দেখায়। কেউ লোভ দেখায়। কেউ চাতুরি করে। কেউ মারতে আসে। যত তারা একজোট বাঁধে, মেয়েটা তত একা হয়ে যায়। আর যত একা হয়ে যায়, তত অসম্ভব তেজ আসে তার শরীর ও মনে। রাজ্যের কোনো পদাধিকারী মানুষ বাদ গেল না। তারা প্রচুর কথা বলল। শুধু কেউ বলল না, “আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমার জন্য আমি আছি, এই আমার হাতটা ধরো। দেখো, দুনিয়াটা বদলে যাবে। একবার চোখ-দুটো বন্ধ করো, উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে কবোষ্ণ করে তুলব তোমার নরম দেহ।”
সবশেষে চাষিবউ আবারও একদিন এল। এবার সে একা আসেনি। সঙ্গে পিউকাঁহাও এসেছে। চাষিবউ জানত, পিউকাঁহার বুকে মেয়েটার জন্য একটা মমতা আছে। চাষিবউ মেয়েটাকে বোঝায়—একলা বেঁচে থাকাটা কোনো কাজের কথা নয়। তার উপর জন্ম থেকেই রাজার কুনজরে আছে সে। সেইজন্য বিয়েটা হয়ে যাওয়াই সবথেকে ভালো।
মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। গ্রামেরই এক অবস্থাপন্ন চাষির সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের দুদিন আগে হাতির পিঠে চেপে আগে-পিছে সৈন্য-রথী সাজিয়ে সেজেগুজে ভিখারির মতো রাজা এলেন। রাজা এলেন, তাও কিনা রাজ্যের কিনারে পরিত্যক্ত পণ্ডিতমশাইয়ের আশ্রমে, সেই বোকা মেয়েটার কাছে! শুধু একটা মুক্তোর জন্য!
মেয়েটা মাটির উপর শক্ত দেবদারু গাছের মতো ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। তার নাসারন্ধ্র স্ফীত হয়। উত্তেজনায় বুকের ভিতর তিরতির করে কাঁপে, বক্ষবাস আলগা হয়ে যায়। মেয়েটা সরাসরি রাজার দিকে তাকায়।
—কী চাও তুমি?
—মুক্তোটা।
—কেন?
—আমি রাজা, রাজা যা চায় তা-ই পায়।
মেয়েটার দু-চোখে আগুন ঝরে।
—তোমার ভাবনায় কিছু ভুল আছে। আমরা, মানে দেশের মানুষ তোমাকে রাজা বানিয়েছি, তাই তুমি চাইলেই সবকিছু পেতে পারো না।
রাজার চোখ লাল হয়ে ওঠে। একরত্তি মেয়ে এত সাহস পাচ্ছে কোথা থেকে!
মেয়েটার ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গের হাসি আসে। চোখে তাচ্ছিল্য। চিবুক তুলে বলে—“রাজা, তোমার দিন শেষ, নতুবা তুমি, দেশের রাজা হয়ে শুধু একটা মুক্তোর জন্য এই জীর্ণ কুটিরে আস? তুমি দেশের রাজা নও, তুমি হলে রাজভিখারি। আর সহসা মার খেতে-খেতেই মানুষ একদিন ঘুরে দাঁড়ানোর ভাষা শেখে। সাহস আসে আপনা-আপনি। তুমি ফিরে যাও রাজা, এ মুক্তো আমি তোমায় দেব না।”
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রাজা বুঝতে পারে, জোরজবরদস্তিতে কাজ হবে না। তাই নিজেই হাতির পিঠ থেকে নেমে সামনাসামনি এসে মেয়েটার কাঁধে হাত রাখে।
—আমি তোমাকে বিয়ে করে রাজপ্রাসাদের মহারানি বানিয়ে দেব।
এমন একটা কিম্ভূতুড়ে কথা শুনে মেয়েটা হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে তার দু-চোখ দিয়ে বড়ো বেদনার অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তার ঠোঁট কাঁপে। কোনোরকমে সে বলে—“রাজা, তোমার বয়স কত?”
এবার রাজার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। তিনি হুংকার দিয়ে বলেন—“যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা! রাজার বয়স থাকে না। তারা যখন যা ভোগ করতে চায়, তখনই তা পায়। এটাই রাজ্যের আইন।”
যেই-না এই কথা বলা, মাধবীলতার ঝোপ থেকে, কাঁঠালগাছের মাথা থেকে, কলাগাছের পেছন থেকে—অসীম, নাসিমা, রেবা, মিজানুর, শতদলেরা হই হই করে বেরিয়ে আসে। সমস্বরে তারা চিৎকার করে ওঠে—“এ আইন তোমার নিজের গড়া, এ আইন আমরা মানি না।”
মেয়েটা এক-পা দু-পা পিছোতে পিছোতে অসীমদের সঙ্গে মিশে যায়। জীবনে সে এই প্রথম আঙুল তুলে চিৎকার করে কথা বলে—“রাজা তুমি ধ্বংস হবে। রানি হয়ে আমি অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ দেখব, আর মণিমাণিক্যে কাঁচুলি বাঁধব, এ তুমি ভাবলে কী করে? আমার আশ্রম, বালিখালি নদী, গাছ, পাখি, এদের সবাইকে ছেড়ে আমি তোমার প্রাসাদে গিয়ে থাকব ভাবলে কী করে?
অসীম আর নাসিমা শক্ত করে একে-অপরের হাত ধরে চিৎকার করে ওঠে—“রাজা তুমি নিপাত যাবে, অত্যাচারী রাজা ধ্বংস হবে।”
রাজা এইসমস্ত কাণ্ডকারখানা দেখে কোনোরকমে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে হাতির পিঠে ওঠেন। মুকুটখানা নিজের মাথায় চেপেচুপে রাখতে রাখতে তুত্লে ওঠেন—“দে-দেখে নেব, সবকটাকে শূলে চড়াব।”
রাজার এই করুণ অবস্থা দেখে শকুনের খুব কষ্ট হয়। সে একটা নদীতে ভেসে আসা মরা গোরুর পেটে বসে নাড়িভুড়ি খাচ্ছিল। মরা গোরুর চোখ তার প্রিয় খাদ্য, কিন্তু এমন লোভনীয় খাবারও তার কাছে বিস্বাদ ঠেকছে এখন। শত হলেও রাজার বন্ধু সে। খুব মনখারাপ হয়ে যায় তার।
১০
এদিকে দেখতে দেখতে মেয়েটার বিয়ের দিন উপস্থিত হয়। গ্রামের বারোয়ারি মন্দিরে সামিয়ানা খাটিয়ে বিয়ের সামান্য আয়োজন করা হয়েছে। বিয়ের দিন সকালবেলাতেও নাসিমা তাকে বলেছে—“এই মেয়েটা, বিয়েটা না-করলেই পারতিস।”
মেয়েটা মুখ নীচু করে চুপ করে থাকে, তারপর বড়ো বড়ো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার দু-চোখ বেয়ে।
সব মিলিয়ে পিউকাঁহার মনে বেশ আনন্দ। যাক, তবু শ্বশুর ঘরে গিয়ে মেয়েটা নিশ্চয়ই সুখে থাকবে।
লাল চেলি আর ফুলের গয়নায় মেয়েটাকে স্বর্গের দেবীর মতো দেখায়। যে চাষি তাকে বিয়ে করতে এসেছিল, বিয়ের মন্ত্র ভুলে নববধূর দিকে সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
চাষিবউ কেঁদে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শত হলেও সে মা, কাঁদতে কাঁদতে বলে—“তোর ভালোর জন্যই বিয়েটা দিলাম।”
শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় মেয়েটা নাসিমার হাত ধরে বলে—“নাসিমাদিদি, পণ্ডিতমশাইয়ের সমাধিটা মাঝেমাঝে ঝাড়পোঁছ কোরো, আর রোজ সন্ধ্যাবাতি দিও।”
মেয়েটা কোনোদিন সংসারে বড়ো হয়নি, শ্বশুরবাড়িতে এত লোকের মাঝে তার দম আটকে আসে। আবার ভালোও লাগে। জোয়ান, তাগড়া মরদ স্বামীকে নিয়ে একটু একটু গর্বও হয়। কিন্তু যখনই নদী, মাঠ, আশ্রম, ফুল-পাখিদের কথা মনে পড়ে যায় তখনই বুকের ভিতরটা হু-হু করে ওঠে। তবু মনে হয় রাজপ্রাসাদে রানি হয়ে বন্দি জীবনযাপনের থেকে তো অনেক ভালো। শ্বশুরঘরে স্বামীর সঙ্গে প্রথম রাতে বাড়ির সব বাতিগুলো যখন নিভে যায়, জামরুল গাছের কোটরে হরিতাল আর হরিতালি পাখি-দুটি নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই নতুন বর চাষি তিন টোকা হাঁড়িয়া খেয়ে ঘরে ঢোকে। মেয়েটা জন্মেও এমন ঘটনা দেখেনি। সে লজ্জা ভুলে চাষির মুখের দিকে সরাসরি তাকায়।
চাষি লাল মাড়ি বার করে হেসে বলে—“বউ তোকে এত সুন্দর দেখতে, তাই আনন্দে আমি হাঁড়িয়া খেয়ে এলাম।”
মেয়েটার কপালে ভাঁজ পড়ে। তবু সে মেনে নেয়।
চাষি খাটিয়ার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে—“তোর কাছে একটা মুক্তো আছে না?”
মেয়েটার চোখের সামনে সমস্ত স্বপ্নগুলো শীতের তুষারের মতো ঝুরো ঝুরো হয়ে ঝরে পড়ে। তার মাথার ভিতর সব বোধগুলো কেমন যেন গুলিয়ে যায়। সে কোনোরকমে ঠোঁট নাড়িয়ে উত্তর করে—“তুমিও!”
নতুন স্বামী ডিবায় রাখা পান থেকে একটা সাজিপান গালে দেয়। তারপর কচরমচর চিবিয়ে উত্তর করে—“আমিও মানে! তোর মা এসে কেঁদেকেটে পড়ল, আমার মেয়েটাকে উদ্ধার করো। বিয়েতে কিছুই তো দেয়নি। কতগুলো ঝুটো গয়না পরিয়ে বিয়ে দিল, বলে কিনা তোর কাছে একটি দামি মুক্তো আছে—সেটা আমায় দিবি।”
মেয়েটা দাঁতে দাঁত চেপে সটান উঠে দাঁড়ায়।
—কক্ষনো না, এ মুক্তো আমি কাউকে দেব না। যোগ্য মানুষ ছাড়া কাউকে দেব না।
নতুন বর আর সহ্য করতে পারে না। একে সে নেশাগ্রস্ত, তার উপর রেগে আগুন। রাগ সহ্য করতে না-পেরে ডিবেটাই সজোরে ছুড়ে মারে মেয়েটার দিকে।
মেয়েটার কপাল ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়ায়। লাল চেলি আরও লাল হয়। কিন্তু এই প্রথম তার চোখে জল আসে না। শেষ চৈত্রের খরখরে আগুনের ফুটিফাটা জমির মতো জ্বলতে থাকে তার চোখ দুটো।
ঘরের আগল খুলে ঝিনুকটা বুকে চেপে সে কোনোরকমে ছুটতে থাকে। ছুট—ছুট—এক্কেবারে বালিখালি নদীর কিনারে এসে কোনোরকমে থেমে গিয়ে হাঁপাতে থাকে। শরীরে ঝুটো প্রসাধনের সাজ এক এক করে খুলে ফেলল সে। বুকের ভিতরটা দপদপ করছে। সমস্ত শরীর-মন ঘিরে অসহ্য যন্ত্রণা। মনে হয় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সমস্ত যন্ত্রণাজ্বালার নিরসন করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, ঝিনুকের তাহলে কী হবে? কোনো যোগ্য মানুষের হাতে এই মুক্তো তুলে না দিয়ে এ জীবনে তার মুক্তি নেই।
দু-হাত শূন্যে তুলে চিৎকার করে মেয়েটা—“তুই বলে দে ঝিনুক, তোর শরীরের মুক্তো আমি কার হাতে তুলে দেব?”
রাতের অন্ধকারের বুক চিরে চিরে দূর, অনেক দূরে ছড়িয়ে যায় এ কান্না।
—তুই বলে দে ঝিনুক, এ যন্ত্রণা আমি কার হাতে দেব?
এমন বিলাপে পশুপাখি, গাছগাছালির ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙে না শুধু মানুষের। জলের ভিতর যে মাছগুলো সারাদিন খেলা করে, অন্ধকারের কালো জলের গভীরে একটুখানি স্থির হয়েছিল, তারা ঝটপটানি শুরু করে। শ্যাওড়াগাছের মাথায় সাদা মণি বার করে যে শকুনটা ঝিমোচ্ছিল, সে পা হড়কে খানিকটা পড়তে পড়তে উড়তে শুরু করে। মেয়েটার কপালে রক্ত দেখে আনন্দে তার মনটা নেচে ওঠে। পিউকাঁহা অন্ধকারে দিক ভুল করতে করতে মেয়েটার কাছে আসবার জন্য আর্তনাদ করে ওঠে—পিউ – কাঁ - হা।
এদিকে নতুন বর চাষি তো মেয়েটার পালিয়ে যাওয়ায় একটু ভড়কে যায়। বাড়ির অন্যসব লোকেরা তাকে বকাবকি করে - আরে নতুন বউয়ের সঙ্গে প্রথম রাত! প্রথম রাতেই কেউ মুক্তোর জন্য চাপাচাপি করে! ও তো এ বাড়ির বউ। পরে ঠিক বার করে নেওয়া যেত। এখন বোঝো কাণ্ড! বউও গেল মুক্তোও গেল। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট হল। ও মেয়ে যা ঠ্যাঁটা, কোথায় গিয়ে সেঁধিয়েছে কে জানে।
নতুন বর চাষির এক গোঁ—তার ওই বউও লাগবে না, মুক্তোও লাগবে না। সে আর তাকে ঘরেই নেবে না। অমন অপয়া বউ তার লাগবে না।
সকলে মিলে তাকে অনেক বোঝায়। কিন্তু নতুন বর চাষি কিছুতেই মানে না। প্রথম রাতে যে বউ পালায়, সে বউকে কিছুতেই ঘরে নেবে না সে।
অবশেষে বাড়ির সকলে অনেক ভাবনাচিন্তা করে একটা পথ বার করে। পথটা হল এরকম, গ্রামের সকলকে বোঝাতে হবে মেয়েটার মাথা খারাপ। ও আসলে পাগল। চাষিবউ তার পাগলি মেয়েকে গছিয়ে দিতে চেয়েছিল।
এমন একটা যুক্তিকে খাড়া করতে পেরে, চাষির পরিবারের সকলের কী আনন্দ। সত্যিই তো, কানা-খোঁড়ার সঙ্গে সংসার করা যায়, কিন্তু পাগলের সঙ্গে ঘর বাঁধা অসম্ভব। পাগল বউয়ের জন্য চাষির সমবেদনায় আত্মীয়স্বজনরা বিলাপ করে। নতুন কনে দেখার প্রস্তুতি শুরু করে দেয় তারা।
পিউকাঁহার ছানিপড়া চোখে জলের বাঁধ ভাঙে। এ কী সর্বনাশ হল মেয়েটার! এও ছিল কপালে! নাসিমা আর অসীম এসে মেয়েটাকে কোনোরকম সান্ত্বনা দেয় না। তারা বলে—“জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা”। তারা সমস্বরে বলে ওঠে—
“সূর্যের রং ফিকে হয়েছে
আগুন গিয়েছে চুরি,
সর্ষের খেতে ধূমকেতু নামে,
অট্টহাসিতে গোলাগুলি নাচে।
কমরেড তুমি জাগো—
এপাশে ইগল, ওপাশে হায়না
মাঝখানে সোঁতা নদী
মারণফাঁদ পাতা আছে বন্ধু
রাজার রাজ্যে খুন।
ল্যান্ডমাইনে ফুলশয্যা
সেখানেই তুমি চলো
তোমার জন্য তুই আছে যখন
আপনির কী দরকার?
কমরেড তুমি জাগো—
শিখরকান্তি হিমগিরি ছুঁয়ে, সমুদ্রে চলো নামি।
বোকা মেয়েটা ভেলভেলেটা
নও তুমি আর সোনা।
জলের আয়নায় শরীর দ্যাখো তুমি।
ও ভারী বুকের বাহার।
সূর্যের রং ফিকে হয়েছে
আগুন গিয়েছে চুরি।
কমরেড তুমি জাগো—
কমরেড তুই জেগে ওঠ সোনা।”
১১
নিজের লাল চেলি আর ঝুটো গয়নাগুলো একটা পুঁটুলিতে বেঁধে কী যেন ভেবেও নদীতে ফেলে দিতে পারে না মেয়েটা, পুরোনো তোরঙ্গের ভিতর তালা বন্ধ করে রেখে দেয়। তখন বসন্তকাল। কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, রাধাচূড়ার আলোর ছটায় মানুষ দিশেহারা। রঙের উৎসবে মানুষের মনে মনে নতুন হিল্লোল জাগে। শুধু শান্তি নেই রাজপ্রাসাদের রাজার মনে। সারা রাজ্যে অস্থির অস্থির অবস্থা।
বসন্ত কেটে যাওয়ার পর চাপা গুমোট, আগুনঝরা দিন। রাজার রাগ, অসহিষ্ণুতা পলাশ-শিমুল ফলের মতো ফেটে ফেটে তুলো হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজা একে ধরেন, ওকে মারেন। অসহ্য দাবদাহে চারিদিক-ফুটিফাটা ধরণির বুকের ভিতর থেকে বিষধর সব খড়িশের উঁকিঝুঁকি দেখা যায়।
পণ্ডিতমশাইয়ের আশ্রম ঘরে দফায় দফায় মিটিং চলছে। অবশেষে মিটিঙে সিদ্ধান্ত হয়—রাজার এই জুলুমবাজি কিছুতেই মেনে নেওয়া যাবে না। অতএব বিদ্রোহ।
আবার অসহ্য গরমে নদনদী খালবিলের জল শুকিয়ে যেতে থাকে। পিউকাঁহার মারাত্মক অসুখ। তার দিন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
অনেকদিন সংসার করার পর সেই কাঠুরিয়ারও চাষিবউকে আর ভালো লাগে না। বউয়ের ঘ্যানর-ঘ্যানর প্যানর-প্যানর বড়ো একঘেয়ে মনে হয়।
জলের আকাল শুরু হতেই নাসিমা-অসীমরা সিদ্ধান্ত নেয়, আগেরবারের মতো আর করা যাবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা তাদের ঢের শিক্ষা দিয়েছে। তাই তারা ঠিক করল রানির ওই শখের অ্যাকোয়ারিয়ামের ঢঙি মাছেদের জলের জোগান প্রথম বন্ধ করতে হবে। কিন্তু প্রাসাদের অন্দরমহলে ঢুকতে গেলে তো একটা যোগাযোগ দরকার। সেটা কীভাবে সম্ভব?
মেয়েটা তখন উঠে দাঁড়ায়। বলে—“আমি করব এই যোগাযোগ। আমার সেই খোঁড়া দাসী মা আছে। তার কাছে যাব। রাজা শুধু আমাদের নয়, ওর জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছে, সে নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবে।”
আনন্দের সঙ্গে চিৎকার করে অসীম গান গেয়ে ওঠে।
নাসিমা হেসে মেয়েটার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলে—“তুই তো আর আমাদের বোকা মেয়েটা নেই দেখছি! দেখিস, এইবার একজন সুন্দর, সুঠাম, সু-মনের সওদাগরের দেখা তুই পাবিই পাবি।”
মেয়েটা লজ্জায় মুখ রাঙা করে বলে—“যাঃ!”
চুপিচুপি মেয়েটা একদিন বড়ো একটা তরমুজ নিয়ে দাসমহলে উপস্থিত হয়। দাসমহলে ঢোকা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। সেখানে সব নীচু শ্রেণির মানুষেরা থাকে। তাদের জীবন এমন কিছু মূল্যবান নয় যে আঁটোসাঁটো অবস্থার মধ্যে নিজেদের আটকে রাখবে। এতে অবশ্য তাদের একরকম ভালোই হয়েছে। অন্তত স্বাধীনতাটুকু বিসর্জন দিতে হয় না। তবে আক্ষরিক অর্থেই এখানে জল, আলো, বাতাস এত কম যে কেউ চোখে কম দ্যাখে, কেউ কানে কম শোনে, কারও-বা শ্বাসকষ্ট, কেউ-বা অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগে। রাজপ্রাসাদের বাদ দেওয়া অথবা বিদেশ থেকে আনা বিষ সারের অধিক ফলানো ফসল খেয়ে কেউ খোঁড়া, কেউ রাতকানা রোগে ভোগে, কারো সন্তান গর্ভেই মারা যায়। এখানকার মানুষজনের সঙ্গে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা রাতদিন অশ্লীল গানবাজনা, খিস্তিখেউড় নিয়ে মেতে থাকে। খুনজখমও যে দু-একটা হয় না তা নয়। তবে ওটা বিশেষ কিছু না। নীচুতলের মানুষের জীবনের কী এমন দাম! আর, রাজ্যে খুনখারাপি, চুরিডাকাতি না থাকলে রাজার আর কী মূল্য থাকল!
একটু খোঁজাখুঁজির পর আস্তাবলের পিছনে দাসীবউকে খুঁজে পাওয়া গেল। তার দুর্দশার অন্ত নেই। রাজা তাকে এখন নিজের কাজ ছাড়াও আস্তাবলের কাজে লাগিয়েছেন। সে ভালো করে চলতে পারে না। ঘোড়ার লাথি খেয়ে খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সারা চোখমুখ ছড়ে-ছেঁচে একাকার হয়ে গেছে। এমন দৃশ্যে মেয়েটার চোখে জল আসে। মেয়েটা ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে— “মা।”
দাসীবউ পিছন ফিরে মেয়েটাকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তাকে ঘরে এনে বসায়। পাকা পেঁপে কেটে খেতে দেয়। তারপর বলে—“বড়ো কষ্ট রে এখানে। রাজা এখন মেপে জল দেন সকলকে। তার উপর আমার ঘরে পুরুষমানুষ না থাকায়, কাজ হয় কম, তাই আমার বরাদ্দ আরও কম। তেষ্টায় বুক গলা শুকিয়ে যায় আমার।”
মেয়েটা দাঁতে দাঁত ঘষে সান্ত্বনা দেয়—“তুমি দুঃখ কোরো না মা, রাজার দিন শেষ। তোমাকে আমি নতুন পথ দেখাব।”
দাসীবউ শান্ত হয়। গুটিবসন্তে ভরা ছোপ ছোপ মুখটাতে অনেকদিন পরে খুশির ঝিলিক দেখা যায়। অনেকদিনের ক্লান্তিতে জমে থাকা স্বেদবিন্দুগুলো গলতে থাকে। করুণার মূর্তি হয়ে দাসী বলে—“তাই যেন হয় মা, তাই যেন হয়।”
মেয়েটা গোপনে তাকে কাজ বুঝিয়ে দেয়। দাসী একদিকে যেমন রোমাঞ্চিত হয়, অন্যদিকে আবার ভয়ে তার সারা শরীরে শিহরন খেলে যায়। এমন একটা কর্মকাণ্ডে নিজেকে সে জড়াতে পারবে, তা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি। উত্তেজনায় সমস্ত শরীর তার থিরথির করে কেঁপে ওঠে। তবু সে কোনোরকমে বলে—“আমি পারব। দেখে নিও, নিশ্চয় পারব।”
দাসী এরপর মেয়েটাকে সাথে করে প্রাসাদের সীমানা ছাড়িয়ে নদীর কিনারা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায়। বিদায়ের সময় দু’জনেই চোখের জল গোপন রাখতে পারে না। একে-অপরকে বিদায় জানিয়ে উল্টো-বাগে হাঁটতে শুরু করে।
সূর্য তখন নদীর ওপারে পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়েছে। তার সমস্ত শরীর বেয়ে লাল আবিরের গোলা নামছে। এমন একটা মর্মন্তুদ সময়ে যখন দিনমণি অস্তাচলগামী, পিউকাঁহার ছাতি ফেটে যায় তেষ্টায়। সে জনারের খেতের আলের জল খেতে যায়। কিন্তু বিষ সারে ভরপুর জল খেয়ে ওই আলের ধারেই মুখ থুবড়ে পড়ে মৃত্যু হয় পিউকাঁহার।
পিউকাঁহার মৃত্যুর খবরে মেয়েটার ভিতরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সে কিছুতেই মানতে পারে না। চিৎকার করে ওঠে সে—“রাজা, তোমায় আমি ছাড়ব না। তোমার লোভ—আমার সুহৃদ, আমার বন্ধু, আমার পিউকাঁহার মৃত্যুর কারণ। তোমার ধ্বংস হবেই।”
চাষিবউ কাঠুরিয়ার কাছে পুরানো হয়ে গেছে। অনেকদিন ঘরসংসার করার ফলে কাঠুরিয়া আর তার মধ্যে নতুন কিছু খুঁজে পায় না। সবই যেন অনেক দিনের অভ্যাসের ফল। আর অভ্যাস হল এমন জিনিস, যেখানে নতুনত্ব কিছু থাকে না।
১২
কিছুদিন পর রাজপ্রাসাদে হুলুস্থুলু কাণ্ড। রানির অ্যাকোয়ারিয়ামের সব লাল-নীল মাছেরা মরে গিয়ে ভেসে উঠেছে। এমন সাহস কার হল যে, রানির অ্যাকোয়ারিয়ামে বিষ দেয়! মন্ত্রী-সান্ত্রী, মায় রাজার চোখের ঘুম উঠে গেছে। রানি তো কেঁদেকেটে অস্থির। নাওয়া-খাওয়া, রূপচর্চা ভুলে সে এক ঘোরতর অবস্থা। পোড়াকাঠের মতো চেহারা হচ্ছে তাঁর। বিভিন্ন দেশ-বিদেশ থেকে আনা মাছ! কতরকম নাম তাদের! কী সুন্দর দেখতে!
রাজার বন্ধু শকুন এসে রাজাকে বোঝায়—“রাজা, তোমার সামনে ঘোর দুর্দিন।”
রাজা কপালে ভাঁজ ফেলেন, তাঁর বোধগম্যই হয় না, অতটুকু একটা পুচকি মেয়ে—তার এত সাহস হয় কোথা থেকে! রাজা রাজ্যের প্রজাদের কথা ভুলে নিজের নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
মেয়েটার আর কিছুই ভালো লাগে না। সে শুধু সারাদিন ভাবে, কবে পাবে যোগ্য মানুষ, মুক্তোটা যার হাতে তুলে দিতে পারবে। কখনো-কখনো মনে হয়, নাসিমা বা অসীমের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু ওদের কিছু কিছু কথা, কিছু কিছু কাজ তার সঠিক বলে মনে হয় না। এই যেমন মাছগুলোকে মেরে ফেলা। কী হবে অত সুন্দর কতকগুলো নিরীহ মাছ মেরে ফেলে? রাজার অনেক অর্থ আছে, তিনি আবার অ্যাকোয়ারিয়াম বানাবেন, মাছ আনাবেন, আবার যে কার সেই হবে। তার থেকে যদি গ্রামের মানুষকে বুঝিয়ে রাজার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি করা যেত, বেশি ভালো হত বই-কি। কিন্তু তার সাহসে কুলোয় না। কারণ নাসিমা-অসীমরা তার পাশে না থাকলে সে এতদিন শ্মশানের ছাই হয়ে যেত। নাসিমা-অসীমরা তো তাকে সাহস করে স্বপ্নটা দেখতে শিখিয়েছে।
রাজার বিরুদ্ধে নাসিমা-অসীমদের বৈঠকের শেষ নেই। মেয়েটা শুধু বুকের ভিতর ঝিনুককে নিয়ে অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করতে করতে শুকতারা থেকে সন্ধ্যাতারা দেখা যায়, তবু কেউ আসে না। দিন যায়, দিন যায়। ঋতু বদলে ঋতু আসে। চৈত্রের শেষ আকাশে একটু একটু করে খোলা তরোয়াল হাতে নিয়ে সেই কালপুরুষের মূর্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মেয়েটা সেদিকে চেয়ে চেয়ে ভাবে, আমার কালপুরুষ—আমার স্বপ্নে দেখা সওদাগর—আমার সেই যোগ্য মানুষ—কবে আসবে তুমি? কত দিন, আর কত দেরি সেই দিনটা আসতে?
এইসব ভাবতে ভাবতে মেয়েটা ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে ওঠে। এইরকম একটা সময়ে পয়লা বৈশাখের সাত দিন পরে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠলে, রাতের জ্যোৎস্না-ভেজা আকাশের নীচে বালিখালি নদীর তীরে মেয়েটা হাঁটু গেড়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে জলের দিকে চেয়ে ভাবছিল—তার জীবনটা কেন এমন হয়ে গেল।
তখনই পাহাড়ের বুক চিরে একটা শব্দ নেমে আসে। যেন কোনো অলৌকিক স্বপ্নের শব্দ। প্রথমটা গুম-গুম-গুম, তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় ঘোড়ার খুরের শব্দ। মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়, উত্তেজনায় ঘামে বুকের মাঝে ঝিনুক ভিজে যায়। ক্রমশ শব্দটা যেন ফেনা তুলে বাতাস কেটে কেটে তার দিকেই এগিয়ে আসে। মেয়েটা ভয় পেয়ে একটু কেঁপেও ওঠে। ছায়ামূর্তি ক্রমশ স্পষ্ট হয়। দূর থেকে মেয়েটা দ্যাখে, যেন কোনো বিয়চ্চারী দেবদূত, নির্ঝরিণী পার হয়ে নেমে এসেছে। আকাশ-গঙ্গা থেকে সৌম্যকান্তি, ধীশক্তি, কান্তিময়ের দু-চোখ আঁকা তন্দ্রালু স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা মোহাবিষ্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বালিখালির জল তার পায়ের পাতা ভিজিয়ে আঁচল ছুঁয়ে যায়। মেয়েটার ঠোঁট কাঁপে, বুক ও নাসারন্ধ্র স্ফীত হয়। অনেকদিন আগে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে যায়। পরিরাও ঠিক কুসুম কাননে এমনই অপেক্ষা করছিল ঝিনুক হাতে।
যুবক ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে লাগাম হাতে মেয়েটার কাছে এসে বলে—“এই মেয়েটা তোমার নাম কী?”
মেয়েটা উত্তর করে—“আমার নাম নেই।”
—কেন! তোমার নাম নেই কেন?
মেয়েটা আস্তে আস্তে বলে—“আমারও যে একটা নাম থাকতে পারে এর প্রয়োজনীয়তা কেউ বোধ করেনি।”
যুবক চোখ বুজে একটু ভেবে নামকরণ করে—“আজ থেকে তোমার নাম ঝিনুকফুল।”
ঝিনুকের কথা শুনে মেয়েটা চমকে ওঠে।
—তুমি জানলে কী করে, আমার কাছে একটা ঝিনুক আছে? কী করে জানলে আমার কাছের সেই আশ্চর্য মুক্তোর কথা?
সওদাগর যুবক মেয়েটার একেবারে সামনাসামনি দাঁড়ায়। হাসিমুখে সে বলে—“আমি সব জানি। নাসিমা-অসীমদের কথা জানি, জানি তোমাদের স্বপ্নের কথা। আমাকে না জানলে হবে কেমন করে!”
যুবক আরও ঘন হয়ে এসে বলে—“দেবে আমায় ঝিনুকফুল, তোমার সেই অসামান্য মুক্তোটা? ওটা যে আমার খুব প্রয়োজন।”
মেয়েটা সন্দিগ্ধ মনে জিজ্ঞাসা করে—“তুমি কে?”
—আমি একজন সওদাগর। বাণিজ্যতে যাচ্ছি। এমন সময় তোমার মুক্তোটা পেলে খুব ভালো হত।
জীবনে এই প্রথম মেয়েটা অন্যের কাছে কিছু দাবি জানায়।
—কিন্তু সওদাগর, বিনিময়ে তুমি আমাকে কী দেবে?
সঙ্গে সঙ্গে সওদাগর যুবক উত্তর করে—“কেন, আমার ভালোবাসাটা!”
মেয়েটা কেমন যেন অবাক হয়ে যায়। হাঁসেরা হঠাৎ পাখনা ঝেড়ে জল ছিটিয়ে দেয় মেয়েটার গায়ে। মেয়েটা মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করে—“ভা-লো-বা-সা!”
—হ্যাঁ।
—কতটা দেবে?
—পুরোটাই, যতটা তুমি নিতে পারো।
মেয়েটা বুকের ভিতর হাত রাখে। একটু সংকোচের সঙ্গে বার করে আনে সেই অত্যুজ্জ্বল, অসাধারণ মুক্তোসমেত ঝিনুক। সওদাগরের হাতে তুলে দিতে দিতে বলে—“এই নাও কমরেড।”
দু-জোড়া চোখের নীলে এক রোমাঞ্চকর ঝিলিক খেলে যায় মেয়েটার। দু-চোখের আল টপকে নেমে আসে দু-ফোঁটা জল।
সওদাগর খুব কাছে এসে মেয়েটির চিবুক তুলে নিজের দিকে ফেরায়।
—তুমি আমার জন্য অপেক্ষা কোরো কমরেড!
মেয়েটার চোখ বুজে আসে। এত ভালোলাগা, এমন বিশ্বাস, এমন মুগ্ধতার বোধ তার আগে কখনও হয়নি। আবেগে তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। মেয়েটির হাত থেকে ঝিনুকটি নিয়ে সওদাগর মেয়েটির বন্ধ চোখের পাতায় নিটোল দুটো চুমু খায়। তারপর ঘোড়ার পিঠে উঠে লাগামে টান দেয়।
১৩
ভোরের শুকতারাকে সাক্ষী রেখে হ্রেষাধ্বনিতে চাপা পড়ে যায় মেয়েটির ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না। বালিখালির তীরের বালি উড়িয়ে যুবক হাত-তিরিশেক যাওয়ার পর মেয়েটা ছুটতে থাকে। আকুল চিৎকারে সে ডাক দেয়।
—সওদাগর, সওদাগর! একটিবার থামো!
ঘোড়া দাঁড়িয়ে যায়। সওদাগর যুবকের চোখে জিজ্ঞাসা।
মেয়েটি হাঁপিয়ে উঠেছে। নিজের বুকের ধুকপুকানি যেন নিজেই শুনতে পায় সে। তবু কোনোরকমে বলে—“তুমি কী বাণিজ্য করতে যাচ্ছ সওদাগর?”
স্মিত হাসে সওদাগর। লুটিয়ে পড়া অলকগুলি মেয়েটার চবুতরা থেকে সরিয়ে দিতে দিতে দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেয়—“সমাজতন্ত্র।”
মেয়েটা স্থির চোখে তাকায়। দীর্ঘ—বড়ো দীর্ঘ এই সময়...
মেয়েটা ফিশফিশ করে বলে—“পারবে!”
সওদাগর মেয়েটার চোখে চোখ রেখেই উত্তর দেয়—“খুব পারব।”
—সত্যিই পারবে?
সওদাগর দৃপ্ত কণ্ঠে বলে—“কেন পারব না? তোমার সেই আশ্চর্য মুক্তোটা আছে না আমার কাছে! এখন আমি সব পারব।”
মেয়েটা সওদাগরের হাতে হাত রাখে।
—যদি সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ে?
আকাশের দিকে তাকিয়ে সওদাগর মেয়েটির কাঁধ ছুঁয়ে জবাব দেয়—“তখন নতুন করে ভাবব। সমাজতন্ত্রের উন্নত কোনো রূপ। বন্ধু, এ ছাড়া আর তো কোনো পথও খোলা নেই আমাদের সামনে। তবু আমরা তখন নাসিমা আর অসীমের বিয়েটা তো দিতে পারব।”
মেয়েটা ঘাড় নেড়ে সায় দেয়—“হক্ কথা।”
মেয়েটা ইতস্তত করে বলে—“তবে তুমি তোমার জিনিসটা ফেরত নাও।”
সওদাগর একবার পূর্ব আকাশে দৃষ্টি মেলে তাকায় মেয়েটার দিকে। আবেগ ভরে জানতে চায়—“কী ঝিনুকফুল?”
—তোমার ভালোবাসাটা। বাণিজ্য সম্পূর্ণ হলে তখন তো এদেশের চেহারাটাই বদলে যাবে। রাজার গদি ওলটাবে। অসীম-নাসিমার ভালোবাসা স্বীকৃতি পাবে। আমার মা আমাকে কোলে বসিয়ে পিঠে খাওয়াবে। বাবাকে বাধ্য হয়ে খোঁড়া দাসীকে বিয়ে করতে হবে না। নির্দোষ দাসীবউয়ের জীবনটাও নষ্ট হবে না। পিউকাঁহার মৃত্যু হবে না। আর আমার স্বামী, মুক্তোর লোভ ছেড়ে সে শুধু আমাকে চাইবে। আর তুমি, তুমি বন্ধু—তুমি তো আমার জীবনে আর-একটি দুর্লভ মুক্তো। আমি অপেক্ষায় থাকব। যাও বন্ধু, বাণিজ্যে যাও। নিয়ে এস সেই অমোঘ সমাজতন্ত্র। বিদায় কমরেড। আমি সত্যিসত্যিই তোমার পথ চেয়ে থাকব।
ঝুঁকে পড়ে অভিবাদন জানায় সওদাগর। মেয়েটার গোলাপের মতো গাল দুটো ছুঁয়ে দিয়ে বলে—“সত্যিই তুমি বোকা মেয়েটা, ভেলভেলেটা।”
বিশাল ইচ্ছে-পূরণ হল তো শেষমেশ ! গল্প বলায় একটা সারল্য আছে যেটা টানে। কিন্তু প্রাসাদে উকুন ভর্তি মাথার দাসীকে থাকতে দেওয়া হবে কেন? আর যৌবনবতী কিশোরী কেমন করে হবে। হয় সে যুবতী নয় তো কিশোরী।
সেশমেস সওদাগর অত্থাৎ কিনা ক্যাপিটালিষ্টের হাতে থাকবে সমাজতন্ত্রের চাবিকাঠি! ভয়ঙ্কর (অপ)রূপকথা!!
মেয়েটা, গরীব চাষী, চাষী বউ, অত্যাচারী রাজা, রাজার বন্ধু শকুন, অসীম, নাসিমা - সবাই বর্তমান যুগে বাস্তব | অবাস্তব শুধু কিন্তু স্বপ্নের সওদাগর আর স্বপ্নের সেই সমাজতন্ত্রটাই