লাল রঙের বড় বাড়িটার সামনে দিয়ে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার হেঁটে গেছে রাজিয়া। কখনো একা। কখনো ওর দলের সঙ্গে। কিন্তু কখনও ভেতরে ঢোকার সাহস হয় নি।
বাড়িটার সামনে দুদিকে দুটো রোয়াক। তাতে অলস দুপুরে রিকশাওয়ালারা গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে খেতে বিশ্রাম নেয়, অন্য সময়ে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমোয় রাস্তার নেড়িগুলো। দুটো রোয়াকের মাঝখানে একটা সবুজ রঙের কারুকাজ করা কাঠের দরজা। এত বিশাল আর ভারী যে ছোটবেলায় রাজিয়ার ওগুলোকে লোহার তৈরী বলে মনে হত। সেই বিরাট দরজাটা ডান পাশে আটকানো একটা শ্বেতপাথরের নামফলক। তার ওপর কালো দিয়ে প্যাঁচানো হরফে লেখা “সিংহভবন”।
সিংহভবনের দরজা খোলা থাকলে রাস্তা থেকে সোজা দেখা যায় দেবীদালানে শোভা পাচ্ছেন কুলদেবী সিংহবাহিনী। অষ্টভূজা দেবীমূর্তি কাঞ্চনবর্ণা ও রক্তাম্বরা। সর্বাঙ্গে সোনালি অলংকার। হাতে শাণিত অস্ত্র ও অভয়। অলংকার, অস্ত্র, বস্ত্র, সবই এখানে মাটির। সিংহবাহিনী এখানে সম্পূর্ণ মৃণ্ময়ী।
সিংহভবনে দেবীর বিসর্জন হয় না। শোনা যায়, সেই কোন এক কালে এক বিজয়া দশমীর রাত্রে ভাসান দিয়ে ফিরে আসার পর জমিদার রাজেন্দ্রনারায়ণ সিংহরায় স্বপ্নে দেখেছিলেন লাল শাড়ি পরা এক কিশোরী কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বলছে, “বাবা, তোমার এত বড় বাড়িতে সবার জায়গা হয়, শুধু আমারই জায়গা হয় না? শুধু আমাকেই ভাসিয়ে দিতে হয়?” তারপর থেকে সিংহভবনে আর কখনো মূর্তি বিসর্জন হয় নি। নিয়মরক্ষার্থে শুধু ঘট নিরঞ্জন হয়।
আজকে সিংহভবনের ভারী দরজাটা খোলাই ছিল। রাজিয়া রাস্তা থেকে দেখল দেবীর দেহে নতুন রং, মাথার ওপর নতুন চাঁদোয়া। ক’দিন আগেই পুজো গেছে, তারই ছোঁওয়া। সিংহরায় পরিবারে দুর্গাপুজোর ঠাটবাট গেলেও এখনও অন্তত প্রতি পুজোয় এটুকু করা হয়। রাজিয়া দরজার বাইরে থেকে খানিকক্ষণ অপলকে তাকিয়ে রইল সেই মাতৃমূর্তির দিকে। তারপর চোখ বুজে প্রণাম সেরে দ্বিধাগ্রস্ত পা রাখল সিংহভবনের সাদা-কালো খোপকাটা পাথরের দালানে।
ঢোকার সরু প্যাসেজটার দুদিকের দেওয়ালের ওপরদিক দিয়ে গেছে সার সার হরেক রকমের তার, পাইপ। কোনওটা ইলেক্ট্রিকের, কোনওটা বা কেবল কানেকশনের। আর নীচের দিকে সার সার করে লাগানো বিভিন্ন মাপের লেটার বাক্স। বাক্সের অবস্থান দেখে বোঝা যায় কে কোন তরফের। যত বড় তরফ, বাক্স তত উপরের দিকে। আর বাক্সের রঙচঙ, কারুকাজ দেখে বোঝা যায়, কার বর্তমান আর্থিক অবস্থা কেমন। সিংহবাড়িতে লেটারবাক্স পারিবারিক আর অর্থনৈতিক হায়ারার্কির পরিচয় বহন করে।
রাজিয়া দেখল সবথেকে উপরের সারির কোণার দিকে রাজনারায়ণ সিংহরায়ের নাম লেখা ম্রিয়মাণ কালো রঙের লেটার বাক্স। বহুদিন রং পড়ে নি তার গায়ে। ভালো করে চেষ্টা করলে পড়া যায় ওখানে আসলে আছে দুটো নাম। রাজনারায়ণ, আর তাঁর ছেলে রাজেশনারায়ণ। কোনও লেটারবক্সেই কোনও মেয়ে-বউয়ের নাম নেই। ওই যে বললাম, সামাজিক হায়ারার্কি।
****
জড়োসড়ো পায়ে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় ওঠার সময় রাজিয়া বুঝতে পারছিল বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে নানা কৌতুহলী চোখ ওকে জরিপ করছে। অলস নিঝুম দুপুর। অনেকেই বাড়ি নেই। যারা আছে, তাদের মধ্যেও বেশির ভাগ ঘুমোচ্ছে। ভাগ্যিস, নইলে এই কাটাছেঁড়া আরও তীক্ষ্ণ, আরও তীব্র হত।
এটা হবেই, জানা কথা। তাই গত দশ বছরে বেশ কয়েকবার একা বা ওর দলের সঙ্গে এই বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও ভেতরে কখনো পা রাখার কথা ভাবে নি রাজিয়া। তিনতলায় উঠে আসা তো দূরের কথা। ওকে ওর দীক্ষা মা বলেছিল পুর্বাশ্রমের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যেতে হয়। হিজড়া সমাজের এটাই নিয়ম। তাই রাজেশনারায়ণকে মুছে ফেলে ওকে দেওয়া হয়েছিল ওর নতুন নাম। দীক্ষা মা জিজ্ঞেস করেছিল, “কি নাম নিবি রে বেটি?” রাজেশের মনে পড়েছিল ছোটবেলার কথা। ইস্কুলে ইতিহাস পড়ার সময় কেমন কখনো নিজেকে মনে হত লক্ষীবাই, কখনো রাজিয়া সুলতানা। পুরনো নামের সঙ্গে মিলিয়ে তাই নিজের নতুন নাম রেখেছিল রাজিয়া।
পূর্বাশ্রমের কথা এতদিন তো ভুলেই ছিল। তাই এমনকি পুজোর কদিন মনটা হু হু করলেও কখনও এদিকে পা মাড়ায় নি ও। কিন্তু আজ আর কিছু করার নেই। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই সিংহভবনের চৌকাঠ পেরোতে হল রাজিয়াকে। উকিল বলেছে, এনআরসিতে নাম তুলতে হলে বার্থ সার্টিফিকেটটা যেভাবেই হোক নিয়ে যেতে হবে। বাকি কাগজপত্র, অপারেশানের সার্টিফিকেট সব যোগাড় হয়ে গেছে। শুধু এইটাই বাকি।
জীবনও কখনো কখনো কিছু কৌতুক করে। আজ রাজিয়ার নাগরিকত্ব প্রমাণের কাজে লাগবে দশ বছর আগে বিসর্জন হয়ে যাওয়া রাজেশনারায়ণের জন্মনথি। যাকে কেউ মনে রাখে নি। রাজিয়া নিজেও না।
*****
গঙ্গার পাড়। গতকাল দুর্গাপুজোর কার্নিভ্যাল হয়ে গেছে। তাই এদিক ওদিক পড়ে আছে শোলার মুকুট, গাঁদাফুলের মালা। ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা বাচ্চা আর কিছু কুকুর।
রাংতার মুকুটগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাজিয়ার মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। কেমন খাতার পাতা ছিঁড়ে মুকুট বানাত ও। তারপর মায়ের কাজল দিয়ে কপালে আঁকত ত্রিনয়ন। নিজেকে মনে হত মহালয়ার দিন টিভিতে দেখা দুগ্গাঠাকুর।
অক্টোবরের শেষ। তার ওপর কালকে রাত্রে বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা। কমলা ওড়নাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল রাজিয়া। তারপর কাদা থেকে তুলে একটা ছেঁড়া মুকুট মাথায় পড়ল ও। ব্যাগ থেকে ছোট হাত আয়নাটা বের করে নিজেকে দেখল। মুখটা তেলতেলে হয়ে আছে, ধেবড়ে আছে চোখের কাজল। শুধু কপালের টিপটা যেন জ্বলজ্বল করছে।
বাড়িতে ওর জন্মনথি পাওয়া যায় নি। বাবা বাড়ি ছিল না। রাজিয়া সেটা জেনেই দুপুরবেলা গেছিল যাতে বাবার মুখোমুখি পড়তে না হয়। মা বলল, সিংহবাহিনীর কাছে রাজনারায়ণ পুত্রই চেয়েছিলেন, সন্তান নয়। তাই সন্তান যখন পুত্র হওয়ার পরীক্ষায় ব্যর্থ হল, তখন সেই সন্তানের কোনও চিহ্ন বাড়িতে রাখতে চান নি তিনি। তাই একদিন রাজেশের সব কাগজপত্র, ছবি, জামাকাপড় একসাথে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তারপর পুত্রের শ্রাদ্ধশান্তি পিন্ডদান ইত্যাদি করে বাড়ি ফিরেছিলেন রাজনারায়ণ । এখন গোটা সিংহভবনে রাজেশনারায়ণের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। একমাত্র লেটার বাক্সটা ছাড়া।
ছেঁড়া মুকুটটা মাথায় পড়ে গঙ্গার দিকে পা বাড়াল রাজিয়া। ঠান্ডা জলে, কাদায় পা ডুবে গেল খানিকটা। সেইভাবেই খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল রাজিয়া। তারপর আস্তে আস্তে ব্যাগ থেকে বার করল পনেরো হাজার টাকা খরচ করে তৈরী করা এন আর সির যাবতীয় কাগজপত্র। এক মিনিটের দ্বিধা। তারপর কাগজপত্র শুদ্ধু সেই ফাইলটা একটানে গঙ্গায় ছুঁড়ে দিল ও।
পরিবারের কাছে স্বীকৃতি পাওয়ার পরীক্ষায় নিজের জীবনের কুড়িটা বছর একবার নষ্ট করেছে রাজেশ। দেশের কাছে নতুন করে আবার সেই অপমান সহ্য করার শক্তি রাজিয়ার ক্ষতবিক্ষত দেহে আর অবশিষ্ট নেই।