জয়পুর এয়ারপোর্ট থেকে সৌম্য যখন বের হল, তখন ঘড়িতে সন্ধ্যে ছ’টা দেখালেও বাইরে দিব্যি আলো রয়েছে। তার সাথে গরমের হলকা। এয়ারপোর্টের এসি থেকে বের হয়ে বাইরে পা রাখতেই গায়ে যেন ছ্যাঁকা লাগল।
ঝুনঝুনু জয়পুর এয়ারপোর্ট থেকে একশ’ আশি কিলোমিটার। কলকাতা থেকে দুর্গাপুরের মত। গুগলবাবা বলছে গাড়িতে ঘণ্টাতিনেক সময় লাগবে। ঠিকমত গাড়ি চললে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
জয়পুর ছোট এয়ারপোর্ট, তাই ভিড় কম। এয়ারপোর্টের বাইরে একটা কাউন্টার, সেখান থেকে লং ডিসটেন্স যাওয়ার ট্যাক্সি পাওয়া যায়। সেখান থেকেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে তাতে চড়ে বসল সৌম্য আর মানস। রজত কিছুতেই সৌম্যকে একা ছাড়তে রাজি হয়নি। তাই শেষ মুহূর্তে মানসকে বলতে হল সঙ্গে আসার জন্য।
সৌম্যকে একা আসতে না দেওয়ার পেছনে গত কাল রাত্রের ঘটনাটা দায়ী। গত রাতে জীবন লজ থেকে বের হয়ে ট্যাক্সির অপেক্ষা করছিল ওরা। পিন্টুকে দিয়ে ফোন করিয়েছিল সেই ট্যাক্সিওলাকে, যিনি আনন্দকে নিয়ে এয়ারপোর্ট গেছিলেন। রতনলাল সাউ। আদত বাড়ি ঝাড়খন্ডে হলেও কলকাতায় তিরিশ বছর হয়ে গেছে। রতনলাল জানালেন, যে তিনি এখন স্টেশনের কাছে একজন প্যাসেঞ্জারকে ছাড়ছেন। আসতে মিনিট পনেরো-কুড়ি লাগবে। চাইলে তিনি অন্য ড্রাইভার পাঠিয়ে দিতে পারেন। সৌম্য জানাল, যে ওরা ওঁর গাড়িতেই যেতে চায়। অপেক্ষা করতে কোনও সমস্যা নেই।
জীবন লজের বাইরে দাঁড়িয়ে, দিব্যেন্দুকাকুর সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করে, সিগারেট ধরিয়েছিল সৌম্য। ফাঁকা রাস্তা দেখে এক হাতে রজতের ঘাড়ে আঁকিবুঁকি কাটছিল। হঠাৎ একটা গাড়ি প্রচণ্ড জোরে কোথা থেকে এসে হুশ করে বেরিয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে রজত সৌম্যকে ধরে এক ঝটকায় সরে না গেলে একটা বড়সড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত। রজতের মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গিয়েছিল। একটু সামলে নিয়ে বলল, “আমাদের কেউ খুনের চেষ্টা করছে।” সৌম্য মৃদু হেসে বলল, “এগুলো রাতের শহরে বড়লোকের বখাটে ছোঁড়াদের কাজ। রাত বাড়লে সবাই সলমন খান হয়ে যায়।” রজতকে এই বলে প্রবোধ দিলেও সাদা ইনোভার পাশের আঁচড়ের দাগটা সৌম্যর চোখ এড়ায়নি। অর্থাৎ কেউ এখন আর শুধু ওদের ওপর নজর রেখে ক্ষান্ত দিচ্ছে না, সরাসরি খুন বা আহত করার চেষ্টা করছে।
সৌম্য বোঝালেও রজত যে আশ্বস্ত হয়নি, সেটা বোঝা গেল, যখন ও সৌম্যকে একা রাজস্থান যেতে দেবে না বলে গোঁ ধরে বসল। অগত্যা অগতির গতি মানস। তবে মানসকে বলতেই ও এক কথায় রাজি। এমনিতেই ছেলেটা খুব ঘুরতে ভালবাসে। তার ওপর সৌম্যর ওপর ওর একটু হাল্কা ব্যথা আছে। ফলে ওকে রাজি করাতে বেগ পেতে হয়নি।
ঝুনঝুনু গিয়ে ঠিক কী করবে, তা এখনও সৌম্য জানে না। তবে দিব্যেন্দুকাকু কনফার্ম করেছে, যে আনন্দ মিশ্র তুহিনের খুনের এক দিন আগে দিল্লি থেকে কলকাতা এসেছিল। আর তুহিনের খুনের দিন দুপুরের ফ্লাইট ধরে কলকাতা থেকে জয়পুর গেছে। শুধু তাই নয়, ওই টিকিটটা কাটা হয়েছিল সেই দিনই সকালে, অর্থাৎ তুহিনের মৃতদেহ পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। জীবন হোটেলের ট্যাক্সি ড্রাইভার রতনলাল সাউও আনন্দ মিশ্রর ছবি দেখে কন্ফার্ম করেছেন, যে তিনি ওই দিন সকালে ওই ছেলেটিকেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, কেননা ছেলেটি এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে কাঁদছিল।
এর বাইরে দিব্যেন্দুকাকু আরো জানালেন, যে তুহিনের ফোন থেকে খুনের আগের দিন বিকেলে যে নম্বরে কল গেছিল, সেটি দিল্লির নম্বর। কিন্তু সিমকার্ডের মালিককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সিম কার্ড নেওয়ার সময় ভুয়ো পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল। খুনের দিন সকালের পর থেকে সেই সিমকার্ড আর চালু করা হয়নি। অতএব ফোনের সূত্র ধরে আগে এগোনোর রাস্তা আপাতত বন্ধ। তবে ঝুনঝুনুর এবং জয়পুরের পুলিশ স্টেশন, এয়ারপোর্ট, রাস্তা সব জায়গাতেই নজর রাখছে। কোনো খবর পেলে ওঁরা সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা পুলিশকে জানিয়ে দেবেন।
ঝুনঝুনু যাওয়ার পথে ট্যাক্সিতে বসে চোখ বুজল সৌম্য। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবা দরকার। ভেবেছিল ফ্লাইটে বসে জটগুলো ছাড়ানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু সে বৃথা। মানস সারা রাস্তা বকবক করতে করতে এসেছে। তাই এখন চোখ বুজে ঘুমের ভান না করলে ও এখনো কথা বলে যাবে। আসলে কয়েকটা খটকা মন থেকে যাচ্ছে না। এক, আনন্দ মিশ্র যদি খুনের সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে সে অন্য কোথাও না লুকিয়ে নিজের বাড়ি ঝুনঝুনুতেই ফেরত এল কেন? গা ঢাকা দিতে হলে তো কোনো বড় শহরে যাওয়া বেশি সুবিধেজনক হত। দুই, খুন করার জন্য ও যদি তুহিনকে রাইসিন দিয়ে থাকে, তাহলে সেদিন রাত্রেই ও পালাল না কেন? পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করে রইল তাই শুধু নয়, সে রাত্রে আবার পার্টিতে গিয়ে তুহিনের সাথে সবার চোখের সামনে ফ্লার্ট করল কেন? তিন, সেই সন্ধ্যেবেলা আর পরের দিন সকালে কে এসেছিল আনন্দ মিশ্রর কাছে? তাদের মধ্যে কী নিয়েই বা কথা কাটাকাটি হয়েছিল?
কিন্তু সৌম্যর চোখ বুজে থাকার চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হল না। দেখা গেল, ড্রাইভার ভদ্রলোক খুবই মিশুকে মানুষ। নিজের থেকেই নিজের কথা বলতে আরম্ভ করলেন। নাম ব্রিজেন্দর লাল। যেতে যেতেই শোনা হয়ে গেল, যে তাঁর তিনটি মেয়ে। তিনজনকেই তিনি পড়ালিখা শিখিয়ে বড় মানুষ করতে চান। তাঁর জরুও ঝুনঝুনুর প্রাইমারি স্কুলে পড়ান। দু’জনের রোজগারের অর্ধেকটাই যায় মেয়েদের পড়াশুনোয়। মেয়েদের বিয়েশাদির জন্য পয়সা জমাচ্ছে না বলে রিস্তেদাররা ওঁকে বুরবক বলে। কিন্তু ওঁর নিজের পাক্কা বিশ্বাস যে আসলে ওই রিস্তেদাররাই বুরবক।
সৌম্য জানতে চাইল, যে ঝুনঝুনুতে থাকার কোনও ব্যবস্থা আছে কিনা। উনি জানালেন, ঝুনঝুনুর বাইরেই একটা মহল আছে, যেটা এখন হোটেল করে ভাড়া দেয়। এখন অফ সিজন, তাই রুম পেতে অসুবিধে হবে না।
সৌম্য ফোনটা বের করে ব্রিজেন্দরকে আনন্দ মিশ্রর ছবিটা দেখাল। বলল, যে ওর পুরোনো কলেজের বন্ধু। কলেজে থাকতে ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল। এখন মিটমাট করতে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় থাকে সেটা ও জানে না। ব্রিজেন্দর বললেন, “ঝুনঝুনু মে এক লাখ সে উপর আবাদি হ্যায়। কোথায় খুঁজবেন ওকে?”
কোথায় খুঁজবে সেটা সৌম্যও জানে না। কিন্তু মন বলছে, একটা কিছু সূত্র ও এই ঝুনঝুনুতেই পাবে। সৌম্য বলল, “আমি আপনাকে ছবিটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। যদি একটু আশেপাশে যারা গাড়ি চালান, তাঁদের কাছ থেকে কিছু জানা যায়।” ব্রিজেন্দর জানালেন, উনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
মাধোপুরের কাছে গাড়ি থামিয়ে সৌম্যরা চা খেতে আর হাত পা ছাড়াতে নামল। চায়ের দোকানটায় লোকজন কথাবার্তা বলছে আগামী নির্বাচন নিয়ে। ঝুনঝুনুর এবারের ভোট খুব টানটান। একদিকে ক্ষমতাসীন পার্টির সি. কে. পন্থ আর অন্যদিকে বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী রনভিজয় শেখাওয়াত। লোকজনের কথাবার্তা মন দিয়ে শুনছে, এমন সময় ফোনে টুং করে একটা মেসেজ ঢুকল। রজতের মেসেজ। একটা কান্নার ইমোজি আর তার পর লেখা “শাশুড়ি মা এর মধ্যেই ঘরের কী কী সারাই করতে হবে তার লিস্ট আমাকে ধরিয়ে দিয়েছেন। কাল পুরো দিন প্লাম্বার আর ইলেক্ট্রিশিয়ানের পেছনে যাবে। প্লিজ কাম সুন।”
সৌম্য একটা মুচকি হাসির ইমোজি পাঠিয়ে চোখ বুজল। নিজের মাকে ও ভাল চেনে। সব কিছু যতক্ষণ না টিপটপ, মনমত হয়, ততক্ষণ ভদ্রমহিলার খুঁতখুঁত চলতে থাকে। এতে একদিকে অবশ্য সৌম্যর সুবিধে হয়। আত্মীয়স্বজন কোনও সম্বন্ধ আনলে মা কিছু না কিছু একটা খুঁত ঠিক খুঁজে বার করে ফেলে। ফলে সৌম্যকে আর পাত্রী বাতিল করতে হয় না।
*****
সৌম্যকে মেসেজটা করে ফোনের অ্যাড্রেসবুক খুলল রজত। পৃথার সাথে একটু কথা বলার দরকার ছিল। কিছু জিনিস কন্ফার্ম করতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সাড়ে আটটা বাজে। বেশি রাত হয়নি। এই সময় কল করাই যায়।
খানিক বাজার পর ফোনটা তুলল পৃথা।
- হ্যালো, কে কথা বলছেন?
- আমি রজত। সৌরলোক ডিটেক্টিভ এজেন্সিতে সৌম্যর পার্টনার।
- ও হ্যাঁ, রজতবাবু, নমস্কার।
- নমস্কার। কেমন আছেন?
- চলছে। এখন ফোন করলেন? কিছু দরকার আছে?
- আসলে কিছু ইনফরমেশন জানার ছিল। তাই কল করলাম।
- বলুন।
- একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন থাকবে। আশেপাশে যদি অন্য কেউ থাকে, তাহলে আমি পরে ফোন করতে পারি, বা আপনার সঙ্গে আলাদা করে দেখা করে নিতে পারি।
পৃথা একটু থমকাল। তারপর বলল, “আপনি বরং ফোনটা রেখে দিন। আমি – যে নম্বরটা আমাকে সৌম্যবাবু দিয়েছেন – সেখানে ফোন করি।”
রজত বুঝল, পৃথা শুধু সাবধানীই নয়, বুদ্ধিমতীও। ব্যক্তিগত কথা কোনো অচেনা নাম্বার থেকে আসা ফোনে বলতে চাইছে না। রজত ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দিল।
খানিক বাদে সৌরলোক ডিটেক্টিভ এজেন্সির জন্য নেওয়া আলাদা ফোনে পৃথার কল এল।
- বলুন, কী জানতে চান?
রজত আর আলাপচারিতা না বাড়িয়ে প্রশ্নে চলে গেল। সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, তুহিন যে মুম্বই যায়নি, কলকাতাতেই ছিল, সেটা আপনি জানতেন, তাই না?”
পৃথা অসম্ভব চমকে গেল। বলল, “আপনি কী করে জানলেন?”
- আমি কী করে জানলাম, সেটা বড় কথা নয়, কথাটা ঠিক কি না সেইটা বলুন। দয়া করে কিছু লুকোবেন না।
- হ্যাঁ, আমি জানতাম। ও আমাকে বলেছিল।
- সবাইকে মুম্বাই যাচ্ছেন বলে কলকাতায় রয়ে গেলেন, আপনি এর কারণ জানতে চাননি?
- দেখুন, আমাদের একে অন্যকে প্রশ্ন করার অভ্যেস কখনোই ছিল না। তবে এক্ষেত্রে বলেছিল, যে ও ক’দিন ঋকের সাথে সময় কাটাতে চায়।
- তাহলে আপনি ঋকের ব্যাপারটাও জানতেন?
- হ্যাঁ, জানতাম।
- আপনার এই নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না?
- প্রথমে শকড হয়েছিলাম। তারপর সামলে নিয়েছি।
- আপনাদের মধ্যে ঝগড়া হত?
পৃথা এইবার একটু থমকালো। তারপর বলল, “সে আর কোন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে না হয়?”
রজত একটু হেসে বলল, “আপনাদের মধ্যে সম্পর্কটা তো অনেকদিনই হয়ে গেল আর স্বামী স্ত্রী-র মত ছিল না, তাই না?”
পৃথার গলা এবার একটু কঠোর হল, “দেখুন রজতবাবু, তুহিন আর আমার মধ্যে কোনো শত্রুতা ছিল না, এটুকু আমি আপনাকে বলতে পারি।”
- শত্রুতা তো বলিনি, বন্ধুত্বের সম্পর্কও তো হতে পারে, তাই না? যাই হোক, একটা লাস্ট প্রশ্ন আছে। তুহিনবাবু যে মুম্বাই যাননি, সেটা আপনি ছাড়া আর কে কে জানত?
- আমার চেনা আর কেউ না।
- দয়া করে সত্য গোপন করবেন না। আর কেউ কি জানত না?
- না।
- আপনি আর কাউকে বলেননি?
পৃথার গলায় আবার কঠোরতা ফিরে এল, “বললাম তো, আর কেউ জানত না। বারবার একই প্রশ্ন করছেন কেন বলুন তো?”
- আপনার আঙুলে যে আংটিটা দেখলাম, সেটা তো আপনাদের বিয়ের আংটি নয়। আপনাদের বসার ঘরের দেওয়ালে আপনার আর তুহিনবাবুর যে বড়ো সাদা-কালো ছবিটা আছে, তাতে তো আংটির অন্য ডিজাইন দেখলাম। কবে পাল্টালেন? গত নভেম্বর-এ?
- আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো? কী চান আপনি?
- আমাদের কাজ শুধু সত্যিটুকু খুঁজে বের করা। আর কিছু নয়। প্লিজ সত্যিটুকু আমাদের জানান।
- মহেশ জানত। আমি বলেছি।
- মানে তুহিনবাবুর বিজনেস পার্টনার, মহেশ কুমার, তাই তো?
- হ্যাঁ।