মেসেজটা দেখে কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে বসে রইল দু’জনে। তাহলে এটা অন্য কিছু নয়, খুনই!
দু’জনের মধ্যে রজতই প্রথম মুখ খুলল, “বিষ? কে দিল?”
অল্পবয়সী সুবেশা তরুণী জার্নালিস্ট – যিনি ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন – তিনি মহেশকে প্রশ্ন করলেন, “যেদিন তুহিনবাবু মুম্বই যাবেন বলে বাড়ি থেকে বের হলেন, সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন?”
মহেশকুমার এবার অত্যন্ত রেগে গেলেন, “আর ইউ ইন্টারোগেটিং মি? আমি আর কোনও প্রশ্নের উত্তর দেব না। দ্যাটস ইট। নো মোর কোয়েশ্চেন।”
মহেশকুমার সাংবাদিককে প্রায় ঠেলে ধাক্কা মেরে গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সাংবাদিকটি ক্যামেরার দিকে ফিরে বললেন, “যেমন আপনারা দেখলেন, মন্ত্রী তুষার মিত্র-র ছেলে নিহত তুহিন মিত্রের বিজনেস পার্টনার আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করলেন। এখন আমরা আবার দেখে নেব তুহিনবাবুর দেহের ছবি, যা আজ ভোরে দমদমের সেভেন ট্যাংকের কাছে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আমাদের সূত্র অনুযায়ী, তুহিনবাবুর মৃত্যু বিষপ্রয়োগের ফলেই হয়েছে, যদিও পুলিশ এখনও সরকারিভাবে কিছু জানায়নি। আর খানিক বাদেই অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার সাংবাদিক বৈঠক করবেন। অনুমান করা হচ্ছে…” টিভিটা মিউট করে দিল সৌম্য। এখন টিভির পর্দা জুড়ে আবার নিথর তুহিনের ছবি।
রজত ঘরে এল। বলল, “বাবাকে বললাম পার্টি আর ঋকের কথা। পার্টির ব্যাপারটা ওরা অলরেডি জানত। বলল, হোটেল থেকেই খানিক আগে কল এসেছিল। মন্ত্রীর ছেলে বলে কথা, হোটেলওয়ালারাও খুব ভয়ে আছে। আপাতত বাবা আর দু’-একজন হোটেলে যাচ্ছে সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে। হোটেল থেকে বলেছে, ওদের কাছে পুরো গেস্ট লিস্ট আছে। তবে যে জায়গাটায় পার্টি হচ্ছিল, সেই জায়গায় একটা সিসিটিভি খারাপ থাকায় পুরো এরিয়া কভার হয়নি। উপরন্তু আলো-আঁধারি থাকায় খুব একটা কিছু পরিষ্কার বোঝাও যাচ্ছে না। বাবা জিজ্ঞেস করল, আমরা যাব কিনা?”
সৌম্য বলল, “না, বরং চল মানসের বাড়ি যাই। ওর থেকে ডিটেল্স নিতে হবে। আর দেখি যদি ঋকের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়।”
ওরা বের হওয়ার মুখেই সোহিনীদেবীর কাছ থেকে সৌম্যর কাছে ফোন এল।
- হ্যাঁ মা, বল।
- হ্যাঁরে, টিভিতে দেখলাম তুহিন মিত্র খুন হয়েছে। ও তোর কলেজে বন্ধু ছিল না?
- হুম্।
- কী কাণ্ড বল তো! আমার তো ভেবেই বুকটা হু হু করছে। কী মিষ্টিই না ছিল ছেলেটা! হ্যাঁ রে, তুই ঠিক আছিস তো?
- হ্যাঁ মা, আমরা ঠিক আছি। একটু বের হচ্ছি।
- আমরা মানে?
- আমি আর রজত।
- ওহ্, ও তোর ওখানে? ন’টা তো বেজে গেল। কখন বাড়ি যাবে আর কখন খাওয়াদাওয়া করবে? আর এখন বাইরে যাচ্ছিস যে?
- আহ্ মা, এটা কলকাতা শহর। ন’টা এমন কিছু রাত নয়। আর আমরা বাইরেই কিছু খেয়ে নেব।
- এই তোদের এক স্বভাব। কথায় কথায় বাইরে খাওয়া। একে তো একগুচ্ছ টাকা নষ্ট, তার ওপর শরীর। এরকম রোজ রোজ বাইরে খেলে শরীর ঠিক থাকে?
- রোজ কোথায় বাইরে খাই মা? উফ্!
- রোজ না হোক, ফি-হপ্তায় তিন দিন। ওই হল। বাড়িতে দেখার কেউ নেই তো, তাই। থাকত ঘরে কেউ একজন দেখেশুনে রাখবার, রেঁধেবেড়ে দেওয়ার, এমন বাইরে বাইরে খেতিস না।
- ওহ্ মা, এবার রাখো। আজকে আমার মুড ভাল নেই, এইসব ঘ্যানঘ্যান ভাল লাগছে না।
ফোন কেটে দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল সৌম্য। কাঁকিনাড়ার বাড়িতে একলা থাকা বয়স্ক মাকে এভাবে বলতে ওর ভাল লাগে না, কিন্তু সবসময় মাথাও ঠিক রাখা যায় না। ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধবোধ সৌম্যকে গ্রাস করল। মাথাটা নামিয়ে নিল ও। পাশের দিকে তাকালে দেখতে পেত রজতের মুখটাও কেমন কালো হয়ে গেছে।
***
মানসের কাছ থেকে যতটুকু জানা গেল, তা হল এই, যে শনিবার রাত ১১টা নাগাদ তুহিন আর ঋক পার্টিতে পৌঁছয়। তারপর যথারীতি হাই-হ্যালো, নাচ, ড্রিংক্স এসব চলছিল। সবাই বেশ ভাল মুডেই ছিল। কথা নেই, বার্তা নেই – কোথা থেকে ওই আমন শর্মা নামে ছেলেটা এসে তুহিনকে চুমু খেতেই পুরো সিচুয়েশন পাল্টে গেল। ঋক তো রেগে টং। তারপর খানিক কথা কাটাকাটির পর তুহিন আর ঋক দু’জন পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। নাহ্, কোথায় গেছিল সেটা মানস জানে না। পার্টিতে তুহিনের হাতে গ্লাস ছিল, সে ব্যপারে মানস নিশ্চিত। কিন্তু কী খেয়েছে, কার থেকে খেয়েছে – তা মানস জানে না।
ঋকের ব্যাপারে মানসের থেকে বিশেষ কিছু জানা গেল না। শুধু এটুকু খবর পাওয়া গেল, যে ঋকের পুরো নাম ঋকবেদ শাহ। গুজরাটি উচ্চারণে রুকভেদ। তবে নিজের নামের বেদত্ব এবং শাহত্ব বিসর্জন দিয়ে ও নিজেকে ঋক বলেই পরিচয় দেয়। মিশুকে, হাসিখুশি, নিরামিশাষী। নিজের সেক্সুয়ালিটির ব্যপারে আউট অ্যান্ড প্রাউড। তুহিনের ঠিক বিপরীত। ইন ফ্যাক্ট, কলকাতার গে কমিউনিটিতে তুহিনের থেকে ঋককে বেশি লোক চেনে।
ঋকরা আদতে গুজরাটি হলেও, কলকাতায় পূর্বপুরুষের বাড়ি আছে দমদমে। বাবার এক কালে কাপড়ের ব্যবসা ছিল। সেই সূত্রেই কলকাতায় বসবাস, পরিচিতি, কলেজ। তবে বেশ কয়েক বছর হল ঋকের পরিবার গুজরাটে চলে গেছে। ঋকেরও ফ্যাশনের ব্যবসা মুম্বইতে। তুহিনের সাথে ওর কবে থেকে প্রেম সেটা মানস জানে না। তবে তুহিন যে প্রায়ই মুম্বই যেত, সেটা ও জানে। ইদানীং গত দু’বছরে প্যানডেমিকের জন্য ওর ফ্যাশন ব্যবসা বেশ মার খেয়েছে, সেটা ঋক প্রায়ই বলত। তবে কোনও ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস চলছিল বলে ও শোনেনি।
মানসের ওখান থেকে বেরিয়ে সৌম্য দিব্যেন্দুকাকুকে ফোন করল।
- কাকু, বিরক্ত করলাম না তো?
- আরে না না। কিছু পেলে?
- এখনও না। তবে তোমাকে একটা ফোন নাম্বার দিচ্ছি। চেক কর, কখন কোন জায়গার টাওয়ারে ছিল। যদি এয়ারপোর্টের টাওয়ারের আওতায় ওই ফোন থাকে, তাহলে ওই সময়ের সমস্ত কলকাতা-মুম্বই ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার লিস্টে দেখবে, ঋক শাহ বলে কেউ গেছে কিনা। যদি না পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্য সব ফ্লাইট চেক করতে হবে। সে হবে এক খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা। আরেকটা জিনিস চেক করতে হবে – এই নাম্বার থেকে শনিবার দুপুরের পর থেকে কী কী কল করা বা রিসিভ হয়েছে। আর তুহিনের নম্বর থেকে কী কী ফোন মেসেজ এসেছে, গেছে সে তো তোমরা নিশ্চইয়ই দেখছ।
- ঠিক আছে। আমি এখনই রাজাকে বলে দিচ্ছি। অল্প বয়স, কিন্তু খুব এফিশিয়েন্ট ছেলে। ও-ই কেসটা দেখছে।
- তুমি একটু ওঁর সাথে আমার ইন্ট্রো করিয়ে দেবে?
- হ্যাঁ হ্যাঁ। সে আর বলতে। কাল সকালেই করিয়ে দিচ্ছি। এক কাজ কর না। কাল দশটা নাগাদ তুই আর রুপু আমাদের বাড়ি চলে আয়। রাজাও ওই সময় আসবে পোস্ট-মর্টেমের পুরো রিপোর্ট নিয়ে। সেটাও দেখে নিবি।
- ঠিক আছে। আর শোনো, আমরা এখন একটু ঋকের বাড়িতে যাচ্ছি। একটু সরেজমিনে দেখা দরকার। তোমাদের কাউকে পাঠাবে? আমি তাহলে ঠিকানাটা হোয়াটস্যাপ করে দিচ্ছি।
- আমি তাহলে রাজাকে বলে দিচ্ছি ওখানেই চলে যেতে। পুলিশ ছাড়া মাঝরাতে খুনীর বাড়িতে একা যাওয়াটা ঠিক হবে না।
ফোনটা রাখতেই রজত জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁ রে, বাবা তো ঋককেই খুনী ঠাওরাল দেখছি।”
- তাই তো দেখলাম। তোর কী মনে হয়?
- নাহ্ রে, ঋক খুনী নয়।
- কেন বলছিস এ কথা?
- দ্যাখ, ঋক খুনী হলে পার্টিতে সবার সামনে ঝগড়া করে নিজের দিকে সন্দেহ টানত না। বরং, এখন চুড়ি ভেঙে নাটক করত।
রজতের অ্যানালিসিস শুনে সৌম্য মুচকি হেসে বলল, “কিন্তু ধর যদি ওই ঝগড়ার জন্যই রাগের মাথায় খুন করে ফেলে?”
রজত বলল, “বাহ্ কী বুদ্ধি! হঠাৎ রাগের মাথায় খুন করবে বলে পকেটে রাইসিন নিয়ে ঘুরছিল। রাগ হলেই খাইয়ে দেবে বলে।”
রজতের কথা বলার ধরনে সৌম্য হা হা করে হেসে ফেলল। তারপর রজতের মাথাটা বুকের কাছে টেনে বলল, “কেয়াবাত ওয়াটসন।”
রজত আদুরে গলায় বলল, “আমার ওয়াটসন হতে বয়েই গেছে।”
- তবে কী, তোপসে?
- আমি সহধর্মী, সত্যবতী।
সৌম্য রজতকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেল। রাতের কলকাতার ল্যাম্পপোস্টরা সাক্ষী রইল ওদের দাম্পত্যের এই মুহূর্তটার।