অন্ধকার সরিয়ে আলো ফুটবে ফুটবে করছে। পুরো কামরা এখনো ঘুমোচ্ছে । গভীর রাত অবধি যে ছেলেটা টিটির পেছন পেছন বার্থের খোঁজে ডান হাতে টিকেট আর বাঁ হাতের ভাঁজে টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল , বাথরুমের ধারে খবরের কাগজ পেতে সেও এখন ঘুমিয়ে কাদা । কামরা জুড়ে ঘামের ভেজা গন্ধের আস্তরণে ধাক্কা মারছিল ভোরের নরম হাওয়া । ট্রেনে ঘুমানোর এটাই মোক্ষম সময় । কিন্তু ইমানুল্লা জেগে গেছিল । জানলা দিয়ে চোখ ছড়াল বাইরে, দিক বোঝার জন্য। তারপর ওর মিডল বার্থ থেকে নেমে জমি খুঁজল । সুবিধামত জায়গা দরকার । ফজরের নামাজ আদায় করবে।
পঞ্চাশ ছুঁই ইমান মিঞা । পাতলা মাজা চেহারা, একটু কুঁজোমত। ছোট মুখে কাঁচায় পাকায় লম্বা দাড়ি। একটা পায়ে খুঁত থাকায় একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। তাই হয়তো বয়সের তুলনায় বেশী ধীরজ, সতর্ক। তার সাবধানী চোখে খুঁজে নিল দুটো বার্থের মাঝখানে একটু জায়গা । দেখে শুনে সেখানেই নামাজের জন্য হাঁটু মুড়ে বসবে ইচ্ছা । বসতে বসতেই লোয়ার বার্থে ঈষৎ হাঁ করে ঘুমনো লোকটার মুখটা কাছে চলে এসে তাকে চমকে দিল । আল্লা! এ মুখ তো ভোলার নয়। মুখের বয়স দশ বছর বেড়েছে , চুল সাদায় কালোয় , কিন্তু খড়খড়ে ওঠা-না-ওঠা দাড়িতে ঢাকা চোয়ালের কাঠিন্য সকালের অস্ফুট অন্ধকারেও স্পষ্ট । নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিয়েছিল ইমানউল্লার। দশ বছর পরেও। এ কি মুসিবত খাড়া করলে আল্লা ! কোনমতে নামাজ আদায় করে ইমান গুটিসুটি মেরে আবার মিডল বার্থে উঠে চাদরে মাথা ঢাকল । ঠিক লুকাচ্ছে তা নয় , সত্যি বলতে তার তো গোপন করার কিছু নেই। তখনও ছিল না। এখনও নেই । কিন্তু তবুও একটু ভাবার সময় দরকার । এই মুহুর্তে রাগ, বিতৃষ্ণা, আশঙ্কা সব অনুভূতিগুলো মিলে মিশে একাকার। দশ ভাবনা দশ দিকে দৌড়াচ্ছে মাথায়, লাগামটানা দরকার । বমির বেগ এল ইমানের । জিভ ঠেলে ধরল সামনের দুটো না-থাকা দাঁতের ফাঁকে , দরজা বন্ধ করার মত। কিন্তু চোখ বোঁজার সাহস পাচ্ছিল না , বুঁজলেই ছুটে আসছিল দশ বছর আগের আখ্যান। কিন্তু চোখ খোলা রেখেও কি তার থেকে সরে থাকা যায় , গিয়েছে ? সেই মুসিবতের দিন গুলো শেষ হয়ে যাবার কত বছর পরেও সে মাঝরাতে ঘেমে নেয়ে উঠেছে ধড়ফড়িয়ে । উঠে পড়েছে বিবিজানও , ঘাড়ে কপালে পানি ঢেলেছে। আতঙ্ক তো সারাটা জীবনেরই সঙ্গী তার । কোথাও কিছু হলেই মনে হয় আবার সে বুঝি ফেঁসে যেতে পারে। যদিও ফেঁসে জাবার আর কিছু বাকিও তো নেই। সবই তো শেষ হয়ে গেছে তার। তবু অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলা সে এড়িয়ে চলে। কোথাও গণ্ডগোলের খবর পেলেই ইমানুল্লা শামুক খোল। কিন্তু তাতেও কি সে কিছু বাচাতে পারল? হাসান ভাই বলত, ডরপুক হয়ে বাঁচা যায় না ইমান মিয়া, আল্লার কাছে কী জবাবদিহি করবে? সালমাও বলে সে কথা। কিন্তু ইমান কি করতে পারে? ডর তো সে জেনে বুঝে পয়দা করে নি, তাকে ঘিরে আছে দশ বছর ধরে। কিন্তু সে ভয়টা যেমন সবদিনের সঙ্গী, বড় পরিচিত- দাঁত মাজা গোসল করার মত । জীবনের নিয়মের সাথে এত জড়িয়ে গেছে যে অস্বাভাবিক বলে আর মনেই হয় না। কিন্তু ট্রেনের কামরায় এস আই ঘোষের সাথে এমন হঠাত মোলাকাত হওয়াটা সেসবের বাইরে । অহেতুক ক্ষতের মুখে খুচিয়ে ঘা করতে চায় না। যা হওয়ার সেতো হচ্ছেই , হয়েই গেছে। এখন সব আল্লার হাতে ছেড়ে দিয়েছে সে । কি হবে যা পেছনে ফেলতে চায় সেসব আবার অস্তিত্বের কেন্দ্র বিন্দুতে নিয়ে এসে? কিছু কি আর ফেরত আসবে? জানে সব, তবু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ইমান মিঞা পিছলে ঢুকে যাচ্ছিল স্মৃতির কাল থাবায় ।
সে তখন বেনিয়াপুকুর হাই মাদ্রাসায় অঙ্কের মাস্টার । ভুলে যেতে পারলে ভাল হয় এমন একটা দিন। তবু ভুলতে তো পারে না। ওটাই বরং সব সময়ে বুকে চেপে থাকে। সেদিন বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে প্রায় মাদ্রাসার দোর গোড়ায় , এই এস আই ঘোষ এসে তার কাঁধে হাত রেখেছিল – কি ইমান মিঞা , চললে কোথায় ?
সেদিনও ঘোষের পরনে খাকী ছিল না , তাই ইমান বুঝতে পারে নি প্রথমে । অচেনা মুখ , অথচ তার কাঁধে হাত দিয়েছে , হঠাৎ চমকে উঠেও নিজেকে সামলে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল ইমান ।
সেলামালেকুম , আপনি -
এস আই ঘোষের চোখ থেকে আপাত হাসি ততক্ষণে সরে যাচ্ছিল – জিগরি দোস্ত তোমার, চিনে যাবে। এখন চল আমার সাথে। ওর হাতটা ইমানের কাঁধে ততক্ষণে থাবা হয়ে যাচ্ছিল ।
কেন যাবে , যাবেই বা কোথায় ? কিছুই বুঝতে পারছিল না ইমান । কে আপনি ? আমার কাঁধে কেন হাত রেখেছেন ? বাঁ হাত দিয়ে থাবার থেকে নিজের কাঁধ ছাড়িয়ে নিতে গেছিল ইমান । পর মুহূর্তে থাবাটা চড় হয়ে তার গালে এসে পড়ল । ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গেছিল ইমান । রাস্তার ওপারেই মাদ্রাসা , সকাল বেলা ছেলেরা তখন ঢুকছে । অপমান , লজ্জায় আর রাগে অন্ধ হয়ে লোকটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছিল ইমান । কিন্তু তার আগেই আরো দুটো হাত এসে পেছন থেকে জাপ্টে ধরল তাকে । এর পরেই নাকের ওপর আসা ঘুষিতে মুখটা রক্তে ভেসেছিল। চোখে অন্ধকার নেমে আসার আগের মুহূর্তেও রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে পড়া কৌতুহলী ছাত্রদের কথা ভেবে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল ইমান , সে যে ওদের মাস্টার! শরীরের ব্যাথার চেয়েও সেই ভাবনা ওকে ভেঙ্গেচুরে দিচ্ছিল ।
তখনও ইমান জানত না , ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে । চোখ খুলল পানির ঝাপটায় । মুখে রক্তের নোনা স্বাদ পেতে ধরমর করে উঠে বসতে গিয়ে বুঝল তার হাতদুটো পিঠের দিকে পিছন করে বাঁধা । চোখ মুখের উপর থেকে চুইয়ে পড়া পানিটা যে মুছবে সে উপায়ও নেই । তবু ঝাপসা চোখে বুঝতে পেরেছিল ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে দু তিনজন পুলিশের লোক । আর সামনে ছিল এই ঘোষ । নিজেকে এদের পায়ের কাছে পড়ে থাকতে দেখে খুব অসহায় লেগেছিল ইমানের। তার এত দিনের তিল তিল করে জমানো সম্মান , মাস্টারীর সুনাম সব কিছুতে যেন পানি ঢেলে দিল কেউ আজ । ভয়ের শিহরন খেলল তার শরীরে। মনে শীতের কাঁপুনি। আব্বাজান , সালমাবিবি আর তার জান , তার কলিজা আজহার মিঞার কিছু করেনি তো এরা ? কিন্তু কেন , কি করেছে সে ? হঠাত একি নতুন দাস্তান তার জীবনে? এক লহমায় সব কিছু ছত্রখান। চোখ পিট পিট করে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে। ঠাহর হল একটা অন্ধকার স্যাঁতসেতে ঘর, জেল কি এটা? নাকি থানা ? ইমান মিঞা কোনদিন জেলেও যায় নি , থানাতেও না । তবে বায়স্কোপে দেখেছে জেল মানে লোহার গরাদ থাকে , এখানে সেসব কিছুই তো নেই । অন্ধকার একটা ঘর , তার দরজা শক্ত করে ভেজান । ফাক ফোঁকর দিয়ে যেটুকু আলো ছিটকে আসছে। তাছাড়া একটা ধুলোয় মোড়া চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব টিমটিম করছে শুধু। তবু আস্তে আস্তে অন্ধকারে চোখ সয়ে আসছিল । ইমান দেখল ঘরে আর কিচ্ছু নেই । শুধু এই কজন ছাড়া । সামনের অবয়বগুলো ধীরে ধীরে পরিস্কার হয়ে আসছিল এবার।
জুলজুল করে দেখছে দেখ , যেন কিচ্ছু জানে না । বাঞ্চোত ! থক করে এক দলা থুতু ফেলেছিল এস আই ঘোষ , ঠিক তার মুখে। হাত পেছনে বাঁধা , মোছার উপায় ছিল না । ঘেন্নায় মুখটা বোধহয় একটু বেঁকেছিল , ঘোষ সপাটে এক লাথি কসিয়েছিল তার পুরুষাঙ্গে , শরীরটা যেন ঝনঝন করে উঠল তার । যেটুকু মাথা তুলেছিল আবার পড়ে গেল উলটো দিকে। কেন মারছে ওরা তাকে ?
পাশের পুলিসটা খিক খিক করে হেসে উঠেছিল – শালার কাটার গুস্টি । শুয়োরের পালের মত পয়দা করে তো, এরপর আর পারবে না বাঞ্চোত। লোকটার কথায় সবাই নির্দয় হাসিতে যোগ দিল।
কেন মারছেন আমাকে , কি করেছি আমি ?
মারবে না ওকে জামাই আদর করবে । জানিস না, কি করেছিস ? তোদের সব কটাকে ধরে অনেকদিন আগে দেশ থেকে তাড়ান উচিৎ ছিল । টেররিস্ট !
পুরুষাঙ্গ থেকে উঠে আসা ব্যাথাটা আসতে আসতে নামছিল। ভাবতে চেষ্টা করল এমন কিছু কি হয়েছে যার সাথে জড়িয়ে তাকে ধরে এনেছে? বোঝা না-বোঝার ধোঁয়াশার মধ্যে আগুনের ফুলকির মত ইমানের মাথায় উকি দিল কালকের বড় খবরটা। কালকেই যেন কি একটা হয়েছিল না? গুলি চলেছিল আমেরিকান সেন্টারে। তাই নিয়ে কি ? কিন্তু ওর সাথে সেই ঘটনার কি সম্পর্ক? আর কিছু ভাবার আগেই আবার লাথি , এবার তলপেটে। সঙ্গে লাঠির বাড়ি । পরমুহুর্তে জ্ঞান হারিয়েছিল ইমান ।
সারাটা দিন এই চলল । মার খাচ্ছে , অজ্ঞান হচ্ছে । চোখে পানি দিয়ে উঠিয়ে আবার মারছে । একটাই প্রশ্ন , নাজিরের কথা, কি জানে ইমান তার বিষয়ে? নাজির না নাজিব? কানটা ঝিঝি করছিল, তাই বুঝতে পারছিল না সে ঠিক শুনছে কিনা। কিন্তু সেতো জানে না নাজির বা নাজিব কে। কোন নাজির ? জানে না বলতেই আবার মার। এখন আর অত লাগছিল না ইমানের, বোধ শক্তি কমে যাচ্ছিল বোধ হয় ।
এই সময় ঘোষ একটা ছবি নিয়ে এল হাতে করে । বল শালা , চিনিস এটাকে ? জাতভাই তোর।
রক্তের আস্তরে তার চোখের অনেকটা ঢেকে গেছিল। তবু ইমান চিনতে পেরেছিল । নাজির কোথায় , এতো আফজল মিঞা , তার ছাত্র । মানে মাদ্রাসার ছাত্র ছিল কয়েক বছর আগে । তারপর বহুদিন নিপাত্তা । দুদিন আগেই তার সাথে দেখা হয়েছিল ইমানের। পার্ক সার্কাসের দিকে কাজে গিয়েছিল । হঠাত দেখা আফজল মিঞার সাথে । বড় প্রিয় ছাত্র ছিল তার । প্রথমে তো চিনতেই পারেনি । লম্বা নুর, পরনে শেরওয়ানি। মনে পড়ল পথের ধারে সোলেমানের দোকানে বসে চা খেয়েছিল ওর সাথে, আর কিছু কুশল প্রশ্ন ।
এবার ঘোষের সাথে আর এক অফিসার , জিজ্ঞেস করল – কি ইমান মিঞা চিনতে পারো ? জান পহেচান কেউ তোমার ?
হ্যাঁ স্যার , একে তো আমি চিনি । আফজল মিঞা , আমার ছাত্র ছিল ।
কবে ছাত্র ছিল ?
সে আজ বছর সাত আট হবে । তারপরে আর দেখা নাই।
দেখা নেই তো তুমি দুদিন আগে পার্ক সার্কাসে কি করছিলে এর সাথে ? কিসের পাঠ দিচ্ছিলে? পড়াচ্ছিলে বুঝি ওকে? এখনও?
এর নরম গলার শীতলতা ইমান মিঞার ভিতর অবধি নাড়িয়ে দিল । কোনমতে বলেছিল – আমার মাদ্রাসার পুরোন ছাত্র সার , হঠাত দেখা হল এতদিন বাদে , তাই কিছু পুরোন দিনের কথা -
এরকম কতজন পুরোন ছাত্রের সাথে তোমার হঠাত হঠাত দেখা হয়? শীতল গলা হঠাত গর্জনে বদলে গেল । তবে ইমানুল্লা যে আবার পিছন ঘুরে পড়ে গেছিল , সেটা ওই গর্জনে নয় ।
হুঁশ আসতে আবার প্রশ্ন। কি কথা হল তোমার আফজলের সাথে? কোথায় থাকে আফজল? কি করে? ওকি মাদ্রাসা থাকতেই কোন গন্ডগোলের সাথে জড়িয়ে ছিল? মাদ্রাসা ছাড়ার পর কি যোগাযোগ ছিল ইমানের সাথে?
সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল ইমানের। কিচ্ছু মনে পড়ছিল না।
না সাব, সেরকম কিছু কথা হয় নি। এত বছর আমার সাথে দেখাও হয় নি।
এলো পাথারি মার চলল আবার । কথা বার করার জন্য । কিন্তু কি বলবে ইমান ? আফজলের সাথে তো দেখাই হয়েছিল কত বছর পরে । আর ছাত্র তো বেটার সমান। মুখ ফসকে যদি কিছু বলেও থাকে, সেসব বলে দিয়ে কি ওকে ফাঁসান ঠিক হবে?
কোন কথাই বের করতে পারছিল না পুলিস । তখন এই এস আই ঘোষ বলল , শালা এভাবে কিছু বলবে না , তুলে নিয়ে আয় ওর বিবি আর বাচ্চাকে এখানে , ওদের সামনে এটাকে ধোলাই দেবো।
হাত বাঁধা থাকলেও এস আইয়ের পা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল ইমান । গোঙাতে গোঙাতে আছারি পিছাড়ি খেয়েছিল।ওটা করবেন না সার – ওর চোখের সামনে ভাসছিল বালক আজহারের নিষ্পাপ চোখ – আমাকে এখানে মারুন সার, যা কিছু করুন। কিন্তু আমার বেটা এখনও বাচ্চা সার।
কেন দেখুক, বুঝুক ওর বাপজান একটা টেররিস্ট, দেশের দুশমন। দেখুক দুশমনির কি শাস্তি।
না, না সাব। ও ওর আব্বুকে চেনে। ও যদি এখানে এসে দেখে এসব একবার , নফরত এসে যাবে স্যার। একটা গভীর কিছু হারিয়ে যাবার ভয়ে দিশহারা হয়েছিল ইমানুল্লা। এসব কি দেখার বয়স ওর ছেলের? বাপের এই হাল দেখলে কি ভাবে নেবে কে জানে। ভয় তো পাবেই, কত প্রশ্নও জাগবে যার উত্তর দেওয়ার জন্য ইমান থাকবে না। অজানা আশঙ্কায় বিহ্বল ইমান এস আই ঘোষের পায়ে লুটিয়ে পড়েছিল। এটা ঠিক হবে না সাব। দেশের নও জোয়ান, ওর দিলটা বেমালুম খাক হয়ে যাবে।
এতক্ষনে ব্যাটার উইক পয়েন্টটা পাওয়া গেছে। এগোনোর পথ পাওয়ার আনন্দে ঘোষ আরও নৃসংস হয়ে গেল। মাদার চোত, পাকি , তুই আমাকে ঠিক-বেঠিক শেখাবি ? মার শালার পোঁদে লাথি । সব কটা এই দেশের খেয়ে আবার এই দেশের দাড়ি উপড়াচ্ছে , দেশের নও জওয়ানের নিকুচি করেছে । ইমানউল্লার কথাকে বিকৃত করতে পেরে খুশি বোধ করে। এরপর ইমান আবার জ্ঞান হারিয়েছিল ।
আজাহারকে নিয়ে এসেছিল ওরা । দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিল তার ছেলে, একবার চোখাচোখি হয়েছিল। তারপর ইমান মিয়া আর চোখ তুলে তাকাতেও পারে নি। চায়ও নি। তাকাতে চায় নি আজহারের ভীত, দিশেহারা চোখের দিকে । শরীরে তখন তার জামা কাপড়ও তো ছিল না , ওরা ডান্ডা দিয়ে মারছিল আর জেরা করছিল । কিন্তু কিছুই বলাতে পারে নি সে সেদিন । কি করে বলাবে ? আফজলের বিষয়ে আর বিশেষ কিছুই তো সে জানত না স্কুল ছাড়ার পরের সময় থেকে। সেদিন চা খাওয়ার সময় আফজল বলেছিল কোথায় থাকে, কি বৃত্তান্ত। সবই তার প্রশ্নের উত্তরে। কিন্তু সেসব নিশ্চয় সত্যি নয়। সত্যি হলেও বলবে না ইমান। ছেলের সামনে ওরা আজ তাকে বেয়াব্রু করে দিয়েছে। এখন যদি সে গলগল করে কথা বলতে থাকে, তাহলে ছেলের সামনে আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাতে সামলাতে জ্ঞান হারিয়েছিল সেদিন। সামনের দুটো দাঁত সেদিনই উপরে নিয়েছিল ওরা, কিন্তু ইমানের জবান দিয়ে কোন কথা গলানো যায়নি।
তবু আর দুই বছর জেলে থাকতে হয়েছিল তাকে । কোন কেস হয় নি তার নামে । কখনোই কোর্টে নিয়ে যায়নি তাকে । তার পর আল্লার কি শুকর হল , একদিন হঠাতই ছেড়ে দিল। কি গুনাহ করে যে জেলে গিয়েছিল , সে জানে না । আবার আল্লার কোন মর্জিতে খোলা আসমানের নিচে এসে দাঁড়াতে পেরেছিল তাও জানে না । কিন্তু তার মধ্যে বদলে গেছিল অনেক কিছুই । সে নিজেও কি বদলায় নি? মাদ্রাসার চাকরিটা ফেরত পেয়েছিল। কিন্তু সংসারটা তছনছ হয়ে গেছিল। আব্বাজানের ইন্তেকাম হয়ে গেছিল ইমান জেলে থাকতেই। সালমা কম বয়েসে বুড়িয়ে গিয়েছিল। ইমান জেলের মার খেয়ে, সালমা সংসারের। খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছিল আজহার,গম্ভীরও। ইমানের চারপাশে সব কিছু কেমন ভেঙ্গে পড়েছিল। সামাজিক সম্পর্ক গুলোও। সেই ভেঙ্গে পড়া সংসার জোড়া লাগাতে তার বেশ কয়েক বছর লেগেছিল , কিংবা কখনোই ঠিক জোড়া লাগে নি আর ।
ইমান হাঁটুটা বুকের কাছে গুটিয়ে নিয়ে পাশ ফিরে চোখ বুঁজল। রেলের চাকার টানাপোড়েন তখন মাথার সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছিল।
২
সুবিমল আড়মোড়া ভাঙ্গল। বেলা এখন অনেক। মাঝরাতে গয়া থেকে ট্রেন ধরেছিল। তারপর যে সেই কম্বল মুড়ে শুয়েছে, চোখ মেলল এইমাত্র। দেখল রমা উঠে সাইড বার্থে ছেলের পা ঘেঁষে বসেছে। ট্রেনে রমার বেশি ঘুম হয় না। বুড়ুন এখনও ঘুমোচ্ছে।
চা এসেছিল?
কতবার। তোমায় ডেকে ছিলাম, তা তোমার তো কোন সাড়া শব্দ নেই। পান খাওয়া ঠোট টিপে হাসল রমা। গড়ন মোটার দিকে, গালে গলায় মেদের প্রলেপ রূপ কমালেও দেখতে এখনও মন্দ নয়। সেটা জানে বলেই রমা চোখ ঘুরিয়ে গালে টোল ফেলে বলে, যা শব্দ সে শুধু তোমার নাকে। বাবা কি নাক রে বাবা, যেন গুলিগোলা চলছে। কি ডাকতে পারো, ট্রেনে বাসেও ছাড়ো না। রেলের চাকার সাথে ডুয়েট চলছিল। হাসির ঝলকে রমার চোখ চিকচিক করে ওঠে।
রমার হালকা কথাকে তেমন আমল দিতে ইচ্ছে করল না সুবিমলের। অভ্যস্ত চোখে কামরাটা জরিপ করতে থাকল। যখন উঠেছিল তখন সব অন্ধকারে ঢাকা ছিল, সবাই গুটিসুটি ঘুমোচ্ছিল। এখনও কেউ কেউ শুয়ে, তবে অন্ধকার আর নেই। সুবিমলের উল্টোদিকের বার্থ ফাঁকা। মাখখানের বার্থ এখনও নামে নি, উল্টোদিক ফিরে ঘুমোচ্ছে এখনও। উপরের বার্থের জন খোলা খবরের কাগজের আড়ালে হারিয়ে গেছে। তার ঝুলন্ত পায়ের ফাটা গোড়ালির ফাঁকে ফাঁকে নোংরা দেখে সুবিমল মুখ কোঁচকাল। নিজের দিকের মাঝের বার্থে ছিল রমা। উপরের বার্থের আরোহীকে ঠাহর হল না নিচ থেকে। তবে সে অথবা সুবিমলের উল্টো বার্থের অধিকারী বোধহয় সাইড বার্থের উপরে গিয়ে বসেছে। কারণ সুবিমল দেখল সাইড বার্থের উপরে দুই যুবক যুবতী কানে মুখ লাগিয়ে গুজ গুজ করছে। ছেলেটার হাত মেয়েটার উরুতে আলগোছে রাখা, কোমরের খোলা জমি ছোঁবে কি ছোঁবে না করছে। সুবিমল মেয়েটির সবুজ ব্লাউজে ঢাকা বুকটা একবার মেপে নিয়ে চোখ সরাল।
রমার চোখে চোখ পড়তে ওর ইশাড়াও সাইড বার্থের উপরে। নিঃশব্দ ঠোঁটে কথা ফোটাল ‘ দেখেছো’ । এতে রমার দেখার জন্য কি আছে সুবিমল বোঝে না। এই বয়সেও রমার প্রেম বিষয়ক কৌতূহলটা বড় বেশী। সুবিমল পাত্তা না দিয়ে উঠে বসল। টুথ পেস্ট আর ব্রাশ হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে রওয়ানা দিল । যাবার সময় বলে গেল , এখুনি আসছি, চা কফি কিছু এলে রেখে নিও।
ট্রেন কানপুরে থামল। রমা চা নিল। উপরের বার্থ থেকে মেয়েটি মুখ বাড়ায়, বৌদি আমাদের জন্যও একটু চা বলবেন? তারপরে ছেলেটির কানে, এই যা না , নিচ থেকে চা টা নিয়ে আয়।
রমা বড় মিশুকে। বলল , নিশ্চয়। নিচের বার্থের বউটি ততক্ষণে ফিরে এসেছিল। তাকেও জিজ্ঞেস করল, চা খাবেন?
বোরখার মাথা নড়ল দুদিকে। মানে না।
রমা জানালা বাড়িয়ে চা নিয়ে ছেলেটিকে দিল, দু কাপ। সাথে প্রশ্ন করতেও ছাড়ল না, যাচ্ছো কোথায় তোমরা?
দিল্লী বউদি , আমরা ওখানে কলেজে পড়ি। ওপর থেকে মেয়েটা।
ছেলেটা চা নিয়ে আবার উপরে উঠে যেতে রমা আবার বোরখা পরিহিতার দিকে মুখ ফেরাল- এদিকে এসে বসুন না , কেমন মাথা গুঁজে বসে রয়েছেন। আচ্ছা দাঁড়ান। আমার কর্তা উঠে গেছে তো , আমি এই মিডল বার্থটা তুলে দিছি।
রমা আর বউটি মিলে মাঝখানের বার্থটা উঠিয়ে দিল। সামান্য কাজ, একসাথে করতে গেলেও কেমন একটা সখ্যতা আপনি গড়ে ওঠে। রমাও সাইড বার্থ ছেড়ে এখন চা নিয়ে সালমার পাশে। কথা জমানোর চেষ্টা করে। না করে উপায় কি? কতটা সময়ের পথ, কথা না বলতে পারলে হয়?
আমার নাম রমা, দিল্লী যাচ্ছি। আমি, আমার কর্তা আর ছেলে। গয়া গেছিলাম, এবার দিল্লী আর আগ্রা।
আমি সালমা, নরম শান্ত বউটি, আমরাও দিল্লী।
আর আগ্রা যাবেন না বুঝি? আমার তো তাজমহল দেখার ইচ্ছা সেই কতদিনের! রমা উচ্ছসিত হয়।
বেড়াতে বেরোলে পৃথিবীটা খুব রঙ্গিন লাগে। ভাবতে ইচ্ছা করে চারপাশের সবাই যেন বেড়াতেই বেরিয়েছে, সবার ছুটি।
সালমা মাথা নাড়ল , না , শুধু দিল্লী যাবো। কাজে। বলতে বলতেই আনমনা। চোখ হারিয়ে গেল জানালার বাইরে, প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে। রমার উতসাহিত কথার তোড় এই মেপে কথা বলা বউটির কাছে এসে কেমন এলিয়ে যায়। স্রোত থাকলেও, ঢেউ নেই।
ততক্ষণে বুড়ুন উঠে গেছিল। বলল , মা , আমিও চা খাবো। বুড়ুন পনেরোয় পা দিয়েছে, সবে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। এমনি তে চা খায় না, তবে বাইরে বেরোলে চলে।
চা না হয় নিবি, কিন্তু চোখে মুখে একটু জল দিয়ে আয়।
ধুর , কেন মুখ ধোবো এখন? আমি তো চা খেয়ে আবার ঘুমবো। জানালা দিয়ে হাঁক পাড়ল – চায়ে , ইধার এক কাপ দেনা ভাইয়া।
বুড়ুন একটা পেপারও নিল। রমা বটুয়া থেকে টাকা দিতে দিতে বলল , কিরে , বাংলা কাগজ পাওয়া যাবে না?
বুড়ুন চা হাতে এখন খেলার পাতায়। শচীন রিটায়ার করে গেল মা । তোমরা এমন সময়ে গয়ায় পিন্ডি দিতে ছুটলে , আমি কলকাতায় শচীনের লাস্ট ম্যাচটা দেখতে পেলাম না।
রমার এই এক ছেলে। বুড়ুন-গর্বে সে যে গর্বিতা তা তার হাঁ করে ছেলের প্রতিটা কথা গেলা দেখেই বোঝা যায়। সালমার দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হাসল , ক্রিকেট খেলে আমার ছেলেটা-
সালমা তাকে নিরাশ করল না, বড় ভালো আপনার বেটা, দেখলে বুক জুড়িয়ে যায়। জোয়ান হচ্ছে তো, সাবধান, এই বয়েসটা এমন।
ছেলের গল্প করতে পেলে রমা আর কিছু চায় না। ছেলে যে ক্রিকেট খেলে স্কুলের টিমে , চ্যাম্পিয়ান খেলোয়ার, এসব নিয়ে ফলাও করে বলার ছিল। কিন্তু সালমার উত্তরে কথাটা অন্য দিকে ঘুরে গেল। বাউন্ডারী লাইনে ক্যাচ ধরার মত লুফে নিয়ে রমাও কথার দিক বদলাল। সে আর বলতে। ছেলে আমার ক্লাস নাইনে উঠেছে , এখনই – রমা সালমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসায় – মেয়েদের মধ্যে ওকে নিয়ে যে কি হয়, আগে আগে কিভাবে সামলাবো তাই ভাবি। খুশিতে ঝুমঝুমায় রমা।
মাঝের বার্থে ইমান মিয়া এবার নামার তোড় জোড় করছিল। নামার আগে এদিক ওদিক দেখে নিচ্ছিল, চার পাশ। যেন কিছু চাই, খুঁজছে।
সালমা চিন্তিত হল, দ্রুত পায়ে উঠে দাঁড়াল গিয়ে, লাগবে কিছু আপনার? চা, পানি?
ইমান চাপা গলায় বলল, বিবিজান, এই কামরা ছাড়তে হবে, কাপড় চোপর গুছিয়ে নাও।
কেন? রিজার্ভেশন করিয়েছিলেন না? এখন যাবো কোথায়? সালমা যুগপৎ বিস্মিত ও বিরক্ত হয়। বারবার এদিক ওদিক দৌড় করাতে পারি না আমি। কারনটা কি বলবেন তো।
ইমান কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাথরুম থেকে ফেরত আসা সুবিমলকে দেখে ঝটপট আবার মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল। বাথরুমে বড় ভীড় ছিল। সুবিমলের আসতে তাই দেরী হয়েছিল। রমা বলল , তোমার জন্য চা রেখে রেখে আমরা খেয়ে নিলাম, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। এই বুড়ুন, বাথরুমের কাজ কর্ম গুলো সেরে আয় না, এরপর এত নোংরা হয়ে যাবে আর পারবি না।
বুড়ুন বাথরুমে যেতে, সুবিমল নিজের জায়গায় না বসে সাইড বার্থে বসে বুড়ুনের রেখে যাওয়া কাগজটায় চোখ বোলাল। চা হাতে কাগজ দেখতে দেখতে ভুরু কুঁচকোয় সুবিমল।
স্বামীর সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সদা ব্যাস্ত রমা বিচলিত হয়, চা টা বুঝি একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল? খেওনা তবে, এখুনি আবার আসলে নেওয়া যাবে খন।
আরে না, দেশটার কি হল সেটাই ভাবছি! মুখ দিয়ে অস্ফুটে আওয়াজ বের করে সুবিমল।
কেন গো, কি হল আবার?
কি আবার হবে, ভাল খবর কি আর থাকে কাগজে? এই মোসলাগুলো থাকতে দেশে কি শান্তি রাখতে দেবে কোন?
রমা অস্বস্তি নিয়ে আড়চোখে তাকায় তার পাশে বসা সালমার দিকে। শুনে থাকলেও তার অভিব্যক্তি বোঝা যায় না। তবু কথা ঘোরাতে রমা বলল, বুড়ুন বলছিল তোমাদের শচীন নাকি খেলা ছেড়ে দিল এবার?
সুবিমল খেঁকিয়ে ওঠে, রাখো তো তোমার শচীন। দিল্লীতে কি চলছে সেটা দেখো আগে। পর পর দু সপ্তাহে দুবার বম্ব ব্লাস্ট। তেরোজন মারা গেছে। মুজাহিদিনদের হাতের কাজ। দুরমুশ করতে হয় ব্যাটাদের।
কাউকে ধরতে পারল দাদা? উপর থেকে ছেলেটা মুখ বাড়ায়। লাস্ট উইকের ব্লাস্টটা আমাদের কলেজের সামনেই হয়েছিল বলে শুনেছি।
ভাগ্যিস আমাদের কলেজ ছুটি চলছিল। মেয়েটিও যোগ দেয়। কি ভয় যে লাগছে , আমাকে তো বাড়ি থেকে আসতেই দিচ্ছিল না।
আরে ধুর, ছেলেটা হাত দিয়ে যেন হাওয়া তাড়ায়। এক জায়গায় দুবার কখনও হবে না, টেররিস্টরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? আবার কোথাও করবে, পুলিশ টিকিও ছুঁতে পারবে না।
পুলিশও কোন ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। দুই টেররিস্ট তো পরশুদিনই এনকাউন্টারে মারা গেছে। একটা তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পরে সুবিমলের মুখে। কিন্তু কি অডাসিটি , তারপরেও আবার ব্লাস্ট হয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছ? গমগম করে ওঠে সুবিমলের গলা। পাকিস্তানের মদত আর ট্রেনিং। সবকটা মুসলমানকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিলে তবে যদি কিছু হয়।
কিন্তু এনকাউন্টার করল কেন? খবরের কাগজ থেকে মুখ সরাল উপরের বার্থের লোকটা এবার। ওদের ধরতে পারলে তো বরং কিছু খবর জানা যেতো। হয়তো পরের ব্লাস্টটা হত না।
সবাইকে চমকে দিয়ে সালমা বলে ওঠে, আল্লা জানেন, পিছন থেকে গুলি করে মেরেছে ছেলেটাকে, ওদের হাতে তখন কোন হাতিয়ার ছিল না। তার জলভরা চোখ বোরখার সীমানা ছাড়ায়।
হঠাত কামরাটা এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তে সুবিমল ঝাঁঝিয়ে ওঠে, বেশ করেছে, এতগুলো নিরীহ লোকের জান নিতে ওদের তো হাত কাঁপেনি। দেশের দুষমন সব। ধরে ধরে সবাইকে গুলি করে মারা উচিত।
সালমার কান্না আর নিঃশব্দ রইল না। বাধ্য হয়ে রমাকে বলতে হল , তুমি থামো তো একটু। সব জায়গায় গিয়ে তোমাকে পুলিশগিরি করতে হবে না।
এসব কথার মধ্যে ইমানুল্লা অনেকক্ষণ ঘাপটি মেরে পড়েছিল। বুকের ভিতরের সব ক্ষত লুকিয়ে রেখেই তো দশটা বছর কেটে গেছে তার। সেই ক্ষত ছড়িয়েই না আজ সব উজার হয়ে গেল। আজাহারের ইন্তেকামের সাথেই তার শেষ হয়ে গেছে। তবে আর কিসের ভয়? কেন সালমাকে একা একা কাঁদতে ছেড়ে দেবে ইমান? মাঝখানের বার্থ থেকে নড়েচড়ে ওঠে ইমানুল্লা। দেশের শত্রু কে বানাল ওদের সার? কেন ওরা হল দেশের দুশমন? কেন নিজের দেশটাকে দেশ বলে ভাবতে পারেনা এই নওজোয়ানেরা আর?
খুব ধীরে ধীরে বললেও কথার মধ্যে কোন অস্পষ্টতা ছিল না। বহুদিন হল সব দিক দিয়ে কুঁকড়ে যাওয়া ইমানুল্লা হঠাত কোথা থেকে এমনভাবে বলার জোর পেলো? সালমাও কান্না ভুলে অবাক হয়ে তাকায়।
ওসব পলিটিক্যাল কথাবার্তা আমাকে বলে লাভ নেই। আমি নিজে পুলিশের লোক, এমন অনেক দেখেছি। যত মাদ্রাসাগুলোয় মোল্লার দল ছোটবেলা থেকে ব্রেন ওয়াশ করছে আর টেররিস্ট হওয়ার ট্রেনিং দিচ্ছে। রাগ আর অসম্ভব বিতৃষ্ণায় ঠোঁট বেঁকে যায় সুবিমলের।
এবার গায়ের চাদর সরিয়ে পুরোপুরি উঠে বসে ইমানুল্লা। আপনি যে পুলিশের লোক সেটা আমার থেকে আর কে বেশি জানে এস আই সাব? আপনার সাথে জান পহেচান তো ছিল আমার।
পুলিশের বউ হলেও বাড়তি ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না রমা। এসব কথার তোড়ে একটু থতমত খেয়ে গেছিল। তাই ভুল ধরিয়ে দিতে পারল না যে এস আই নয়, তার স্বামী ইন্সপেক্টার, ইন্সপেক্টার ঘোষ ।
থমকে গেছিল সুবিমলও, চেনা চেনা লাগছে যেন। এক ঝটকায় হঠাত মনে পড়ে গেল সুবিমলের। দশ বছর আগের আমেরিকান সেন্টারের কেস। সব মনে পড়ে যাচ্ছে এবারে। এরকম অনেক কেসই হ্যান্ডেল করতে হয়েছে গত দশ বছরে। কিন্তু এ ছিল বড় ঢ্যাট্যাঁ, নাকি সাদাসিধা! কিছুতেই মুখ খোলে নি বলে নয়। সেরকম অনেকই তো ভুলভাল লোক জালে পড়ে, আদতে কিছুতে নেই, তাই জানেও না যে কিছু উগড়াবে। তারাও শেষ মেষ কিছু আনিয়ে বানিয়ে কবুল করে নেয়। কিন্তু এর ভাব ভঙ্গীর মধ্যে একটা গোয়ার্তুমি ছিল, নিজের দেশ নিজের দেশ করে খুব কপচাত বটে। তবে ছেলের সামনে ধোলাই খাবার পরে কেমন গুম মেরে গিয়েছিল লোকটা। পড়ে পড়ে মার খেয়েছে, কিন্তু রা কাড়ে নি। শেষ অবধি যদিও কিছু পাওয়া যায় নি ওর এগেন্সটে। তাই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল বছর দুই বাদে। তবে প্রথম কমাস খুব দুরমুস হয়েছিল লোকটা। সুবিমলের হাতেই তার বেশির ভাগটা। দাপুটে পুলিস অফিসার হিসাবে নাম আছে তার। কিন্তু থানার কাজ থানাতেই রেখে আসা পছন্দ তার। তাই হঠাত এই মোলাকাত পছন্দ হয়নি তার। রমার দিকে আড়চোখে তাকাল একবার। অস্বস্তিটা মাছি তাড়ানর মত নাকের কাছে হাত নেড়ে তাড়াতে চাইল সুবিমল।
সুবিমলের চোখ দেখেই বুঝতে পারল ইমান , যে চিনতে পেরেছে। ইয়াদ হল এবার? মনে করা মুশকিল হবে স্যার, আমার মত আরও কত লোককে বন্দোবস্ত করেছেন। কিন্তু কি গুনাহ করেছিলাম আমি? কোন গুস্তাকির জন্য আমাকে ধরে রাখতে হয়েছিল দু বছর?
অস্বস্তি আরও ছড়িয়ে পড়ছিল সুবিমলের মধ্যে। বুঝতে পারছে কামরার সবকটা চোখ এখন এখানেই। ফাটল ধরা গলায় বলে, খবর নেওয়ার জন্য জেরা করতেই হয় পুলিশকে। খোঁজ খবর না নিলে জানব কি করে কে ভাল , আর কে বদমাশ?
অন্য কারোর হদিশ নেবার ছিল, তো আমার জিন্দেগিটা যে বরবাদ হয়ে গেল সার। আমার বেটার জিন্দেগিটাও যে আপনি নিয়ে নিলেন। ওর টেররিস্ট ট্রেনিং তো মাদ্রাসায় হয়নি স্যার, সেটা দিয়েছেন আপনি। ওর সিনায় আজ যে গুলি ঢুকেছে, সেটা তো দশ সাল আগে আপনার বন্দুক থেকেই বেরিয়েছিল না এস আই সাব?
এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে সালমা। আমার বেটাকে গুলি করে মারল ওরা, খোলা সড়কে পিছন থেকে গুলি মেরে জান নিয়ে নিল ওর।
কাগজে পড়া টেররিস্ট হঠাত খুব কাছে এসে যাওয়ায় পুরো কামরা থমকে গেছিল। রাস্তায় গুলি খাওয়া টেররিস্টকে নিয়ে কথা বলা এক রকম, কিন্তু সামনে বসে থাকা রক্ত মাংসের লোকটার গুলি খাওয়া ছেলেকে নিয়ে কথা বলাটা আলাদা।
ইমানের ধীর গলায় স্তব্ধতা ভাঙ্গে। কামরার স্তব্ধ বাতাসে ওর কথাগুলো যেন কেটে কেটে বসছিল। জান তো ওর অনেকদিন আগেই নিয়ে নিয়েছিলেন আপনি। এস আই সাব, ইয়াদ আছে আমি আপনাকে কত বললাম, কাঁদলাম, পায়ে ধরলাম। বললাম আমাকে যেভাবে মারছেন , মারুন। আমার ছেলেটাকে ডেকে তার সামনে এমন করবেন না। কিন্তু শুনলেন না। আমাকে একেবারে বেয়াব্রু করে দিলেন। বেটার সামনে আমার কি ইজ্জত রইল? দেশের , পুলিশের কি ইজ্জত রইল? ও যে টেররিস্ট হয়ে গেল সেটা কি মাদ্রাসায় করল, ওর মজব করল , না আপনি করলেন এস আই সাব?
কামরার সবার কৌতূহলী চোখের সামনে ডাকাবুকো পুলিশ অফিসার সুবিমল নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছিল। এই মুহূর্তে নিজের উর্দির অভাবটা খুব বোধ করছিল সুবিমল। উর্দি যেন একটা প্রোটেকশন তার।ওটা ছাড়া নিজেকে কেমন ন্যাংটো ন্যাংটো লাগছিল। একটা লুকোনর জায়গা পেলে ভাল হত। কিংবা গন্তব্য এসে গেলে। জানে কোনটাই সম্ভব নয়। কিন্তু সুবিমল ভাবল অন্তত বুড়ুনটা যেন এখুনি ফিরে না আসে, ও যেন এসবের কিচ্ছু শুনতে না পায়।
সাহসি কলম। মনস্তাত্ত্বিক নিপীড়নের কুখ্যাত চিত্র।