এসব কথা আমার বাবা কাকার মুখে শোনা। দেশের বাড়ির গল্প। তবে কিনা, দেশের বাড়িটা এখন অন্য দেশে।
উত্তর পূর্বের যে ছোট শহরে কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমাদের বাড়ি ছিল, এবং মামাবাড়ি এখনো আছে (এর কোনোটাই কিন্তু আমাদের আদি বাড়ি বা মামাবাড়ি নয়, আমার ঠাকুর্দা এবং দাদামশায় পকেচক্রে এসে এই শহরে থেকে গিয়েছিলেন।), সেখান থেকে গাড়িতে করে টিলা-জঙ্গলের রাস্তা ধরে ঘন্টাখানেক গেলে এক প্রাচীন কালীমন্দির আছে। কালীমন্দিরের পেছনে আছে এক দীঘি। দীঘির অন্য পাড়ে কাঁটাতারের বেড়া। তার পর কিছুটা নেই মানুষের জমি- নো ম্যানস ল্যান্ড। তারপর আবার একপ্রস্থ কাঁটাতার। তস্য পেছনে একটা রেলস্টেশন। রেললাইনের একপাশ থেকে একটা শাখা বেরিয়ে এসে নো ম্যানস ল্যান্ড ভেদ করে আমাদের দেশের সীমানায় ঢুকে পড়ে কয়েক গজ এগিয়ে থেমে গেছে। কাঠের স্লিপার উধাও, লোহার পটিগুলো জং ধরে ধরে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
তার পেছনে একটা সাদামাটা দালানে সে দেশের সেনাবাহিনীর অস্থায়ী চৌকি।
সেনাবাহিনী ঘাঁটি গেড়ে বসার আগে ওটা ছিল স্কুল। সেই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন আমার বাবার ঠাকুর্দা, আমার প্রপিতামহ।
এখনো কালেভদ্রে সেদিকে গেলে, আমাদের সীমানার ভেতরে সবচেয়ে উঁচু যে টিলাটা রয়েছে তার ওপর দাঁড়ালে স্কুলটা, মানে সৈন্য ঘাঁটিটা দেখা যায়। আমাদের শহরে কোনো রেললাইন না থাকলেও, গভীর রাতে কান পাতলে পরে আমাদের প্রপিতামহের ভূতপূর্ব স্কুলের পাশ দিয়ে ছুটে চলা রেলগাড়ির গম্ভীর ভোঁ শোনা যায়।
দেশ ভাগের পর যারা সর্বস্ব ছেড়ে ওপার থেকে এসেছিল, আমাদের বাপঠাকুর্দা কিন্তু তাঁদের মধ্যে নেই। এঁরা এসেছিলেন আরো আগে। আমার ঠাকুর্দা ব্রিটিশ আমলে পুলিশে কাজ করতেন। আমাদের ছোট্ট দেশীয় রাজ্যটি যখন স্বাধীন ভারতে যোগ দিল, তখন তিনি এখানে চাকরি নিয়ে আসেন, এখানেই কর্মজীবন শেষ করেন।
তখন আমাদের ছোট শহর যেন নতুন সভ্যতার আলো দেখা আফ্রিকার কোনো গহীন জনপদ। পাহাড় থেকে নেমে আসা দাঁতাল হাতি শহরের রাস্তায় নেমে হুটোপাটি করে, নাম তার গনেশ। আদিবাসী দেবতার পূজার রাত্রে শহরের রাস্তায় কেউ বেরোলে প্রাণদন্ড হয়। রাজার রাজত্ব গেলেও তাঁকে সবাই মহারাজ বলে, তাঁর স্ত্রীকে মহারাণী।
সে যাই হোক, আসল গল্পটা এটা নয়। এরও অনেকটা আগের ঘটনা। আমার বাবা তখন বালক। বাবার ছোটবেলা কেটেছে চা বাগান এলাকায়। দিনদুপুরে বাঘ বেরোয়। সপ্তাহে একবার স্থানীয় ডাক হরকরা ছাতুয়া বুড়ো আসে চিঠি নিয়ে। মোড়ের মাথায় তার তালপাতার তৈরি ছাতাখানা দেখতে পেলে 'চিঠি চিঠি' করে দৌড়ে যাওয়া তখন বাবাদের একমাত্র বিনোদন।
সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশপাশ হবে। আমার ঠাকুর্দা কলকাতায় চাকরি করতে গেলেন। সঙ্গে নিলেন আমার বাবাকে। কলকাতায় পিতাপুত্রের সংসার কিছুটা দাঁড়িয়ে যাবার পর ঠিক করলেন ঠাকুমা আর কাকা পিসিদের নিয়ে যাবেন।
একজন গ্রাম সম্পর্কের দাদু, তাঁর নাম সোনাদাদু কি রাঙাদাদু কিছু একটা হবে, তাঁর ওপর ভার পড়ল বাড়ি দেখেশুনে রাখার।
নির্দিষ্ট দিনে গরুর গাড়িতে রওনা দিলেন ঠাম্মা, বড়কাকু আর পিসিরা। গরুর গাড়ির পেছন পেছন আসছে বড়কাকুদের পোষা কুকুর ভুলু। সেই সকাল থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে, ভুলুর চলার বিরাম নেই।
অবশেষে, যখন রেলগাড়িতে চাপা হল। বড়কাকু ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন, ট্রেনের সঙ্গে দৌড়ের অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছে ভুলু। একটু পরে তাকে আর দেখা গেল না।
বহুদিন পর সেই গ্রাম সম্পর্কের দাদুর কাছ থেকে একটা চিঠি এসেছিল। তাতে বিষয় সম্পত্তির আপডেট ছিল। কুশলপ্রশ্নাদি ছিল।
আর কাঠখোট্টা বৈষয়িক কথাবার্তার শেষে লেখা ছিল "ভুলু আর ফিরা আসে নাই।"
পুরো গল্পটা রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম যদিও ছিন্নমূল মানুষের এমন গল্প শুনেছি জানিও। কিন্তু শেষলাইনটায় কেমন যেন মনটা হু হু করে উঠলো...