আমাদের ছোটবেলায় পাড়ার ধারে কাছে যখনই কোনো পুলিশ আসত তখন আড়াল থেকে দুষ্টু ছেলেদের (মানে যাদের সঙ্গে ভাল ছেলেদের মিশাতে নেই) বলতে শুনতাম “বন্দে মাতরম, পুলিশের মাথাগরম।” দেখাদেখি দুএকবার বলতে গিয়ে মায়ের কাছে প্রবল ধমক খেয়েছি। কারণ, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে- বন্দে মাতরম শুনে পুলিশের মাথা আর গরম হয় না। পরে বড় হয়ে জেনেছি ওটা ছিল স্বদেশী যুগের একটা ‘ব্যাকডেটেড’ রসিকতা। আর স্বাধীন ভারতের বয়েস তখন মাত্র পঁচিশ বছর ছিল কিনা, তাই পরাধীন বাঙালীর ভাষার কিছু লবজ, কিছু রঙ্গরসিকতা, মুদ্রাদোষ সম্ভবতঃ লোকপরম্পরায় টিঁকে গিয়েছিল। সেগুলো পরবর্তীকালে লোপ পেলেও পুলিশের প্রতি আমজনতার বিতৃষ্ণা তখনও রয়ে গিয়েছিল এবং সেই বিতৃষ্ণা এখনও বহাল তবিয়তে বিরাজমান। “কবিকে দেখে টুপিটা তোর খুলিস” থেকে শুরু করে “পুলিস তুমি যতই মারো মাইনে তোমার একশ বারো” তারই প্রমাণ। কার যেন (সম্ববত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখায়) পড়েছি গ্রামের চৌহদ্দি দিয়ে একজন রোগা পুলিশকে পালং শাক কিনে ফিরতে দেখে গ্রামের সব লোক কেমন ভয়ে পালিয়েছিল। মায়ের কাছে শুনেছি, মায়েদের ছোটবেলায় চোরপুলিশ খেললেও দাদুভাইয়ের কাছে বকুনি খেতে হত- দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে, সেই আনন্দে চোরেরা সব চুরি করা ছেড়ে দেয় নি কি? তাহলে এই অবাস্তব খেলার মানে কি? অবশ্য প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসের আগেই স্বাধীন দেশের ভালোমন্দ সম্বন্ধে দাদামশায়ের ধ্যানধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল- সে অন্য গল্প। যেবার মিনিবাস ধাক্কা মেরে আমার গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে দিল, আর থানায় ডায়েরী লেখানোর পর দারোগাবাবু যখন এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিতে বলেন সেবার “পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা” কথাটার সত্যতাও বেশ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম।
মোদ্দা কথা, পুলিশ সম্পর্কে আম ভারতবাসীর মনোভাব সব যুগেই মোটামুটি এক। তবে দেশ/ রাষ্ট্র আর স্বাধীনতা সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা বিভিন্ন জনের বিভিন্নরকম। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
প্রথম উদাহরণঃ আমার পিতামহ- আক্ষরিক অর্থেই ‘আংরেজো কে জামানে কা জেলার’। পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতে আই জি প্রিজনস হয়েছিলেন। ইংরেজ সেনাপতি জেনারেল লর্ড অকিনলেকের সই করা সার্টিফিকেট (‘ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস টু হার ম্যাজেস্টিজ এম্পায়ার’ না কি যেন) যত্ন করে সিন্দুকে রাখতেন। অথচ চরম বৈপরীত্যের পরিচয় দিয়ে, স্বাধীন দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। (আর ঐ লালমুখোদের চাকরি করতে হয় না, আর কাউকে অকারণে জবাবদিহি করতে হয় না)। দেশভাগের কুফল অনেকটাই ভোগ করেছিলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টদের নামে কুকুর পুষতেন। যেমন গোল্ডেন রিট্রিভার ভুট্টোর মৃত্যুর পর ডালমেশিয়ান জিয়া। তবু ভারতীয়ত্ব নিয়ে গর্বিত ছিলেন।
দ্বিতীয় উদাহরণঃ আমার মাতামহ- স্বদেশী যুগে জেল খেটেছেন। স্বদেশী গোলাপজল থেকে স্বদেশী দেশলাই- সমস্ত ধরণের ব্যবসা করতে গিয়ে একাধিকবার সর্বস্বান্ত হয়েছেন। রাগারাগি করে একাধিকবার চাকরি ছেড়ে দিদাকে বিপাকে ফেলেছেন। স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মতানৈক্য হওয়াতে বিরূদ্ধ গোষ্ঠীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হাতে মার খেয়ে স্বয়ং নেতাজীরই হস্তক্ষেপে ছাড়া পেয়েছেন। আগেই বলেছি, স্বাধীন দেশে চুরি ডাকাতি হয় না গোছের রোম্যান্টিক ধ্যানধারণা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার বয়েস চার বছর হতে না হতেই এই স্বাধীনতার অসারত্ব সম্পর্কে যে প্রতীতি জন্মায় তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল।
তৃতীয় উদাহরণঃ কার্গিল যুদ্ধের সময় টিভির খবরে দেখা অজ্ঞাতপরিচয় মিষ্টান্ন শিল্পী যিনি বিশাল কড়ায় জিলিপি ভাজতে ভাজতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলছিলেন “আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছে। ইচ্ছে হচ্ছে আমিও কার্গিল গিয়ে যুদ্ধ করি।”
চতুর্থ উদাহরণঃ বিদেশি ট্যাক্সিওয়ালা যিনি আমাকে জানালেন তাঁর এখনকার দেশ আমেরিকা, ভূতপূর্ব দেশ আজারবাইজান, যেটা আগে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এও জানালেন যে তিনি তাঁর চল্লিশ বছরের জীবনের কোনো না কোনো সময় তিনি এই তিন দেশেরই নাগরিক ছিলেন। এবং যখন যে দেশের নাগরিক থাকেন তখন সেই দেশ নিয়ে গর্বিত হন। এটা আমার কাছে নতুন, কারণ আমার পরিবারে অনেকেই এক জীবনে দুটি বা তিনটি দেশের (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) নাগরিকত্ব ভোগ করেছেন, কিন্তু সব কটা নাগরিকত্বই তাঁদের মনে তিক্ততা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতির সৃষ্টি করে না।
পঞ্চম ও শেষঃ আমার এককালের বন্ধু, সহকর্মী ও গুরু দান্তে কাস্তিলো রামোস। সিঙ্গাপুরের নাগরিক। মেক্সিকান বাবা ও ফিলিপিনো মায়ের সন্তান। জোর গলায় বলে থাকেন তাঁর কোনো দেশ নেই। রবিঠাকুর ছাড়া, আমার জানা একমাত্র বিশ্বনাগরিক।
যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমার জাতীয়তা নিয়ে আমার মনোভাব কি, মুশকিলে পড়ে যাব। স্বাধীনতা সঙ্গ্রামীর নাতি হিসেবে এই দেশ নিয়ে হৃদয়ের খুব গভীরে একটা নরম কোণ আছে। আবার মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে- যে দেশে কার্টুন ফরওয়ার্ড করে জেলে যেতে হয় সেই দেশের মানুষ হওয়াটা আদৌ গর্বের কিনা। কখনো ইচ্ছে করে চতুর্থ বা পঞ্চম উদাহরণটির মত হতে। ছোটবেলায় চাকমা শরণার্থীদের দেখতাম তাড়া খাওয়া পশুর মত সীমান্তের এপার ওপার করতে বাধ্য হতে। সেই স্মৃতির দিকে তাকালে মনে হয় দেশ বা জাতীয়তা এগুলো সব অর্থহীন। এই লেখার শেষ প্যারাগ্রাফ লেখার আগে ভেবে চিনতে দেখছি, যে, দিনের শেষে আমার ভারতীয়ত্ব নিয়ে আমি মোটের ওপর গর্বিত। কতগুলো ঘটনা বা অভিজ্ঞতা আমাকে এরকম ভাবায়। তার কয়েকটা বলি।
ঘটনা একঃ গত বছর যখন রাজ্যে সরকার পালটালো তখন আমাদের গৃহপরিচারিকা মালতীকে তার এক বন্ধু বলল “তোদের দিদি তো মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেল।” মালতী বলল “হবেই তো, আমি ভোট দিয়েছি না?” এই মুহুর্তে ভাবছি, যাক, আমি অন্ততঃ এমন একটা দেশে বড় হয়েছি যেখানে একজন দরিদ্র মানুষ জানে, যে একজনকে মুখ্যমন্ত্রী বানানোর ক্ষমতা তার আছে। এদেশে প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার নেই, স্বাস্থ্য নেই, শিক্ষা নেই, কিন্তু এই ভরসাটুকু আছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই খাদ্য, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এই অধিকারটুকুও তো অনুপস্থিত। অবশ্য আমাদের ভুল বুঝিয়ে এই অধিকারটার অপপ্রয়োগ করানো সহজ, আর তাই আমরা অধিকাংশ সময়ই আমাদের দেখাশোনার ভার অযোগ্য হাতে তুলে দিই- কিন্তু সে গল্প আলাদা।
ঘটনা দুইঃ পার্ক সার্কাসের এক গলির মুখে একটা কার যেন মাজারের সামনে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একজন রিকশাচালক পথের ধারে রিকশা দাঁড় করিয়ে মাজারের ভেতরে গেলেন, যাবার আগে আমার দিকে একবার তাকালেন। একটু পরে বেরিয়ে এলেন একমুঠো কি যেন নিয়ে। এক টুকরো আখ আমার হাতে দিয়ে বললেন “ভগওয়ান কা পরসাদ লে লো বাবুজি।”
আমার মেয়ে সেই দেশে জন্মেছে যেখানে কখনো স্কুলে না যাওয়া একজন মানুষ জানেন, তাঁর আল্লাহ আর আমার ভগবানে কোনো ফারাক নেই। আমার দাদুর জেল খাটা বৃথা যায় নি।