অসম্ভব কাজের চাপ আর প্রবল দুশ্চিন্তা রমেশের শরীর মন আর বহন করতে পারছে না, কদিন ধরেই শরীরটা খারাপ লাগছিল, আজ সকালে আর বিছানা থেকে উঠতেই পারলেন না, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, সাথে যেমনি মাথাব্যথা তেমনি বমি বমিভাব। রোজকার অভ্যেসমত অমলা ভোর ভোর উঠে স্নান সেরে গৃহদেবতাকে ফুল জল দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকেছেন। বেলা ন’টা বেজে গেল এখনও রমেশের কোন সাড়াশব্দ নেই, এত দেরী তো ছুটির দিনেও হয় না! উঠেছেন কিনা দেখতে এসে অমলা দেখেন জ্বরের ঘোরে রমেশের জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে। অনেকবার ডাকলে আস্তে আস্তে ‘উঁ উঁ’ করছেন। গায়ে তো হাত রাখা যাচ্ছে না এত তাপ। ভয়ে অমলার প্রাণ উড়ে গেল। এই মানুষটা সবার অসুখ সারিয়ে বেড়ায়, এখন একে সারাবে কে? তাঁর ভাইরাও কেউ কাছে পিঠে থাকে না, ছোটঠাকুরপোকে ব্যারাকপুরে খবর দিইয়ে আনাতে আনাতে বিকেল তো হবেই। দেওরপোদের খবর দিলে এক্ষুণি আসবে, কিন্তু তারাও হয়ত এতক্ষণে কলেজে বেরিয়ে পড়েছে। একা মেয়েমানুষ তিনি এখন করেন কী? পারুকে আজ একবার স্কুলে যেতে হবে ম্যাট্রিকের অ্যাডমিট কার্ড সংক্রান্ত কিছু কাজ আছে, স্নানে যাবে, বাবার স্নান হয়ে গেছে কিনা দেখতে এসে অমলা’কে অমন হতভম্ব মুখে দাঁড়ানো দেখে ঘরে ঢুকেই বাবাকে দেখে আঁতকে ওঠে পারু, এক পলকের জন্য মনে হয় বাবা কি মারা গেছেন? রমেশকে অত বেলায় অমনভাবে শুয়ে থাকতে কোনোদিন দেখে নি বেচারি। পরক্ষণেই রমেশ আবার ‘উঁ উঁ’ আওয়াজ করতেই মনে মনে জিভ কেটে মা’কে জিগ্যেস করে ‘কী হইছে বাবার?’ অমলা কোনমতে খড়খড়ে শুকনো জিভ নাড়িয়ে বৃত্তান্ত জানান। পারু ব্যস্ত হয়ে নীচে দৌড়ায়, দাদা কোথাও বেরিয়ে যাবার আগেই আটকাতে হবে। দাদাকে নিয়ে উপরে এসে বলে বাবার অফিসে তো ‘টেলিফোন’ নামে এক আশ্চর্য্য যন্ত্র আছে, সেই দিয়ে ছোটকাকার কোর্টে খবর পাঠানো হোক, তাঁরা নিশ্চয়ই জানিয়ে দেবেন, দাদা গিয়ে বাবার অফিসে খবরটা দিয়ে টেলিফোন করে মীর্জাপুর স্ট্রীট চলে যাক, ততক্ষণে পারু আর মা মিলে বাবার মাথা ধুইয়ে দিক।
মেয়ের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে এতক্ষণে অমলাও খানিক স্থির হ’ন। বলেন একটু দূরেই শশী ডাক্তারের ডিস্পেনসারি, অমর প্রথমে গিয়ে তাঁকে কল দিয়ে আনুক, তিনি কী বলেন, ওষুধ কী দেন সেসব শুনে এনে দিয়ে তারপর খবর দিতে যাক বরং। ততক্ষণ ওঁরা দুজনে মাথা ধোয়াবেন, তাতে যদি জ্বরটা একটু নামে। অমর বেরিয়ে গেলে পারুকে পাঠান রান্নাঘরটা একটু সামলে আসতে। শশি ডাক্তার রমেশের বন্ধুস্থানীয়, খবর পেয়ে তাড়াতাড়িই এলেন। থার্মোমিটারে জ্বর উঠল ১০৪, মুখটা একটু গম্ভীর হল ডাক্তারের, বললেন ‘এখন সাতদিন একদম বিছানা থেকে উঠতে দেবেন না, ওষুধ দিচ্ছি, অমর আমার সাথে আসুক নিয়ে আসবে একেবারে। তিনদিনে না কমলে রক্তটা পরীক্ষা করাতে হবে। লিখে দিচ্ছি সব। আর একটু পোস্টাই খাবারদাবার দেবেন বৌঠান, মাংসের স্ট্যু, টেংরির জ্যুস, পাকা পেঁপে এইসব।‘ উমেশকে ফোনে খবর দেওয়া সম্ভব হল না, আজ তিনি কোর্টে আসেন নি। কিন্তু দুপুর আড়াইটে নাগাদ উমেশ যখন নিজেই এসে উপস্থিত হলেন, তখন জানা গেল তাঁর আজ আড়িয়াদহে একটা কাজ ছিল, সেটা শেষ করে এমনিই বড়দার বাড়ি এসেছেন দেখা করতে। এতক্ষণে একদাগ ওষুধ পড়ায় রমেশ একটু একটু চোখ খুলে তাকাচ্ছেন, চিঁ চিঁ করে বললেন ‘ব’ একটু তর লগে কথা আসে।’ অমলা কিছু টা নিশ্চিন্ত বোধ করেন, অমর আসে নি এখনো হয়ত প্রভাসদের সাথে করেই আসবে। ছেলের আক্কেল দেখে মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেন অমলা, বাপের এতখানি অসুখ, ছেলে কোথায় খবর রেখে চটপট বাড়ি ফিরে আসবে, যদি কোন দরকার লাগে! তা না উনি সেই মেসবাড়িতে গিয়ে বসে আছেন, কে জানে অন্য কোথাও গেছে কিনা। ছোটঠাকুরপো যে এমন হঠাৎ চলে আসবে তা তো আর অমর জানত না! সাধে আর রমেশ ওকে ভাদাইম্যা বলেন। উমেশকে রুগীর পাশে বসিয়ে অমলা পারুকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যান, ভর দুপুরবেলা এসেছে দেওর, যা হোক দুটো ডালভাত ঝোলভাত তো মুখে দিক। ঊমেশ লক্ষ করে বড়দা আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন, চোখের নীচে গভীর কালি তাঁর। ভাবেন সেজদার সম্বন্ধে যে খবরটা শুনেছেন সেটা হয়ত সত্যি তাহলে। মেজদাই বা কেমন আছে কে জানে।
মীর্জাপুর স্ট্রীট থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যেই প্রভাস আর সুহাস এসে গেল, ভানুর একটু দেরী হবে, পরীক্ষা এবার সে দেবেই আর গোটা ফেব্রুয়ারী মাস কলকাতা জুড়ে ঝামেলা চলেছে, ফলে লাইব্রেরী যাওয়া সম্ভব হয় নি। ফেব্রুয়ারীর শুরুতে শিক্ষামত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এসে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীকে ভারতের ‘জাতীয় গ্রন্থাগার’ ঘোষণা করে উদ্বোধন করে গেছেন, তারপর থেকেই এমন মারদাঙ্গা শুরু হল যে আর অতদূরে সেই বেলভেডিয়ারে যাওয়া সম্ভব হয় নি। ভানু ফিরলেই ম্যানেজারবাবু বলে দেবেন। এখন রাস্তাঘাটের অবস্থা স্বাভাবিক , রাত হলেও আসতে অসুবিধে হবে না। ফাল্গুনের বেলা একটু বড়ও হয়েছে, উমেশও সন্ধ্যে করেই বেরোবেন, ফিরতে তাঁকে হবেই ওদিকে পরিবার রয়েছে। কাল দিনটা বাদ দিয়ে পরশু আবার আসবেন, অমলা বলেন সবাইকে নিয়েই আসতে তাহলে দরকার হলে থেকে যেতে পারবেন। উমেশ ইতস্তত করেন, অসুখের বাড়িতে এতগুলো লোক এসে ওঠা একটু কেমন যেন লাগে। অমলা খুলেই বলেন, পারুর এবার ম্যাট্রিকের বছর, বারবার ওকে রান্নাঘর দেখতে হলে পড়বে কখন বেচারি? আর মাথাও তেমন পরিস্কার নয় ওর, ছোটজা এলে তাঁর নিজের একটু সুরাহা হয়। উমেশ এবার বুঝে সম্মত হন। জেলার সায়েব খবর পাঠিয়েছেন দু’একদিনের মধ্যেই দেখতে আসবেন রমেশকে। ভাইপোদের সাথে কথা বলে উমেশ বোঝেন কিশোরগঞ্জের কোন খবরই ওরা পায় নি তা প্রায় মাস দুই হল। সুহাস বলে সেই উল্টোডিঙি থেকে গোলমাল ছড়ানোর পরে শহরে মিলিটারি নামার গল্প, ‘দরজার কড়াডি বুঝলা ছুডুকাকা মনে অইতাসিল খুইল্যা আইবো, ম্যাঞ্জারবাবু তো কিসুতেই খুইলবার দিবাইন না, আরে না দিলই কি বাঁইচতা?’ পারু ভীতমুখে বলে ‘তরা কিতা করলি?’ প্রভাস বলে ‘আরে গোবিন্দবাবু আছুইন না, উনিই গিয়া খুইল্যা, কথা বইল্যা আইয়্যা কইলেন বাড়ি থেইক্যা না বাইরানির কথা’। সুহাস আবার বলে ‘হ বিমলের দিল্লি যাইবার কথা আছিল, চাউকরির পরীক্ষা দিবার লাইগ্যা, তা হাওড়া অবধি গ্যাসে প্রাণডি হাতে লইয়্যা, ওইদিকে ট্রেন তো আসেও নাই, ছাড়েও নাই। কত ঝকমারি কইর্যা ফিরছে।‘ উমেশ বলেন ‘হ আসানসোল থেইক্যা দিল্লি মেল ঘুরাইয়্যা দিসে, শুরুত দুই একদিন ঘুইর্যা ঘুইর্যা শিয়ালদা আইছিল, তা বর্ধমানের অইদিকে ট্রেনে উইঠ্যা কাইট্যা থুইতাছে, মুসলাগো যাইতে দিবো না অইপারে --- সরকার থেইক্যা তাই আসানসোলেই ট্রেন থামাইয়া দিসে। কয়দিন অইহান থেইক্যাই আপ ডাউন চলছে।‘ বলতে বলতে সেজদার নামে শোনা খবরটা মনে পড়ায় একদম চুপ হয়ে যান উমেশ, উপস্থিত কজনও।
আজ পাঁচ দিন পর রমেশ উঠে বসেছেন, দুপুরে সুরুয়াটুকু নিজেই চুমুক দিয়ে খেয়েছেন, নিজে হেঁটে বাথরুমেও গেছেন। রক্ত পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছে কাল, আজ বিকেলে অমর গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে শশী ডাক্তারকে একেবারে দেখিয়ে আসবে কথা আছে। গতকাল জ্বর ছিলই না প্রায় সারাদিনে, উমেশ তাই সকালে বারাকপুরে কোর্টে গিয়েছিলেন মোকদ্দমাগুলোর কি অবস্থা জানোতে। আজও আড়াইটে নাগাদ এসে গেলেন, যাবেন তিনি অমরেশের সাথে। মেজদা সেই কোথায় ‘বিদেশে’ পড়ে আছে, মাথার উপর এই বড়দাই ভরসা। সবচেয়ে ছোট উমেশ বরাবরই তাঁর দাদাদের ছায়ায় ছায়ায় নিশ্চিন্তে বড় হয়েছেন, গায়ে আঁচটুকু লাগে নি। এখন হঠাৎ করেই যেন বড় বেশী জীবনের তাপ লাগছে, তাই এই ছায়াটুকু অক্ষত রাখার চেষ্টা। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন ভয়ের কিছু নেই, রক্ত কম আছে, তা সে ভাল করে খাওয়া দাওয়া করলে ঠিক হয়ে যাবেখনে, অন্য কোন বড় অসুখ বিসুখ নেই। যাক নিশ্চিন্ত। ওঁরা বাড়ি এসে দেখলেন তিন ভাইপোও ততক্ষণে এসে গেছে, এরাও কদিন সমানে মেস আর জ্যাঠার বাড়ি করেছে, বিশেষত ভানু, তাকে বড়জ্যাঠার পাশ থেকে ওঠানোই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ বেশ কদিন পরে বাড়িতে একটু হালকা আবহাওয়া, বেচারি পারুকে শুধু কোণের ঘরে বই মুখে বসে থাকতে হচ্ছে। সন্ধ্যের শাঁখ বাজার সময় রমেশ উঠে বিছানাতেই কখানা বালিশ পিঠে নিয়ে বসেছিলেন, আধাঘন্টা বসে আনন্দবাজার পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে মাথা ঝিমঝিম করায় আবার শুয়ে পড়েছিলেন। অমলারা দুই জা’য়ে রাতের খাবার ব্যবস্থা করে এসে বসতে আবার উঠে বসলেন। পারু বাদে বাকী সবাই আবার গুটি গুটি শোবার ঘরে জড়ো হল। গলায় এখনও আগের জোর আসে নি, তাও যতটা সম্ভব জোর দিয়ে রমেশ বলেন ‘আমার একটা কথা কওনের আছে, যদি আমার কিছু হইয়া যায়, এই কথা তাইলে হয়ত তুমরা জাইনতেও পারতা না।‘ সবাই উৎকন্ঠা নিয়ে তাকায় ওঁর দিকে।
রমেশ ভাল করে দম নিয়ে আস্তে আস্তে বলেন ‘আকরাম আলি আছিলেন আমার রুগী, সিঁথির মোড়ে যে ডিস্পেন্সারিতে আমি বসি সপ্তাহে দুইদিন, হেইখানো দেখাইতে আসতেন উনার প্যাডের ব্যাদনা লইয়া। আমার ঔষধে ভাল হইয়্যা গেসলাইন, হ্যার লাইগ্যা আমারে বড় মানেন তিনি। তুমরা জানো আমি তিনারে প্রপার্টি এক্সচেঞ্জের লাইগ্যা দ্যাশো পাডাইসিলাম। তাঁর লগে আরো একজন গেছিলেন, তিনারও এদিকে কিছু জমিজিরাত আছে যেইটা বদলাবদলি কইরতে চান।‘ ভানু নড়েচড়ে বসে, ওর কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে যেন, বাবার সেই রাগত মুখ --- তাহলে কি ওইদিকে কিছু অঘটন ঘটল? রমেশ ওদিকে বলে চলেছেন যোগেশ আকরাম আলিকে একবারে বারণ করে দিয়েছিলেন প্রভাসদের সামনেই, দেশ্ তিনি ছাড়বেন না। আকরাম আলি তারপর আর মনীশের কাছে যান নি, দেশ তো তিনিও ছাড়তে চান নি, যোগেশের কথা তিনি বোঝেন বৈকী। অন্য ভদ্রলোকটিকে মনীশের কাছে পাঠিয়ে তিনি ঢাকায় চলে যান। বিক্রমপুরের দিকে তিনি কিছুটা জমি পেয়ে যান, সেখানেই থাকবেন মনস্থ করেন। এর পরেও এদেশে এসেছেন, তখন রমেশের সাথে দেখা করে বলে গেছেন সবই। কিন্তু মনীশ যে অন্য লোকটিকে কী বলেছিলেন তা জানা নেই, মনীশ নিজে কাউকেই জানান নি, সে ভদ্রলোক জঙ্গলবাড়িতেই বাস শুরু করেন। এরপরে, বলতে গিয়ে রমেশ থেমে যান, প্রভাস দেখে উমেশ মুখ নীচু করে বসে আছেন, ‘তার মানে ছুডুকাকাও জানেন কিছু একটা’যা ওরা জানে না। ওর বুক ধড়াস ধড়াস করতে থাকে, চোরাচোখে ভাইদের দিকে তাকায়, সবাই একদৃষ্টিতে রমেশের দিকে তাকিয়ে আছে, ‘তারপর কী’ জিগ্যেস করার সাহসটুকুও নেই কারো। রমেশ থেমে থেমে খুব কষ্ট করে বলেন সেই লোকটি মনীশকে প্রথমে তাঁর দুই কন্যাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেয়, মনীশের বড় মেয়েটিই যুঁইয়ের চেয়েও ছয় বছরের ছোট, বিবাহ প্রস্তাব নাকচ হবার পর মনীশকে নাকি ধর্মান্তরিত হবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। মনীশ কী উত্তর দিয়েছিলেন, আবারও তা কেউই জানে না। ফেব্রুয়ারীর সেই ভয়ানক দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি কুমিল্লা গিয়েছিলেন, সেখান থেকে বর্ডার পেরিয়ে ত্রিপুরা চলে আসাই উচিৎ ছিল। কিন্তু তিনি একা গিয়েছিলেন তাই গোলমাল লাগতেই জঙ্গলবাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করেন, সেই ট্রেন ভৈরব ব্রীজের উপরে উঠার পর --- আর কিছু বলতে পারেন না জোরে শব্দ করে কেঁদে ওঠেন রমেশ। প্রভাসের কেবল মনে হয় বয়স্ক পুরুষ কাঁদলে এরকম বিশ্রি শোনায় তাহলে!
ঝুনু আজ তিনমাস সন্তানসম্ভবা। কলকাতার সংসার এখন ওরই উপর, শাশুড়ি চম্পাহাটিতেই, এখানে আসার শিগগির কোন সম্ভাবনা নেই। সরস্বতীপুজোর দিনে যখন প্রথম জানল ও মা হতে চলেছে, কেমন যে অদ্ভুত লেগেছিল! একবার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে খুব মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে! যাহ ওর আর গড়ের মাঠে বসে পা ছড়িয়ে যত খুশি বাদাম খাওয়া হল না! গোপুকে এই দুঃখের কথা বলায় তার কী হাসি, ‘কেন বৌদি আমরা সবাই যাব, তোমার ট্যাঁ’টাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে, তারপর সবাই মিলে বাদাম খাব।‘ ধুস কী যে বলে! ‘মা’ হলে আর ওরকম হুটহাট এদিক ওদিক যাওয়া যায় না। ঝুনুর মা তাঁর নিজের বাপের বাড়িতেই ক’বার যান? অন্য কোথাও তো যানই না। এই তো এত কাছে আছে ঝুনু, বাবা আসেন, খোকন আসে কতবার, এমনকি টুনুকেও নিয়ে এসেছেন দু’একবার। কিন্তু মা? নাহ একবারও আসেন নি। ঝুনুরাই যায়। আর গড়ের মাঠে তো ভাবাই যায় না, ঝুনুর ধারণা সেখানে শুধু পুরুষরাই বেড়াতে যায়। ছোটমামা অবশ্য বলে অনেক বড়লোক মেয়ে বৌ’রা নাকি মটরগাড়িতে করে হাওয়া খেতে আসে বিকেলবেলা। তারা আবার ফেরিওলার থেকে বাদাম, ঘুগনিদানা এইসব কিনেও খায়। আহা গড়ের মাঠে কি ভাল চিনেবাদামমাখা পাওয়া যায়। খোকন একবার ছোটমামার সাথে খেলা দেখতে গিয়ে কিনে নিয়ে এসেছিল। ঝুনু আবার তার থেকে একটু টুনুকেও দিয়েছিল। চিনেবাদাম তো এমনিতেই খেতে কত ভাল, তাতে আবার নুন, আমচুর আরো কিসব দিয়ে মেখে দিয়েছিল। উললসস। মনে পড়লেই মুখ জলে ভরে যায়। সেই থেকেই ঝুনুর সাধ ছিল বড় হলে যখন ওর অনেক পয়সা হবে, তখন অনেক চিনেবাদাম খাবে। গড়ের মাঠে গিয়ে ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে কটাশ কটাশ করে খোসা ভেঙ্গে ভেঙ্গে খাবে। খোকন বলে গড়ের মাঠে তো অনেক ঘাস – তার কেমন একটা গন্ধ আছে, ভারি অন্যরকম গন্ধ। ওদের চম্পাহাটির বাড়ির বাগান আর তরকারি খেতের গন্ধের সাথে নাকি কোন মিল নেই। কে জানে কেমন সে গন্ধ!
হঠাৎ খেয়াল হয় ঝুনু সেই থেকে খালি খাবার কথা ভাবছে। লজ্জা পেয়ে মাথার কাপড়টা ভাল করে টেনে দেয়, ওদের দুই ভাইয়ের আসতে এখনও খানিক দেরি আছে, চত্তির মাসের বেলা পড়ে আসছে এই বেলা রাতের তরকারি করে ডালটা ফোড়ন দিয়ে রাখবে বলে রান্নাঘরে যায় ঝুনু। এত অসুখে পড়ল ওরা, এখন যাই সেরে উঠছে। পয়লা বৈশাখে নেমন্তন্ন করে গেছে বাবা চম্পাহাটির বাড়িতেও হাতচিঠি পাঠিয়েছে উপেনের হাত দিয়ে, তবে কেউই আসতে পারবেন না তা বাবাও জানে, উপেনও বলেই দিয়েছে, ‘আপনি দিয়েছেন বাবা আমি নিশ্চয় পৌঁছে দেব, তবে আসতে বলার কথা মা’কে আমি বলতে পারব না, আপনিও বুঝবেন নিশ্চয়ই’। বাবা অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলে মাথা নেড়ে চলে যায়। ঝুনুর মনে পড়ে যায় রুনুর সাধের দিন গোপুর সেই একলা যাওয়া, তখনও ওরা জানত না কি বিপর্যয় অপেক্ষা করে আছে ওদের জীবনে। বোনেদের সাথে দুটো দিন কাটিয়ে ঝুনু এবাড়ি এসে শোনে বিক্রমপুর থেকে খবর এসেছে সেদিকে নাকি খুব ঝামেলা লেগেছে, এর মধ্যে ওঁদের অবশিষ্ট জমিটুকু বিক্রি করার চেষ্টা করাতে জেঠশ্বশুরকে কারা নাকি হুমকি দিয়ে গেছে, এই দন্ডেই এসব ছেড়ে না গেলে আর জ্যান্ত ফিরতে পারবেন না। সেই থেকে শ্বশুররা আর রাতে ওঁদের ভিটেয় থাকতে পারছেন না, পালিয়ে পালিয়ে জমির কাজ যারা করত তাদেরই বাড়িতে আত্মগোপন করে আছেন – ফিরতেও পারছেন না রাস্তায় আক্রান্ত হবার ভয়ে। পাশের গ্রামের একজনা এপারে এসে ঠিকানা খুঁজে খবর দিয়ে গেছে। তারপর দিন কুড়ি আর খবর নেই, তারপর এলো সেই কালান্তক দিন, খুড়শ্বশুর একলা ফিরলেন। তিনি লুঙ্গি পরে পায়ে হেঁটে কুমিল্লা দিয়ে ত্রিপুরায় ঢুকে এসেছেন। শ্বশুর আর জেঠশ্বশুর কলকাতাগামী ডাউন ঢাকা মেল ধরেছিলেন, ফেব্রুয়ারীর এগারো কি বারো, ঠিক তারিখ খুড়শ্বশুর জানেন না, তিনি তার আগেই বেরিয়ে গেছেন। সে ট্রেন তো আর একটিও জীবিত মানুষ নিয়ে আসতে পারে নি, আর ওঁদের কাছে লুঙ্গিও ছিল না।
রুনুর এবারেও একটি মেয়েই হয়েছে, জামাইয়ের অবশ্য সে নিয়ে কোনও দুঃখ বা ক্ষোভ আছে বলে মনে হয় নি। প্রমদাও বেশ খুশি হয়েই বলেছেন যাই হোক সুস্থ হলেই হল, আর কপালে থাকলে ঐ এক ছেলেই রুনুর রাজা হবেখনে। সরলার মনটা কেবল খুঁতখুঁত করে, তিন তিনখানা মেয়ে রুনুর পার করতে হবে। আর প্রমদাও নিজের নাতনির বেলায় বেশ দরাজ, অথচ টুনুকে কী চোখে দেখেছিলেন, দেখেন এখনও তা তো সরলার আর বুঝতে বাকি নেই। সাধে কি আর মা বলেন ‘আসলের চেয়ে সুদ মিষ্টি’। ঝুনু বলে ‘রুনুর ছোট খুকীটা কি যে মিষ্টি হয়েছে দেখতে! একেবারে পদ্মফুলের মত মুখখানা।‘ চৈত্রমাস পড়বার ঠিক আগ দিয়ে রুনুকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন ভেবেছিলেন, তা মাঘ থেকেই কলকাতা জুড়ে এমন গোলমাল শুরু হল যে ফাল্গুন পড়বার পরেও ঠিক ভরসা করতে পারছিলেন না, সেই করতে করতেই ফাল্গুনের শেষ দিয়ে হাওড়ায় ভীষণ ঝামেলা শুরু হল, সে তো চলল চত্তিরের শুরু অবধি, শিবপুর, ব্যাঁটরা, মালিপাঁচঘড়ার দিকে নাকি মিলিটারি নেমে সব পিটিয়ে তবে ঠান্ডা করে। সেইসময় রুনুটা আবার কী যে এক জ্বরে পড়ল, সে সাতদিন মেয়ের কোন হুঁশই নেই। তারপর দেখো এই বুড়ো বয়সে মেয়ের সারা গা জুড়ে হাম বেরোল। দেখতে দেখতে প্রথমে তিনমাসের খুকীটার পরে মেজমেয়ে আর ছেলেরও হাম হল। অথচ আশ্চর্য্য টুনু বা খোকনের কিছু হয় নি। ভাগ্যিস। এতগুলো ছোঁয়াচে রুগী নিয়ে কী যে আতান্তরেই পড়েছিলেন সরলা। সবচেয়ে বড় কথা বাচ্চা হতে এসে বাপের বাড়িতে শিশুর কিছু অঘটন ঘটে গেলে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের কী হাল হত কে জানে! বড়জামাইকে মেয়ে তাঁর যমের মতন ভয় পায়, দেখেছেন তিনি। জামাই তেমন একটা আসেও না, সেই সাধের দিনে একবার আর বাচ্চা হবার পরে দুবার, ব্যাসস। ঐ দেওরই নিয়মিত এসে খবরাখবর নিয়ে যায়। তা সেসব সারতে সারতে চত্তিরমাস পড়েই গেল তখন আর সদ্যপ্রসূতিকে পাঠানো যায় না। এই পয়লা বৈশাখটা মিটে গেলে জামাই এসে নিয়ে যাবে কথা হয়ে আছে। ডাক্তার বলে গেছেন একটু করে ঘিয়েভাজা লুচি পরোটা দিতে রুনুকে আর কোলের শিশুটি ছাড়া বাকি রুগীদেরও, সরলা তাই এইমাসে বড় একটিন ডালডা আনিয়েছেন, এমনিতে গাঢ় হলুদ রঙে সবুজ নারকেলগাছ আঁকা কৌটোয় ভরা ডালডা জিনিষটা তাঁর বেশ পছন্দের, গন্ধটা এত সুন্দর! কোথায় লাগে ঘিয়ের গন্ধ। এছাড়া লুচি বা ভাজা মিষ্টির স্বাদও বেশ ভাল হয় ডালডায় ভাজলে। সরলা টুনুকে ডেকে নেন, আজ কখানা লবঙ্গলতিকা বানাবেন সবার জন্য।
পয়লা বৈশাখ রবিবারে হওয়ায় রুনুর শ্বশুরবাড়ি থেকে দুদিন আগেই প্রমদার অফিসে খবর পাঠিয়েছে জামাইরা সেদিনই এসে রুনুদের বাড়ি নিয়ে যাবে। নাহলে আবার এক সপ্তাহ দেরি, তার মাঝে আবার ঝামেলা শুরু হয়ে গেলে কতদিনে থামবে কেউ জানে না। রুনু যাওয়ার পর ওরা আর একটা বাড়িতে ভাড়া উঠে যাবে, এখন আছে একতলায়, এইবারে একটা তিনতলাবাড়ির দোতলায় ভাড়া পেয়েছে, সে ভাড়াও নাকি নামমাত্র। পয়লা বৈশাখের দুপুরে জামাই এসেছে, খাওয়ার ব্যবস্থা ভালই রাখতে হয়েছে। সবার শেষে মাংস একটু কমই পড়ে, যতটুকু শেষ অবধি ছিল টুনু আর খোকনকে ভাগ করে দিয়ে দেন সরলা, থাক তিনি অমনিই ধোঁকার ডালনা আর নতুন এঁচোড় উঠেছে, এনেছিলেন প্রমদা, তারই ডালনা দিয়ে খেয়ে নেবেন। মাংস এখন ছয়মাসে একদিন হয় কিনা সন্দেহ, ছেলেমেয়েরা এত ভালবাসে, খাক ওরা। খাওয়া দাওয়ার পর প্রমদা ছোটশালা, বড়জামাই আর তার ভাইকে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরে বসলেন। আজ সরলার ছোটভাইও দুটো ভাত খেল এখানে, সেই ঝুনুর বিয়ের পর এই। কলকাতা শহরে এই এক ছাদের নীচে সব, সেখানে আর বাইরের ভিতরের কি, তবু অভ্যাসবশত সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথম ঘরটাকেই বাইরের ঘর বলেন, বাইরের লোক এলে ওখানেই বসান এই আর কি। টুনু একটা ছোট কাঁসার রেকাবে করে জোয়ান মৌরী ধনের চাল ভাজা রেখে গেল। প্রমদা এটা সেটা কথা শুরু করেন, জামাইয়ের কাজ কর্ম সম্পর্কে বেশি প্রশ্ন সে পছন্দ করে না, বরাবরি দেখেছেন, তাই শিবপুরের এখনকার অবস্থা জিগ্যেস করেন। এই দিন পনেরো আগেও তো দিনরাত কার্ফ্যু, মার্শাল ল’ চালু ছিল। জামাই জানায় হ্যাঁ খুবই চাপ গেছে গত দুই মাস, দিন নেই রাত নেই যখন তখন গন্ডগোলের খবর আসছে আর ফোর্স নিয়ে দৌড়াও। আর ব্যাটাদের হাতে আজকাল এমন সব আগ্নেয়াস্ত্র থাকে, কখন ফটাশ করে চালিয়ে দেয়। এই তো বালির ওদিকে ট্রেনে হামলা হচ্ছিল থামাতে গিয়ে বড়বাবু পেটে গুলি খেয়ে গেলেন, এখনও সেলাই কাটে নি তাঁর। প্রমদা মনে মনে ষাট ষাট করে ওঠেন ‘আহা বড্ড বিপদের চাকরি বাবাজির।’
জামাই আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসে বলে ‘যাক এলাকা থেকে প্রায় সবকটাকে ভাগানো গেছে। শয়তানের ছাওয়ালগুলো, পুড়িয়ে মারতে পারলে শান্তি হত!‘ প্রমদা ঠিক না খেয়াল করেই বলেন ‘হ্যাঁ যত গুন্ডা সব জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছে মনে হয়।‘ জামাই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, ‘না না আপনি জানেন না বাবা এই শেখের ব্যাটারা শয়তানের ছাওয়াল সব, আমাদের কটা ছিঁচকে চোরের সাধ্য কি ওদের মত হিংস্র জানোয়ার হয়? দ্যাখেননি ওদের দেশে ওরা কী করছে? যাক দূর হয়ে যাক ওরা নিজেদের জায়গায়।‘ প্রমদা থতিয়ে যান – জামাইরা তো আজ পঁচিশ ত্রিশ বচ্ছর হাওড়াতেই থিতু, তাঁর জানা মতে ওদের তো কিছু ক্ষতি হয় নি! রুনুর দেওর এইসময় বলে ‘হ্যাঁ তাওইমশাই, এত যে লোক আসছে, তারা থাকবে কোথায় এরা না গেলে? মোচলারা দুইদিকেই জামাই আদরে থাকবে কেন?’ প্রমদা কী যেন বলতে গিয়েও থেমে যান। এই কথাটা অফিসেও শুনেছেন অনেকবার। কিইবা বলবেন বুঝতে পারেন না, অস্পষ্ট একটা অস্বস্তি হয় খালি। পরিস্থিতি হালকা করতে ছোটশালা বলে ‘তা বাবাজি নতুন বাড়ি যেটায় যাবে, তার মালিক কি সেই বাড়িতেই থাকেন? জলটলের ব্যবস্থা কেমন? টাইমকল আর গঙ্গার জল দুইই পাবে তো?’ দেওরই আগ বাড়িয়ে বলে ‘মালিক আর কোথায়? সে বহুতদূর এখন, থাকুক শান্তিতে সেখানে। এই আমরাই তিনটে ফ্যামিলি ভাগযোগ করে তিন তলায় থাকবো, তা ধরেন গিয়ে খাতায় কলমে এক্ষুণি না হলেও ও বাড়ি আমাদেরই হল আর কি। ছোটনাতনি আপনার, সাক্ষাৎ লক্ষ্মী, আসতে না আসতেই বাপকাকার আয়পয় বেড়ে গেছে।‘ দুই ভাই মিচকি মিচকি হাসে। কিছু একটা যেন বুঝেও বুঝতে পারেন না প্রমদা, স্পষ্ট জিগ্যেস করতে ভয় করে তাঁর, শীতও লাগে যেন, কাঁপুনি দেয় গায়ে।