এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ভোটবাক্স  বিধানসভা-২০২১  ইলেকশন

  • সাদায়-কালোয়

    স্বাতী রায়
    ভোটবাক্স | বিধানসভা-২০২১ | ০৫ এপ্রিল ২০২১ | ২৭৭৭ বার পঠিত
  • কালোটাকার ধুয়ো তুলে কদিন আগেই নোটবন্দি হয়েছে। তার পরে তিনমাসও হয় নি। ২০১৭-র ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট বক্তৃতা চলছে। ভরা সংসদে অরুণ জেটলি বললেন, one of the main priorities of our Government is to eliminate the black money component from the economy. নির্বাচনী তহবিলের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার জন্য সরকার শীঘ্রই ইলেকটোরাল বন্ড বাজারে আনবে। সরকারি মতে, এর ফলে কে কত টাকার বন্ড কিনছে, সেটা তাদের ব্যালান্স শিটেই থাকব। আর কে মোট কত টাকা পেল সেটাও তাদের নির্বাচন কমিশনের কাছে হিসাব দাখিল করতে হবে। শুধু কে কাকে কত টাকা দিল সেই হিসেবটা জানা যাবে না। এই বাজেটেই সরকার নগদে দেওয়া অনুদানের সীমা ২০০০ টাকায় বেঁধে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে সরকারপক্ষের আশা যে রাজনৈতিক তহবিলের শুদ্ধতা অনেকাংশে বাড়বে।

    এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকল্প ঘোষণা হল। ইলেকটোরাল বন্ড অনেকটা বেয়ারার চেকের মত, শুধু তাতে কে পেল বা কে দিল তা লেখা থাকে না। এর মারফতে

    ১) একজন ভারতীয় নাগরিক বা ভারতে রেজিস্টার্ড যে কোন বেসরকারি কোম্পানি কেওয়াইসি প্রমাণ সহ চেক বা অনলাইন ফান্ড ট্রান্সফারের মারফত বন্ড কিনতে পারবেন।
    ২) সেই বন্ড দিতে পারবেন যে কোন রেজিস্টার্ড রাজনৈতিক দলকে, একটাই শর্ত যে সেই দলকে বিগত সাধারণ নির্বাচনে ১ শতাংশের উপর ভোট পেয়ে থাকতে হবে। প্রাপক নিজের একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টের মারফত সেই বন্ড ভাঙাতে পারবেন।
    ৩) যত টাকার খুশি বন্ড কেনা যাবে – ব্যক্তি বা কোম্পানি কোন বাবদেই কোন উর্ধ্বসীমা আর রইল না।
    ৪) কেনার পনের দিনের মধ্যে বন্ড ভাঙাতে হবে। যে মূল্যের বন্ড পনের দিনের মধ্যে ভাঙানো হবে না, সেই পরিমাণ অর্থ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে চলে যাবে।
    ৫) বন্ড বিক্রির দায়িত্ব শুধু স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার হাতে। বিক্রি হবে জানুয়ারি, এপ্রিল, জুলাই আর অক্টোবর মাসে। দশ দিন করে প্রতি ত্রৈমাসিকে। নির্বাচনের বছরে আরও তিরিশ দিন বেশি বিক্রি করা হবে।

    এত কাণ্ড সবটাই কেবল টেবলের নিচের কালোটাকার হাতবদলের সমস্যার সমাধানে। ভারতের নির্বাচনে কালোটাকা যে ব্যবহার হয় তা আমরা সবাই অনুমান করতে পারি, কিন্তু এই সমস্যার গভীরতা কত? সেটা ঠিকমত বুঝতে হলে একটু ইতিহাসে চোখ বোলাতে হবে।

    স্বাধীনতারও আগে, ১৯৪৩ সালে, আম্বেদকর, মহাত্মা গান্ধী আর জিন্না সম্বন্ধে বলেছিলেন, “In establishing their supremacy they have taken the aid of “big business” and money magnates. For the first time in our country, money is taking the field as an organized player. “ সেই সময়ের থেকে টাকার দাম, রাজনীতির ক্ষেত্রে, কমে তো নিই, বরং বেড়েছে। আর ভোটযুদ্ধের বাজারে তো প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের সঙ্গে টাকার গভীর যোগ। যত বেশি টাকা, তত প্রার্থীর দৃশ্যমানতা বেশি, তত জেতার সম্ভাবনা বেশি। এদেশে যদিও নির্বাচন কমিশন খরচের উর্ধ্বসীমা বেঁধে দেন, কিন্তু বাস্তবে কী হয় সেটা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলেন বিজেপি নেতা গোপীনাথ মুন্ডে। ইন্ডিয়া টুডের খবর অনুসারে, ২০১৩ সালে তিনি প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন যে ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে তার খরচ হয়েছিল মাত্র ৯০০০ টাকা আর ২০০৯ সালের নির্বাচনে তাঁর কেন্দ্রে তিনি ৮ কোটি টাকা খরচ করেছিলেন। আলোড়ন উঠেছিল তাঁর এই কথায়। ২০০৯ সালে তাঁর কেন্দ্রে খরচের উর্ধ্বসীমা ছিল ২৫ লাখ টাকা। মজা এই যে, নির্বাচনী কমিশনের কাছে মুন্ডের খরচের যে হিসেব জমা দেওয়া হয়েছিল, তাতে তাঁর নির্বাচনী খরচ বলা হয়েছিল মাত্র ১৯ লাখ টাকা। তাহলে? এই ৮ কোটির মধ্যে সাদা কালোর মিশেল ঠিক কত? কতটা তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদের থেকে আসা আর কতটাই বা অন্য লোকের ( পড়ুন শিল্প/ ব্যবসার থেকে ) দান? জানা নেই।

    তবে দাখিল হওয়া হিসেব আর বাস্তবের হিসেবের মধ্যে ফাঁকটা বড়। পুরো দেশের কথা হিসেবে আনলে সে এক ভয়ানক গরমিল। এত বিপুল টাকার জোগান দেয় মুলত বিভিন্ন শিল্প। শিল্পমহলের ঘাড়ে যখন এই ব্যয়ভার বহনের আংশিক বা সম্পুর্ণ দায় চাপে তখন তো সেও বিনিময়ে কিছু চাইবে। কখনও সেটা বিভিন্ন চুক্তিতে তার প্রতি পক্ষপাতের আবদার, কখনও তার কোলে ঝোল টেনে কোন বিধির শিথিলিকরণ বা তার সুবিধা করে দিতে কোন নতুন বিধি আনা ইত্যাদি ইত্যাদি। যে গরু দুধ দেয়, তাকে তো আর নিরাশ করা যায় না! আর এত টাকার পুরোটাই সাদা পথে আসে শুনলে বোধহয় ‘ঘুড়ায়ও হাসব’।

    কৃষ্ণধনের সঙ্গে রাজনীতির গভীর আঁতাত অবশ্য নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার আগেও ছিল। স্বাধীনতার পরে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৯ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্পোরেট অনুদান নেওয়া বেআইনি ঘোষণা করে সমস্যা আরও বাড়িয়েছিলেন। পরে রাজীব গান্ধী কর্পোরেট অনুদানকে ফের ফিরিয়ে আনলেও বড় বদল এল ২০০৩ সালে, যখন রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি অনুদান পুরোপুরি কর্পোরেটের করযোগ্য আয়ের থেকে বাদ দেওয়া হল। আয়কর আইনের ৮০জিজিসি ধারায় ব্যক্তির জন্য আর ৮০জিজিবি ধারায় কর্পোরেটগুলি এই সুবিধা পেল। এই প্রথম সাদা টাকায় অনুদান দেওয়ার কিছুটা উৎসাহ দেওয়া হল কোম্পানিগুলোকে। তবে অনুদানেরও সীমা বেঁধে দেওয়া ছিল। বিগত তিন বছরের গড় আয়ের মাত্র ৫% রাজনৈতিক দলকে দান করা যাবে। পরে উর্ধ্বসীমাটি বেড়ে সাড়ে সাত শতাংশ হয়। রাজনৈতিক দলগুলির উপরও নির্দেশ দেওয়া হল যে ২০০০০ টাকার উপরের সব অনুদানের বছরওয়াড়ি হিসেব দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। আগেই নিয়ম হয়েছে সব রাজনৈতিক দলকে বছর বছর অডিটেড আয়-ব্যয়ের হিসেব জমা দিতে হবে। সব মিলিয়ে একটুখানি স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা। এই পটভূমিকায় ২০১৪ সালের সাধারন নির্বাচনের সময় থেকেই কালো টাকা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। শেষমেষ রাজনৈতিক ফান্ডিং স্বচ্ছ করার জন্য ২০১৭-১৮ সালের ইউনিয়ন বাজেটে ইলেকটোরাল বন্ড এল।

    সরকারি ঘোষণা মত, ২০১৮ র মার্চ মাসে প্রথম ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি শুরু হল। শুরুতেই বেশ জনপ্রিয়। এ বছর জানুয়ারি অবধি বন্ড বিক্রির ও ভাঙানোর হিসাবটা এরকম


    হিসেবমত এক হাজার, দশ হাজার, এক লাখ, দশ লাখ, এক কোটি টাকার বন্ড থাকলেও কোটি টাকার বন্ড বিক্রি হয়েছে ৯২%, কাজেই অনুমান করাই যায় সেই বন্ড কিনেছে কর্পোরেটরাই। আর এ কথা বোঝার জন্য কোন প্রাইজ নেই যে এই টাকার সিংহভাগই গেছে কর্পোরেট-তোষক বিজেপির পকেটে। সে অবশ্য আমাদের দেশে শাসকের দল চিরকালই কর্পোরেট দাক্ষিণ্য পেয়ে থাকে। আগে পেত কংগ্রেস। এখন পায় বিজেপি। কাজেই সেটা ততখানি সমস্যার বিষয় না। বরং অনেক বেশি সমস্যার বিষয় অন্যত্র।

    গোড়াতেই আরবিআই, নির্বাচন কমিশন আপত্তি করেছিল। আপত্তির কারণ,

    ১) আরবিআই বলে, এই স্কিমের ফলে রাজনৈতিক ফান্ডিং এর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা তো আসবেই না, উলটে যে কিনছে তার থেকে এক বা একাধিক কোম্পানির লোকের হাত ঘুরে সেই বন্ড রাজনৈতিক পার্টির হাতে যাবে। ক্রেতা আর দাতা আলাদা লোক হলে, মাঝের জনদের পরিচয় জানা যাবে না। ফলে এটা কালো টাকা সাদা করার উপায় হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। স্বচ্ছতা আনতে চাইলে সরাসরি চেকে বা ডিজিট্যাল পেমেন্টই তো ভাল উপায়। আরবিআই নিজের ভূমিকা খর্ব হওয়ার ভয়ও পায়।

    ২) এই আইনের আওতায় জনপ্রতিনিধিত্ব আইনেও বদল আনা হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে যে টাকা পেল, সেগুলোর দাতার নাম আর অনুদানের হিসেবে তোলার বাধ্যবাধকতা রইল না। এই বদলে নির্বাচন কমিশনের আপত্তি ছিল। তারা বলেছিল যে এতে স্বচ্ছতা ব্যাহত হবে। সরকারি কোম্পানি বা বিদেশি সংস্থা অনুদান দিচ্ছে কিনা তাও বোঝা যাবে না। এমনকি কোম্পানিজ অ্যাক্টে বদল এনে যে দানের উর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয় বা কোম্পানিগুলিকে আর নিজেদের প্রফিট অ্যান্ড লস স্টেটমেন্টে রাজনৈতিক অনুদান দেখাতে হবে না [২০১৮ সালের আগেও অবশ্য কয়েকটি কোম্পানির আন্যুয়াল রিপোর্ট খতিয়ে দেখে আমি কে কোন দলকে কত অনুদান দিয়েছে সে তথ্য খুঁজে পাই নি। কেউ যদি এ বিষয়ে আলোকপাত করেন খুশি হব]। বলা হয় তাতেও নির্বাচন কমিশন আপত্তি করে। এই সব রদবদল শেল কোম্পানি তৈরি করতে সাহায্য করবে বলে তারা সন্দেহ প্রকাশ করে।

    তবে সরকারের এইসব আপত্তিতে কান দেওয়ার সময় ছিল না তখন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তাঁরা সব আইনে বদল করে এই স্কিম চালু করে দেন। দাতার পরিচয় গোপন রাখাই এই স্কিমের মূল উদ্দেশ্য। সরকারপক্ষ দাবি করেছিল যে দাতারা নিজেরাই এটা চেয়েছেন, পরে অবশ্য তারা স্বীকার করে কেউ এমন চেয়েছেন তার কোন প্রমাণ নেই। তাহলে কি স্বচ্ছতা বাড়ানোর ভানের আড়ালে কালো টাকা সাদা করাই আসল লক্ষ্য ছিল?

    পরের তিনবছরে বার বার নাগরিক সমাজ থেকে আপত্তি এসেছে। বার বার তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু কোন লাভ হয় নি। স্কিম রমরম করে চলছে। এর মধ্যে সরকার নিজের করা নিয়ম নিজেই ভেঙেছে।

    ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে বন্ড বিক্রির জন্য সরকার প্রথমে পাঁচদিনের অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করেন যেটা পরে আদালতের নির্দেশে তুলে নিতে বাধ্য হয়।
    বন্ড ভাঙানোর নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও, ২০১৮ সালের মে মাসে সরকার ২০ কোটি টাকার বন্ড এসবিআইকে ভাঙানোর অনুমতি দেয়।

    এছাড়াও ২০২০ সালের এপ্রিল ও জুলাই মাসে নির্বাচনী বন্ড বিক্রি বন্ধ থাকলেও বিহার নির্বাচনের আগে অক্টোবর মাসে বন্ড বিক্রি ঠিকই চালু হয়ে যায়।

    আরও মজা এই যে এডিআর বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে ২০১৯ সালের ৩০শে মের আগে অবধি যে ৯৬ টি দল ইলেকটোরাল বন্ডের মারফত টাকা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন, তার মধ্যে অন্তত প্রমাণিতভাবে ৪২টি দল ইলেকটোরাল বন্ড পাওয়ার যোগ্য নন। কারণ তাঁরা বিগত সাধারণ ভোটে ১ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। অনেক দলের তথ্য অবশ্য না পাওয়া যাওয়ায় বিশ্লেষণ করা যায়নি। আশ্চর্য এই যে সরকারের তরফে কোন প্রকাশ্য তালিকা নেই যে কোন কোন দল এই বন্ডের মাধ্যমে টাকা ভাঙাতে পারে। কে ভাঙাচ্ছে তা আগে খতিয়ে দেখার কোন উপায়ও নেই। ফলে যে বন্ড হাতে পায় সেই ভাঙ্গিয়ে নিতে পারে। আর এই ধরণের ঘটনা ঘটলে নির্বাচন কমিশনের হাতে কোন অস্ত্রও নেই যার প্রয়োগ করে শাস্তি দেওয়া যায়।

    নিয়ম না মানা বা নিজস্ব আর্থিক লাভ দেখে নিয়মের প্রতি চোখ বন্ধ করে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে অবশ্য আমাদের দেশের লোকজন তেমন ভাবিত নয়। এদেশে অক্ষরে অক্ষরে নিয়ম মেনে চললেই বরং লোকে অবাক হয়। বরং যেটা বেশি বিপজ্জনক সেটা হল সরকারপক্ষ বার বার দাতার পরিচয় গোপন থাকবে বলে আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও এই বন্ড কিন্তু নন-ট্রেসেবল না। বন্ডের গায়ে নম্বর লেখা থাকে। সাদা চোখে দেখা যায় না সেটা, কিন্তু আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মিতে ফুটে ওঠে। কেনার সময় একজন কেওয়াইসি দেখিয়ে বন্ড কিনছে, নম্বরওলা সেই বন্ড একটি দল ভাঙ্গাচ্ছে, তাহলে কে কত টাকা কাকে দিল সেটা বুঝে নেওয়া ব্যাঙ্কের পক্ষে কি অতই কঠিন? প্রয়োজনে সিবিআই বা অন্যান্য সরকারি সংস্থার সঙ্গেও ভাগ করে নেওয়া হবে এই তথ্য। তত্ত্বগতভাবে বন্ডের উদ্ভব হয়েছিল একটি বিশেষ সমস্যার সমাধানে। যে কোন পার্টিকে কে কত টাকা দিচ্ছে জানা থাকলে, অন্য পার্টি ক্ষমতায় এসে অনেকসময় দাতাদের উপর প্রতিহিংসা নেয়। সেই সমস্যার সমাধান হল কি? ব্যাঙ্ক জানবে, সরকারপক্ষ জানবে কে কাকে কত টাকা দিল, শুধু বিরোধী পক্ষ আর সাধারণ মানুষ জানবে না? এই বুঝি গণতান্ত্রিক ন্যায়ের ধারণা? আর এই রকম মিথ্যে কথা বলা সরকারকে ঠিক কতটা বিশ্বাস করা যায়?

    তার থেকেও বড় কথা হল এমনিতেই কর্পোরেটকে সাদা টাকায় রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য সরকারি কোষাগারে কর বাবদ কম টাকা ঢুকছে। তার উপর এই বন্ড ছাপানো, বিক্রি ইত্যাদির বাবদে স্টেট ব্যাঙ্ককে কমিশনও দেওয়া হয়। এখনও অবধি প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা সেই বাবদে খরচ হয়েছে। সেই খরচ কিন্তু দাতাদের বা রাজনৈতিক দলের পকেট থেকে যায় না, যায় আমার-আপনার ট্যাক্সের টাকা থেকে। খরচের দায় আমরা বইব অথচ আমরা জানব না কোন কোম্পানি কার ফান্ডে কত টাকা ঢেলে নিজের সুবিধার কাজগুলো করিয়ে নিল। এই তথ্যটি নিশ্চিত ভাবে জানা- না জানা কি কোন ভাবে জনতার প্রার্থী তথা দলের নির্বাচনের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে না?

    নির্বাচনী বন্ড পুরো তুলে দিলে হয়ত আবার আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই ফিরে যাব, বরং দাবী তোলা হোক এই বন্ডের স্কিমের বদল। প্রতিটি অনুদানের জন্য দাতা আর গ্রহীতা দুজনেই চিহ্নিত হন এবং দলের নির্বাচনী কমিশনের কাছে দেওয়া রিপোর্টের আওতায় আসুক। বন্ড নন-ট্রান্সফারেবল করা হোক। সেই সঙ্গে কোম্পানির বাৎসরিক হিসেবেও স্পষ্ট ভাবে লেখা থাকুক কাকে কবে কত টাকা দান করা হয়েছে। যাতে মিলিয়ে দেখা যায়। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের হিসেবের নিরপেক্ষ অডিট হোক। নির্বাচনের দলগত খরচ এবং প্রতি কেন্দ্রের প্রার্থীর নিজস্ব খরচ দুটোই জনগণের চোখের সামনে আসুক। সেই সঙ্গে প্রকাশ্যে আনা হোক ব্যয় পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণও। হিসেব দাখিলের পরে সেটা ফেলে রেখে দিলে কোন লাভ নেই, তার স্ক্রুটিনিও দরকার। তা না হলে সেই তথ্য কতখানি প্রামাণ্য সেই সন্দেহ থেকেই যায়। আর সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে অধিকার দেওয়া হোক যাতে কোন প্রার্থী বা দল নিয়ম না মানলে তাকে যথাযথ শাস্তি দেওয়ার।

    তবে সত্যি কথা বলতে কি, নির্বাচনী বন্ড আসলে সমস্যার পাহাড়ের চুড়োটুকু মাত্র। নির্বাচনী বন্ড চালু হওয়ার দেড় বছর পরে ভারতে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনকে বলা হয় ভারতের ‘costliest’ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিধিভঙ্গের দায়ে যত নগদ টাকা, গয়না ধরা পড়ে তার পরিমাণ ১৮৩১ কোটি টাকা আর ড্রাগস, মদ ধরা পড়ে ১৫৮৪ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে মোট ৩৪৭৬ কোটি টাকার জিনিস ধরা পড়ে। এই পরিমাণ সম্পদ যদি বাজেয়াপ্তই হয়, তাহলে মোট খরচ কত ছিল? সিএমএসের “পোল এক্সপেন্ডিচার দ্য ২০১৯ রিপোর্ট” এই নির্বাচনের মোট খরচের একটা আন্দাজ দিয়েছে – তাদের মতে মোট খরচ ৫৫০০০ কোটির উপরে ( ১৯৯৮ সালে সেটা ছিল ৯০০০ কোটি টাকা ) আর তার মধ্যে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মোট খরচের পরিমাণ প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা। এদিকে নির্বাচনের সময়ের খরচের যে হিসেব কিছু কিছু পার্টি দাখিল করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে তারা মোট খরচ করেছে মাত্র ২৯৯৪ কোটি টাকা। তবে এইখানে অবশ্য একটা ছাড় থাকে, কারণ ২০১৯ সালে নির্বাচনের দিন ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে একটা খরচের হিড়িক পড়ে। যেটা এই নির্বাচনী খরচের আওতায় আসে না। তবু দাখিল করা ব্যয় আর বাস্তবের ভিত্তিতে করা আনুমানিক ব্যয়ের মধ্যে তফাতটা অনেকখানি। আর এ তো গেল রাজনৈতিক দলের খরচ। সিএমএস বলেছে, প্রতি কেন্দ্রে গড়ে ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়, আর প্রার্থীর খরচের হিসেব দিতে গিয়ে জানিয়েছে, তার মধ্যে ৪০% খরচ প্রার্থীর। প্রার্থীর খরচের উর্ধ্বসীমা ২০১৯ সালে অনেকটা বাড়লেও আর স্থানভেদে সীমার কিছুটা হেরফের হলেও কোথাওই এক কোটিও ছোঁয়নি। দুয়ের ফারাকটা কষে ফেলা সহজ, আর তার সম্ভাব্য উৎসগুলোও অনুমান করা কঠিন না। বরং যেটা অনুমান করা কঠিন তা হল প্রার্থীর নিজের অর্থ বনাম সংগৃহীত অনুদানের অনুপাত, আর সাদা-কালোর অনুপাত। রাজনৈতিক ফান্ডিংএর অস্বচ্ছতা দূরীকরণ তাহলে কীরকম হল?

    ততোধিক সমস্যা হল এই যে এই ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের খরচ কিন্তু আদতে নির্বাচনের প্রক্রিয়াটাকে বিপুল ধনী প্রার্থীদের কুক্ষিগত করে দিচ্ছে। কে যেন বলেছিলেন, ‘Money is the mother’s milk of politics.’ তার জলজ্যান্ত প্রকাশ আমরা দেখছি এদেশে। এমনিতেই আমাদের দেশের লোকের ক্ষমতার বণ্টনের অসাম্য নিয়ে তেমন একটা হেলদোল নেই। অর্থও একটা ক্ষমতা আর ৪০-৫০টা ঝকঝকে বিশাল এসইউভি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে নির্বাচনী প্রচার করলে লোকের মনে সেই আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন জাগে না তেমন, বরং বেশ সম্ভ্রমে মাথা নিচু করে ফেলে। এই সামাজিক পটভূমিকায় গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত যে সেরা প্রার্থীর নির্বাচন সেটা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ধনীতম প্রার্থীর নির্বাচনে। ভোট তুমি কার? যে সব থেকে বেশি টাকা ছড়াবে তার। ব্যতিক্রম যেটুকু আছে সেটুকুই আঁকড়ে এখনো গণতন্ত্র টিমটিম করে জ্বলছে। তবে এই ভাবে চলতে থাকলে তার আয়ু আর বেশি দিনের নয়। এখনো কি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আমূল বদলের সময় আসেনি যাতে সত্যিই গণতন্ত্র দম ফেলে বাঁচে?


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ভোটবাক্স | ০৫ এপ্রিল ২০২১ | ২৭৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন