২০০৭, লন্ডন, কর্ক স্ট্রিট। আমার একক প্রদর্শনী, ল্যান্ডস্কেপ। শনিবার, সন্ধে। লন্ডনের সন্ধে। একটু আগে ঘোড়সওয়ারের একটা বড়ো বাহিনী, খুরের আওয়াজ তুলে সামনের রাস্তা দিয়ে চলে গেল। অদ্ভুত একটা সংগীত। একটা ছন্দে হাঁটা। ঘোড়ার নাল লাগানো খুর, জমিতে টোকা খেয়ে একটা মেটালিক আওয়াজ তোলে। এমন এক তালে তা বাজে, একটার পর একটা, টরে টক্কার মতো, সংকেত পাঠায় দূর দূর দেশে। আমি গ্যালারির কাচের দেয়ালের এপার থেকে শুনে যাই, এক মনে। সন্ধেটা অন্যরকম হয়ে গেল।
আমরা ছোটো বয়স থেকে রাস্তায় গাড়ি, ঘোড়া বলে এসেছি, কিন্তু আক্ষরিক ঘোড়া কোথায়? সুদূর লন্ডনে এসে ঘোড়ার দেখা মিলল। নির্জনতা ভেঙে গেল। হালকা আঁধারে কালো, খয়েরি, মসৃণ ঘোড়াদের শরীর চলে গেল। কর্ক স্ট্রিট এর কাছেই রয়েল আর্ট কলেজ, চিত্র শিল্পের কেন্দ্র-বিদ্যালয়। আমাদের শিল্প শিক্ষার গতিপ্রকৃতি এরাই ঠিক করে। আজ তা নানা অংশে ভেঙে, ভিন্ন ভিন্ন বিচিত্র চিন্তা তাকে বিভ্রান্ত করে রেখেছে। আমি তারই ফল। বহু অধ্যাপক, ছাত্ররা আসত, আমার প্রদর্শনীতে বারবার, প্রতিবছর। নানা কথা উঠে আসত। ঐতিহ্য ভেঙে যাচ্ছে। ক্লাসিক ধারণা পালটে যাচ্ছে।
এমনই এক সন্ধ্যায় দেখলাম, দর্শক বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। একটা ঘূর্ণি যেন। এক তরুণী প্রচণ্ড ছটফট করছে। একবার কক্ষে ঢুকছে, আর একবার বেরুচ্ছে। কেন এমন করছে? কী দেখে করছে? কিছুই বুঝতে পারছি না। ঠিক সেই সময়, আমার কন্যা, যার তত্ত্বাবধানে এই প্রদর্শনী, প্রসাধন কক্ষে গেছে, বেসমেন্টে। কাউকে শুধাতেই পারছি না, ঘটনাটা কী? এমন সময় বেশ বড়ো একটা দল, তরুণ, তরুণী, বাউন্সার সহ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল, আমার প্রদর্শনী কক্ষে। কেন্দ্রে একজন, মনে হল বিশিষ্ট কেউ। খুব চেনা মুখ, বয়স্ক। কোথাও যেন বহুবার দেখেছি। কিন্তু নাম মনে করতে পারছি না।
বেশ মন দিয়ে আমার কাজ দেখছেন। পাশেই খুবই লম্বা টান টান কালো চুলের এক দীর্ঘাঙ্গী তরুণী। কালো পোশাকে, সান্ধ্য পোশাকে। যাকে ঘিরে উত্তেজনা তারও কালো পোশাক। মুখে প্রচুর বলিরেখা। চোয়াড়ে চৌকো মুখ, দেখে ব্রিটিশ মনে হল। সেই ছটফটে তরুণী প্রচণ্ড উত্তেজনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ভদ্রলোককে আগলাচ্ছে একজন দীর্ঘদেহী, বিশালাকার একজন পুরুষ, সেও কালো পোশাকে। তাকেই বাউন্সার মনে হচ্ছে। স্বাস্থ্যবান! আগলে রাখছে সবকিছুই। আমি বসে বসে সবকিছুই লক্ষ করছি। কিন্তু কিছুই বুঝছি না। একটা চরকিপাক দিলেন ওই ভদ্রলোক। পা-গুলো যেন নাচছে। ক্রস করে করে হাঁটছেন। মাঝে মাঝে এক একটা ছবির সামনে দাঁড়াচ্ছেন। ঝুঁকে পড়ে মন দিয়ে দেখছেন। জলরঙের কাজ, কাগজের ওপর; কিছু সূক্ষ্মতাও রয়েছে এখানে সেখানে। হয়তো তাই নজরে পড়ে যাচ্ছে। এইসব করে হঠাৎই ওরা পাশের গ্যালারির দিকে হাঁটা লাগাল।
আর ঠিক তখনই আমার কন্যার আবির্ভাব। আমি বললাম, “বাইরে গিয়ে দ্যাখ তো, ওই কালো পোশাক পরা, মাঝারি উচ্চতার লোকটি কে? বেশ চেনা লাগছে, কিন্তু মনে করতে পারছি না।” ওই চেঁচিয়ে বলল, “আরে মিক জ্যাগার, রোলিং স্টোনের। তুমি চিনতে পারলে না? ইনি তো মবড্ হয়ে যান, কোথাও গেলে। গানের আসরের টিকিট পাওয়া যায় না। ইশ্! একটু আগে এলে, আলাপ করতাম। এমনিতে বিশিষ্ট জনেদের সাথে আমার ছবি তোলা নিষেধ। ওতে নাকি আমার নাম্বার কমে যায়! যাক্, আরও একটা সুযোগ ফসকাল!” এতক্ষণে বুঝতে পারলাম জনগণের উত্তেজনার উৎস!
মিক জ্যাগার কে? স্যার, মাইকেল ফিলিপ জ্যাগার, একজন ব্রিটিশ গায়ক। গান লেখক, অভিনেতা আর প্রযোজক। বিশ্বখ্যাত রোলিং স্টোন গান দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৪৩-এ জন্ম। আবার লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর ছাত্র। ২০১৯-এর এপ্রিলে একটা অস্ত্রোপচার হয়, হৃদয়ে। এখন সুস্থ। বর্তমানে ৩৬০ মিলিয়ন ডলার তাঁর সম্পত্তি। অষ্টম ধনী, গায়ক বাজিয়ে হিসেবে।
তিনি আমার প্রদর্শনী এলেন, দেখলেন, কী বুঝলেন বুঝলাম না। এত দূরের দর্শক, এত দূরের চিত্র ভাবনা আমার। সংযোগ হওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া কৌতূহল কতটা গড়ায়, জানি না। একটা বিশেষ বৃত্তের মানুষ এঁরা। এদের কৃপা হলে শিল্পীর শুনেছি ভাগ্য খুলে যায়। আমার সাধারণ ভাগ্যই নেই। তো খোলার প্রশ্ন নেই, ব্যাপারটা ওখানেই ইতি।
অসামান্য !
হীরেন