২০০৬ সাল। প্যারিস। সকাল। মেঘলা আকাশ। যে-কোনো সময় বৃষ্টি আসতে পারে। যদিও মাঝে মাঝে রোদ দেখাও যাচ্ছে। আমি আর আমার কন্যা সাজি বেরিয়ে পড়লাম, অনেকের সাথে দেখা হতে পারে। কাফে, কফি, হালকা আহার, বেশ একটা মৌতাত আছে। প্যারিসের গন্ধটা আমার ভীষণ প্রিয়। সেটা কীসের গন্ধ বুঝতে পারি না। কোনো সুগন্ধী হতে পারে। শ্বেত শুভ্র ত্বকের গন্ধ হতে পারে, পোশাকের সাথে লেগে থাকা গন্ধও হতে পারে। কড়া কফির গন্ধও হতে পারে। এইসব সঙ্গে করে নিয়ে আমরা চলেছি, শিল্পের পীঠস্থান।
অপূর্ব কারুকাজ মানে, আর্ট ন্যুভোর ঢালাই লোহার, ব্যাঁকানো, অলংকার ভরা, পাতাল রেলের স্টেশন চত্বর, সিঁড়ি, রেলিং, আর সুড়ঙ্গ, তার গোল মাথা, বড়ো বড়ো রঙিন পোস্টার। আমরা নানা টিউব ধরে ধরে চলে এলাম একটা বড়ো চত্বরে। নাম মনে নেই, শ্যাঁসিশেল হতে পারে, হুপাবলিস হতে পারে, নেঁপিয়ো হতে পারে। জেরাড্ ইউরিগেরা—একটা বিশাল টুপি পরা খর্বকায় চিত্রসমালোচক-এর সাথে বৈঠক। অনেকটা পাবলো পিকাসোর মতো দেখতে ওনাকে, বহু জানাশোনা। আমাকে নিয়ে একটা বই লিখছেন, ফরাসি ভাষায়। কন্যা অনুবাদ করবে ইংরেজিতে। সে কাহিনি ভিন্ন। পরে কখনও বলা যাবে।
আজ যাকে নিয়ে এই বিচিত্র কাহিনি, তাঁর নাম রামিরেজ। এই রামিরেজ এক সময় সালভাদর দালির সহকারী ছিলেন। দালি এক সময় এই প্যারিস শহরে কাটিয়েছেন। পিকাসোর বন্ধুও ছিলেন, সেও ভিন্ন গল্প। বলব কখনও। জেরাড্ নিয়ে গেল একটা বেশ বড়োসড়ো শিল্পীদের ঠেকে। একটা বেশ বড়ো রেস্তোরাঁ। ভিতরে প্রচুর মানুষজন। সামনে একটা খোলা বারান্দা, যা স্বচ্ছ প্লাস্টিকে মোড়া। ছাদটা ঢাকা। পর্দার মতো ঝুলছে চারধারে। বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। এখানকার বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু মুশলধারায় নামে। অপূর্ব লাগে দেখতে। স্বচ্ছ পর্দা বেয়ে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে। সামনে, নানা পোশাকে বসে আছে শিল্পীদের দল, সবাই ভিনদেশি। দেখতে এত ভালো লাগছে। ফরাসি, তেলরঙের ছবি। এক এক করে করমর্দন হল, গালে গাল ঠেকানো। বঁজু মঁসিয়ো, বঁজু মাদাম। অপূর্ব সুন্দর গোলাপি গালে, গাল ঠেকাতে কী যে ভালো লাগত। তার সঙ্গে সুবাস! জেরাড্-এর এক তরুণী বান্ধবী বা প্রেমিকা লম্বা কালো চুল, হয়তো পূর্বী দেশের কিন্তু দীর্ঘকায়। সুন্দরী খুবই। তাকে ঘিরে শিল্পীর দল।
এরই মাঝে বেশ বয়স্ক শীর্ণকায় এবং দীর্ঘ শরীরের এক শিল্পীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হল। এই হুয়ান রামিরেজ স্পেনীয়। রামিরেজ একটা বড়ো পোর্টফোলিও নিয়ে এসেছে। প্রচুর পুরানো কাগজের কাটা অংশ। আঁকা ছবির কালো-সাদা প্রতিলিপি। পাতার পর পাতা। একটা বা কয়েকটাতে দেখা গেল, রামিরেজ ঘোড়ায় চড়ে আছে, কোট, টুপি পরে। নীচে রাস্তার ওপর ইজেল ও ক্যানভাস। লম্বা একটা তুলি, কখনো-কখনো তলোয়ারে তুলি বেঁধে ছবি আঁকছেন। তখনও ঘোড়ায় বসা। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য।
প্রচুর মানুষ জড়ো হত প্যারিসের রাস্তায় এমন দৃশ্য উপভোগ করতে। আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ওই অ্যালবাম দেখতে। রামিরেজ বেশ গর্ব ভরে দেখাতে লাগল একটার পর একটা কাগজের অংশ, যা ততদিনে হলুদ হয়ে গেছে। গত শতাব্দীর গল্প। দালি তখন বেঁচে। ওনারও যথেষ্ট বয়স তখন। চল্লিশের বা পঞ্চাশের দশকের ঘটনা হয়তো। দালি গত হয়েছেন আশির দশকের শেষে। রামিরেজ তখন হয়তো যুবক, সেই ছবিগুলো আমার চোখের সামনে এখনও ভাসে।
এইসব দেখা পর্ব ও আড্ডা শেষ হলে, রামিরেজ আমাকে একটা চোখ মারে। আমরা যুবক বয়সে যেটা মহিলাদের দিকে মাঝে মাঝে করতাম, যা ভীষণ অন্যায় বলে চিরকাল বলা হয়েছে। যাইহোক, ওর ইঙ্গিতটা ঠিক বুঝিনি, সমকামী কি না ভাবছিলাম। কিন্তু না, দেখলাম ও ব্যাগ থেকে অনেক রংতুলি বের করে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। আমাকে স্থির থাকতে ইঙ্গিত করছে ইশারায়। ওই প্রচণ্ড বৃষ্টি, প্রচণ্ড উচ্চস্বরে আড্ডা, চুরুটের গন্ধ, কড়া কফির গন্ধ আর তার মধ্যে আমি স্থির বসে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপরেই সেই আশ্চর্য চমক দেখতে পেলাম। যে কফিশপে আমরা বসে ছিলাম, তাদের কাপ ও প্লেটের বিশেষ একটা ধরন ছিল। লাল রঙের সীমানা আঁকা। ঘন লাল, ঠিক তার মাঝখানের গোল শূন্য অংশে আমার একটা মুখচ্ছবি এঁকে ফেলেছে রামিরেজ, স্পেনীয় শিল্পী, দালির সহযোগী। মুগ্ধ হয়ে গেলাম দেখে।
আমার কন্যা দ্রুত ওর বড়ো ব্যাগের মধ্যে তাকে চালান করে দিল। সে এল কলকাতায়। একদিন সকালে একটা দুর্ঘটনায় সে ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যায়। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে মেরামত করে ফেলি, যা আজও সংরক্ষিত আছে। সেই সকালে আমিও প্রতিদান হিসেবে ওনার একটা ছবি উপহার দিই। আজ আঁকলাম স্মৃতি থেকে।
শিল্পীই জানে শিল্পের আনন্দ ও যন্ত্রণা। সমৃদ্ধ হ ই এসব লেখা পড়লে। গুরু আমার ও নিজের ঘর। সে ঘরে এত মণি মাণিক্য ছড়ানো তে কুড়িয়ে তোলা সব সম্ভব হয় না
আমি একজন অত্যন্ত সাধারণ পাঠক মাত্র - হিরন বাবু অন্য মাত্রার মানুষ। ওনার ঝোলায় এরকম অনেক মনিমুক্তো আছে - আশায় রইলাম এরকম আরও লেখার।
চমৎকার স্মৃতিকথা। ধীরে ধীরে পটের মতো খুলে যাবে অজানা চিত্র। হিরণদা নমস্কার। আলাপ করিয়ে দিন সকলের সঙ্গে।
সকল চিত্রকরকে চিনব হিরণ মিত্রর চোখ দিয়ে।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম আমার স্বপ্ননগরীর বৃত্তান্ত। সঙ্গে,ভিডিও ক্লিপিংটি অ্যাডেড ভ্যালু!
এক অসাধারণ যাত্রার সূচনা পড়লাম। জানালার ধারে সীট বাগিয়ে বসলাম। হিতার উই গো ---