২০০৬, প্যারিস। যেদিন সকালে রামিরেজের সঙ্গে দেখা হয়, হয়তো সেদিন, অথবা তারই আশেপাশে, এক সকালে, এই প্রখ্যাত ভাস্কর ওয়াঙ কিপিং-এর সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। ১৯৪৯-এ জন্ম, কেইজিং-এ প্যারিসে আছেন, ১৯৬৪ সাল থেকে। বহু সম্মানে ভূষিত।
যখন আমরা প্যারিসের গ্যালারি অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছি তিনজন, তখনও জানি না কার সাথে ঘুরছি। বিভিন্ন গ্যালারিতে ঢুকছি। ওয়াঙ-এরই পরিচিত, তারা নানা কথা বলছে, আমি পাশে পাশে। এক কাফেতে ঢুকে তিনজন খেলাম। কালো কফি বড়ো কাপে। ছবি নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। প্যারিসে এসেছি, ছবির রঙের দোকানে যাচ্ছি। বিশাল একটা কারখানা। ছাদ ছুঁয়েছে ক্যানভাস-এর স্তূপ। রঙের র্যাকের শেষ দেখা যায় না। সব রকম শেড। এ দেশে যে রং-ই চাইব, দেখা যাবে তার স্টক নেই। এমনই দুর্দশা। ওখানে, কী প্রাচুর্য। প্রতিটা শেড থরে থরে সাজানো। বিভিন্ন কোম্পানির, বাছাই করার সুযোগ, কারা যে এত আঁকে, ভেবে পাই না। রপ্তানি হয় নিশ্চয়ই, নানা দেশে। আমি অবাক তাকিয়ে থাকি। ইজেলের কত বাহার। যে কোণের অংশটায় ফ্রেম বানাচ্ছে, যন্ত্রের সাহায্যে তার কর্মকাণ্ড দেখলে তাক লেগে যায়। এক ধরনের হীনম্মন্যতা এসে পড়ে। এসব কাটিয়ে, নিজের কাজে মন দিই। এখান থেকে বাঁধাই হয়ে, লন্ডন যাবে সমস্ত ছবি। বেশ ব্যয়বহুল ব্যাপার। এই দেশে, আরও একটি বিশেষ ব্যাপার, প্রতিটা ফ্রেমের নির্দিষ্ট মাপ আছে। সেই মাপের থেকে সামান্য ছোটো বা বড়ো রাখলে সমূহ বিপদ। দ্বিগুণ দাম পড়বে তার। নির্দিষ্ট মাপ থাকলে, সাধ্যের মধ্যে ঘটবে। সেই মাপ ধরে আমার ছবিগুলো বোধহয় আঁকা হয়েছিল। অনেকদিন আগের ব্যাপার, ভুলে গেছি।
এই কথাগুলো বিশদে বলার কারণ, ওয়াঙ। যার বিশাল বিশাল স্টুডিয়ো, নানা শহরে। শুধু প্যারিস শহরেই, দশহাজার স্কোয়ার ফুটের কাজের জায়গা। পরে জেনেছিলাম, উনি, কাঠের বিশাল মাপের ভাস্কর্য বানাতে ওস্তাদ।
দুনিয়া জোড়া নাম। কিন্তু যেভাবে আমার সঙ্গে ঘুরছিলেন, গল্প করছিলেন, বোঝার উপায় নেই, দশটা রোল্স রয়েস-এর মালিক। হংকং-এ গেলে বিমানবন্দরে বিশিষ্ট জন আসেন, সম্ভাষণ জানাতে। পরে গুগলে গিয়ে দেখতে পেলাম, তাঁর কাজের বহর। বিশ ফুট উঁচু কাঠের ভাস্কর্য। সারা পৃথিবীর জাদুঘরে ছড়িয়ে রয়েছে ভাস্কর্য, এতটাই খ্যাতিমান। একসাথে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি, পাশাপাশি, একটু পিছিয়ে কন্যা, ফিশফিশ করে বাংলায় এইসব খবর দিতে থাকে আমাকে। আমি হতবাক। আমি সামান্য এক ছবি আঁকিয়ে, তার এত খাতির। তার কারণও ছিল, সেই সময় বা তার কিছু পরেই, জেরার্ড আমাকে নিয়ে একটা বই লিখছিল, ফরাসি ভাষায়। ওয়াঙ-কে নিয়ে প্রদর্শনী, নানা মহলে আলাপ করানো, এইসব করতে যাবে জেরার্ড। উনিই আলাপ করান। এইসব ঘটনা ঘটেছিল চোদ্দো বছর আগে। তারা সব কোথায় কোনো হদিশ জানি না। জেরার্ড কোথায়? ওয়াঙ কোথায়? জেরার্ড-এর খুবই পছন্দের ভাস্কর, তাই তাকে বিশেষ স্থান দিতে, উনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ওয়াঙ-এর সাথে আর পরে কখনও দেখা হয়নি। আজও জীবিত, কাজে ব্যস্ত, এটুকুই জানি। একটা সময়, ওয়াঙ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন। প্যারিসের ওইসব রাস্তায়, মানুষজন, হেঁটে ঘুরতেই ভালোবাসে। কোনো ব্যস্ততা নেই। ধীর ছন্দে জীবন চলছে যেন। গল্পে, শিল্প-আলোচনায় বয়ে যাওয়া নদীর মতো, কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছিল সকাল। রোদ বিছানো রাস্তা, গাছের ছায়া। মানুষের কণ্ঠে তখন কথার ফরাসি সংগীত।
(ক্রমশ...)
অসাধারন ! জানার শেষ নেই যে।
কাজের ব্যস্ততায় পুরো ধারাবাহিক এড়িয়ে গেছি! এই পর্ব থেকেই পড়া শুরু করলাম। ব্রাভো