২০০৭ সাল, ফ্লোরেন্স, ইতালি। দ্বিতীয় ভাগ। দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে আমি অংশ নিয়েছি। বিশাল প্রদর্শনী। আশ্চর্য এই যে, পরের কিস্তি মানে ২০০৯ সালে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ২০০৮-এ শিল্পের বাজারে ধস নেমেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটে শেয়ারের দর পড়ে গেছে অস্বাভাবিক। তার ঢেউ এসে লেগেছে দেশে দেশে। আমাদের দেশেও তা লাগে। মাত্র, তিন হাজার কোটির লেনদেন বছরে। এই শিল্প বাজারে, তাও হত কিনা সন্দেহ। যারা বিনিয়োগ করত, তারা সন্ত্রস্ত। হাত উঠিয়ে নিচ্ছে। আসলে, শিল্প মানে এই কলায় বিনিয়োগ একটা ফাটকা। বাড়িয়ে খেলা, বাড়িয়ে বলা, বাড়িয়ে দর হাঁকা। শিল্পীরা রাতারাতি ধরাকে সরা ভাবতে শুরু করে দিল। যারা চাকরি করত, তারা সব ত্যাগ করে, পুরো মাত্রায় শিল্পচর্চায় মন দিল। যে দুজন চরিত্রকে নিয়ে আসব আজ এই আসরে, তারাও ওই ফাটকার ফল। তারাও ফাটকা খেলত। আমি কোনোদিন এই খেলা বুঝিনি, খেলতেও পারিনি। অদ্ভুত সমাহিত, চর্চার মধ্যে ডুবে থেকেছি। তাই ব্রাত্য হয়ে গেছি। এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না।
ফ্লোরেন্সের যে বিশাল স্থাপনা শিল্প জাতের কাজটি প্রদর্শিত করি, তা প্রায় নিখরচায় করা। সামান্য ক্যানভাস। অ্যাক্রেলিক রং, সিল্ক স্ক্রিন পদ্ধতিতে, অক্ষর ছাপা সরাসরি ক্যানভাসের উপর। শুধু ঝোলানোর ব্যবস্থা। মেঝেময় যে লেখা ছড়ানো ছিল, তা দ্রুত অক্ষর-এর এক অদ্ভুত নড়াচড়া। মাঝে মাঝে শক্ত সাদা বোর্ডের জানালা রাখা, যার মধ্যে দিয়ে অক্ষর উঁকি মারছে। মেঝের চারকোনা অক্ষর খাড়াই দাঁড়িয়ে, কোথাও তাঁবুর মতো, কোথাও প্রাচীরের মতো, কোথাও শুয়ে আছে তারা। একটা কোলাহল কোনো শৃঙ্খলা নেই, শিল্পে, চিত্রে চিরকাল শৃঙ্খলার চর্চা হয়েছে। শিল্পীর শৃঙ্খলা ভাঙলেও, অন্য এক শৃঙ্খলাকে নির্মাণ করেছে। আমি তাকেও আঘাত করলাম।
সেই আঘাত, কত পক্ষের খুবই মনে ধরল। প্রচুর দর্শক এল একে ঘিরে। আশ্চর্য কানে এল, পুরস্কারের তালিকায় নাকি আমার নাম উঠেছে। একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ঘটনাটা এমন, সে বছর জুরিতে ছিলেন ভারতের ললিতকলা আকাদেমির চেয়ারম্যান হরিহরণ বা এমন কোনো নামের এক ব্যক্তি। তিনি যে-কোনো কারণেই হোক আমাকে হিরণদা সম্বোধন করতে থাকে। তাঁকে আমি ইতালিয়ান টেলিভিশনে পরিচয় করিয়ে দিই। তাঁর সাক্ষাৎকার ওরা নেয়। তাঁর তখন অবসরের সময় হয়ে এসেছিল। আমার কন্যা এই শিল্প নিয়ে একটা ফাউন্ডেশন চালায়, লন্ডনে। সেটা শুনে উনি খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েন। আমাকে হয়তো পুরস্কারের জন্য তদ্বির করেন। সত্যি মিথ্যে জানি না, শেষপর্যন্ত একজন ইতালিয়ান শিল্পীই পুরস্কার পান এটা জেনেছি।
একই সাথে আরও একটা ঘটনা ঘটে। জর্জ ও গিলবার্ট, সেই পৃথিবীখ্যাত সমকামী শিল্পী যুগল, বহুক্ষণ আমার শিল্পের সঙ্গে সময় কাটান। তাঁদের এই বিশৃঙ্খলা খুবই পছন্দ হয়, এই অক্ষর চর্চা। বারবার খুঁটিয়ে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন। সেই বছর ফ্লোরেন্সে এই দুজনকে বিশেষ সম্মান জানায় কর্তৃপক্ষ। সেই জন্যও ওদের উপস্থিতি, প্রশংসা সবই আমার পক্ষে যেতে থাকে। এমন একটা আবহাওয়া তৈরি হয়ে যায়, যেন পুরস্কার পাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। খুবই হতাশাজনক ভাবে বেশিদিন থাকতে পারিনি ও দেশে। দেশে ফেরার তাড়া ছিল, সে আর-এক গল্প।
যে ক্যানভাসগুলো পরপর ঝুলছিল, লম্বা দেয়ালে, অক্ষর দেয়াল বনে গিয়ে, তার সামনে কার্পেট বেছানোর মতো ছুটে বেড়ানো অক্ষর। ঠিক তার উপরে ঝুলছিল, কাগজের বেশ লম্বা লম্বা, প্রায় বটের ঝুরির মতো লিপির স্ক্রোল। তারই ফাঁক থেকে দেখা যাচ্ছে দেয়ালকে, লাল, কালো, সাদা, ধূসর।
জর্জ আর গিলবার্ট, নানা আধুনিক প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে, নানা ইমেজ, মিরর ইমেজ, চড়া রঙে, আলোকচিত্রকে নানা কসরতে আলংকারিক বানিয়ে বিশাল দেয়াল জোড়া দৃশ্য বানাতে ওস্তাদ। নানা কোম্পানি শুধু ওদের নির্দেশে, আদেশে, নানা প্রযুক্তি প্রয়োগ করে। তার খ্যাতি, অর্থ, প্রতিপত্তি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আমার ওখানে উপস্থিতি বা পুরস্কার আলোচনায় ঢুকে পড়া, খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। তাই আমার কোনো পুরস্কার জোটেনি। কল্পনা করাই হাস্যকর। খালি হাতে ফিরে আসি।
কাজগুলো লন্ডনের ওয়ারহাউসে রাখা আছে। তিন, চারদিন সময় লেগেছিল সবটা প্রস্তুত করতে। আমার কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। জায়গাটা দেখার পরই সব সিদ্ধান্ত নিই। উতরোয় কাজটা।
সংযোজন—জর্জ ও গিলবার্ট সমকামী শিল্পী। ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ সম্মান টার্নার প্রাইজ পেয়েছেন যৌথভাবে। একজন ইতালিয়ান আর অন্যজন ব্রিটিশ। আমার থেকে দু-বছরের বড়ো। ১৯৪৩/৪২। ২০০৪-এ দুজন বিয়ে করেন। যদিও দুজনই পুরুষ। এখন লন্ডনে থাকেন, ১৮ শতকের একটি বাড়ি কিনেছেন, পূর্ব লন্ডনে। পৃথিবীর প্রথম সারির শিল্পী। নানা বিচিত্র পরীক্ষা চালান, দৃশ্য ভাষায়।
(ক্রমশ...)
দারুন হচ্ছে, হিরণদা। একদিন শঙ্খবাবুর কবিতা নিয়ে সাদা-কালো ছবির গল্প শুনবো। বইটা আজও স্বপ্নের মত লাগে।