১৯৯৭ সাল, প্যারিস, আমার কন্যা সাজির বিয়ে। ওই শহরে। আমি কর্তা, গিন্নি, পুত্র পলাশ, হাজির হলাম। পথের নানা বিভ্রাটের কথা আজ বলছি না। তখন প্যারিস শহরে, নানা দেশি ও বিদেশি বন্ধুদের জমায়েত। যেমন, সুইৎজারল্যান্ডের ফ্রাঁসোয়া ফ্লুরি, মিলানের লেতিতমিয়া কোম্বা, কলকাতা বা খড়দহের অরুণ হালদার, আর ওঁর স্ত্রী ইসাবেল। আড্ডা জমে উঠল, এও জানা গেল, পবনদাস বাউল ও মিমলু সেন ওখানে ডেরা বেঁধেছে। আমাদের পরিক্রমা শুরু হল। আজকের যিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র, আরিয়ান মুশকিন, যাঁর পূর্ব প্যারিসে, জঙ্গলের ধারে, ‘কার্তুজে’ একটা নাট্যশালা আছে।
একটু বিশদে বলা যাক বিষয়টা। এই পূর্ব অঞ্চলটা জঙ্গল ঘেরা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, এইখানে বারুদ ও কার্তুজ তৈরির কারখানা ছিল। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর, দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় জঙ্গল ঘেরা পরিত্যক্ত পড়ে থাকে। ফরাসি সরকারের বিশেষ ব্যবস্থায় বহু এমন অঞ্চলকে শিল্প, চিত্র, ভাস্কর্য, নাটক এমন নানা কর্মকাণ্ডের আওতায় আনেন। বহু শিল্পী এমন সুবিধা যেমন পেয়েছেন, তেমন পেয়েছেন নাট্যকার, পরিচালকরাও। ১৯৬৪ সালে এখানকার পাঁচ বা ছয়টি ঢাকা, বিশাল, স্থাপত্য যা খুবই সাধারণ দর্শন বা দেখতে, হস্তান্তর করা হল। এরিয়ান মুশকিন বিশিষ্ট নাট্যকার, পরিচালক পেলেন ঢোকার মুখের কারখানাটি। একটা অভিনব মঞ্চ নির্মাণ করলেন। তিনি, ১৯৯৭ সালে প্রথম ওনার সাক্ষাৎ পাই। কয়েকবার তারপরেও গিয়েছি। বহু নাট্যব্যক্তিত্বকে পেয়েছি। সে কাহিনি দীর্ঘ। এর কয়েক বছর পরই তিস্তাপারের বৃত্তান্ত নাটক মঞ্চ-এ অংশ নিই। কলকাতায় এঁদের ব্যবস্থাটি খুবই বিচিত্র। মূলত তিনটি বা চারটি অংশে ভাগ করা। শেষ অংশে, মঞ্চ স্থাপত্য বানানোর ব্যবস্থা। মাঝের অংশে, সাজসজ্জার, প্রসাধনের অঞ্চল। মুশকিন আমাদের দড়ির চারপেয়েকে এক-একজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্য বরাদ্দ করেছেন। সেই পায়াতে বাঁশের মাথায় একটা আয়না ঝোলানো। খাটিয়ার ওপরে তাদের ব্যবহারের পোশাক। অভিনেত্রীদের জন্য একটা পর্দা ঘেরা কোনা আছে। বাকিরা সর্বসমক্ষে মানে, নিজেদের মধ্যে সব কাজকর্ম সেরে ফেলেন।
এই অংশ থেকে একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে, মঞ্চের দিকে। রাস্তার দু-ধারে দর্শকরা বসেন। মঞ্চে ঢোকা-বেরোনোর ওই একটিই রাস্তা। কোনো সাইড উইংস নেই। মাথায় যে সাদা কাপড়ের আচ্ছাদন, তার পিছনে মানে ভিতরে আলো। মনে হচ্ছে খোলা আকাশে দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে। সেইসময় ভারতের কেরল থেকে একটি দল, মার্শাল আর্ট প্রদর্শন ও শিক্ষা দিচ্ছিল ফরাসি অভিনেতাদের। আমরা তাও দেখলাম। সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটল এরপর আমার স্ত্রী অনিতাকে ওরা লাল পাড়, ঘিয়ে রঙের গরদের শাড়িতে সাজাল। প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের জন্য একটা শুরুয়াত, ভারতীয় ঢঙে। ও আরতির ভঙ্গিতে প্রদীপ জ্বালাল। আমি তাও এঁকে রাখলাম।
বেশ কয়েকবার মুশকিন ম্যাডামের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। প্রদীপ জ্বালানোর পরই ভারতীয় ও ফরাসি শিল্পীরা মঞ্চে এলেন, সোজা সাজঘর থেকেই, নৃত্যভঙ্গিমা সহ। তাও আঁকলাম আমি। ম্যাডাম খুবই নামি মহিলা। ফরাসি প্রেসিডেন্টের খুবই কাছের লোক ছিলেন শুনেছি। একবার শ্যামানন্দ জালান কলকাতায় একটা নাট্য অভিনয় আনার চেষ্টা করেন। এক কোটি দর হাঁকেন উনি। স্বভাবতই তা আর ঘটেনি।
এই ঢাকা অঞ্চলটার বাইরে, বেশ কয়েকটি আধখোলা বা ছোটো ঢাকা ব্যবস্থা রাখা আছে। শৌচালয় ছাড়া, ক্যারাভান, চাকা লাগানো কাঠের ঘর আছে, খাবার বা আহারশালা আছে, ছাউনি দেওয়া। আমি পবন, মিমলুর সাথে ওই ক্যারাভানে সন্ধে কাটিয়েছি। মূল শহর থেকে যানবাহন আছে এই নাট্য অভিনয় দেখতে আসার জন্য। বহু আগে থেকে ব্যবস্থা করতে হয়। মিমলু এক প্রকার সহকারী বলে আমরা কিছু সুবিধা পেয়েছিলাম। আজও পবন-মিমলুর ডেরা ওই ক্যারাভান বা অমন কিছু। এই অভিনেতারা, কিছু স্থায়ী বাসিন্দা, কিছু শহর থেকে আসে। সবাইকে সব কাজ করতে হয়। শৌচালয় পরিষ্কার, আহার প্রস্তুত, পোশাক বানানো, নিজেদের সাজিয়ে তোলা, মহড়ায় থাকা আর মঞ্চ নির্মাণ, সব কর্মে পটু হওয়া আবশ্যক। এর একটা পোশাকি নাম আছে—Theatre du Soleil। সূর্যের থিয়েটার।
আরিয়ান মুশকিন—১৯৩৯, তেসরা মার্চ জন্ম, ফ্রান্সে। মলিয়ার পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক। ফরাসি নব্যধারার নাটক, নির্মাতা, ১৯৬৪ সালে, থেয়াত্র্ দ্যু সোলেইল, প্রতিষ্ঠা করেন। আত্ম আবিষ্কারের থিয়েটার, আমরা এমনই বলতাম। বড়োসড়ো শরীরের মহিলা, রাশভারী, ব্যক্তিত্বময়ী। সমস্ত কিছুর ওপর অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ রাখেন।
জানার সুযোগ পেয়ে ধন্য হলাম । বউ ফরাসী জানে তাতে আগামেমনন বোঝার সুবিধে হল খানিকটা