২০০০ সাল সম্ভবত। জেরার্ডের সঙ্গে আলাপ। প্যারিসে। কন্যা সাজি একসময়, প্যারিস শহরে, শিল্প নিয়ে বেশ যুক্ত ছিল, এক ফরাসি শিল্প বোদ্ধাও হয়তো জুটে যায়। তার নাম এখন মনে পড়ছে না। কিন্তু অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার মাধ্যমেই হয়তো আসল ব্যক্তি জেরার্ডের সাথে আলাপ, আমার নিজের একটা সূত্র ছিল, বাংলাদেশের শিল্পী সাহাবুদ্দিন। এর কাছে নিয়ে যায়, অরুণ হালদার। এদের নিয়েও লিখব।
২০০০-এ আমার একটা যৌথ প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা হয়। জেরার্ড তখন বেশ নামিদামি শিল্প সমালোচক। প্রচুর শিল্পীকে চেনে, যদিও আমার তেমন কোনো হিল্লে হয়নি বা বিশ্ব মানচিত্রে আমার কোনো জায়গা হয়নি। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক, জেরার্ডের সাথে বন্ধুত্ব হয়, অস্থায়ী হলেও। এর আরও একটা কারণ, জেরার্ড মূলত, বড়ো ভাস্কর্য, বড়ো স্থাপনাশিল্প এইসব নিয়ে মেতে থাকত। চিত্রশিল্পীদের নিয়ে হয়তো কমই লিখেছে। বহু শিল্প প্রদর্শনীর কিউরেটার। অজস্র বই প্রকাশিত হয়েছে। সবই শিল্প বিষয়ক। অকৃতদার মনে হয়। তবে রমণীসঙ্গ খুবই প্রিয়। প্রেমিকা জুটেই যায়। আমি লক্ষ করতাম এবং আমরা প্রায়ই, দুপুরের আহার বা রাত্রি, রেস্তোরাঁতে কাটাতাম। এতে নাকি ফরাসি সরকারের কাছ থেকে কিছু বাড়তি আর্থিক সুবিধা জোটে। হয়তো!
জেরার্ড-এর গতিবিধি খুবই দর্শনীয় ছিল। প্যাবলো পিকাসোর ধাঁচ আছে চেহারায়। তেমনি বেঁটে। মুখের গড়ন অনেকটা স্পেনীয়দের মতো। মাথায় মস্ত টাক ঢাকতে নানা বাহারের টুপি পরতেন, বহু নিশ্চয়ই সংগ্রহে ছিল। রোজই দেখতাম নতুন টুপি। চুরুট খেতেন। অসম্ভব দামি, ১৫০০ টাকা এক-একটা চুরুটের দাম, সেই সময়, কুড়ি বছর আগে। এবার চুরুটটা বিশেষ কেস থেকে বেরুত। চুরুট-এ ড্যাম্প লেগে গেলে বাতিল। তাকে এমন অবস্থায় রাখার জন্য, মাইক্রোওয়েভের মতন যন্ত্রও আছে। তারপর বেরুত কাটার। অসম্ভব ধারালো। যে দিকটায় মুখে দেওয়া হবে, তার কিছুটা অংশ কেটে ফেলে দেওয়া হয়। চুরুট ধরানোর বিশেষ লাইটার আছে। ঝড়-জলে তা নেভে না। দেখেছি, সাউথ আফ্রিকার বন্দিশালায় যে বন্দির মৃত্যুদণ্ড আদেশ হয়েছে, তাকে বানাতে হয় এই বিশেষ জাতের লাইটার। এরপর যেটা মারাত্মক, ওই বন্দির বন্দিশালার যে কয়েদ নাম্বার, তা খোদাই করে রাখার নিয়ম। একটা মৃত ব্যক্তির উপস্থিতি সর্বক্ষণ সাথে থাকে, যে সেটা ব্যবহার করছে। এমন কোনো লাইটার জেরার্ডের ছিল কি না জানা নেই। তবে অনেক বাহারি টুপির মতো, লাইটারও ছিল। খুবই আয়েশ করে চুরুট ধরাতেন। ধোঁয়া ছাড়তেন। আমরা লাঞ্চ বা ডিনার খাওয়ালে বেশ কায়দা করে ধন্যবাদ দিতেন ফরাসিতে, মের্সি-ব্যকু বলে।
এমন সব চলত প্যারিসের দিনকালে। আমার নিজেকে কেমন শিল্পী শিল্পী মনে হতে লাগল। যদিও ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। ধোঁয়া ভরা কলকাতায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটা ভেঙে যায়। ফরাসি দেশে, রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, সর্বত্র একটা অপূর্ব সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ঠান্ডার দেশ আর ফরাসি সুগন্ধীর জগৎজোড়া নাম। জেরার্ড খুবই শৌখিন মানুষ। লেখালিখি নিয়ে থাকেন। আমার চিত্রকলা ও ভাবনা নিয়ে একটা মুখবন্ধ লেখেন। ‘স্যাডোস’ নামে একটা বই বের করে এফভিডব্লুউ প্রকাশনা থেকে। এ সবই জেরার্ডের যোগাযোগ। অনেক সময় কাটালাম, ওদের ছাপাখানায়। এই প্রথম ও শেষ প্রকাশনা বিদেশ থেকে আমার। প্রচণ্ড ব্যয়সাপেক্ষ এইসব কাজ। তার ছ-ভাগের এক ভাগ দিয়ে, এদেশে এমন মানের প্রকাশনা সম্ভব। আসলে ব্র্যান্ডিং, তার দাম দিতে হয়। যদিও এমন কোনো বই এদেশে আমার এখনও কেউ প্রকাশ করেনি। লেখা আঁকার তিরিশটি বই প্রকাশ পাবার পরেও।
জেরার্ডকে নিয়ে একবার একটা মজার ঘটনা ঘটে। প্যারিসের কোনো এক প্রান্তে, সেদিন, কোনো এক শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন ছিল। আমাকে ঠিকানা দিয়ে দেয় জেরার্ড অগ্রিম, আমিও পৌঁছে যাই। পথঘাট বেশ চিনতাম তখন, বহুকাল থেকেছি। টিউব, বাস ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলাম। অঞ্চলটাও বেশ চেনা। গিয়ে, নিজের পরিচয় দিই, গ্যালারির মালিককে। তারপর আলোচনা চলতে থাকে। আমার কাজ নিয়ে বেশ উৎসাহ দেখলাম। বললাম কিছুটা। তখনও জেরার্ড এসে পৌঁছাননি, সামান্য দেরি হয়। যে মুহূর্তে জেরার্ড ঢুকছেন, সেই মালিক বলে ওঠেন, তোমার সঙ্গে এমন একজন ভারতীয় চিত্রশিল্পীর আলাপ করাব যে সেই তথাকথিত, তন্ত্র আঁকা ভারতীয় নন। এখানে বলে রাখা ভালো, যত ভারতীয় শিল্পী প্যারিসে গিয়ে কাজ করেছেন, দেখিয়েছেন, বেশিরভাগই তন্ত্রকে মূল দর্শন হিসেবে প্রকাশ করেছেন। তা একসময় একঘেয়ে হয়ে যায় ফরাসি শিল্পবোদ্ধাদের কাছে। বেশ কঠিন এই অভ্যাস। যাইহোক, বেশ হাসির রোল উঠল কক্ষে। জেরার্ড উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। যিনি আমার অবশ্যই পূর্ব পরিচিত। জেরার্ড আমার দাবি সম্বন্ধে বেশ ওয়াকিবহালই ছিলেন। বেশ মজা পান এই ঘটনায়। এখন আর তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। কন্যা প্যারিস ছেড়ে লন্ডনে ডেরা বেঁধেছে। মাঝে মাঝে যায়। আমি বেশিরভাগ সময় লন্ডনেই থাকি। সেই ফরাসি সুবাসকে খুবই হারাই আজও।
(ক্রমশ...)