২০০৭ সাল, ফ্লোরেন্স, ইতালি। এই গল্পটা দু-ভাগে বলব। প্রথম ভাগ—কী হল, কোথায় হল, কেন হল ইত্যাদি। হঠাৎ লন্ডন থেকে সাজির দুরভাষে কথা। বছরের মাঝখান। বছরের শেষে, ইতালিতে দ্বিবার্ষিক শিল্পকলা উৎসব, প্রদর্শনী। আমি আমন্ত্রিত। বেশ ভালো ও বড়ো জায়গা বরাদ্দ হয়েছে আমার শিল্পকর্ম প্রদর্শনের। বেশ উৎফুল্ল হয়ে গেলাম। আমি নিজেকে যদিও খুবই বিচ্ছিন্ন রাখি, শিল্পমহল থেকে। বিদেশে, নানা শিল্পবৃত্ত কার্যকর। তারা নানা দ্বাররক্ষী দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। তালিকাভুক্ত মুষ্টিমেয় শিল্পী প্রবেশ অধিকার পায়। তার কাহিনি লম্বা। আমার ইউরোপ, আমেরিকায় সামান্য যাতায়াত ও খুবই সামান্য সূত্র থাকাতে মাঝে মাঝে এমন দুর্ঘটনা ঘটে। এবার বহু পরিকল্পনায় মেতে উঠলাম। অর্থ খুবই সীমিত। মেয়ের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু একটা ঘটিয়ে তুলতে হবে। এর একটা পোশাকি নামও ছিল—‘সভ্যতার সংলাপ’। ভাবনা শুরু হল কলকাতায়। হাতে কয়েক মাস সময়। কিন্তু কোথায় গিয়ে কাজ করব, কতটা ব্যবস্থা করা যাবে, এ নিয়ে বিভ্রান্তি শেষ দিন পর্যন্ত রয়ে গেল। দশ ফুট চওড়া, কুড়ি ফুট লম্বা মেঝেতে আর আট ফুট উঁচু, কুড়ি ফুট লম্বা দেয়াল পাওয়া গেল। এমন একটা বেশ বড়োসড়ো জায়গা যা আবার প্রদর্শনীর কেন্দ্রস্থলে থাকবে, আমি গভীর ভাবনায় ডুবে গেলাম।
সময়, ঘড়ির কাঁটা টিক টিক এগুতে লাগল। ভাবনাও। সংলাপ চলতে লাগল আমার মনে মধ্যে। এত কথার পরও ব্যাপারটা যতই দু-হাত ছড়িয়ে ভেবেছিলাম, বা ভাবতে গেলাম, তার কিছুই তখন আর রইল না। সময় কমে আসছে। নানা খুঁটিনাটি খবর, তার চূড়ান্ত ব্যবস্থা কোনোটাই ঘটে উঠছে না। শেষ পর্যন্ত কাজ নিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে, ভিসা, টিকিট সব হয়ে যাওয়ার পর, হাতে রইল মাত্র সাতদিন আক্ষরিক ভাবে। আমার যা স্বভাব, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া, দ্রুত সব ঘটিয়ে ফেলা এবং অনিশ্চিত ও অজানার মধ্যে নিজেকে ছুঁড়ে ফেলা, তাই করলাম। কিছু সহযোগীর ব্যবস্থা করলাম। সাতখানা ক্যানভাস, যা জড়িয়ে নেওয়া যাবে, তা আনা গেল। সাতদিনের মধ্যে আট ফুট খাড়াই, চার ফুট বা তিন ফুট চওড়া ঠিক মনে পড়ছে না, কয়েকটা ক্যানভাস এঁকে ফেলা গেল, যা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে ছাদ থেকে, বাকি বিষয়টা লন্ডনে ব্যবস্থা করব ঠিক করলাম। রওনা দিলাম।
লন্ডন, সেখান থেকে প্যারিস। ইতিমধ্যে রঙিন অপূর্ব কাগজ, লাল, কালো, সাদা, হলুদ জোগাড় করা গেল। বহু আঁকিবুঁকি কাটা কাগুজে ছবি সাথে চলেছে। প্যারিসে সময় পাওয়া গেল, রঙিন ফোটোকপি করার। এবার মুখোশও পেয়ে গেলাম। কথা ছিল, ফ্লোরেন্সে জোগাড় করব, যা আর ঠিক পাওয়া গেল না। যাকে বলে সমর-অস্ত্র নিয়ে ইতালি রওনা দিলাম, রাতের ট্রেনে। এবার মূল গল্পে চলে যাই। একটি গ্রিক হোটেলে থাকার ব্যবস্থা, শিল্প মেলার খুবই কাছে। হেঁটেই যেতাম আমরা দুজন, কন্যা সাজি ও আমি। নিজেরাই বইতাম সব। জায়গা যেদিন পেলাম, হঠাৎ দেখলাম, মানে যাকে ইতালিয়ান ভাষায় বলবে ‘কে-খুক্ষে’, একটি সিনেমা বানানোর দল আমাকে ঘিরে ধরেছে। রহস্যটা আজও বুঝিনি। কেন এল, কীভাবে, কারা ব্যবস্থা করল, কিছুই জানি না। আজও ইউটিউবে তা দেখা যায় (এই লেখার শেষে লিঙ্ক তিনটি দেখুন)। দুটো ক্যামেরা আমাকে তাক করেছে। একটা সাধারণ গতিতে চলবে। আর একটা খুবই ধীরগতি, যখন তা প্রক্ষেপিত হবে, তা হয়ে যাবে দ্রুত গতি। যেন দ্রুত আমি সব ঘটিয়ে ফেলছি। এটা এক সময়, সিনেমার জন্মের সময় ঘটত, তখন হাতে চালানো হত বলে এবং তা খুবই ধীর বলে। পরে আমরা দেখতাম হঠাৎ সবই দ্রুত চলাফেরা করছে। আজ বিদ্যুৎ এলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই ওরা করল। পরিচালকের নাম জানলাম, লরেঞ্জো। পুরো নাম মনে নেই। ইতালিয়ান। তার সহযোগীরা সব ব্যবস্থা করে ফেলল।
সমস্ত ঘটনাটাই ওরা দৃশ্যবন্দি করবে ঠিক করেছে, অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ। কুড়ি বাই দশ মেঝে, সীমানা চিহ্নিত। আমি স্বভাব মতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই রঙিন কাগজ, মুখোশ, আঁকিবুঁকি কাটা, ফটোকপি, কাঁচি, ছুরি, এইসব। আসলে যা বলতে চাইছিলাম। এমন এক অপাঠ্য ভাষা নিয়ে খেলা হচ্ছে, যা অক্ষরের মতো দেখা যাচ্ছে। নানা দেশের নানা অক্ষর, কোলাহল করছে। কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝতে পারছে না। সভ্যতা তো এমনই। কোনো সভ্যতাই কখনও কাউকে বুঝে উঠতে পারেনি। দুর্ভাগ্য মানবজাতির। অর্থ, ক্ষমতা যাদের বেশি, তারাই তাদের ভাষা অন্যের উপর জাহির করেছে। আমার বলার কথা তেমনি হল।
লরেঞ্জও দ্রুত নির্দেশ দিচ্ছে সহকারীদের। আমি ছুটে বেড়াচ্ছি। কথা বলে যাচ্ছি। বুঝিয়ে যাচ্ছি ঘটনাটা। সাজি এক পাশে লক্ষ করে যাচ্ছে, বিস্মিত মুখে। ভাবছে, বাবা কী পাগলামো করে চলেছে। মনে পড়ল, যখন আমরা, বাবা ও মেয়ে হেঁটে হেঁটে ভোরের কুয়াশা ঠেলে, ওই স্থাপত্যের দিকে এগিয়ে যেতাম, রাস্তার দু-ধারে প্রাচীন, ইতালিয়ান, কারুকার্যমণ্ডিত স্থাপত্য, পাশেই আধুনিকতা, প্রশস্ত রাস্তা, পরিচ্ছন্ন, দুটো বাদামি মানুষ হাঁটছে। আর একটা বিচিত্র গান গাইছে। গুপীর গান। সত্যজিতের গুপী গাইন চলচ্চিত্রের এক বিষাদ দৃশ্য— গুপীকে গ্রাম থেকে গাধার পিঠে চাপিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উলটো দিকে গাধার উপর গুপী বসে মানে লেজের দিকে মুখ করে, আর গুপী গাইছে। তৃতীয় সুর আর ষষ্ঠ সুর গুপী চলল বহুদূর। বাঘে যদি ধরে, গুপী যদি মরে? হাউ হাউ কান্না। আমরাও কাঁদতাম, মজা করে। পৃথিবীটা অনেক বড়ো। আমি তৃতীয় বিশ্বের এক অখ্যাত, অনামা প্রান্তিক শিল্পী। অমন বিশ্ব দরবারে, যেখানে ঘোগের বাসা, পড়েছি। তাই অমন গান ও কান্না!
একদিন, কাজ শেষে, ইতালিয়ান টেলিভিশন আমার সাক্ষাৎকার নিতে এল। সে আর-এক পর্ব। পরের দিন শোনাব।
(ক্রমশ…)
কোনোরকম কর্পোরেট ফান্ডিং ছাড়া সম্পূর্ণরূপে জনতার শ্রম ও অর্থে পরিচালিত এই নন-প্রফিট এবং স্বাধীন উদ্যোগটিকে বাঁচিয়ে রাখতে
গুরুচণ্ডা৯-র গ্রাহক হোন