(বাঁদিক থেকে) দিয়েগো রিভেরা, ফ্রিদা কালো এবং নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট-এর প্রথম সভাপতি অ্যানসন গুডইয়ার
ফ্রিদা কালো (১৯০৭-১৯৫০) ছিলেন মেক্সিকান দেয়ালচিত্র শিল্পী দিয়েগো রিভেরার স্ত্রী। বয়সের ফারাক দুজনের বিস্তর। কুড়ি বছরের। এই বিবাহকে কালোর বাবা বলেছিলেন, এক হাতির সাথে কপোতের বিবাহ। ফ্রিদা একটা বীভৎস দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মারা যাচ্ছিলেন। দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী। সেই অবস্থায় ছবি আঁকা শুরু করলেন। যার বিষয় হল নিজে। বেশি দিন বাঁচেননি। কিন্তু প্রভূত প্রাণশক্তি নিয়ে বিচিত্র বাস্তবতাকে আবিষ্কার করলেন। নিজেকে সুরালিস্ট বলতেন না। বলতেন—“আমি কখনও স্বপ্ন আঁকিনি তো! এঁকেছি শুধুই নিজস্ব সত্যিটুকু!”
এই নিজস্ব সত্য—এমন নির্মম, এমন অন্ধকার। হতাশা নয়, বিষাদ। আমার ওনার ডায়ারি পড়তে পড়তে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বেশিক্ষণ পড়তে পারছিলাম না। বারবার ফিরে যেতে হচ্ছিল একটা অমোঘ টানে। আমি নিজে স্বপ্নে বাঁচি। সে বাঁচা বিচিত্র। যদিও অন্ধকারে ছবি আঁকতে ভালোবাসি। কিন্তু সে অন্ধকার, ফ্রিদার অন্ধকার নয়। ফ্রিদার অন্ধকারে অপূর্ব এক ভালোবাসা আছে, প্রেম আছে। অসম্ভব প্রেমিক ছিলেন। এই প্রেম আপাত ভাবে মনে হয় জীবনের প্রতি, হয়তো তাই। সামনে বার বার মৃত্যু এসে দাঁড়ায় দোরগোড়ায়। উপেক্ষা করেন তাকে। মুখ ফিরিয়ে রাখলেও দৃষ্টির আড়াল হয় না সে। মৃত্যু, যন্ত্রণা, ভিতরের চাপা বেদনা, এসবই লিপিবদ্ধ হতে থাকে, ডায়ারির পাতায় পাতায়। তার সাথে চলে ভাবনার ছবি। সেসব এক বিচিত্র ছবি। শিল্পশিক্ষার কতগুলি মুদ্রাদোষের জন্ম দেয়। প্রচলিত শিল্পশিক্ষার এক ধরনের দক্ষতার আয়োজন থাকে। তথাকথিত স্ব-শিক্ষায় এই আয়োজন অদ্ভুত। কোন্ রেখা, কোন্ রেখাকে ছুঁয়ে যাবে। কোন্ রং কেমন ভাবে লেপন করা হবে, তার প্রথাগত, প্রচলিত কোনো অভ্যাসই এখানে কার্যকর নয়। যদিও এক অর্থে সব শিল্পীই স্ব-শিক্ষিত, তবুও একটা অদৃশ্য বিভাজন দেখা যায়। ফ্রিদা এ ব্যাপারে মুক্ত ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে আমার সাথে দিয়েগোর কাজের পরিচয় ঘটে। সেই কাজ আমাকে প্রভাবিতও করে। বার বার দেখতাম। কিন্তু ফ্রিদার কাজ দেখি অনেক পরে। ১৯৫৪ সালে যখন উনি মারা যান, তখন আমার বয়স নয়। প্রথম যখন দেখি, ওঁর দৃষ্টি থেকে নিজেকে সরাতে পারতাম না। এত কথা শুরুতে বলার কারণ, এরপর যে অসম্ভব প্রেম ও বিষাদের জগতে ঢুকে পড়ব, যা আমাকে অসম্ভব বিষণ্ণ করে রাখবে। একজন নারী তাঁর মৃত্যুচেতনা ও অসম্ভব জীবনপ্রেমী—এই দ্বৈত সত্তা নিয়ে জীবনের সাতচল্লিশ বছর কাটিয়ে গেলেন। প্রথম দুর্ঘটনার কথা ভাবলে, তিরিশ বছর এমন দুর্বিষহ জীবন। একই পুরুষকে দুবার বিবাহ করলেন। অজস্র সম্পর্কে জড়ালেন। সে তো জীবন-প্রেমই।
বিভিন্ন শব্দের আশ্চর্য সম্মোহক সব স্বরভঙ্গির ওঠাপড়া নিয়ে যে কালোর এই রোজনামচার পাতা জুড়ে খেলা করা, ভালো করে নজর করলে তাতে খানিক উন্মত্ততাও লক্ষ করা যায়। একটি শব্দ, যেমন, আমারিয়ো, স্প্যানিশ ভাষায় ‘হলুদ’। কালোর রঙের ব্যাখ্যার অভিধান অনুযায়ী এটার অর্থ ‘উন্মাদ আচরণ এবং রহস্যময়তা’। কিছু কিছু টুকরো টুকরো শব্দ। পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝা দায়। হয়তো তাদের ভিতরের কোনো সংকেত আছে। মনোজগতের সংকেত, যা আজ বুঝে ওঠা বেশ দুষ্কর মনে হয়। কিন্তু ধ্বনি ও অর্থ পাশাপাশি থাকার জন্য একটা ঝংকার সৃষ্টি হয়, যদিও তা বিষাদের সুরে বাঁধা, তবুও মাঝে মাঝে উচ্ছ্বাসও লক্ষ করি। আমি সামান্য এই চিত্রজগতে বিচরণ করি। বহু বছর আছি এর সাথে। কিন্তু ফ্রিদার ডায়ারি পড়ার আগ্রহ থাকলেও, অনুবাদের আড়ষ্টতা আমাকে বেশ পীড়া দিয়েছে। কোনো সমালোচনা নয়, এমন এক রমণী, শিল্পী ও প্রেমিককে আমি কাছে পেতে চাইছি, ঢুকে যেতে চাইছি তার মনোজগতের নানা সংকেতে। কোথাও একটা বাধা আসছে। জানি না।
ফ্রিদা লিখছেন—মহিলা সর্দার—শাকুনবিদ্যা-শ্বাস/ সুরভি-প্রেম-শুঙ্গ-বিহঙ্গ/ ডহর-উচ্চতা-বন্ধ-নীল/ বালি-তার-প্রাচীন/ জ্যোতিষ্ক-কুক্ষিদেশ-উন্মুক্ত-হলুদ/ আনন্দ-কস্তুরী-ল্যাভেন্ডার ফুল...
নীল বা বেগুনি রঙের মিশেল দেওয়া লাল রং যাকে আমরা বলি ম্যাজেন্টা, কালোকে মনে করিয়ে দেয় প্রিকলি পেয়ারের রক্ত অর্থাৎ নোপাস ক্যাকটাস ফুলের কথা। ফ্রিদার অনেক ছবিতেই এই ফুল এসেছে। নিজের শরীর, যন্ত্রণাকাতর শরীর, মুখাবয়ব, একে ঘিরেই ফ্রিদার জগৎ। মাঝে মাঝে বাইরের সংযোগ ঘটত। কিন্তু বেশি সময় বিছানায়। বিছানাতেই ছবি আঁকা। শিল্পী তাই এই বিশেষ সেলফকে এড়াতে পারেননি, বা চাননি। “নিজেকে আঁকি বারবার, কারণ একা থাকি তো! এত ভালো বিষয়বস্তু আর পাই কোথায় নিজেকে ছাড়া? যার সঙ্গে আমার চেনাজানা আর অন্তহীন বোঝাপড়া? আমি স্বপ্ন আঁকতে পারি না। আমার বাস্তবই ভালো।”
শিল্পী কেন ছবি আঁকেন? এই আঁকা একটা এমন চলন, যাত্রা, উন্মোচন, এমন বোঝাপড়া, যা আঁকার মধ্য দিয়েই ঘটে চলে। আঁকতে আঁকতে হয়তো শারীরিক যন্ত্রণা ভোলা যায়! মনের গতিকে পালটানো যায়! আর নিজেকে একা মনে হয় না। সমস্ত শিল্পই একটা সেলফ। চিত্রগুলি জীবন্ত এক অস্তিত্ব। তার সাথে কথা বলে, তারা শিল্পীর কাছে ফিরে ফিরে আসে। এই ফিরে আসাই শিল্পীর প্রাণশক্তি। এ কোনো শখ-আহ্লাদ নয়। শখ মেটানো নয়। এটাই যাপন। এই অতীব কষ্টকর যাপন, ফ্রিদাকে বহন করতে হয়েছিল। এই রোজনামচাই তার সাক্ষী। ঈশানী রায়চৌধুরীকে ধন্যবাদ, এমন একটি অপূর্ব কাজ আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। প্রকাশককেও ধন্যবাদ।
ঈশানী লিখছেন—মন্তব্য করছেন—“৪০-৪১ পৃষ্ঠার ছবির কেন্দ্রে যে অবয়বটি আছে, তা অনেকটা জ্যানাসের মতো দেখতে ষাঁড়ের মাথা, যা পরোক্ষ ভাবে যেন রোমান দেবতা আর পিকাসোর মাধ্যমে আমাদের চেনা গ্রিক উপকথা... দুইয়ের ইঙ্গিত বহন করে। ১৯৩৯ সালে প্যরি শহরে কালোর সঙ্গে পিকাসোর সাক্ষাৎ হয়েছিল। মিনোটার, অর্থাৎ গ্রিক উপকথা অনুযায়ী যে প্রাণীর মাথা আর লেজ ষাঁড়ের আর শরীর মানুষের... কালো খুব উপভোগ করতেন মানুষের অর্ধনারীশ্বর, বা বলা ভালো, উভলিঙ্গ রূপ। ১৯৪৪ সালে তিনি দুটি ছবি এঁকেছিলেন, যাতে তিনি নিজে আর রিভারা একটি মুখের মধ্যেই মিলেমিশে একাকার হয়ে আছেন।”
ফ্রিদা বলতেন, তিনি নিজেই নিজের জন্মদাত্রী। সাধারণ ভাবে নিজেকে ভালোবাসা, নিজের সাথে প্রেম—এই ভাবনার সঙ্গে, এর কোনো মিল নেই। নিজেকে নিয়েই চর্চা হচ্ছে, কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা। ‘নিজ’ এটি একটি মাধ্যম মাত্র। ৫১ নং পৃষ্ঠায় সম্ভবত কালোর সবচেয়ে আচ্ছন্নকারী ছবি।
দুটি (অথবা তিনটি) পোর্ট্রেটের একত্রীকরণ, যা তাঁর বড়ো মাপের চিত্র ‘দ্য টু ফ্রিদাস’-কে মনে করিয়ে দেয়। কালোর পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নগ্ন আত্মপ্রতিকৃতি পৃষ্ঠা নং ১২৪, ১৪১ এবং ১৫৮-র সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলিকে একটি সিরিজ হিসেবে বিবেচনা করলে কালোর ক্রমাগত শারীরিক অবনতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
“এই ছবি ফ্রিদার ডায়ারির শেষ ছবি এবং ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে সম্ভবত তাঁর শেষ আঁকাও বটে... যে মৃত্যুকে উনি উপহাস করেছেন, আবার ভয়ও পেয়েছেন, যে জীবনান্ত তিনি আকাঙ্ক্ষা করেছেন, আবার তার বিরুদ্ধে সংগ্রামও করে গেছেন, এ ছবি সেই ছবি।” পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার মুহূর্তকে এমন ভাবে দৃশ্যে কল্পনা করা, এ খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। সেই অর্থে ফ্রিদা খুব স্বাভাবিক ছিলেন না।
রোজনামচার একটা পাতা...
—নেই
চাঁদ, সূর্য, হিরে, হাত—
আঙুলের ডগা, বিন্দু, রশ্মি, সূক্ষ্ম জালি কাপড়, সাগর।
পাইন-সবুজ রং, গোলাপি কাচ, চোখ,
আমার ইরেজার, কাদা, মা, আমি আসছি।
= হলুদ ভালোবাসা, আঙুল, কাজে আসে
যে সন্তান, ফুল, ইচ্ছে, কুশলতা, রজন।
চারণভূমি, বিস্মাথ, তপস্বী, সুয়প টারিন।
বৃত্তাংশ, বজর, টিন, আর একটি ঘোড়ার বাচ্চা।
...
বহু দৃশ্যকল্পের, অজস্র সম্ভার। একটা ঘোর লাগা শব্দ-এর মিছিল। এই লেখাটার সামান্য উদ্দেশ্য একটা মহতী জীবনকে ছুঁতে যাওয়া। পাঠকের আগ্রহ বাড়ানো। বইটির পাতায় পাতায় শব্দ, অক্ষর ও চিত্রের বিস্ময়। ধানসিড়ি খুবই যত্ন নিয়ে ছেপেছেন। বিন্যাস খুবই সুন্দর। নির্ভুল সংকলন। এটা ঠিকই এই বইটি আরও দীর্ঘ আলোচনা দাবি করে, যা এখানে সম্ভব হচ্ছে না। ফ্রিদার বহু দিক আলোচনায় আসে। রিভেরার প্রতি গভীর প্রেম, আচ্ছন্নতা। বিচ্ছেদের পরেও ফিরে আসা, আবার একই সাথে বহু, নানা ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, পড়ার আগ্রহ! এখানে ফ্রিদা নানা পরতে, নানা স্তরে বিভক্ত, জীবনকে অসম্ভব ভালোবাসার নিদর্শন।
এক অজানা তথ্য খুব সহজেই বর্ণিত হয়েছে। ধন্যবাদ লেখককে। প্রকাশকও ধন্যবাদার্হ।
'ফ্রিদা কালো (১৯০৭-১৯৫০) ছিলেন মেক্সিকান দেয়ালচিত্র শিল্পী দিয়েগো রিভেরার স্ত্রী।' - লেখাটা এই লাইন দিয়ে শুরু হলো কেন ভাবছি। ফ্রিদার প্রেম, সম্পর্ক, এইসব তাঁর জীবন ও শিল্পের পরিচয় পেতে গুরুত্বপূর্ণ তা ঠিক। তবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দিক থেকে বরং ফ্রিদা তো অনেক বেশি, পরিচিত।
এই প্রশ্নটুকু ছাড়া, লেখাটা খুব ভালো লাগলো। ফ্রিদার মত প্রথাভাঙা শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে হিরণ মিত্র'র থেকে যথাযথ আর কার কলমই বা হতে পারে।