(১)
আমার নাম হাবু। আর আমি এখন জেলে। কী করেছি? সেটা বলতেই তো লিখতে বসেছি।
আমার একটা সমস্যা আছে। কথায় কথায় খুব রাগ হয়। খুব ভায়োলেন্ট রাগ আমার। এই তো সেইদিন পাশের বাড়ির রনিকে ধরে অকথ্য অত্যাচার করলাম। কেন? কারণ আছে। আমার টিয়াকে অপমান করেছিল বলে। কানের সামনে আমার ভালোবাসা নিয়ে মশকরা করছিল। তাই ফেলে মেরেছি। মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছি। আর কোনোদিন লাগবে না আমার সাথে। তবে কাউকে বলতে পারবে না সে, এমন ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছি।
স্কুলে যাই আমি। কিন্তু মন টেকে না আমার। বাপ আমার পিঠে প্রত্যেক দিন একটা করে লাঠি ভাঙে মদ খেয়ে এসে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ধরে তাকেও বুঝিয়ে দিই। কিন্তু বাপ বলে কিছু করে উঠতে পারি না। হয়তো একদিন সত্যি কিছু একটা করে বসব। প্যান্টের থেকে বেল্ট খুলে মারব, যেমন ভাবে আমাকে মারে। দেখব কী সুখ আসে।
মা তো অনেকদিন আগে চলে গেছে। না না, সে ঠিক আছে। অন্য আর-এক বাপের সাথে থাকে। আমার তাকে পোষায় না। তাই হয়তো সেই বাপের বেটাকে পিটিয়ে দিয়েছিলাম সেইদিন। আমার মাকে মা বলতে এসেছে। হারামি শালা।
বিরক্ত করে দিয়েছে আমাকে এই জঘন্য পৃথিবী। তাই আমি শেষ মেষ ঠিক করলাম সুইসাইড করব। গলায় দড়ি অবধি লাগিয়েছিলাম। সব প্ল্যান ছিল। বাপ মদ খেয়ে এসে মারধর করবে। তারপর বিছানা ভিজিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে রোজকার মতো। আর সেই সুযোগেই বারান্দাতে দড়ি টাঙিয়ে ঝুলে পড়ব। লোকে ক্ষুদিরাম বলবে। সেও স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিল আর আমিও। কিন্তু আর হল কই? দড়ি লাগিয়েছিলাম, কিন্তু পটলটা এমন ভাবে পা কামড়ে ধরল আর হল না। তারপর টিয়াও রাগ করেছিল আমার উপর।
ও, পটল হল আমার খোঁড়া কুকুরটা। তার আবার খোঁড়া হাওয়ার পেছনে আমার বাবাই দায়ী। পিছনে গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে তার পায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে পটল আমার খোঁড়া।
মাতাল বাপ আর পালিয়ে-যাওয়া মাকে নিয়ে আমার হারানো এই জীবন। উঠতে বসতে খালি গালাগালি আর মারধর। রাগ জমে জমে পাহাড় হয়ে গেছে আমার মধ্যে। তাই মাঝে মধ্যে ডিনামাইট দিয়ে ব্লাস্ট করে দিতে হয়। বেশির ভাগ সময় সেই বিস্ফোরণের ফুলকি পাড়ার ছেলেদের উপর গিয়েই পড়ে। বাপের রাগ কেন আমার উপর তা বুঝে উঠতে পারি না।
তবে সেইদিন আমার সাথে যা একটা ঘটনা ঘটল তার ব্যাখ্যা আমি এখনও দিতে পারব না।
(২)
আমি ছাদের ঘরে বসে বসে বিড়ি খাচ্ছি আর একটা গান চালিয়েছি। গানটা হল ভিভাল্ডির উইন্টার। ক্লাসের স্যার বলেছিল এর কথা। তাই ভাবলাম চালিয়ে দেখি ইউটিউবে। তো সেই হাড় কাঁপানো বেহালার সুর এই ভ্যাপসা গরমে আমাকে উইন্টারের ফিলিং দিতে পারল না। আমি জানলা দিয়ে সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওখানেই টিয়াকে দেখতে পাই। টিয়া আমার খুব প্রিয়। সারাক্ষণ হাসে আমাকে দেখে। আমিও হাসি। স্কুলে যায়, কথা বলে আমার সাথে।
এখনও দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখছে। আমি ধোঁয়া ছাড়তে থাকি আপন মনে। আর নজর রাখি। বেহালার সুরটা আমার ফুসফুস থেকে বেরোনো ধোঁয়ার মতো কাঁপছিল তখন।
হঠাৎ একটা ‘ভ্রুম’ আওয়াজ করে গাড়ি এসে দাঁড়াল পাশের বাড়িতে। যখনই ভিভাল্ডির জিনিয়াস নিয়ে ভাবতে বসেছিলাম তখুনি এই কাণ্ড। নিশ্চয়ই কেউ নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে সেখানে। দেখলাম একটা লোক তার পরিবার নিয়ে নামল। পরিবারে আমার বয়সি একটা ছেলেও আছে। বেশ ফান্টুস মার্কা। মার্কেটে আর-একটা কম্পিটিশন।
ছেলেটাকে বেশ ভালো দেখতে। ফরসা, ছিপছিপে চেহারা।
বুঝতেই পেরেছিলাম। এটাকেও পেটাতে হবে। ওর ওই স্টাইল আমার পছন্দ হচ্ছে না।
ঝংঝং করে বেহালাগুলো এলোমেলো সুরে আমার মধ্যে সুপ্ত হয়ে থাকা এবোমিনাল স্নোম্যান যেন জেগে উঠছিল। একটা সুযোগ দরকার, এরকম মার দেব যে চোখে সানগ্লাস ঠুকে চলা বের হয়ে যাবে।
আমি প্ল্যান করতে থাকলাম। পটল আমার পাশে বসে ল্যাপটপের উপর পা রেখেছে। সেই ভাঙা পাটা। সঙ্গে সঙ্গে বাপের কথা মনে পড়ে গেল।
‘ধড়াম!!!’
ল্যাপটপটা জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলাম। হঠাৎ করে এরকম একটা আওয়াজ হাওয়ায় আগত লোকজন যেন চমকে উঠল। পটল আমায় শিখিয়েছে। টেরিটরি বুঝিয়ে দিতে হয়। এটা আমার টেরিটরি, টিয়া আমার। কেউ ওর দিকে তাকাতে পারবনা।
টিয়া আর নেই ওখানে। আর ওই ফান্টুসটা আমাকে মেপে গেল। বলাই বাহুল্য, সেই রাতেও পিঠে আমার লাঠি ভেঙেছে।
(৩)
কিছুদিন পরে দেখি আমারই স্কুলে ভরতি হয়েছে ওই বাঁদর ছেলেটা। দেখেই মাথা গরম আমার। ব্যাগে একটা কচি ছিল। ইচ্ছে করছিল ঢুকিয়ে দিই। কিন্তু আটকে গেলাম। একটু টাইম দিতে হবে। আড় চোখে মেপে নিলাম। ও আমাকে বেশ নজরে রেখেছে। আমার শরীরের রক্ত পেট্রোলের মতো জলে উঠছে। আজ ওর হাড়গুলোকেই গুঁড়ো করে পেপারে রোল বানিয়ে খাব। অঘোরী হতে যাব।
অন্যের ভস্মে নিজের ভেতরে ধুকধুক করে জ্বলে ওঠা আগুনকে নেভাব। শুনেছি কোন্ এক উপজাতির লোক মানুষের মাংস খেয়ে শক্তি বর্ধন করে। ক্যানিবাল হয়ে যাব আমি।
টিফিনের সময় দেখলাম একা দাড়িয়ে শিমুল গাছের নীচে। কী একটা দেখছে। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। মনটা কেমন মারব মারব করছে।
কাছে যেতেই মুখ ঘুরিয়ে বলল, “হাবু নাকি? তুইও এই স্কুলে পড়িস?”
মনে মনে বললাম, তো কি ন্যাকামি করতে এসেছি? ছেলেটাকে যতটা ছিপছিপে ভাবছিলাম ততটা না। আমার থেকে হয়তো বেশি, মাসল-টাসল আছে। তাই একটু সামলে চলতে হবে।
“এই তুই কিন্তু টিয়ার থেকে দূরে থাকবি বলে দিলাম।”
ছেলেটা আমার দিকে একটা ডোন্ট কেয়ার অ্যাটিট্যুড নিয়ে দেখল। তারপর বলল, “টিয়াটা আবার কে?”
“আমার পাখি। ওর দিকে তাকালে তোর ডানা কেটে দেব। এই বলে রাখলাম। খুব সাবধান।”
“আর তোর দিকে তাকালে?”, ছেলেটা একটা অদ্ভুত মুচকি হেসে বলল।
আমার তো পিলে চমকে গেল। বলে কী ছেলেটা।
মাথাটা চড়াৎ করে গরম হয়ে গেল। “মেরেই ফেলব তোকে। বেশি বেয়াদবি? তুই চিনিস না আমাকে।”
“তা চিনতেই তো চাইছি”, স্বাভাবিক ভাবে বলল ছেলেটা।
আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। কী করব বুঝতে পারছি না। হাসব না মারব কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথাটা কেমন ভেজা ভেজা লাগছিল।
ছেলেটার শরীর থেকে কেমন যেন একটা উষ্ণতা অনুভব করতে লাগলাম। ব্যাপারটা অন্যদিকে যাচ্ছে। আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। আস্তে আস্তে গজগজ করতে চলে গেলাম।
(৪)
বাড়িতে ফেরার পথে দেখা হল আমার খাঁচা খোলা পাখির সাথে। সবুজ আর সাদার কম্বিনেশনের জামাকাপড়।
আমি সাইকেলটা নিয়ে ওর পাশে গিয়ে জোরে ব্রেক কসলাম।
“হু!!!”, চমকে উঠল।
“ঘুরতে যাবি?”
একটা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকাল সে। মনে হচ্ছিল এখুনি শিস দিয়ে “না” বলবে।
“যাব। কী খাওয়াবি আগে বল”, কোমরে এক হাত দিয়ে অন্য হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরল।
“কাঁচা ছোলা।”
দুটো চোখ দিয়ে প্রায় গিলে খাবে যেন।
“বেশি বাড় বেড়েছিস না?”
টিয়া এবার রেগে গিয়ে গটমট করে চলতে লাগল। আমারও মাথা গরম হয়ে উঠেছে। ওই ছেলেটার দৌলতেই আমার মাথা কাজ করছে না। সাইকেলটাকে একেবারে হায়াবুসার মতো ছুটিয়ে দিলাম।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে, কিন্তু পটলকে খুঁজে কোথাও পাচ্ছি না। এই ঘর, ওই ঘর, দোতলা, বাইরে—সব জায়গায় খুঁজলাম। “পটল! পটল!” কোনো সাড়া নেই।
মনটা একটু খারাপ লাগতে শুরু করল। রাত বেড়েছে। কিন্তু পটলের কোনো খোঁজ নেই। সামনে একটা গাড়ি আসছে। নিশ্চয়ই আমার মাতাল বাপ। দরজা খুলে ঢুকল মাতাল বাপ, সঙ্গে আবার আর-একজন। জানি না আবার একে মা বলতে হবে কি না। লোকেরা মা-বাবার জন্য ছটফট করে আর আমি? আমার মা-বাবার অভাব নেই। নিজেকে কেমন যেন বিশ্বসন্তান বলে মনে হয়।
জানলা দিয়ে দেখি টিয়া কী করছে। দেখি একটা সাদা কাপড়ে জড়িয়ে আছে। ওর ঘরে একটা গোল চাঁদের মতো লাইট আছে। টিমটিম করে জ্বলে রাতের বেলায়, কেমন যেন মুক্ত আকাশের খোঁজ দেয়। কোন্ এক সপ্নের দেশে নিয়ে যায়, যেখানে আমার টিয়া হয়তো তার সবুজ ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। আর আমি সেই আলোর ছায়াপথে দাঁড়িয়ে থাকি তাকে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য। সারা শরীরটা কেমন যেন উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
ওমনি ছাদের দরজা খুলে কে যেন ঢুকে পড়ল ঘরে। আমি চিৎকার করে ডাকার আগেই চোখের সামনে তারা ফুটে উঠল।
কতক্ষণ ওরকম ছিলাম জানিনা। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি সকাল হলে গেছে।
রাতে চোর ঢুকেছিল। ইশ, একটু যদি জানতে পারতাম আগে থেকে তাহলে লাঠি দিয়ে মেরে মেরে শেষ করে দিতাম। যে বাপের রক্ত আমার গায়ে আছে সেখানে মারধর করতে পিছপা হইনা আমি।
বিছানা থেকে উঠে বাথরুম যেতে গেলাম। যা চুরি হাওয়ার হয়েছে। বাপ বুঝবে। বাথরুমে যেতে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ। ঠক ঠক করে বুঝতে পারলাম আমার নতুন মা জায়গা দখল করে নিয়েছে।
একটু পরেই বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু বয়স্ক ভদ্রমহিলা। আমাকে দেখে বলল, “মনে হচ্ছে বেশ ভালোই রাত কেটেছে।” হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। কথাটার মানে বুঝতে পারলাম না।
বাথরুমের দেয়ালে টাঙানো বাঁকা আয়নাটা দেখে চমকে উঠলাম। সারা শরীরে দাগ। এটা কখন হল? বোকা না আমি। বুঝি এই দাগের মানে। এবার আমার টেম্পোরারি মায়ের কথাটা কেমন লজ্জা পাইয়ে দিল। কিন্তু কীভাবে?
পটল এখনও ফেরেনি। কোথায় যে চলে গেছে? আমি মনখারাপকে পকেটে নিয়ে স্কুলের দিকে এগোতে থাকলাম। রাস্তায় আবার সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে দেখি। দেখেই সারা গা জ্বলে উঠল।
আমি একটু এগোতেই দেখি ও আমার কাছে চলে এসেছে।
“কী রে, কাল রাতে আমার ঘরে এসেছিলি কেন?”
শুনেই আমি চমকে উঠলাম। “তোর ঘরে মানে? কী যা তা বলছিস তুই? আমি তোর নামটা অবধি জানি না।”
ছেলেটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “ঋক।” তারপর বুকপকেট থেকে চশমা বার করে চোখে এঁটে বলল, “ইয়ার্কি করছি। স্বপ্নে এসেছিলি তুই আমার।”
আমার হাতটা মিসমিস করে উঠল। কিন্তু কেন জানি না কোনো এক অদৃশ্য শক্তি এসে আমার হাত চেপে ধরল।
“আজকেও আসিস কিন্তু।”
আমি কিছু না বলে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম টিয়া দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য। তার সেই একই সবুজ-সাদা জামাকাপড়ে। আমি পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে চললাম। পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
“কী রে, আজ আর ঘুরতে নিয়ে যাবি না?” টিয়া বলে উঠল।
আমি মুখ না ঘুরিয়ে রওনা দিলাম স্কুলের দিকে।
(৫)
ফেরার সময় মাথাটা খারাপ হয়েছিল। আজ পুরো একদিন হল পটলকে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় আছে ছেলেটা কী জানি। মনে খুব চিন্তা লাগছিল।
নিজের খেয়ালেই বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌঁছে গেলাম তখন দেখি ঋক সামনে দাঁড়িয়ে। আমার আর ওর সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না। তাই আমি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে যাব অমনি দেখি ও আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে দাঁড় করাল।
“দ্যাখ কাকে নিয়ে এসেছি”, বলে পাশ থেকে দড়ি টানল।
আমার চোখ দুটো ছানাবড়া। “পটল!! কোথায় ছিলি তুই?”
“রাস্তার ধারে ড্রেনে পড়ে গিয়েছিল। উঠতে পারছিল না।”
ঋককে দেখে আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারিনি। ছেলেটা একটু অদ্ভুত। আমি পটলকে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম।
সন্ধেবেলায় আমার আবার এক নতুন মা এসেছে। তার সাথে বাপ মাতাল হয়ে অকারণে জিনিসপত্র ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে। কীসের এই আনন্দ তা বলতে পারি না। নীচে যেন বিয়ে লেগেছে। মদের ফোয়ারা বইছে আর আমার মাতাল বাপ নেচে যাচ্ছে। যেন জমিদারের বাইজিবাড়ি। আমি তাকে বাধা দিতে যাওয়ায় কোমর থেকে বেল্ট খুলে আমার পিঠে তার ফুর্তির সীমারেখা টেনে দিল। একবার নয়, বার বার। আমি চিৎকার করতে করতে দেখি আমার নতুন মা নেশার ঘোরে হেসে যাচ্ছে। আমার চোখের জলের সাথে তার মদের জলের খুব একটা পার্থক্য নেই। আজকে বুঝলাম রোমানরা কেন গ্ল্যাডিয়েটরদের খেলা দেখতে যেত। অন্যের উপর অত্যাচারে এক অদ্ভুত আনন্দ আছে।
আমি যত বাপের হাত ধরে প্রতিবাদ করি আর বাপ তত চাবুক চালিয়ে যায়। আমাদের বাড়িটা যেন একটা কলোসিয়াম। আর আমরা দুই গ্ল্যাডিয়েটর।
শেষে পরাজিত হয়ে ফিরে এলাম আমার কোটরে। পিঠে আমার বাপের নৃশংসতার আঁচড়। আগ্নেয়গিরির অঙ্গার যেন পিঠের উপর পড়েছে। আর জ্বলে যাচ্ছে আমার সর্বাঙ্গ। বিছানার উপর বুক পেতে শুয়ে তাকিয়ে রইলাম। টিয়া? তুই কোথায়? উড়ে গেছে হয়তো ডানা মেলে।
হঠাৎ করে কার যেন একটা কোমল স্পর্শ পিঠে অনুভব করলাম। সারা দেহে কেমন যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। কে এসেছে? নীচে তো হয়তো এতক্ষণে উলঙ্গ নৃত্য চলছে, তাহলে কে এসেছে? সেই চোরটা নয়তো? যে আমার সারা গায়ে দাগ কেটে গেছে। আজকে আর শক্তি নেই লড়াই করবার। আমি বিধ্বস্ত আজকে।
হাতের কোমল ছোঁয়ায় আমার সর্বাঙ্গ গরম হয়ে উঠল। আমি মাথা তুলে চেয়ে দেখি কেউ নেই। কেউ নেই? তাহলে? আমার ঘাড় বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগল। রাতের সহস্র তারার আলো জানালা দিয়ে আমার গায়ের উপর এসে পড়েছে। আমার হাত-পা অবশ। সেই আলোতেই যেন স্নান করে উঠেছি আমি। একটু উষ্ণ বাতাস আমার সারা শরীরের ব্যথাতে মধুর মতো কাজ করল। আবেগের সাগরে আমি ভেসে যাচ্ছি। আমার চেতনা, আমার আত্মা সব যেন বেখেয়ালি হয়ে পড়েছে। টিয়া, তুই এসেছিস? কোনো উত্তর এল না। খালি একটা ছোঁয়া। এই ছোঁয়া আমার চেনা। আমি জানি কে এসেছে। তাকে দেখতে আমি পাচ্ছি না, কিন্তু তাকে বুঝতে পারছি।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন সারা শরীরে কোনো ব্যথা নেই। কী হয়েছিল রাতে আমার সাথে? কোথায় সে?
আমি রোজকার মতো সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। দেখি ঋক দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে একটু ট্যারা ভাবে তাকিয়ে মুচকি হেসে উঠল। অন্য সময় হলে আমার সারা শরীর জ্বলতে থাকত। লাঠি নিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিতাম, কিন্তু আজকে অন্য কিছু ইচ্ছা করছিল। আমি সাইকেলটা নিয়ে তার কাছে গেলাম।
বুঝতে পারছিলাম আমার শরীরে কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে। আমার মন আমাকে আটকে রাখলেও আমার আত্মা আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ওর কাছে গিয়ে দুহাত দিয়ে ওর গাল দুটো ধরে ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিলাম।
আমার মনে যে কী চলছিল তখন তা পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। খালি এইটুকু বলতে পারি ভালো লাগছিল। মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল ঋকের সাথে। মনে হচ্ছিল কত জন্ম জন্মান্তর ধরে এক ভাবে আছি আমরা।
যখন ওকে ছাড়লাম আমি, তখন মুচকি হেসে বলল, “কী চাস তুই?”
আমি বললাম, “আমার টিয়া হবি?”
“টিয়া? কিন্তু আমি তো ভাবতাম উলটো দিকের বাড়ির মেয়েটার নাম টিয়া।”
আমি হাসলাম। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলাম, “হবি আমার টিয়া? বল না।”
ঋক আবার একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ হব। যদি না খাঁচায় বন্দি করে রাখিস।”
আমি হেসে বললাম, “খাঁচাবন্দি তো আমি আছি।”
(৬)
টিয়া আমার প্রেমিক। আমি তার জন্যই বেঁচে আছি। গভীর নিশিতে তার আসা-যাওয়া। তার সাথেই বেড়ে উঠেছি। আমার দুঃখের সাথি, আমার ভালোবাসা। আমার মনচোরা। প্রতি রাতে আমি ও আমার অদৃশ্য ভালোবাসা একসাথে শুয়ে থাকি। তাকে দেখতে আমি পাই না, কিন্তু সে আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। দিনের বেলায় ঋকের সাথেই সময় কেটে যায়। আমার বাপ তার স্বভাবমতো প্রতি রাতে একই কাজ করে থাকে। নতুন নতুন কত লোক আসে আমাদের বাড়িতে, খালি পুরোনো সেই মানুষটা আর আসে না। যাকে কখনও আমি মা বলে ডাকতাম। তবে সেই অভাবও আমার পূরণ হয়ে গেছে। পূরণ হয়ে গেছে আমার ভালোবাসার ঘাটতি। আমাকে যেমন আমার নিজের মা ত্যাগ করে দিয়ে অন্য ভালোবাসার দিকে ছুটে চলেছে, আমিও তাই করব। যেখানেই ভালোবাসার গান বাজবে সেখানেই গিয়ে দাঁড়াব।
পুরুষ, নারী, লিঙ্গ, স্তন, যোনি কোনো কিছুই মাহাত্ম্য রাখে না। আমি শিখেছি এই সমাজ থেকেই কীভাবে অন্যকে আপন করে নিতে হয়। আর শিখেছি সেই অদৃশ্য মানুষটার থেকে সমাজের কোনো তোয়াক্কা না করতে। ভগবানও বলে গেছেন আমি অনন্ত, আমি সত্যি। তাই সব শেষে রয়েছে শুধু আমি। আমি আজন্মকাল ধরে রয়ে গেছি এই পৃথিবীতে। আমি ভালোবাসা, আমি সময় আর আমিই সমাজ।
..........................................
আমার বাপের অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাকে আর আমি বোঝাতে যাই না কিছু। মাঝে মধ্যে রাগ হয়, কিন্তু সেও নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে হয়তো। তবে সেই রাতে যে এমন একটা জিনিস ঘটে যাবে, তা আমি আশা করতে পারিনি।
সেই সন্ধেতে আমি একটা আপেল খাচ্ছিলাম। একটু পটলকে দিই আর একটু আমি খাই। ছুরি দিয়ে কেটে কেটে একটু একটু করে রসিয়ে রসিয়ে খাচ্ছিলাম। অমনি দরজায় দেখি টিয়া দাঁড়িয়ে। নীচে বাপ আমার পার্টি করছে আর এদিকে টিয়া আমার দিকে এক গভীর কামনা ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার টিয়া এখন রক্তমাংসের মানুষ। তার মাসল আছে, পার্সোনালিটি আছে। তাকে দেখেই আমি পুরোনো টিয়াকে ভুলে গেছি। যতই বাপকে ঘেন্না করি না কেন, আসলে তার রক্তই আমার গা দিয়ে বইছে।
জড়িয়ে ধরলাম টিয়াকে। তার স্বপ্নালু দেহকে নিজের করে নিলাম। তার চোখের মধ্যে যেন আমি ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমার সত্তা, আমার অস্তিত্ব তাকে ছাড়া কিছুই নয়।
আমাদের এই বিগলিত মুহূর্তে কে যেন দরজার সামনে থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “শুওরের বাচ্চা!!! আজকে তোকে শেষ করে দেব।”
আমার বাপ বেল্ট খুলেছে আবার। “সপাৎ!” করে চমকে উঠল আমার পিঠটা।
আবার শুরু হল সেই গ্ল্যাডিয়েটর খেলা। আর দাঁড়িয়ে তামাশা দেখল রোমানরা। তবে আজকের দিনটা অন্য। আজকে একজন রোমান আমাকে নিজের ভেবেছে। তাই সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অতর্কিতে আমাকে রক্ষা করার জন্য।
“তোকেও শেষ করে দেব!!! মর! মর!” হুঙ্কার ছাড়ল সেই দাঁতাল পশু।
তারপর নখ বার করে এগিয়ে এল তার দিকে। আমি আটকাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেল। বেল্টের মুখের দিকটা তার মাথায় লেগে ছিটকে বেরোল রক্ত। সেই যুগেও যা হত এখনও তাই হচ্ছে। রক্তের বন্যা আমার গায়ের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। নিষ্পাপের রক্ত হয়তো এই ভাবেই সভ্যতার শেষ দিন অবধি বইবে। আর আমরা খালি দেখে যাব, যতক্ষণ না এই রক্তিম নদীর বাঁধে কোনোরকম ফাটল পড়ে।
কিন্তু আমার বাঁধ অনেককাল আগেই ভেঙে গেছিল। প্রয়োজন ছিল শুধু একটু জোয়ারের।
আপেলের ছুরিটা বসিয়ে দিলাম সেই পশুটার কাঁধে। আরও রক্ত। আরও বেদনা। চিৎকার করে কেঁপে উঠল পুরো কলোসিয়াম। আর অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল রোমান। তার নেশালো হাসি আমার সহ্য হল না। এক পশুর চিৎকারে অন্য পশু জেগে ওঠে। তাই আবার আমার ধারালো নখে ঝরতে শুরু করল এক পরিবর্তনের চিহ্ন।
.............................................
বাড়ি থেকে খাঁচাবন্দি হয়ে যখন বেরোলাম তখনও বডি নিয়ে যায়নি। জেলের ভেতরে আমার আসল মা এসেছিল। নতুন বাপের সাথে। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি। এটা তো হবারই ছিল। এখন আমি আবার একা। জেলের ভেতরে এখন পায়ে শিকল জড়িয়ে আছে। আমার ডানাগুলো ফরফর করছে। উড়তে পারছি না। খালি অপেক্ষা করে আছি কবে টিয়া আসবে আবার আমার কাছে। যেভাবেই আসুক, আমি ঠিক তাকে চিনতে পারব।