
চারটে বাচ্চা হয়েছিল। সাদা কালো পশমের বলের মতন। ভাল করে হাঁটতেও পারত না। দাঁড়াতে গেলে পা বেঁকে যেত। তুরতুর করে ছুটে ছুটে গলির এই ধার থেকে ঐ ধার করত তারা । তাদের নেড়ি-মা ডাস্টবিন, হোটেলের আশপাশ, হাসপাতালের ময়লা জঞ্জাল আবর্জনা ঘেঁটে যদি কিছু পেত, মুখে করে নিয়ে আসত। রাত্রিবেলায় মায়ের পেট ঘেঁষে ঘুমোত চারখানা চোখ সবে ফোটা বাচ্চাগুলো।
গতকাল একটা তীব্র স্পিডে ছুটে আসা সুইফট ডিজায়ার দুটো বাচ্চাকে মাড়িয়ে দিয়ে গেল। রাস্তার ওপরেই খেলা করছিল তারা। গাড়ির আওয়াজ বুঝে সাবধানী এবং সচকিত হবার মত অভিজ্ঞতা ছিল না। গাড়িটাও, চাইলে স্পীড কমাতেই পারত। গলির মধ্যে আর কত স্পিডেই বা গাড়ি চালানো সম্ভব! দেখতে পায়নি এমনও নয়, কারণ তখন দুপুরবেলা। হয়ত, দেখতে পেয়ে গতি হালকা কমিয়ে দুখানা হর্ন দিতে পারত। অথবা স্টিয়ারিং হালকা বাম দিকে ঘুরিয়ে দিলেও কাজ চলে যেত হয়ত। কিন্তু, সম্ভবত দাঁড়াতে চায়নি। সম্ভবত, তার অনেক তাড়া ছিল। অথবা হতেও পারে যে দুটো রাস্তার কুকুরছানার জীবন তার অভীষ্ট লক্ষ্যের তুলনায় খুবই তুচ্ছ ছিল। অথবা হয়ত কিছুই না। রাস্তার কুকুরকে চাপা দেওয়াটাই হয়ত সেই আরোহীর নেশা। যে কোনও কারণেই হোক না কেন, বাচ্চাগুলোকে পিষে দিয়েই এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে রুদ্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাল নিজের গন্তব্যে।
রক্তে আর কাদায় থ্যাঁতলানো দুখানা অসহায় শরীর পড়ে ছিল অনেকক্ষণ। মানুষজন নাকে রুমাল চাপা দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। একটু সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল তাদের। কারণ, দুপুর থেকে নিঃশব্দে বাচ্চাগুলোকে ঘিরে বসে ছিল তিনটে পূর্ণবয়স্ক কুকুর, যাদের মধ্যে একজন ছিল শাবকদের মা। তারা আওয়াজ করছিল না, কাঁদছিল না, ক্রোধ প্রকাশও করছিল না। শুধু নিঃশব্দে বসেছিল। সেটাই তাদের শোকপ্রকাশের ভাষা কি না, কেউ জানত না। কিন্তু পথচারী মানুষদের মনে হয়েছিল, কুকুরের এই নৈঃশব্দকে ভাঙবার মত চটুলতা তারা এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। তাই সেদিন সেই জায়গায় সন্ধ্যেবেলার প্রাত্যহিক আড্ডাটা বসেনি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে জটলা করছিল লোকজন। আর নীরব কুকুরের দল পাহারা দিয়ে যাচ্ছিল শাবকদের মৃতদেহ। পরে, সম্ভবত মেথর এসে বাচ্চা দুটোকে ভ্যাটের গাদিতে ফেলে দিয়েছিল। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল তাদের । চোখ বন্ধ। সেখানে পিঁপড়ে জমছে। তারা তুলতুলে শাবকচক্ষুর মিষ্টি স্বাদ গ্রহণ করতে চেয়েছিল। পিঁপড়েরা যদি সেই চোখ খুলে দিতে পারত, তাহলে সেটাকে কাঁচের তৈরি মৃত পুতুলের চোখের মত লাগা অস্বাভাবিক ছিল না। সেই স্বচ্ছ কাঁচের প্রতিবিম্বে হয়ত তখন এসে ঠিকরে পড়ত আকাশ, সাউথ সিটি, নক্ষত্রমণ্ডলী, কালপুরুষ, আনওয়ার শাহ রোড ফ্লাইওভার।
দু'টি বাচ্চা মেয়ে, একজনের বয়েস ষোল, অপরজনের বয়েস বছর আট-নয়। ষোড়শীর আবার একটা বাচ্চা আছে, বছরখানেক বয়েস। তাকে কোলে নিয়ে কাজের সন্ধানে আসত ঘুটিয়াড়ি শরীফ থেকে। কলকাতায় তাদের বাসস্থান বলতে রাস্তার ধারে যে বড় বড় পাইপগুলো হয়, তার ভেতর। শতচ্ছিন্ন ময়লা জামা পরা দু'টি মেয়ে। বাচ্চাটির মাথা ন্যাড়া, গোল মুখ থেকে জিভটা বেরিয়ে থাকে অল্প। কোমরে ঘুনসি, কপালের এক ধারে কালো টিপ। একটি কলোনি পাড়ার গলিতে একদিন ভোরবেলা তারা ধরা পড়ে। অভিযোগ, তারা নাকি কোন বাড়ি থেকে মোবাইল চুরি করেছে। মানুষজন একত্র হয়ে প্রচণ্ড মারা হয় মেয়েগুলিকে। প্রায় গণপিটুনি। ভয়ে, অপমানে এবং ব্যাথায় আট বছরের মেয়েটি বমি করতে থাকে । যেটা বলবার, অত মার খেয়েও ষোড়শী কিন্তু তার কোলের বাচ্চাটিকে কাছছাড়া করেনি। ফলস্বরূপ যেটা হয়, মা-কে এভাবে মাটিতে চুলের মুঠি ধরে আছড়িয়ে মার খেতে দেখে ভয়ংকর আতংকে কিছু না বুঝেই চিল চিৎকার করতে থাকে কোলের শিশুটি। পুলিশ এসে তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এবং থানায় গিয়ে আবিষ্কার হয় যে গতরাত থেকে শিশুটি অভুক্ত আছে, কারণ তার কিশোরী মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। গতদিন কোনও কাজ জোটেনি বলে খাদ্যের সংস্থান করাও সম্ভব হয়নি। কাজেই, শিশুটির কান্না যদি ভয় পেয়ে নাও হয়ে থাকে, খিদের চোটে হতেই পারত। সেই ক্ষুধার্ত শিশুটি, কুকুরশাবকদের মতই যার আস্তানা হলেও হতে পারত ভ্যাটের আস্তাকুঁড়ে এবং যার নরম মৃত চোখে স্বচ্ছ আকাশ উছলে পড়বার সম্ভাবনা তৈরি হতে হতেও হয়নি, তার এক বছর বয়েস হবার আগেই পুলিশ গারদ দেখা হয়ে গিয়েছিল।
শীতের কলকাতায় রাস্তার ধারে জ্বলতে থাকা আগুনে গা সেঁকে নেওয়া ফুটপাতবাসী, ভ্যাবাচ্যাকা কুকুরের দল, ফ্লাইওভারের নিচে রাত কাটানো পরিবার, আসলে এরা সকলেই খুব ভয়ে থাকে । গড়িয়াহাটের ভিড়ে অনায়াসে কুকুরের পেটে পা উঠে যায়। রাত্রিবেলার মাতাল গাড়ির ছুটন্ত স্পিড দিক ঘুরিয়ে দিতে পারে ফুটপাতে। সাউথ সিটির ঝকঝকে কাঁচে নিজেদের ছায়া পড়লেও এরা দেখে ভয়ে সিটিয়ে যায়। কলকাতার মতনই আর একটি শহর, পুণে-র অভিজাত রাস্তা কোরেগাঁও পার্কের একটি ম্যাকডোনাল্ডের পাশে একদিন এক তরুণী মা ভিক্ষে করছিল। কোলের বাচ্চাটি ঘুমন্ত। সেখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের দেখে পয়সা চেয়েছিল সে । আমার বান্ধবী বলল, 'পয়সা দিই না। ম্যাকডোনাল্ডে চলো, তোমার বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছি'। মেয়েটি খুব ভয় পেয়ে উত্তর দিল 'না দিদি। ভেতরে ঢুকব না। একবার ঢুকে পড়েছিলাম, সিকিওরিটি মারতে এসেছিল। ওদের চোখ মুখ, আর ভেতরে যারা বসে থাকে, কী ভাল ভাল জামা পরা, ওদের দেখে ভয় লাগে। তুমি খাবার কিনে এনে দাও, এখানেই খাব।" আমার তখন মনে পড়ছিল, কলকাতার একটি অভিজাত আবাসনের কথা। সেই আবাসনের কোনও একটি ফ্ল্যাটে যে কাজের মাসী আসতেন, তিনি একবার ফ্ল্যাটের কর্ত্রীর কাছে একটা চাদর চেয়েছিলেন। শীতকালে ঠাণ্ডা মাটিতে শুতে তাঁর মেয়েদের খুব কষ্ট হয়। চাদর দেওয়া হল। মাসী তখন বললেন, 'দিদি, তুমি একটা কাগজে লিখে দাও যে আমাকে চাদর দিয়েছ। নাহলে গেটের কাছে সিকিওরিটি ধরবে। ওরা প্রতিদিন বেরোবার আগে আমাদের সার্চ করে, কিছু চুরি করেছি কি না দেখতে। আমরা তো বস্তিতে থাকি, তাই আমাদের অপর প্রতিদিন সার্চ করবার অর্ডার দেওয়া আছে"।
সেই মাসীর চোখে মুখে যে অপমান আমি দেখেছিলাম, আর পুণে-র রাস্তায় সেই তরুণী মায়ের গলায় যেই অপমান, তাদের দুজনেরই মূলে আছে ভয়। ভয় পেতে পেতে, পেতে পেতে সেই ভয়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত অপমানের যে নির্যাসটুকু আছে, সেটাকে ধকধক করে নিজের মধ্যে জ্বলতে দেওয়া। দিনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত সেই অপমানকে চাটতে চাটতে অবসন্ন হয়ে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়া। ফুটপাতের চটের ওপর শুয়ে শেষ রাতের আধো ঘুমে স্বপ্ন দেখা--কলকাতার নোংরা আকাশ থেকে নেমে আসা একটা পরি পেঁয়াজ-মুলো মাখা একথালা মশলা মুড়ি আর আধমালা নারকেল নিয়ে এসে সামনে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আর বলছে `খা, পেটভরে খা`। এবং সেই স্বপ্নের মধ্যেও পরবর্তী অপমানটুকুর অপেক্ষায় সজাগ থাকা। কেননা যে কোনও মুহূর্তেই একটি বাঘালো বুলডোজারের নিপুণ দাঁত ঘুমজলে ডুবে থাকা ঘাড় কামড়ে তিরতিরে মুরগিছানার মত ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে উন্নয়নের ভ্যাটে।
উন্নয়ন, ত্রিশূল মিছিল, ফ্লাইওভার, হাইরাইজ, শপিং মল, হুংকার, হুংকার, হুংকার--- বড়লোকদের হুংকার। দামি মোবাইল ফোনের হুংকার। আইনক্সের হুংকার। 'ডু ইট নাউ', 'রাস্তার ধারের উন্নয়ন', 'বেঙ্গল বিজনেস সামিট', 'আচ্ছে দিন'-এর হুংকার। এত এত হুংকারে যদি মধ্যরাতের কলকাতায় ভীতু কুকুরের ডাক চাপা পড়ে যায়, যদি ঊষা কারখানার ছাঁটাই হওয়া বুড়ো শ্রমিক খুচরো পয়সা জমিয়ে জমিয়ে স্ত্রী-এর ক্যান্সারের দামী ওষুধ কিনতে গিয়ে ঝাঁ-চকচকে ড্রাগ স্টোরস থেকে গলা ধাক্কা খায়, তাহলে সে কীসের কলকাতা? বসন্তের কোকিল কাশবে, কেশে কেশে গলায় রক্ত তুলবে, সে কীসের বসন্ত?
Prativa Sarker | unkwn.***.*** | ৩১ মে ২০১৮ ০৪:০২83750
শেখর | unkwn.***.*** | ০২ জুন ২০১৮ ০২:৫৯83757
Kakali Sinha Roy. | unkwn.***.*** | ০২ জুন ২০১৮ ০৭:৩৩83751
শক্তি | unkwn.***.*** | ০২ জুন ২০১৮ ০৮:০৬83752
রৌহিন | unkwn.***.*** | ০২ জুন ২০১৮ ০৯:২২83753
কল্লোল লাহিড়ী | unkwn.***.*** | ০২ জুন ২০১৮ ১০:০৮83754
দ | unkwn.***.*** | ০২ জুন ২০১৮ ১১:০০83755
Sumit Roy | unkwn.***.*** | ০২ জুন ২০১৮ ১১:৪১83756