পুরানো দক্ষিণ কলকাতার দুপুর। ছবি নীলাঞ্জন হাজরা
শহর আসলে গ্রামের ভগ্নাবশেষ, এমনটা বলেছিলেন রজার বেকন। ইউরোপের রেনেসাঁস সময়কালে অবিরল গ্রাম পতনের আওয়াজ শুনেছিলেন তিনি, দেখেছিলেন কীভাবে নগর তার উচ্চাশার ভাস্কর্য নির্মাণ করে কৌমের সমাধির উপর দাঁড়িয়ে। আজ ২০২০ সালে এসে যখন কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্তের লেখা ‘চেনা কলকাতার অচেনা ফুটপাথ’ বইটা পড়তে শুরু করি, তখন গগনচুম্বী সাফল্যমণ্ডনকে পিছনে রেখে শাইলকের বাণিজ্য বিস্তারের অপর প্রান্তেই অভ্রান্ত চিনে নিতে পারি অশনি সংকেতের গঙ্গাচরণের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়। বুঝে যাই, একদা এই শহরের বুকে দাঁড়িয়ে রাজা লিয়র-বেশী নীলকণ্ঠ বাগচী কেন দেখেছিলেন সব পুড়ছে, সভ্যতা, ইতিহাস, সমাজ এবং তিনি নিজে। কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্তর বইটা আর কিছু না করুক, আমাদের সামনে ছুড়ে দিল একটা নির্মম আয়না, যাতে নিজেদের নিহিত পাতালছায়া দেখতে আমরা বহুকাল হল ভুলে গিয়েছি।
‘চেনা কলকাতার অচেনা ফুটপাথ’ কলকাতার ফুটপাথ এবং তার ওপর নির্ভর করে টিকে থাকা মানুষজনের ইতিহাস। ইচ্ছে করেই শুধু ফুটপাথবাসীদের কথা বললাম না কারণ বইটায় সেটা বাদেও ফুটপাথ সম্বল করে জীবিকানির্বাহ করেন এমন মানুষজনের কথাও প্রচুর আছে, এবং সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যে বিষয়ে পরে বিস্তারে লিখছি। ঋতবাক-প্রকাশিত বইটির এই পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণে ছ-টি ভাগ দেখতে পাচ্ছি। প্রথম ভাগে কলকাতায় ফুটপাথ তৈরির ইতিহাস এবং তার পরবর্তী অধ্যায়গুলি, যেমন মন্বন্তরের সময়ে, দেশভাগের সময়ে অথবা বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ফুটপাথ কীরকম ভাবে ভরে গিয়েছিল উদ্বাস্তু নিঃস্ব মানুষে তার বিবরণ। দ্বিতীয়ভাগ এই বইয়ের শ্রেষ্ঠ অংশ, যেখানে অনেকটা এম্পিরিকাল স্টাডির ধরনে লেখক ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন ফুটপাথে বেঁচে থাকা মানুষদের অভিজ্ঞতা—পথশিশু, ভিখিরি, ফুটপাথবাসী, অপরাধীদের চালচিত্র। তৃতীয় ও চতুর্থভাগে ‘অপারেশন সানশাইন’-এর ডকুমেন্টেশন করেছেন লেখক। পঞ্চমভাগে আছে বর্তমান সময়কালে হকারদের অবস্থা কীরকম তার আলোচনা। ষষ্ঠভাগে কিছু পুরানো লেখাপত্র, যার মধ্যে শহরের জনসংখ্যা ও ডেমোগ্রাফি বিষয়ক পরিসংখ্যান এবং কয়েকটি স্মৃতিচারণা মূলক লেখা। ৩২০ পাতার বইয়ের মধ্যে প্রায় অর্ধেক অংশই নিয়েছে অপারেশন সানশাইন ও হকার বিষয়ক আলোচনা—স্বাভাবিক। কলকাতার ফুটপাথের আলেখ্য লিপিবদ্ধ করতে গেলে সানশাইন সম্ভবত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যাকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়।
প্রথমভাগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা যেটা, মন্বন্তর, দেশভাগ বা জয় বাংলার সময়ে ফুটপাথে স্থান নেওয়া মানুষজনের সাক্ষাৎকার। পুরানো বইপত্র ঘেঁটে লেখক এগুলোকে তুলে এনেছেন। কিন্তু কিছুটা দুর্বলতা এখানে লুকিয়ে আছে। ‘দাঙ্গা, দেশভাগ স্বাধীনতা আর ফুটপাথ’ অংশটির কথাই ধরা যাক। ১৫ পাতার অধ্যায়, তার মধ্যে প্রায় ১০ পাতা গেছে দাঙ্গা-দেশভাগের ইতিহাস লিখতে গিয়ে। দরকার ছিল না। এই ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি। প্রেক্ষাপট নির্মাণে এতটা সময় দিলে মূল বিষয় অবহেলিত থেকে যায়, এই অধ্যায়ে যেটা হয়েছে। ‘মন্বন্তর এবং নিঃস্বের আশ্রয়’ অধ্যায়টিও ডুবেছে ওই কারণেই। তবে যোগেন বারুই, মাখনের মা ও খগেন দাস, তিন ফুটপাথবাসীর বয়ান অবশ্যই মূল্যবান অংশ। তিনজনেই দেশভাগের বলি। তিনজনেরই পেশা ভিক্ষাবৃত্তি। পেটের দায়ে এঁদের কারও সন্তান বেশ্যা হয়ে গেছে, আবার কারও সন্তান গেছে হারিয়ে। একদা হাজারে হাজারে যে বরিশাল-নোয়াখালি-কুমিল্লা-পাবনারা ফুটপাথ ভরিয়ে তুলেছিল, তাদেরই তিনটে টুকরোকে তুলে এনেছেন লেখক। এঁরা হলেন বাংলাদেশের সেই গরিবতম সম্প্রদায়, যাঁদের জায়গা হয়নি উদ্বাস্তু শিবির বা কলোনিতে। চিরাচরিত মার্কসীয় ব্যাখ্যায় এর সম্পূর্ণ হদিস মিলবে না কারণ উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে এঁদের যোগ নেই। তবুও কলকাতার তলানি হয়ে, পলিটিক্যাল পণ্ডিতদের চুলচেরা বিশ্লেষণের বাইরেও জীবনকে তুমুলভাবে উদ্যাপন করছেন এরকম কয়েক লক্ষ মানুষ।
১৯৭১ সালে কলকাতাগামী শরণার্থী মানুষ
আর এই মানুষদের ডকুমেন্টেশনের কাজটাই নিষ্ঠার সঙ্গে করে গিয়েছেন কৃষ্ণপ্রিয়। বইটার দ্বিতীয় অধ্যায় শ্রেষ্ঠ অংশ বলেছিলাম, কারণ এখানেই পথশিশুদের কথা, ভিখিরিদের অর্থনীতি কীভাবে চলে, ফুটপাথে বাস করা পরিবারগুলির দৈনিক রোজনামচা কেমন হয়, কীভাবে শিশু অপরাধীরা এখান থেকে উঠে আসে, সেসবের বাস্তব এবং অবিশ্বাস্য কিছু বিবরণ, পড়তে পড়তে গা হিম হয়ে যায়। হাওড়া ও শেয়ালদা স্টেশন চত্বরে যে ভিখিরিদের নিজস্ব হোটেল আছে, যার মালিক ও ক্রেতা দুই পক্ষই ভিখিরি, এ তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ মিশেলে যোগ হয়েছে কথকের আড্ডার ঢং। পাঁচটা হোটেলের উল্লেখ করেছেন লেখক। ইচ্ছে করছে গোটা অধ্যায়টা তুলে দিতে, এত মণিমাণিক্য খচিত। সেটা তো আর সম্ভব নয়, আপাতত টুকরো একটি ছবি দিলাম।
কলকাতার রাস্তায় ভিখিরির সারি। ছবি সৌজন্য জেরি লেভান্ডোস্কি (https://www.skees.org)
“হোটেল বলতে বেশ বড়ো ঝুড়ি একটা। ওই ঝুড়ি নিয়েই এক একজন বসে পড়েছেন। ঝুড়িতে ভাত। ঝুড়ির ওপর প্লাস্টিকের চাদর পাতা। তাতেও ভাত।
ঝুড়ির পাশে সাজানো কতকগুলো থালা। তাতে রয়েছে ডিম, কুচো চিংড়ি, আলুর খোসা ও অন্যান্য সবজির খোসা ভাজা। তার তরকারি। মাছের কাঁটার তরকারি।… ঝুড়ি এবং অন্যান্য খাবারের ওপর কোনো আচ্ছাদন নেই। ভাত দেখা যায় না। মাছি ছেয়ে থাকে। কালো হয়ে যায়। ভনভন আওয়াজ করে মাছি। ঝুড়ির উলটো দিকে ইট পেতে থাকেন হোটেল মালিকেরা। তাঁদের সামনে খাদকের লাইন। অন্ধ-বোবা-কালা-নুলো-সবল-সমর্থ নানারকম ভিখিরির ভীড়। সকাল নটা থেকে লাইন পড়ে যায়। খেয়েদেয়ে ভিক্ষের জন্য চলে যান যে যাঁর মতো।”
কীভাবে এই হোটেল চলে, বিশেষত মালিকও যেখানে ভিখিরি, তার অর্থনীতি বুঝতে বসলে মাথা ঘুরে যাবে। দেখা যাবে, ভিখিরিদের মধ্যেও আস্তে আস্তে তৈরি হয়েছে নিজস্ব মালিক সম্প্রদায়, যাদের লগ্নি হল ভিক্ষের টাকায় চালানো হোটেল। কাঙালের পুঁজিপাটার এই কাহিনি, এক অবিশ্বাস্য নির্মাণ। কৃষ্ণপ্রিয় লেখেন, আর পড়তে গিয়ে মনে হয় ‘ফ্লর দ্যু মাল’ কেন লেখা হয়নি আমাদের ভাষায়, সে নিয়ে হা-হুতাশ করা অর্থহীন। আমাদের ফুটপাথ প্রতিদিন যে দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে, বোদলেয়ারের ইউরোপীয় দৃষ্টির পক্ষে তাকে হজম করতে পারা মুশকিল ছিল।
ছবি সৌজন্য http://kolkataandme.blogspot.com
‘দিবা রাত্রির কাব্য’ অধ্যায়টা আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের ফুটপাথে থাকা তিনটে পরিবারের রোজনামচা। প্রতিদিন সকাল হলেই এদের বাচ্চারা বেরিয়ে যায় কাগজ, ভাঙা বোতল, গ্লাস, প্লাস্টিক এসব কুড়োতে। বেলা বাড়লে পেটের ভেতর খিদে ঝিমঝিম করে। যদি পয়সা থাকে তো মাঝে মানিকতলায় একবার চা-বিস্কুট। ঘরে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যায়। তখন বাচ্চাগুলোর খুব খিদে পায়, জ্বর হয়। মুখ, হাত, পা ফুলে ওঠে। বমি লাগে। তারা শুয়ে পড়ে। সংগৃহীত দ্রব্যাদি নিয়ে তাদের মায়েরা যান বিক্রি করতে। বিক্রি করে সেই পয়সা দিয়ে বাজার করেন। ফিরে এসে রান্না চাপানো। খেয়ে নিয়ে বাচ্চারা খেলতে শুরু করে। খেলতে খেলতেই তাদের ঘুম পেয়ে যায়। এরপর বাচ্চাদের জবানিতে শুনুন—“ভোর সকালে ঘুম ভাঙে। অনেকদিন রাত্রিবেলা চিৎকারে ঘুম ভাঙে। দেখি মড়া নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ঘুম থেকে উঠেই ছুটি। মড়া নিয়ে যাবার সময় খই আর পয়সা ছড়ায়। সেই পয়সা কুড়াই। অনেকদিন রাত্রিবেলা ঘুম ভাঙে, দেখি অন্য কোনো ফুটের একটা বড়ো ব্যাটাছেলে, আমাদের ফুটে এসে কোনো মেয়ের মাই টিপে দিয়েছে। তারপর ঝগড়া। মারামারি। পুলিশও অনেক সময় লাঠি দিয়ে কাপড় সরিয়ে দেখে। মা বলে, যতদিন বাচ্চা আছিস ভালো, তোদের যখন মাই উঠবে, তখন দেখবি ব্যাটাছেলেগুলো কুত্তার মতো ঘুরবে পেছনে পেছনে।” মেয়েগুলো, যারা বলছে, তাদের বয়েস আট থেকে দশের মধ্যে।
কৃষ্ণপ্রিয় পায়ে হেঁটে সারা কলকাতা ঘুরেছেন। তাঁর গল্পের মধ্যে তাই অনায়াসে চলে আসে বিভিন্ন এলাকার ফুটপাথের চরিত্রের তারতম্যগুলো। ‘ফুটপাথের কলকাতা—জীবিকার শোভাযাত্রা’ অধ্যায়টা প্রায় একটা ছোটো গল্পের মতো লাগে, যেখানে লেখক বিভিন্ন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন। সেই প্রতিবেদনে সাট্টার বোর্ড, মুরগি কাটার দৃশ্যের সঙ্গে মিশে গেছে দোকান থেকে কালোয়ারের পানের পিক ফেলবার ছবি। এই বইটার একটা বৈশিষ্ট্য হল, গল্পের পর গল্প জুড়ে জুড়ে অসংখ্য উপন্যাস সম্ভাবনা, গল্পের মুহূর্ত সৃষ্টি করে। পড়তে পড়তে কখনও অসাড় লাগে, মনে হয় তলার জীবন আমাদের দেখে জিভ ভেংচে হাসছে। মনে হয়, নিরাময়হীন অন্ধকার।
অপারেশন সানশাইনের বর্ণনায় লেখক চেষ্টা করেছেন যতটা সম্ভব নৈর্ব্যক্তিক থাকার। নিজস্ব মতামত কম দিয়ে সাজিয়েছেন সেই সময়কার ডকুমেন্টেশন। পড়তে পড়তে কৌতুক লাগে যখন দেখি নামি শিল্পী-সাহিত্যিকেরা কলকাতা সুন্দর করবার কারণ দেখিয়ে হকার উচ্ছেদকে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন। শুধু সেটাই নয়, সেই সময়ে একটি বণিকসভার প্রতিনিধি দলের মিটিং ছিল কলকাতায়। উচ্ছেদ হওয়া হকারদের দল তাঁদের রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শন করেছিলেন বলে ক্রোধে ফেটে পড়েছিল আমাদের নাগরিক সমাজ—পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের সামনে কলকাতার অসুন্দর মুখটাকে তুলে ধরে, গরিব মানুষের মিছিলকে তুলে ধরে কার স্বার্থসিদ্ধি হল, এমনটাই ছিল ক্রোধের বিষয়। তার মানে নগরীর উচ্চাশার ভাস্কর্য কোনো নতুন ব্যাপার নয়! সমস্ত প্রকার বর্গ ও শ্রেণির বাইরে যে জীবন, তাকে পাপোশের তলায় চাপা দিয়ে অস্তিত্বটাকেই উপেক্ষা করবার রাজনীতি সেই নব্বই দশকেই বহমান ছিল! সেই নব্বই, আমাদের তথাকথিত মায়াময় নব্বই। তবে সত্যের খাতিরে বলা ভালো, সুভাষ চক্রবর্তী ও কান্তি গাঙ্গুলির যে দুটি প্রতিবেদন এখানে রাখা হয়েছে, সেগুলো অনেক অবজেকটিভ। হকার উচ্ছেদ নিয়ে নানা বাজারি দৈনিকের সম্পাদকীয়র উল্লাসের পাশাপাশি এই প্রতিবেদনগুলো অনেকটা ব্যালেন্স করে, কেন ফুটপাথ খালি করা জরুরি সে বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করে, সমস্ত ভাবনার সঙ্গে সহমত না হলেও।
কৃষ্ণপ্রিয় যথার্থ বলেছেন যে গ্রাম না বাঁচলে ফুটপাথে ভিড় বাড়তেই থাকবে, কারণ সিংহভাগ ফুটপাথবাসী গ্রাম থেকে নানা কারণে জমি হারিয়ে বা উচ্ছেদ হয়ে শহরে চলে আসতে বাধ্য হন। এটাও অব্যর্থ দেখিয়েছেন যে বামফ্রন্ট জমানায় গ্রামের বেশ কিছু উন্নতি ঘটেছিল, স্ট্রাকচারাল বদল হয়েছিল অর্থনীতিতে, যার ফলে ফুটপাথে ভিড় করা মানুষের সংখ্যা কমেছিল লক্ষণীয় ভাবে। তবে অন্যান্য প্রদেশ থেকে, মূলত বিহার-ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি, এখনও বহু মানুষ চলে আসেন। ঠেলাওয়ালা, রিকশওয়ালা, মুটে, ছাতু বিক্রেতা—এরকম অনেকের কথাই লিখেছেন কৃষ্ণপ্রিয়। তবে একটা জায়গা বাদ পড়ে গিয়েছে।
ফুটপাথকে কেন্দ্র করে কলকাতায় যে রকম খাদ্যের সমারোহ, সেই স্ট্রিটফুডের বিবরণ একটা সম্পূর্ণ অধ্যায় দাবি করে, এটা সমাজবিজ্ঞানের চর্চার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তার কসমোপলিটান চরিত্র তো আছেই, কিন্তু সেটা ছাড়াও এত সস্তায় খাবার যে বিশাল একটা শ্রেণিকে এভাবে সার্ভ করছে এবং অর্থনীতির বিরাট একটা অংশ এর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে, এই বিশ্লেষণটা সমাজবিজ্ঞানে আমি অন্তত দেখিনি। শুধুমাত্র ইকোনমি অফ স্কেলের ওপর ভিত্তি করে যে বিশাল বাণিজ্য কলকাতার বুকে হয়ে চলেছে যার ক্রেতা মূলত নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তরা, তার আখ্যান রচনা কে করবে? এই জায়গাটা কৃষ্ণপ্রিয় খুব হালকা ছুঁয়ে গেছেন, যাতে মন ভরেনি।
গোটা বইটা আসলে লাথ খাওয়া, হেরে যাওয়া মানুষদের গল্প। অথবা হয়তো ভুল হল, এই মানুষেরা কোনো প্রতিযোগিতাতে কোনোদিন নামই লেখাননি যে হারজিতের প্রশ্ন আসবে। সমস্ত খেলা থেকেই ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে তাঁদের। এই জীবনকে দেখেছিলেন ঋত্বিক ঘটক, নবারুণ ভট্টাচার্য, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়রা। আর প্রায় সকলের অলক্ষে ধাপার জঞ্জাল-কুড়িয়ে বেঁচে থাকা মানুষদের নিয়ে শুধু লেখেনইনি, তাঁদের অধিকার অর্জনে দীর্ঘ লড়াই লড়েছিলেন বরেণ্য পরিবেশবিদ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। মুম্বই শহরের বন্ধ হয়ে যাওয়া কটন মিল এবং সেগুলিকে ঘিরে তৈরি হওয়া কোয়ার্টার, তাদের কাজ হারানো শ্রমিক পরিবারগুলি এবং তাঁদের যৌথ স্মৃতি, যে স্মৃতির মধ্যে দিয়ে কারখানাগুলি বেঁচে থাকে, তাই নিয়ে কাজ করেছিলেন নীরা আদকরকার ও মীনা মেনন। কৃষ্ণপ্রিয়র বইটাকে সেই কাজের সমতুল্য হিসেবে দাবি করা অমূলক হবে না। এই বইটা পড়া দরকার এর রাজনৈতিক ভাষ্যের কারণেই। কলকাতার পেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনেক অনেক অন্য কলকাতাকে চেনার উদ্দেশ্যে। যার খবর বহুদিন আমরা ভুলতে বসেছি। এই কলকাতাকে একদা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়—বাউল মন থেকে বেরোনো ‘অন্য কলকাতা’ বইটা এ বিষয়ে মূল্যবান দলিল ছিল। নবারুণের কালমন, মোগলাই, গিনি—এসব চরিত্ররা অনায়াসে এই বইটার কুশীলব হতে পারত। অথবা ‘ভাসান’ গল্পটিতে যে বৃদ্ধ ভিখিরিটি মরে যাবে এবং তার দেহ পাহারায় বসে থাকবে এক পাগলিনী, সেই তাদের গল্পকেই আবার খুঁজে পাই। আমাদের সময়কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গদ্যকার সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘বুনো স্ট্রবেরি’ ও অন্যান্য লেখায় বারবার এই হেরে যাওয়া মানুষদের ও হেরে যাওয়া সময়কে লিখে যাচ্ছেন, রেখে যাচ্ছেন প্রতিরোধের উত্তরাধিকার। কৃষ্ণপ্রিয় এই কাজগুলোকেই আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইতিহাসের নিয়মেই আমাদের কমরেড হয়ে যান নবারুণ, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, রাঘব বন্দ্যোপাধায়রা। সেই একই নিয়ম মেনে দায়বদ্ধতার মিছিলের অংশভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্তও।
এই বইটা দাম দেখে পালিয়ে এসেছিলাম। ঋতবাকের বইয়ের দাম সাংঘাতিক।
আলোচনা ভাল লাগল।
মানুষের ডকুমেন্টেশন। ভাল লাগল লেখাটা ।
ডকুমেন্টেশন জরুরী। কিন্তু সমস্যার সমাধান?
লেখা খুব ভালো হয়েছে। অরণ্য , সমাধান নেই তা না, কিন্তু মানুষ নিরন্ন, বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ালে সরকার যদি লজ্জা না পায়, অন্য মানুষ যদি লজ্জা না পায়, কোন সমাধান নিয়ে কোন চেষ্টা কেউ করবে না।
বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত
"দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা আর ফুটপাথ’ -- প্রতিটি শব্দ যেন মাথায় হাতুড়ির বাড়ি মারে। আর ছবিগুলো বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে যায়।
খুবই অনুসন্ধানী বই, লেখাটিও ভালো লেগেছে।
কৃষ্ঞপ্রিয় দাশগুপ্ত র বিজ্ঞাপনের বিবর্তন এর উপরে একটা বই আছে না? কিরকম মনে হচ্ছে আছে।
আমার কতগুলো কথা মনে হচ্ছিল। গড়িয়াহাটে সেদিন শোনা গেল, এক পরিচিত দোকানদার, এই পূজোর মাস দেড়ে দুই আগে আত্মহত্যা করেছেন, আরেকজন দোকানের ক্যাশিয়ারer হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এই যে মাস সাতেক হল আপিশ যাই না, কোন ক্লিনার, সিকিউরিটি গার্ড, পার্কিং অ্যাটেন্ডেন্ট, গেটের ভেররের বা বাইরের দোকানের কর্মচারী , কারো র নাম ই জানি না। একশো জনের এক দের জনের নাম জানি, আমার একটা অভ্যেস আছে নাম জিগ্যেস করা লোক কে, করে থ্যাংক ইউ বলা , কিন্তু তাতে কি বাল, আসলে তো ১০০ জনে ৪ পাঁচ জনের বেশি নাম মনে নেই। ফস করে দেখলে হয়তো মনে পড়বে। গোটা সেক্টর ফাইভ , রাজার হাট এর মানুষ গুলোর কি হল জাস্ট জানি ই না, ঐ অঞ্চলের লোক না হবার কারণে যাই ও না। আমাদের এন জি ও টা ঐ অঞ্চলে র গ্রামে কাজে করে, কিন্তু মানুষ গুলো কে চিনি ই না।
অথচ পাড়ায় কিন্তু এরকম না। পাড়ায় চায়ের দোকানের লোক জন, তরকারি ওয়ালা , চালওয়ালা , মাছ ওয়ালা, দুধ ওয়ালা, সিকিউরিটি ওয়ালা, অসংখ্য লোকের নাম জানি ও হ্যাজাই। চা খাই আড্ড ও দেই। এক মাছ ওয়ালা ছেলে আছে, তার হার্ট অ্যাটাক এর পরে সুস্থ হয়েই নাকি সে আমার খোঁজ করেছিল তার ভাই আর ভাই য়ের বৌ এর কাছে কারণ আমি তার মত মোটা। শান্তিনিকেতন বোলপুরে তো ছেড়েই দিন, ঠেক ই ঠেক।
তো এই যে শহরের কাজের জায়্গার কর্মী মানুষ দের সম্পর্কে অ্যাপাথি, এই যে আস্ত আস্ত কমিউনিটির রোজগার উড়ে গেল কোন হিসেব নেই, এই গুলোর কোন বিচার নেই। কলেজ স্ট্রীটে কয়েকটা উদ্যোগ হয়েছে বইয়ের বাজারের কর্মী দের হেল্প করার, কিন্তু আজকাল মনে হয়, হেল্প মানে তো বাল কটা টাকা দেই, আধ বেলাও কাজে লাগে কিনা নিশ্চিত নই, কিন্তু মানুষ গুলো কে চিনতে পারলে ভালো হত।
ঈ
বইটি পেতে সরাসরি যোগাযোগ ০৯৮৩৬৭০৯০০৯ (ঋতবাক/ প্রকাশক- সুস্মিতা বসু সিং)