আমরা যারা মার্ক্স ও কোকাকোলার সন্তান, তাদের জীবনে সোভিয়েত ছিল না, রাইফেল ছিল না, স্বপ্ন অথবা কমলকুমার, কিছুই ছিল না। এমন একটা নষ্ট সময়ে আমাদের বেড়ে ওঠা ছিল, যখন বিচ্ছিন্নতার বর্ণপরিচয় সারা পৃথিবী জুড়ে, আর এই ব্যাপারটা শুরুতেই বললাম এই কারণে, এই বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটা, কারণ চোখের সামনে প্র্যাকটিস বলে কোনও কিছু না থাকলে তত্ব জিনিসটা আকাশ থেকে পড়ে না। আমাদের প্র্যাকটিস গোটাটাই ছিল বিচ্ছিন্নতার, যে কারণে করোনার সময়েও প্রচলিত শব্দবন্ধটি যা সামনে এসেছিল, 'সামাজিক দূরত্ব'। তো যাদবপুর, বা অন্যান্য অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে যে শ্রমজীবী ক্যান্টিনগুলো গড়ে উঠল, তাদের আমি পাঠ করব এই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধী একটা প্র্যাকটিস হিসেবেই, যে সময়কালে কোঅপারেটিভ জাতীয় আন্দোলনগুলো ধুঁকছে, পান্নালাল দাশগুপ্ত অথবা শংকর গুহনিয়োগীদের নির্মাণ অস্তমিত, ঠিক সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এ এক উল্লেখযোগ্য প্রয়াস।
যাদবপুরের শ্রমজীবী ক্যান্টিন শুরু হয়েছিল কোনও তত্ত্বকথা থেকে নয়। লকডাউনের সময়ে সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে নিয়মিত মানুষের বাড়িতে রেশন পৌঁছে দেওয়া, মূলত নিজেদের উদ্যোগে রান্না করা খাবার এলাকার নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিতরণ, এই জাতীয় কাজগুলোই শুরুতে ছিল। কিন্তু চিন্তাটা শুরু থেকেই ছিল, এই রিলিফজাতীয় কাজগুলোর থেকে একধাপ এগণও কী করে যাবে, কীভাবে এগুলোকে এমন একটা সংহত রূপ দেওয়া যাবে যাতে এর লকডাউন বা অসময় জাতীয় শব্দগুলোই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। রান্নাঘর প্রথমে ছিল বিজয়গড়ে, তারপর পাকাপাকি ঘর নেওয়া হয়েছে যাদবপুর ৮বি-র কাছে। কিন্তু এই রান্নাঘরের ভাবনা বহুদিন ধরেই এলাকার কিছু কর্মীদের মাথায় ছিল, করোনার অন্তত দুই বছর আগে থেকে--এমন কিছু করা যায় কি না যেটা এরকম এক যৌথ প্রয়াস হবে। তখন সম্ভব হয়নি, আজ বুঝি কেন। অবজেক্টিভ পরিস্থিতি না থাকলে তত্ব প্র্যাকটিসে রূপ পায় না। এটা বলতে বাধা নেই আজ, এই চিন্তা এবং প্র্যাকটিস থেকে যে রান্নাঘর তৈরি হয়েছে সেটা অসময়ের রান্নাঘর না, সবসময়ের রান্নাঘর। করোনা যখন থাকবে না তখনো এই রান্নাঘর থাকবে, এবং এর সঙ্গে তৈরি হবে আরো অনেক অন্যকিছু, যেমন ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে শ্রমজীবী বাজার, চাষিদের থেকে সরাসরি সবজি কেনা হচ্ছে যেখানে, এবং সাধারণ বাজারের সব্জিমূল্যের তুলনায় ৩০ কি ৪০ শতাংশ কম দামে সবজি মিলছে।
কেন এটাকে বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে দেখছি? এই কর্মসূচি শুধুমাত্র একটা পরিষেবার বা যোগানের অর্থনৈতিক মডেল নয়। আমাদের মত সাধারণ অনেক মানুষের কাছেই এই গোটা কর্মকাণ্ডই একটা ক্লাসরুম - সমাজ, অর্থনীতি: ১০১। আমরা যারা এই শতকের সন্তান - আমরা নিজেদের খাদ্যের উৎপাদক, তার প্রক্রিয়ার থেকে ক্রমে বিছিন্ন হয়েছিলাম, আমাদের শহর, বাড়ি, রাস্তা, কলকারখানা, যানবাহন যাঁদের শ্রমের ওপর টিকে আছে - তাদের থেকে- আমরা আবার এক হচ্ছি রোজ একটু একটু করে। আমরা চিনছি সেই মানুষটিকে যিনি একইসাথে নিজের বাড়ির পেছনে অল্প জমিতে সবজি চাষ করেন আবার শহরে এসে রিকশা চালান। সেই মাসি যিনি হাঁস পালন করে তার ডিম শহরের বাজারে বেচেন, তারপর ১০ টা দোকান ঝাঁট দিয়ে ট্রেনে করে বাড়ি ফেরেন। আমরা চিনতে শিখছি আমাদের দেশের চাষিকে, শ্রমিককে - আমরা চিনছি নিজেদেরও, নিজের শ্রেণিকে। একশো বইও আমাদের যা শেখাতে পারতো না তা শিখছি কয়েক মাসে। আর রান্নাঘরের পেছনের অর্থনীতিটাও ঐ যৌথতারই প্রয়াস। ধরুন, আপনি আর আপনার বন্ধু দুজনে দুটো আলাদা বাড়িতে একা থাকেন। আপনারা রান্না করে খান। আপনাদের দুজনের আলাদা রান্না করে খেতে যা খরচা হয়, আপনারা যদি আপনাদের রান্নাঘরকে জুড়ে একসাথে করে নেন, তাহলে আপনাদের দুজনের রান্নার খরচা কমে যাবে। এইভাবেই আপনারা যতজনকে একসাথে জুড়তে থাকবেন, আপনাদের রান্নার খরচা তত কমতে থাকবে। ১০০ গ্রাম চাল দুটো আলাদা স্টোভে ফোটাতে আপনার যা জ্বালানি খরচা হবে, ২০০ গ্রাম চাল একটা স্টোভে ফোটাতে আপনার তার থেকে অনেক কম গ্যাস খরচা হবে। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলে 'ইকনমি অফ স্কেল'। এই যৌথটার অর্থনীতির মডেল থেকেই সামাজিক শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। এই যৌথতা, অর্থাৎ মানুষ যত একসাথে জোটবদ্ধ হবে, যত বেশি করে যৌথযাপনের চর্চা করবে, তত বেশি করে তার আর্থিক ক্ষমতায়ণ হবে, তত সহজে সে নিজের চাহিদা মেটাতে পারবে। এই যৌথতার চর্চা এবং মডেল আসলে তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের - শুধু খাদ্য নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সব ক্ষেত্রে। তারা সেটা করেনা। কমিউনিস্ট পার্টি তাদের সীমিত ক্ষমতায় এক একটা অঞ্চলে ছোট ছোট প্রজেক্টের মাধ্যমে এই যৌথতার চর্চা পরীক্ষা করছে। হিসেব বলে, নির্দিষ্ট সংখ্যায় মানুষ যদি এখান থেকে থেকে নূন্যতম ২০ টাকায় খাবার গ্রহণ করে, তাহলে এই দামেই একজনকে পেট ভরানোর মতন খাবার - ভাত, সবজি, ডিমের ঝোল - দেওয়া সম্ভব। সেই সংখ্যায় পৌছনোই প্রত্যেকটা ক্যান্টিনের লক্ষ্য, যাতে এখান থেকে খাবার গ্রহণ করা মানুষদের কারুর দয়া বা দানের মুখাপেক্ষী হয়ে না থাকতে হয়, এই ক্যান্টিন যাতে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে।
আর এখান থেকেই প্রত্যেকদিনের যে গল্পগুলো তৈরি হচ্ছে, হয়ত আগামীর মহাকাব্য। যেমন বর্ধমানের শেখ জালালউদ্দিন। সেপ্টেম্বরের এক রাত্রিবেলা যাদবপুর শ্রমজীবী ক্যান্টিনে স্বেচ্ছাশ্রমিকরা প্যাকেট তৈরির কাজ শেষ করে ক্যান্টিন থেকে বেরোচ্ছে, তখন তিনি এলেন। দরজার সামনে রাস্তার ওপর জটলার মাঝে এসেই বললেন-
'আপনারা কি কমরেড?' সম্মতিসূচক উত্তর পেয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে রেড স্যালুট দিয়ে জানালেন - 'আমিও কমরেড।'
বর্ধমানের জামালপুরের শেখ জালালউদ্দিন। হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্স করে হোটেলে চাকরি করতেন, লকডাউনের সময় সেই চাকরি চলে গেছে। এখন এই অঞ্চলেই ওয়াও মোমো-র ওয়ার্কশপে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেন, এখানেই থাকবার ব্যবস্থা পেয়েছেন। রোজ যাতায়াতের পথে ক্যান্টিনের খাবারের লাইন দেখেন, আজ নিজে চলে এসেছেন সময় করে। 'আমি কিছু সাহায্য করতে চাই, বেশি কিছু পারবো না, একশো টাকা দিচ্ছি, নেবেন তো?' অথবা সেই বাচ্চা মেয়েটি, যাকে রোজ রিকশ-র সিটে বসিয়ে ক্যানিং থেকে খাবার তুলতে আসেন তার রিকশচালক দাদু। একদিন তাদের আসতে দেরি হয়েছিল, খাবার ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে রান্নাঘরের বনমালীদা আর বউদি নিজেদের খাবারটুকু দিয়ে দিয়েছিলেন। এই ছোট ছোট গল্পগুলোই যৌথ হয়ে একদিন আগামীকে নির্মাণ করবে, এই আশাটুকু না থাকলে এসব প্রয়াসের মানেই হত না। যে আইটি কর্মী অফিস ফাঁকি মেরে ক্যান্টিনে এসে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে, যে ডকশ্রমিক সকাল হতেই বেরিয়ে পড়ছে সবজি কিনতে, অথবা এসব কিছুই না--হয়ত অনেক দূরে বসে কোনও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বহুতলের ফ্ল্যাটে বন্ধুদের আড্ডায় শেয়ার ইএমআই অনসাইটের সফলতার গল্প থেকে কিছুটা দূরত্বে আলগা বসে ঠোঁট টিপে হাসছে দুই তরুণ তরুণী, তাদের মোবাইলের ফেসবুকে হয়ত খোলা শ্রমজীবী বাজারের পেজটা, হাফ ডে সিএল মেরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ইকোপার্ক থেকে মৌলালি দৌড় লাগাচ্ছে যে তরুণ, মিছিলের লেজটুকু ধরবে বলে, এই গল্প তাদের সবার। শ্রেণি দিনের শেষে সত্য, কিন্তু ব্যক্তিমানুষ উঁকি মারেই। তাদের গল্পগুলো না বলা হলে এই সমস্তই যান্ত্রিক অভ্যাসে পরিণত হবে।
এই কাজগুলো রাষ্ট্রের করবার কথা। বিজেপি-র কাছ থেকে সেসব কেউ আশাও করে না। তৃণমূলও করবে না জানাই কথা ছিল। কিন্তু কেন সরকার করল না, সারাক্ষণ সেই নিয়ে অভিযোগ জানানোটা রিঅ্যাকটিভ পদক্ষেপ। সিপিআই(এম) নিতে চেয়েছে প্রোঅ্যাকটিভ রাস্তা--সরকার না করে, আমরাই করব। শুধু ক্যান্টিন বা বাজারই নয়, এর পরে আসবে অন্যান্য প্রয়াস। সেগুলো বলার সময় এখনো আসেনি। তবে একটাই প্রশ্ন, সাধারণ নাগরিক হিসেবেই। বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছর সরকারের সময়েও কি এগুলো করা যেত না? তখন তো নিজেদের সরকার, কাজটা আরওই সহজ হত। বিজয়ন সরকারের নেতৃত্বে কেরল পেরেছে। তারা যা কাজ করছে এই মুহূর্তে, ফাটিয়ে দেওয়া। ভোটে জিতবে কি না এসব প্রশ্ন এখন অতি তুচ্ছ। কিন্তু কেরল যে সামাজিক দায়বদ্ধতা দেখিয়েছে, খুব ছোট পরিসরে এখন বাংলাতে সিপিআই(এম) যে দায়বদ্ধতা দেখাচ্ছে, বামফ্রন্টের সময়ে সেই জায়গাটায় আটকে গিয়েছিল কেন? সমস্যাটা ঠিক কোথায় ছিল?
শেষ করবার আগে যেটা বারবার বলার, এই ক্যান্টিন বা এই বাজার শুধুমাত্র সস্তায় খাবার দেয়া বা সস্তায় সবজি দেয়ার উদ্দেশ্যে নয়। বর্তমানে যে বাজারব্যবস্থা চলছে তার থেকেও উন্নত ব্যবস্থা যে সম্ভব যার ফলে চাষি, বিক্রেতা ও ক্রেতা তিন পক্ষই লাভবান হবেন, অথবা যার ফলে শ্রমজীবী মানুষের কাছে সস্তায় পুষ্টি পৌঁছে যাবে এমন উপায়ে যাতে ক্যান্টিন কোনও অনুদানের ওপর ভিত্তি না করেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, এই মডেলটা বারবার রাষ্ট্র এবং সরকারের মুখের ওপর ছুড়ে মেরে বলা-- আমরা পারছি তো তোমরা পারবে না কেন? এটা মূল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রব্যবস্থার চিন্তার ভিত্তিতে আঘাত হানো, মাঠ বড় করো। এটুকুই।
"যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া !"
--শুধু এই উপলব্ধিটুকু শেয়ার করার জন্যেই শাক্যের উদ্দেশে টুপি খুললাম।
বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করেছি শাহীনবাগ আন্দোলনের সময় বামেরা কেমন যেন গা বাঁচিয়ে আলগোছে চলেছেন-- পাছে মুসলিম তোষণের দাগ লেগে যায়। রাহুল গান্ধীরাও তাই করেছেন। ফলে আম ও ছালা দুইই গেছে।
ত্রিশ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন বঙ্গে বাম রাজনীতির খেটে খাওয়া মানুষের থেকে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে শাক্য নিজেই বলেছেন। তখন প্রবণতা ছিল সরকারী তন্ত্রের উপর নির্ভরতার।
এটাও ঠিক যে এধরণের সমস্ত মডেল, শংকর গুহনিয়োগী বা পান্নালাল দাশগুপ্ত, একটা সময়ের পর ফোকাস হারিয়ে কালের নিয়মে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। দরকার সম্ভবতঃ বদলে যাওয়া সময়ের প্রেক্ষিতে নতুন ফোকাস তৈরি করা।
এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরছিল ডিমানিটাইজেশনের সময় যখন খালি লোকের না খেতে পাওয়ার কথা ঘুরছিল চারদিকে . এবার করা গেল এটাই ভাল ।
চেষ্টা গুলো সফল হোক।
আমার খুব আশ্চর্য অভিজ্ঞতা কয়েকট হয়েছে, অন্য অঞ্চলে এই ধরণের কমিউনিটি কিচেন অর্গানাইজেশনে সাহায্য করতে গিয়ে।
- লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন, খাবার নেবেন বলে, হাতে কেজি খানেক চাল নিয়ে এসেছেন, দেবেন বলে। বললেন, যে ভাই একেবারে কিছু না দিয়ে কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, গত কয়েকদিন খাচ্ছি, এই চালটা ছিল , নেবেন?
-- একজনের বাড়িতে চালের বস্তা পৌছতে গেছি, তখনো কিচেন শুরু করিনি, শুধু পরিচিত যাঁদের সমস্যার কথা জানি, বাড়ি গিয়ে দেখা করছি, যা পারা যায় করছি, চাঁদা বা রেস্ত অনুযায়ী। তো উনি বেরিয়ে এসে গ্রহণ করলেন, আর এটা সেটা কথায় বললেন, ওঁর পাড়ার বড় গাছ ওঁর লাগানো অনেক গুলো, সেই গাছে মৌমাছির চাক হয়েছে বলে উনি খুব গর্ব অনুভব করেন সেটা বললেন, আর বললেন, আমার ছেলে আমাকে কিছুটা দেখে, এ চাল আমি নিজে নেব না, অনেকে আছে যাদের কেউ দেখে না, আমার প্রতিবেশী। ওরা আমার গাছ লাগানোর সঙ্গী ছিল, বছর তিরিশ চল্লিশ আগে, আমরা এক সংগে জয়নগর থেকে কলকাতায় কাঠের কাজ করতে এসেছিলাম। পরে শুনলাম, ভদ্রলোক চব্বিশ পঅরগনায় একসায় কোন একটা দৌড়ের ইভেন্টে চাম্পিয়ন ছিলেন। তাঁর জীবনের সেরা মোমেন্ট, কোন এক জাতীয় চাম্পিয়ন অ্যাথলিটের কাছ থেকে তিনি মেডেল নিয়েছিলেন।
-- আরেকজন অল্পবয়সী ছেলে, সকাল ছটা থেকে খাওয়া দাওয়া না করে রেশন যোগাড়ের কাজ করছিল, অসুস্থ হয়ে পড়লো, বিকেলের দিকে , যে বাণিজ্য সংস্থা সাহায্য আহ্বান করেছিল তাদের খবর পেয়ে গিয়ে , কিছু পৌছতে গিয়ে দেখি ছেলেটি অসুস্থ। ওমা বাড়ি এসে পৌচেছি কি পৌছই নি, ছেলে ফোন করে বলে কাকু থ্যাংক ইউ , আমি সুন্দরবন বেরিয়ে গেলাম। স্পিরিট টা ইনফেকশাস ছিল।
বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত
আমি কর্কট রোগাক্রান্ত গত ১৭ বছর ধরে, উপার্জন হীন, বেঁচে থাকার রসদ হীন, চিকিৎসা হীন, গত ১০ ই মার্চ থেকে, সন্তানসম্ভবা পুত্রবধূ'র পরিচর্যা করতে পুত্রের সদ্য বদলী হওয়া কর্মস্থল , জামশেদপুরে আসতে বাধ্য হই, কারণ মালিকপক্ষ স্ত্রী সন্তান প্রসব করলেও ছুটি দিতে রাজি না হওয়ায়। লকডাউন এর কারনে আজ সাত মাস অধিক আর নিজের বাসস্থান হুগলীর রিষড়া তে
ফিরে যেতে পারিনি, আর্থিক কারণে চিকিৎসা হীন , কোনো সংগঠন এগিয়ে আসে নি এই বান্ধব হীন প্রবাসে। মুখ্যমন্ত্রী থেকে, অধীর চৌধুরী, দিলীপ ঘোষ, লকেট চ্যাটার্জি , সোনু সুদ, সালমান খান, রতন টাটা, গৌতম গম্ভীর, রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন সকলের কাছে, ই মেল , টুইট সত্বেও কেউ এগিয়ে আসে নি, নিরন্ন দিনযাপনের কারণ পুত্রের কর্মক্ষেত্রের বেতন সম্পূর্ন না দেওয়ায় একটি সদ্যজাতিকা কে নিয়ে আমাদের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব, তবু লিখে গেছি। পড়ে গেছি, এখনও আত্মহননের পথ গ্রহণ করি নি।
এটা লড়াই নয়, এটা হল, এক দাঁড়িওলা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবদ, আর একজন আর্জেন্টিনা তে জন্মে, কিউবাতে বিপ্লব করে, বলিভিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে বিনা বিচারে হত্যা হওয়া ব্যক্তিত্বদের স্মৃতি আর দেখানো পথ আগলে , বান্ধব হীন টিঁকে থাকা একটা শরীর নিয়ে, যে প্রথাগত স্নাতকোত্তর হয়েও শ্রমিক হয়ে আন্দোলনে ছিল, শিক্ষকের চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে, ২৮ বছর বিনা পারিশ্রমিকে প্রথম শ্রেণী থেকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত গৃহশিক্ষকতা করেছে। রাতের পর হাসপাতালে অসুস্থ পরিচিত জনের সঙ্গ দান করেছে। নিজে অসুস্থ হওয়ার পর , মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে একা গিয়ে বেঁচে থাকা নামক মৃত্যু কে প্রত্যক্ষ করেছে, কোনো আত্মীয় বন্ধু না না তারা যে ব্যস্ত কাজের মানুষ! আর আত্মীয় রা দুরভাসে যোগাযোগ পাছে, আর্থিক সহায়তা করতে হয়।
আর, জীবন সঙ্গিনী গত ১৭ বছর, নিজের শেষ সম্বল উপুড় করে, আর ২৯ বছরের পুত্র কোনোরকমে মাধ্যমিকের পর দিনে দশ টাকায় বাস ভাড়া, টিফিন, পায়ে হেঁটে, ট্রেনে ঝুলে ডিপ্লোমা বাস্তুকার হয়ে, ক্যাম্পাসে প্রথম ইন্টারভিউ থেকে রুজির সন্ধানে পিতাকে বাঁচাতে, মা , স্ত্রী (বিনা পণে বিবাহ করা) ও সদ্যজাতিকা কন্যা কে ঘরে রেখে সকাল আট টা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত নামমাত্র পারিশ্রমিকে , এক ইনফ্রাস্ট্রাকচার সংস্থার শোষণের শিকার, ছুটি নেই, রবিবার নেই।
এটাকে, গল্প বলা চলে না, লড়াই বলা যায়!
গুরুচন্ডালি র পাঠকদের ও এসব পড়ার সময় থাকলে তো কাব্যি হবে! কি বলেন?