ছেঁড়া মেঘের প্যাতপ্যাতে পাপড়িটা পূর্ণিমার চাঁদকে আড়াল করে দিলে গিরিরাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিল একবার। এই শালার গরম-- কাদার মত নোংরা জল শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে । জ্যোৎস্নায় নয়, যেন ঘামে ভিজে আছে সমগ্র চরাচর । কবরখানার পাশের ভুতুড়ে নিমগাছের গা থেকে টুপ করে একফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ল, এবং গিরিরাজ দ্বিতীয়বার খাবি খাওয়ার মত করে নিঃশ্বাস নিল। অল্প বাতাসটুকু বড় অমূল্য এখন।
কেশব, সীতাপ্রসাদ আর ত্রিপাঠীজি একটু এগিয়ে গেছে। গিরিরাজ বাঁশের লাঠি ঠুকতে ঠুকতে পা চালাল। এই সময়টায় একটা দুটো করে সাপ বেরয়। শালারা বহুত হারামি। ঝোপঝাড় জঙ্গলের মধ্যে গা লুকিয়ে এমনভাবে ঘাপটি মেরে থাকবে যে রামজির বাপের সাধ্য নেই চার চোখ দিয়ে দেখতে পায়। কিন্তু একবার গায়ে পা পড়ুক, ছুবলিয়ে বিষ ছলকে দেবে মাথা অবদি। গোটা মগজে তখন সবুজ হলুদ গেরুয়া নেশা। ঘোর লেগে যাবে, ঘুম পাবে, লোপ পাবে বোধবুদ্ধি। গলার তালু শুকিয়ে কাঠ। সারা শরীরে সেই বিষ ছড়িয়ে যেতে খুব বেশি হলে আধবেলা।
ত্রিপাঠীজি পেছনে মুখ ঘুরিয়ে টর্চের আলো ফেলে হাঁক দিলেন “রাস্তায় খানা খন্দ আছে। দেখে ভাইলোগ”।
“একটু থামলে হত ত্রিপাঠীজি। একটা বিড়ি ধরিয়ে নিই। রাত তো গোটাটাই পড়ে আছে”। কেশব বলল।
ত্রিপাঠীজি এই চারজনের মধ্যে সবথেকে বয়স্ক। ব্রাহ্মণ, প্রাজ্ঞ, এবং একটু আধটু লেখাপড়া জানেন বলে স্বাভাবিক নেতৃত্ব তাঁকেই দিয়ে এসেছে বাকি তিনজন। এমনকি গত বছরের সেই সব রাতগুলোতেও গিরিরাজরা কাজ শুরু করবার আগে ত্রিপাঠীজিকে একবার করে প্রণাম ঠুকে নিত, “আপনার কৃপা গুরুজি”।
মোটা গোঁফে চাড় দিয়ে রাক্ষসের মত হা হা হেসে ত্রিপাঠীজি উত্তর দিতেন “মেরা নাহি, রামজিকা কৃপা হ্যায় বাচ্চে। কাজে লেগে পড়ো”।
পরিত্যক্ত কবরখানার ভাঙ্গা দেওয়ালে হেলান দিয়ে গিরিরাজ বিড়ি খেতে খেতে চারপাশটা জরিপ করে নিল একবার । আগের থেকে অনেক বেশি জরাজীর্ন লাগছে জায়গাটা। অবশ্য সেটা স্বাভাবিক। রক্ষণাবেক্ষণ তো আর হয়নি গত এক বছরে! চারিপাশে ছাতামাথা বন্য গাছের দল নুয়ে পড়েছে। জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে গাছের দলকে আলাদা করে আর বোঝা যাচ্ছে না, বরং সবশুদ্ধ তালগোল পাকিয়ে একটা জগাখিচুড়ি লাগছে। পাঁচিল ফাটিয়ে উঠে এসেছে অশ্বত্থের চারা। লণ্ডভণ্ড কবরগুলোর ওপরে বুনোঝোপের আড্ডা। হাঁটতে গেলে জঙ্গুলে শেকড় পা জড়িয়ে ধরে। মেঘ কেটে চাঁদের আলো পিছলে গেলে মনে হবে ফ্যাটফ্যাটে সাদা জংগল সমগ্র জায়গাটার দখল নিয়ে নিচ্ছে। গিরিরাজের আচমকা মনে হল, জঙ্গল আস্তে আস্তে তাদেরও হয়ত ঘিরে ধরছে। আর এখান থেকে বেরোবার পথ নেই। দুম করে বুকটা একটু কেঁপে গেল। তারপর আত্মসচেতন হয়ে ফালতু চিন্তা ঝেড়ে ফেলবার জন্য বিড়িতে জোরে জোরে টান দিয়ে মাথা ঝাঁকাল কয়েকবার। আজকের রাতে মগজ স্থির রাখা খুব জরুরী।
কেশব মৃদু খোঁচা দিল সীতাপ্রসাদকে, “কী রে তুই এত চুপচাপ কেন আজ?”
সীতাপ্রসাদ এদের মধ্যে সবথেকে বাচ্চা। এখনো গোঁফের রেখা ফোটেনি ভাল করে। সে একটু অস্বস্তির সঙ্গে মাথা ঝাঁকাল, “সেই বাচ্চাটা, এখানেও ধাওয়া করছে।”
গিরিরাজ সচকিত হল, “কোথায়?”
“দক্ষিণের তেঁতুলগাছের নিচে তাকাও”।
আজ বেশ কিছুক্ষণ হল একটা কচি বাচ্চা তাদের পেছন পেছন আসছে। একটু দূরত্ব রেখে, কাছাকাছি ঘেঁষছে না। ওরা প্রথমে ভেবেছিল ভিক্ষে চায়। কেশব তাড়াও করেছিল বার দুয়েক। পালিয়ে গেছে তখন। কিন্তু একটু দূর থেকে পিছু নিয়েছে আবার। গিরিরাজ দেখল, একটা ছায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে গাছের নিচে। নিস্পন্দ।
“ ডুমারি গাঁও-এর রামদুলারির ছেলেটা না?” ত্রিপাঠীজি পোড়া বিড়িটা ছুঁড়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন।
“অন্ধকারে বুঝতে পারছি না ভাল। তবে এত ছোট বাচ্চা এত রাতে বাইরে কী করছে?”
“ছেড়ে দাও। পাত্তা দিও না বেশি। একটু পর নিজেই চলে যাবে। কাল রামদুলারির মরদটাকে গিয়ে কড়কে দিয়ে এসো। বাড়ির জেনানা-বালবাচ্চা-গরু-ছাগলদের হদিশ রাখবে না, রাতবিরেতে বাইরে ফেলে রাখবে, এরকম অলাইছত্র অবস্থায় সংসার চলবে? পরশুও রামদুলারিকে অনেক রাতের বেলা আমি মুদির দোকানে হেসে হেসে ঢলানিপনা করতে দেখেছি। শালি ঢেমনি মাগি! কোলের বাচ্চাটার পর্যন্ত খেয়াল রাখে না।”
কেশব জোরে শেষ টান দিয়ে মাটিতে ঘষে বিড়ি নেভাল, “ডুমারির ওই ওদের আর কয় ঘর বাকি আছে?”
“সত্তর মত ছিল। এখন পাঁচ ছয়খানা। সেগুলোও যাবে। বাকিরা সব টাউনের রিফিউজি ক্যাম্পে।”
ত্রিপাঠীজি অসন্তুষ্টভাবে মাথা নাড়লেন। “এখনো পাঁচ ছয় ঘর কীভাবে থাকে? ভোটার লিস্ট বার করে দেখো। কোথায় কী কী করা উচিত ছিল আর করা গেল না। পঞ্চায়েতের আগে প্রভুজিকে হিসেব দিতে হবে। কথা ছিল আশপাশের পাঁচখানা গাঁও থেকে ইঁদুর মারবার মত করে ফাঁকা করে দেওয়া হবে। এত দেরি হচ্ছে কেন?”
“আপনি জানেন ত্রিপাঠীজি। আমি জেলে ছিলাম। কেশব গোরখপুর পালিয়ে গেল। “গিরিরাজ কাঁধের গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। “নিউজপেপার, টিভি, অপোনেন্ট পার্টি, সব তখন আমাদের পেছনে। আপনি তো টাউনে ছিলেন। আমরা আর একা হাতে কত কী সামলাব?”
“এটা অজুহাত হল গিরিরাজ। আজ যদি এই কাজগুলো তোমরা ঠিকঠাক করে সেরে ফেলতে তাহলে আমাদের তিনখানা তাজা ছেলে এখনও বেঁচে থাকত। লোহা গরম ছিল, পিটিয়ে ঘা মারতে পারলে রাজেশ, শ্যাম আর হরিয়াকে এভাবে বেঘোরে প্রাণ দিতে হত না”।
“হরিয়া ডাকাত ছিল। ওর দলের লোকদের সঙ্গে বখরার গণ্ডগোল লেগেছিল”। কেশব বলল।
“বেশ, যদি হরিয়াকে মেরে থাকে ওর দলের লোকেরা, বাকিদের কী হল? এর থেকে তো ভাবা সহজ যে সকলকেই ওরাই খুন করেছে ।” একটু চুপ করে থেকে ত্রিপাঠীজি যোগ করলেন “না করলেও, এটা ভেবে নিলে তো অনেক ঝামেলার সমাধান হয়ে যায়!”
আকস্মিক এক ঝাপটা হাওয়া কোথা থেকে কয়েকটা শুকনো পাতা উড়িয়ে এনে ফেলল তাদের ওপর। এক ঝাঁক ধুলো চাবুকের মত আছড়ে পড়ল চোখে মুখে । গিরিরাজ কয়েকটা খিস্তি করে চোখ চুলকোতে লাগল। কেশব মাথা উঁচু করে দেখল, ছেঁড়াখোঁড়া চাদরের মধ্যে দিয়ে টুকরো টুকরো চাঁদ উঁকি মারছে, আর তার আলো আশেপাশের মেঘের সীমানার ওপর ঠিকরে পড়ে কেমন রহস্যময় লাগছে। সে হাতের শাবলখানা শক্ত করে চেপে ধরল। আজ যদি কেউ ধরা পড়ে, মাথা ফাঁক করে দেবে এক কোপে, ঠিক যেমন গত বছর মইদুলকে করেছিল।
একটুক্ষণ সকলে চুপচাপ হাঁটল। রাত আরো কিছুটা জমাট হচ্ছিল। লাঠি দিয়ে সীতাপ্রসাদ ছপাং ছপাং করে ঝোপের গায়ে মারল কয়েকবার। একটা ভ্যাবাচ্যাকা পাখি ঘুম ভেঙে উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। কবরখানার পশ্চিম প্রান্তে এসে ত্রিপাঠীজি নীরবতা ভাংলেন, "এখানে বসা যাক। এখান থেকে গোটা জায়গাটা নজরে রাখা যাবে"।
গিরিরাজ বিড়ির প্যাকেট বার করে সকলকে দিল। কেউ বিশেষ কথা বলছিল না। একটা গরম ভাপ উঠে আসছিল আগাছা ঢাকা মাটির গা থেকে। সারি সারি পরিত্যক্ত কবরের ওপর একটা হালকা ঊষ্ণতার চাদর বিছিয়ে দিচ্ছিল সেই ভাপ। অন্ধকার ভেঙে হঠাৎ ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে বিশ্রি শব্দে একটা রাতপাখি ডেকে উঠল। আর তখন, একটু যেন কাঁপা গলাতেই সীতাপ্রসাদ বলে উঠল "আমার ভয় করছে"।
সকলে চমকে তাকাল তার দিকে। আসলে ভয় যে সবার করছিল, কিন্তু বলতে পারছিল না কেউ, সেই অনুভূতিটাকেই কেউ যেন দুম করে বাইরে এনে ফেলেছে। এবার সেটুকু অস্বস্তি চাপা দেবার জন্য প্রায় রূঢ়কণ্ঠে ত্রিপাঠীজি বলে উঠলেন "কীসের ভয়? মেয়েছেলের মত কথা বলছিস কেন?"
সীতাপ্রসাদ দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চাপা দিল। "দশ তারিখ গেল রাজেশ। বারো তারিখে হরিয়া। পনেরোতে শ্যাম। আমার ভয় করছে ত্রিপাঠীজি। এবার আমাদের পালা"।
"বাজে কথা বলিস না", এবার প্রায় জোর করেই ধমকে উঠল কেশব। "রাজেশদের বার বার বলা হয়েছে সাবধানে থাকতে। প্রভুজি পর্যন্ত খবর পাঠিয়েছেন যেন কয়েকদিন লুকিয়ে থাকে। তা না করে বুক ফুলিয়ে মন্দির, ক্লাব, পার্টি অফিস সব জায়গাতে ঘুরছে। থানাতে বসে বসে কনস্টেবলের সাথে খৈনি ডলছে। ওদের বাঁচাবে কে? মরেছে নিজের দোষে।"
সীতাপ্রসাদ একটু চুপ করে থাকল। তারপর আবার বলল "আর কীভাবে মরেছে? সেটা দেখবে না?"
"কীভাবে? তিনজনেই এখানে পড়ে ছিল। এই কবরখানায়। তাতে হলটা কী?"
"উঁহু, শুধু সেটাই নয়। রাজেশ পড়েছিল বেলঘাটের সেই লাশটার কবরের ওপর। সেই--মনে আছে? হরিয়াকে আমি দেখিনি, টাউন গেছিলাম। কিন্তু শ্যামকে আলবিনার কবরের ওপর শোয়ানো ছিল, নিজে দেখেছি"। সীতাপ্রসাদের গলা আবার কাঁপতে থাকল, "আমাদেরও ছাড়বে না ওরা। ত্রিপাঠীজি, আমরা সবাই মরব"।
ত্রিপাঠীজি শক্ত করে সীতাপ্রসাদের কাঁধ চেপে ধরলেন, "যারা মেরেছে তারা সব ওদের গুণ্ডা। এই কয়েক রাত নাইট-গার্ড দেওয়া কি এমনি এমনি নাকি? ওরা সব আশেপাশেই লুকিয়ে আছে। ধরা পড়বেই। টাউন পার্টি অফিসের অর্ডার আছে, যত জলদি পারা যায় ধরতে হবে। এবার আর ভুল করা চলবে না সীতাপ্রসাদ," ত্রিপাঠীজির গলার স্বর কঠিন হয়ে উঠল, মুখ শক্ত, কপালের ডান দিকে একটা শিরা দপদপ করছে, "সব কটা শুওরকে জ্বালিয়ে ফেলতে হবে। জিন্দা। যাতে আমাদের ছেলেদের গায়ে আর হাত তোলবার সাহসটুকু না করতে পারে"।
গিরিরাজ ভুরু কুঁচকে সীতাপ্রসাদের দিকে তাকাল। কিছু যেন বলতে চাইছে ছেলেটা, কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছে না। ভয় পেয়েছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। বার বার ঢোঁক গিলছে, কপালের ঘাম মুছছে। কিন্তু শুধু ভয় না, কিছু একটা যেন লুকিয়ে আছে সীতাপ্রসাদের কথাগুলোর মধ্যে। মাথাটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। “সীতা, এখানে চারজন জোয়ানমদ্দ লোক অস্ত্র হাতে বসে আছে। রাজেশদের খুনিরা এখানেই লুকিয়ে আছে আমরা সকলে জানি কারণ লাশগুলো এখানেই পাওয়া গিয়েছিল। তোর কী মনে হয় যে আমাদের চারজনকে একসঙ্গে কাবু করতে পারবে কেউ? এত ভয় পাচ্ছিস কেন?”
কেশব পাজামার কষি আলগা করে রামের পাইট বার করল। এক ঢোঁক নিজের গলায় ঢেলে বাড়িয়ে ধরল সীতাপ্রসাদের দিকে “নে, নিট মেরে দে। বুকে বল আসবে”।
সীতাপ্রসাদ একটা ঢোঁক খেয়ে মুখ বিকৃত করল। চোয়ালের কষ বেয়ে মদ গড়িয়ে পড়ছে। হাত দিয়ে মুছে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ত্রিপাঠীজির দিকে “রাজেশের গলা দেখেছিলেন গুরুজি? ছুরি দিয়ে কাটা নয়। ছুরি ভোজালি আমরাও চালিয়েছি। এরকম ছিঁড়ে খুঁড়ে যায় না । মনে হচ্ছিল, রাজেশ আর শ্যামের গলা কেউ যেন বাঘনখ দিয়ে ফালা ফালা করে দিয়েছে।”
ত্রিপাঠীজি চোখ সরু করলেন “তুমি বলতে চাইছটা কী?”
“ওদের কোনও ফালতু গুণ্ডা খুন করেনি গুরুজি। খুন করেছে এমন কেউ যে প্রতিশোধ নিয়েছে আমাদের ওপর । আমাদের গত বছরের কাজের জন্য। সেই কারণে ওদের বডিগুলো এখানে এই কবরের ওপর রাখা ছিল”।
চারজন একে ওপরের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল। যেন বুঝতে পারছে না কী বলবে। আর একখণ্ড কালো মেঘ এসে চাঁদটাকে তখন আড়াল করে দিল। অন্ধকারে ঢেকে গেল চরাচর। কেউ কারোর মুখ দেখতে পাচ্ছিল না কিন্তু বুঝতে পারছিল একটা অনির্দিষ্ট ভয় সকলকে আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছে।
গিরিরাজ ফিসফিস করে বলল, “কারা?”
“জানি না”, অস্থির সীতাপ্রসাদ মাথার চুল খামচে ধরল। “কিন্তু গত বছরের সব কটা ঘটনা পর পর খেয়াল করে দেখো। মে মাসে প্রভুজির হুকুম আসল। আমরা ত্রিশূল নিয়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরে কবরখানায় হামলা চালালাম। এখানে, ঠিক এই জায়গাতে,” সীতাপ্রসাদ এলোমেলো হাত চালাল চারপাশে, “এখানে আমাদের গোটা দল এসে কবরগুলো একটার পর একটা খুঁড়লাম। এমনকি পচে গলে যাওয়া বডিগুলোকেও ছাড়িনি । যেসব জেনানারা কংকাল হয়ে গিয়েছিল তাদের বাদ দিলাম শুধু। তারপর কাজ হয়ে গেলে লাশগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলাম যাতে সকলে দেখতে পায়। পরদিন থেকে টেনশন শুরু হল। বলা হল ওরা অ্যাটাক করবে, তাই পার্টি অফিস থেকে রাত্রিবেলা তলোয়ার আর ত্রিশূল বিলি হল। আমরা হামলা চালালাম। খুনখামারি যা হবার তা তো হল, ওদের সবাই চলে গেল রিফিউজি ক্যাম্পে। সব কিছুই জুন মাসের মধ্যে মিটে গেছে। ভোটার লিস্ট চেক করে দেখো, যে কয়খানা ঘর এখনো টিকে আছে তাদের একটাতেও কোনো জোয়ান মদ্দ নেই। আগাছা সাফ করে দেবার মত উপড়ে ফেলেছি। তাহলে এতদিন বাদে এই মার্চ মাসে এমন কাজ করল কে? কে এমনভাবে খুন করল তিনজনকে? আশেপাশের গাঁও গুলোর কেউ নয় কারণ এই কাজ করবার জন্য গায়ের যা শক্তি লাগে তা ওই কয়েকঘর বুড়োহাবড়াদের মধ্যে নেই। আর এমনভাবে বডিগুলো সাজিয়ে রাখল ঠিক যেভাবে আমরা ঐ লাশগুলোকে সাজিয়ে রেখেছিলাম।”
“তার মানে?” ত্রিপাঠীজি অধৈর্য স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
সীতাপ্রসাদ চুপ করে থাকে। গিরিরাজ এক ঢোঁক মদ খেল । গলা বুক জ্বলছে। তারপর সীতাপ্রসাদের দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে কাটা কাটা স্বরে উত্তর দিল “মানে এটাই যে আমাদের ছেলেদের খুন করেছে এমন কেউ যে টাউন থেকে এসেছে। আর সে লুকিয়ে আছে এখানেই। সে প্রতিশোধ নিচ্ছে আমাদের আগের বছরের কাজের। একে একে আমাদের সকলের ওপর নেবে। কিন্তু তাকে আমরা চিনি না বলে ধরাটা এত সহজ নয়।”
ত্রিপাঠীজি মোটা গোঁফ চোমড়াতে থাকলেন। সীতাপ্রসাদের মুখ বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে, যেন ঘুমোচ্ছে। কেশব অস্বস্তিভরে হাতের শাবলটা ঘোরাতে থাকল। ত্রিপাঠীজি একটু বাদে বলে উঠলেন “ভয় পেলে চলবে না। রামজি ভরসা। যদি সত্যিই এমন হয়ে থাকে, তাহলে আবার চিরুনি তল্লাশি চালাতে হবে ঘরে ঘরে। যে ঘরে লুকিয়ে থাকবে, সে হিন্দু হোক কি মুসলিম, কেটে ফেলতে হবে সবাইকে। ত্রিশূলকে যারা ভয় না পাবে, তাদের ছেড়ে রাখলে একদিন ওই ত্রিশূল নিয়েই আমাদের ওপর ঝাঁপাবে।”
কেশব মদের বোতল ঠক করে সামনের মাটির ওপর রেখে বলল “এভাবে রাত্রিবেলা নাইটগার্ড দিয়ে আসল লোককে ধরা যাবে না ত্রিপাঠীজি। আমাদের জোট বেঁধে থাকতে দেখে সে গা ঢাকা দিয়েছে এতক্ষণে। সীতার কথা সত্যি হলে আমাদের একা থাকার সময় হামলা করবে”।
গিরিরাজ হাত রাখল সীতার কাঁধে “তুই এত নিশ্চিত হয়ে বলছিস কী করে? দেখেছিস কাউকে?”
সীতা মুখ তুলে তাকাল, “আমাদের চোখে চোখে রাখছে। আরো একজন জড়ো হয়েছে।”
“অ্যাঁ? কী বলছিসটা কী?”
“এখন দুটো বাচ্চা। তেঁতুলগাছের দিকে তাকাও”।
সকলে ঘুরে দেখল, দুখানা ছায়ামুর্তি নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছের তলায়।
“ঝোপেঝাড়ে বাঘ দেখিস না সীতা। তিন চার বছরের দুটো বাচ্চা, তারা আমাদের ওপর নজর রাখবে? আর ওটা তো রামদুলারির ছানা!”
সীতাপ্রসাদ মনে হয় অনেকটা মদ খেয়ে নিয়েছিল। গোঙানো স্বরে বলল, “বাচ্চা? বাচ্চা তো হয়েছেটা কী, অ্যাঁ? প্রভুজি বলেনি, যে পেটের বাচ্চাকেও গেঁথে ফেলতে হবে? ওরা হল ইঁদুরের জাত, একবার ছেড়ে রাখলেই পিলপিল করে সমস্ত জায়গা ভরিয়ে দেবে। প্রভুজি বলেছে, যেখানে শুয়োরদের পাবে দশেরা করে দাও। বাচ্চা তো কী?”
গিরিরাজ হতাশভাবে ত্রিপাঠীজির দিকে তাকাল, “এ শালার নেশা হয়ে গেছে”।
ত্রিপাঠীজি হঠাৎ রেগে চেঁচিয়ে উঠলেন “চোপরাও ! অনেকক্ষণ থেকে শুনছি এই হয়েছে ওই হয়েছে। এত ভয় যখন তখন এসেছিল কেন সব? এরা সব রামজির সেনা হবে? মেয়েছেলের কলিজা নিয়ে ধর্মযুদ্ধে যাবে ভেবেছে?” বোতলটা নিয়ে গলার মধ্যে এক ঢোঁকে অনেকটা খেয়ে নিয়ে ধকধকে চোখে সবার দিকে তাকালেন। হিংস্র ভঙ্গীতে বললেন “কবর থেকে লাশ তুলে আমি রেপ করেছি সীতাপ্রসাদ। দাঙ্গার সময় পোয়াতি মেয়ের পেট চিরে শিশুকে বার করে এনেছি ত্রিশূলের ডগায়। কোনো শুয়োরের বাচ্চা আমার একটা চুলও বাঁকা করতে পারবে না। যারা ভয় পেয়ে দল ছেড়ে দিচ্ছে, তারা চলে যাক। আমি একাই সামলাব দশ শুয়োরকে।”
সীতাপ্রসাদ অদ্ভুতভাবে হাসল। তারপর বলল , “আপনার মনে আছে গুরুজি, আমরা কাকে কাকে রেপ করেছিলাম?”
ত্রিপাঠীজি উত্তর না দিয়ে হিংস্রভাবে গোঁফ পাকাতে থাকলেন।
“হরিজনপুরের একটা মেয়ের লাশ দুদিন আগে এখানে এসেছিল। তাকে নিয়েছিলাম আমি। যেহেতু আমি সবার থেকে বাচ্চা ছিলাম, আর সেটাই আমার প্রথমবার ছিল, আপনি আমাকে সবথেকে ভাল বডিটা দিয়েছিলেন। রাজেশ ছিল আমার পাশেই। ও নিয়েছিল বেলঘাটের মেয়েটার লাশ। লাশটার বডি পচে ঢোল হয়ে গিয়েছিল কিন্তু মুখটা জুঁই ফুলের মত টুলটুলে সুন্দর ছিল তখনো। মনে আছে কেশবভাই? তুমি সেটা নিয়ে মশকরা করেছিলে। শ্যাম নিল আলবিনাকে। আমাদের গাঁও-এর মেয়ে, জণ্ডিসে মরেছিল কিছুদিন আগে। গুরুজি, আপনি কাকে নিয়েছিলেন?”
ত্রিপাঠীজি ঠাস করে একটা চড় মারলেন সীতাপ্রসাদের গলায়। ভাঙা পুতুলের মত টলমল করে উঠল তার মাথা। চিবিয়ে চিবিয়ে ত্রিপাঠীজি হিসহিস করে উঠলেন “অনেকক্ষণ বেয়াদপি সহ্য করছি”।
“রাজেশ পড়েছিল বেলঘাটের কবরের ওপর। শ্যাম--আলবিনার ওপর। তাহলে হিসেব বলছে আমি থাকব হরিজনপুরের কবরের ওপর। আপনি কার ওপর থাকবেন গুরুজি?”
গিরিরাজ সীতাপ্রসাদের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরল “ চুপ কর হারামজাদা! কাকে কী বলছিস?”
কেশব হঠাৎ হাত তুলে ভয়খাওয়া গলায় চেঁচিয়ে উঠল “আরো দুটো বাচ্চা!”
দুখানা নয়, আরো তিনজন বাচ্চা এসে জড়ো হয়েছে। রাত্রির অন্ধকারে এবং আবছা চাঁদের আলোর কাটাকুটি খেলায় তারা মাঝে মাঝে মিশে যাচ্ছে অন্ধকার গাছের গায়ে। আবার যখন মেঘ সরে যাচ্ছে তখন পাঁচখানা ছোট্ট মূর্তিকে দেখা যাচ্ছে । পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে পাহারা দেবার ভঙ্গীতে। কিন্তু প্রাণ আছে সেটুকু বোঝা যায় কারণ তারা মাঝে মাঝে নড়ছে, জায়গা বদল করছে নিজেদের। আর একটু যেন এগিয়ে এসেছে। ঠিক গাছের নিচ থেকে সরে এসে কবরখানার পাঁচিলের ভাঙা অংশটার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে।
ত্রিপাঠীজি হতভম্বভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন “শালা হচ্ছেটা কী আজ? এত বাচ্চা আসছে কোথা থেকে? অ্যাই গিরিরাজ, তাড়িয়ে দাও ওদের! এই তো ইঁট, এই নাও। এটা ছুঁড়ে মারো।”
গিরিরাজ আস্তে করে ত্রিপাঠীজির বাহুতে হাত রাখল, “ফালতু বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই ত্রিপাঠীজি। বরং সীতার আগেকার বলা কথাগুলো একটু ভেবে দেখুন। যদি টাউন থেকে কেউ এসে খুন করে যায় পরপর, তাকে ধরব কীভাবে?”
"প্রভুজিকে খবর দেওয়া হোক", কেশব ভ্যাবাচ্যাকা গলায় বলল।
"প্রভুজি এখন মিনিস্ট্রি পেয়েছেন", খেঁকিয়ে উঠলেন ত্রিপাঠীজি, "চাইলেই নাগাল পাওয়া যাবে না। ওজন বুঝে কথা বলো কেশব। প্রভুজি আমাদের চাকর বাকর নন যে এসব ফালতু ঝুটঝামেলাতে ডাক দিলেই লোক-লশকর নিয়ে চলে আসবেন"।
সীতাপ্রসাদ উন্মাদের মত চেঁচিয়ে উঠল, "তোমরা কেউ বুঝছ না আমার কথা। রাজেশদের মেরেছে কোনো ইনসান নয়। এই পৃথিবীর কেউ নয় তারা।"
বাকি তিনজন ভূতগ্রস্তের মত সীতাপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারোর মুখে কথা যোগায় না কোনও। একটু বাদে তোতলাতে তোতলাতে কেশব বলে "মানে?"
সীতাপ্রসাদ বিকৃত স্বরে উত্তর দেয়, "মানে? এখনও জানো না মানেটা কী? শ্যাম পড়েছিল আলবিনার কবরের ওপর। তাহলে আমি থাকব হরিজনপুরে। ঠিক কি না?"
কেশব ঝাঁপিয়ে পড়ে সীতাপ্রসাদের গলা টিপে ধরে। "সত্যি করে বল, কে মেরেছে রাজেশদের? আজ জ্যান্তই পুঁতে দেব তোকে হারামি! কে খুন করেছে, বল শালা!"
গিরিরাজ কেশবকে ছাড়িয়ে আনে। সীতাপ্রসাদের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল, মুখ লাল। কাশতে থাকে খক খক করে। ত্রিপাঠীজি উত্তেজনার বশে হাঁপাচ্ছেন। কেশব চিৎকার করে ওঠে "জ্বালিয়ে দেব তোকে আজ ! বল আগে কে মেরেছে।"
সীতাপ্রসাদ কাশতে কাশতে লালা ঝরাতে থাকে। কুকুরের মত জিভ বার করে নিঃশ্বাস নেয়। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে তার। চেরা গলাতে উত্তর দেয় "শ্যামকে মেরেছে আলবিনা । তোমাকে কে মারবে?"
ত্রিপাঠীজি হিংস্র চিৎকার করে ওঠেন "সব মিথ্যে! সব! আলবিনাকে ওরা পরের দিন নিজের হাতে আবার মাটি দিয়েছিল"।
সীতাপ্রসাদ পাগলের মত হেসে ওঠে। "গুরুজি, এই দেখুন ডানপাশের কবরটা। সায়িদা আছে এখানে। আপনি ওর বডিটা রেপ করেছিলেন না? সায়িদা আসবে গুরুজি। দেখুন"।
ত্রিপাঠীজি কেশবের হাত থেকে শাবল ছিনিয়ে নিলেন। "সায়িদাকেও পরের দিন আবার কবর দিয়েছিল ওরা। এই নয় মাসে ও কংকাল হয়ে গেছে"।
সীতাপ্রসাদ খি খি করে হাসে। কেশব ফিসফিস করে বলে ওঠে "কবরটা খুঁড়ুন গুরুজি"।
ত্রিপাঠীজি উন্মাদের মত শাবল চালালেন। একটা বড় খণ্ড মাটি ধসে পড়ল। কেশব আর গিরিরাজ পেছনে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে। আবার শাবলের ঘা। ঝুরঝুর করে মাটি ভাংছে। পরের পর আঘাতে ছত্রখান হয়ে গেল জায়গাটুকু। ঘা মারতে মারতে ত্রিপাঠীজি এক সময় শাবলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দুই হাত দিয়ে মাটি সরাতে লাগলেন। আর তারপর হঠাৎ স্তম্ভিত বিস্ময়ে আর্ত চিৎকার দিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন ।
টর্চের আলো ফেলে গিরিরাজ ও কেশব দেখল সায়িদার মৃতদেহ অবিকৃত শোয়ানো আছে। ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে। পরনের শাড়িটা ছেঁড়াখোঁড়া, যে অবস্থায় মাটি দেওয়া হয়েছিল সেরকমই। শুধু সায়িদার পেটটা ডিমভরা কই মাছের মত ফুলে আছে।
কেশব ভাঙা গলায় বলল "এসবের মানে কী?"
হাহাকার করে এক ঝলক বাতাস বয়ে গেল । গিরিরাজ রুদ্ধ ভয়ে চাপা স্বরে বলল "সায়িদা পোয়াতি হল কবে?"
সীতাপ্রসাদ আচমকা আঙুল তুলল পেছনের দিকে "ওরা সবাই আসছে"।
তারা পেছন ফিরে দেখল, আর চার পাঁচজন নয়, দলে দলে শিশু এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। আর তখনই মেঘ কেটে গিয়ে স্পষ্টভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল চাঁদ। সেই আলোতে দেখা গেল, যাদের তিন চার বছরের শিশু ভাবা হয়েছিল তারা আসলে নবজাতক। সম্পূর্ণ উলঙ্গ, সরু কাঠির মত হাত পা, বেঢপ পেট, গায়ের চামড়া হলুদ রঙের, কিন্তু চোখের মণিটা নেই। সকলের চোখ সাদা, ফ্যাটফ্যাটে জলের মতন।
আতংকে চারজন চিৎকার করে উঠেছিল। অন্যদের কী অবস্থা সেটা দেখবার সময় গিরিরাজের ছিল না। সে পালানোর জন্যে পেছনে ঘুরতে গেল। কিন্তু একটা বাচ্চা হঠাৎ "আব্বা" বলে খলখল হেসে লাফিয়ে পড়ল তার বুকের ওপর, এবং গিরিরাজের গলার ওপর বসিয়ে দিল সদ্য গজানো কচি কিন্তু হিংস্র শ্বাপদের দাঁত।
প্রথম রক্তস্রোত ফিনকি দিয়ে বেরনোর সময়ে গিরিরাজ আবছাভাবে বাচ্চাটার মুখ দেখতে পেয়েছিল । রাবেয়ার মুখ অবিকল কেটে বসানো, যার মৃতদেহকে সে একবছর আগে এখানেই ত্রিশূলের ডগায় গেঁথে ফেলেছিল।