পশ্চিমের টিলাটা নামতে নামতে ইউক্যালিপটাস আর বুনো কুলের অরণ্য ভেদ করে ঠিকরে পড়েছে ডাকবাংলোর যে দিকটায়, ঠিক সেই অংশের বাগান লাগোয়া একটুকরো রেলিং-ঘেরা বারান্দাতে এই গল্পের শুরু। আর গল্পের নিয়ম যেরকম হয়, তোমাকে ঠেলতে ঠেলতে কোন খাদের ধারে নিয়ে গিয়ে ফেলবে আর তারপর ছোট্ট ধাক্কা নাকি টলে যাবার আগেই বুকে টেনে নেওয়া, সেটা গল্প নিজেও জানে না। আপাতত এখানে এখন জামের গায়ের খোসার মত পাতলা অন্ধকার। শীতের হিম নেমে আসছে পাহাড় গড়িয়ে। কার্তিকের শেষ বিকেলে গল্প জেঁকে বসেছে, তাই র্যাপার গায়ে দুই চারজন শ্রোতাও মিলে যাবে তাতে আর আশ্চর্য্য কী!
ডেসমন হাঁসদা এই রেলিং ঘেরা বারান্দা আর ওই আপনজনের মত কোল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা টিলার মধ্যবর্তী দূরত্বটুকু বহুদিন ধরেই অতিক্রম করে আসছে। কখনও কুয়ো থেকে জল তোলবার জন্য, কখনও পাশের গ্রামের হাট থেকে মুরগি কিনে আনতে, আবার এই যেমন গতকাল হল, গ্রামের চার্চে প্রার্থনাসংগীতে বাজাবার উদ্দেশ্যে সে বারবার টিলাটির গা বেয়ে জংগলে ভরা রাস্তায় হেঁটে গেছে। ফিরেও এসেছে সন্ধ্যে জমাট হবার আগেই। তাই এই টিলা তার কাছে আর নতুন করে কোনও রহস্য বয়ে আনার কথা ছিল না। হ্যাঁ, আদিবাসীদের মধ্যে বিশ্বাস আছে যে এই পাহাড়ে ভূত থাকে। তা সে তো ওই দূরের গভীর অরণ্যের মধ্যেও থাকে, কুয়াশাঘেরা এই ডাকবাংলোতেও থাকে, এমনকি ফাদার সাইবো বলে গেছেন যে মানুষের মনের মধ্যেও থাকে। আলাদা করে আর সে কী-ই বা ভয় দেখাবে !
ডেসমন হাঁসদা গত সাতাশ বছর ধরে সরকারী এই ডাকবাংলোতে ক্যাজুয়ালে রাঁধুনী ও মালির কাজ করে আসছে। বহু বহুদিন আগে ডেসমন দূরের কোনও এক লোকালয় থেকে স্রোতে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে ঠেকেছিল। আজকের মত তখনও তার পরণে ছিল একটা ফাটা প্যান্ট আর ময়লা সোয়েটার। প্রয়াত ফাদার সাইবো তাকে গির্জাতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, আর সরকারি টুরিস্ট অফিসকে বলে কয়ে জুটিয়ে দিয়েছিলেন এই কাজ। তার খাওয়া এখানে। শোবার ব্যবস্থা হিসেবে সরকারী বাবুদের বলে কয়ে বাগানের এক কোণে একটা ঝুপড়ি তুলে নিয়েছে। কেয়ারটেকার সাগেন মান্ডি ও পরিবার একলা মানুষ ডেসমনের প্রতিবেশী। আর আছে ডেসমনের মাউথ অর্গান। এই লোকালয়টিতে আসবার পর থেকেই রবিবারের গির্জার প্রার্থনাসংগীতে যোগ দিয়ে দিয়ে ডেসমনের রক্তে সুর মিশে গেছে, যদিও গলায় সমান অনুপাতে মেশেনি। মাউথ অর্গানটি ফাদার সাইবো কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন।একটু মরচে পড়েছে । এখানে ওখানে নড়বরে। তবে দিব্যি কাজ চলে যায়। এখন সেখানে শ্রীদেবীর বই-এর সুর, অথবা ‘কী মহান বারতা গাইছে দূতেরা!”
“হেই ডেসমন দাদা, একটা মিঠুন লাগা না!”
“ছি! ওভাবে বলে না। মিঠুনঠাকুর কি তোর আমার মত পাপী তাপী নাকি? ওনারা দেবতা্, বুঝলি? ওঁয়াদের আনতে মন্তর পড়তে হয়। পেরারথনা লাগে! তবে ধরা দেন”।
“সে না হয় হল। তুই তোর ওই পেরারথনা করেই একটা মিঠুন আন। হিম পড়ছে রে ডেসমন দাদা! বড় জাড় লাগে। গান শুনতে মন চায়”।
“ধেনো খেতে খেতে মিঠুনঠাকুরকে ডাকিস না রে! পাপ হবে। ফাদার সাইবো বলে গেছে, গান হল প্রভুর মেষশাবক...”
“ওরে বাপ্পো তোর মেষ তুই রবিবারে করিস। এখন একটা গান দে। আমি তালে তালে নাচি”।
ডেসমনের মাউথ অর্গান থেকে একটা মিঠুন ঝরে পড়ে। সাগিনের পা বেয়ে নাচের মুদ্রায় ওপরে ওঠে।
জায়গাটা রম্য এবং নির্জন হবার কারণে টুরিস্ট স্পট হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে। মূলত সপ্তাহের শেষেই জনসমাগমটা হয়ে থাকে। কলকাতা থেকে বাবু মেমরা আসে। আর ভিড় হয় শীতকালে। তখন ঘরের বুকিং পাওয়া মুশকিল। সকাল থেকে রান্নার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। টিলার মাথায় পিকনিক করতে যায় টুরিস্ট পার্টি। তাদের জন্য ডিম সেদ্ধ, ব্রেড, জ্যাম, কলার ব্যবস্থা, তারপর দুপুরের মুরগির ঝোল ভাত টিলাতে গিয়ে দিয়ে আসতে হয়। রাত্রে আরেক প্রস্থ রুটি মাংস অথবা পরোটা ডিমের ঝাল, বেগুনভাজা। শেষ পাতে লাল দই। দিলদরিয়া আকাশের মুখ আস্তে আস্তে কালো হতে হতে দিন ঘুমিয়ে পড়ে। ন্যাড়া পলাশ ঝাউ আর বনজাঙ্গালির অরণ্যের ভেতর থেকে গম্ভীর অন্ধকার হাওয়া ফিসফিস করে গানের মত বয়ে যায়। একমাত্র তখনই ডেসমনের অবসর মেলে। সুযোগ হয় বাংলোর পেছনে কাঠকুটো দিয়ে জ্বালানো আগুনে সাগিনের পাশে ধেনোর বোতল নিয়ে বসবার। সংগী থাকে আরেকজন। মাউথ অর্গান।
এ কথা ডেসমনের থেকে আর ভাল কেই বা জানবে যে তার ঠোঁটে সুর আসে না! গির্জার গানে তাল কেটে যায়। অমিতাভ বা মিঠুনকুমারের হিট হিন্দি সিনেমাকে আনতে গিয়ে তার ওপর চেপে বসে গত মাসের শোনা ঝুমুরের সুর। সাগিন, বা গ্রামের অন্যরা তাতেই খুশিতে ডগমগ হয়ে যায়। এই গ্রামে ডেসমন ছাড়া আর কেউ তো এমন যন্ত্র বাজিয়ে সুর তুলতে পারেনি কখনও! তার ত্যাড়াব্যাঁকা সুরের সংগে তাল মিলিয়ে মাতাল পায়ে নাচতে থাকে ছেলেবুড়োর দল। গরীব ডেসমন, যার ভাংগা মাউথ অর্গান, সেটাকে রাখবার জন্য একটা কুঁড়েঘর, কয়েকটা ছেঁড়াখোঁড়া জামা চাদর, টুরিস্ট বাবুর ফেলে যাওয়া দুখানা ফাটা জিনস, জ্যালজ্যালে সোয়েটার আর দুএকটা বাসন কোসন বাদে আর এ সংসারে আর কেউ নেই, সে কী করেই বা আর সুর তুলতে শিখবে! যেটুকু শেখা সবই শুনে শুনে। তবুও প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ডেসমন নিয়ম করে তার মাউথ অর্গানকে ঘসামাজা করে। তারপর প্র্যাকটিস করে, যতক্ষণ না বেড টি-র জল বসাবার সময় হয়। রাত্রিবেলা ঘুমোতে যাবার আগে মাউথ অর্গানকে ভক্তিভরে প্রণাম করে তাকের ওপর তুলে রাখে। সন্ধ্যেবেলা হাতে কাজ কম থাকলে গ্রামের ভেতর চলে যায়। মাহাতো কি রায়দের বাড়ি টিভি চলে। কত নতুন নতুন গান, তাদের চমকে দেওয়া সুর। জ্যোৎস্না আঁচানো রাত্রিবেলায় মাহাতোদের উঠোনে বসে ডেসমন মন্ত্রমুগ্ধের মত ঘরের ভেতরে বসানো টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে—কিছুই তো হল না এ জীবনে বাপ!
আর গান বাজে টুরিস্টপার্টিরা আসলে। সন্ধ্যেবেলায় বার্বিকিউ হয়। লাল গনগুনে আঁচে ঝলসাতে থাকে মুরগির নরম বুক, ছাগলের রাং। ডেসমন বাগানের এক কোণে বসে থাকে। মাঝে মাঝে এসে কয়লা খুঁচিয়ে যায়। সেই সব সন্ধ্যেবেলাতে ধেনো খাওয়া বারণ। তবে বাবুদের মুড ভাল থাকলে নিজেদের বিলিতির তলানীটুকু দিয়ে দেয়। আর মাউথ অর্গান বাজাবার তো প্রশ্নই আসে না। ফিস্টি ভেস্তে যাবে, বাবুরা চটে যাবে। তবে টুরিস্ট পার্টির যন্ত্র থেকে গান বাজে তখন প্রচুর। হিন্দি ইংরিজি বাংলা। কী তার বাহার আর কতরকমের ঝংকার! ডেসমন তন্ময় হয়ে শোনে। বোঝার চেষ্টা করে তাল লয় কোথায় উঠছে, কোথায় পড়ছে। কোনও কোনও সুর ভাল লেগে গেলে খুব ইচ্ছে করে বাবুদের বলতে, যদি আর একবার চালায়। সাহস হয় না। একলা ভীতু মানুষ ডেসমন, ফিস্টি শেষ হয়ে গেলে পোড়া কয়লা, মৃত মোরগ আর অন্ধকার ডাকবাংলোকে পায়ে পায়ে ঠেলে আবার নিজের ঝুপড়িতে ফিরে আসত। সংগী ছিল তখনও সেই এক। মাউথ অর্গান।
ডেসমন এ-ও জানত যে তার ছেঁড়া ফাটা ভাগ্যে কখনও ভাল গান আর ভাল সুরের আশীর্বাদ নেমে আসবে না। তাকে সারাজীবন এই একঘেয়ে প্রার্থনাসংগীত আর হিট হিন্দি গানের সুর নকল করেই চালিয়ে যেতে হবে। তার কলকাতা যেতে ইচ্ছে করত। সেখান থেকে বোম্বে। সেখান থেকে আমেরিকা। সেখানে নাকি বাতাসে সুর ওড়ে? কিন্তু ওই যে বহু দূরের পাহাড়টা, শীতের কুয়াশা কেটে ঝকঝকে আকাশ নামলে যেটাকে আবছা আবছা দেখা যায়, তা ঢালু হতে হতে নেমে গেছে ঝাড়খণ্ডের সীমানার দিকে, সেই প্রান্তের ঘন জংগল আর পাহাড়ি নদীতে ভালুকদের মধু খেতে আসাই এখনও ডেসমনের দেখা হয়ে ওঠেনি। সে আর কলকাতা যাবে কী করে? কলকাতা নাকি কয়েক লক্ষ মাইলের রাস্তা। ডেসমন হাজার পর্যন্ত গুনতে পারে। তারপর হাজারের তালশেষে আরেকটা হাজার, তার লয়ে আরেকটা—কিন্তু লক্ষ পর্যন্ত গুণতে গেলে তার হাঁফ ধরে যাবে।
শেষ কার্তিকের যে পড়ো পড়ো বিকেলে এই গল্পের শুরু, ডেসমন তখন বারান্দায় বসে ঝিমোচ্ছিল। সাগেন গেছে টাউনের দিকে। টুরিস্ট পার্টি একটাই এসেছে, তারা গেছে পাশের ঝরণায়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। হাতে কাজ নেই তেমন। নিঃঝুম বাগানের ওপর আস্তে আস্তে হিমের ভাপ নেমে আসছে। গুটিশুটি চাদর মুড়ি দিয়ে বসছে বাগানের ঘোড়ানিম ইউক্যালিপটাস কৃষ্ণচূড়ার সারি। ডাকবাংলোর পেছন থেকে জংগলের যে রহস্য মশকরা আরম্ভ হচ্ছে, একটু বাদেই তার পিঠে কুয়াশার বোঝা নামবে। গোটা জায়গাটাকে দখল করে নেবে অন্ধকার।
হঠাৎ ডেসমনের চটকা ভেংগে গেল। একটা ক্ষীণ গানের সুর ভেসে আসছে না? সুরটা কী অদ্ভুত! গম্ভীর, মন্ত্রের মত, অথচ একেবারেই একঘেয়ে নয়। প্রচুর উত্থান পতনময়। সুরটা মাথার ভেতর গেঁথে যাচ্ছে। ঝরণা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই বারান্দায়। কিন্তু সুরটা আসছে অনেক দূর থেকে। ডেসমন এদিক ওদিক চাইল। কেউ তো কোথাও নেই ! ঘরের ভেতর কি টেপরেকর্ডার বাজছে? তাও তো নয়! বাগানের পেছনের জংগলটা উঁকি মেরে দেখে নিল, কোনও রাখাল বালক পথহারানো গরু কি ছাগল নিয়ে সন্ধ্যের হাঁটা লাগাচ্ছে কি না। নাহ, কেউ নেই কোথাও। তাহলে সুর আসছে কোথা থেকে?
খুঁজতে খুঁজতে সামনের টিলার ওপর চোখ পড়তে ডেসমন আচমকা স্থির হয়ে গেল। টিলার মাথায় কিছু ছায়ামুর্তি জড়ো হয়েছে। একজন সেতার বাজাচ্ছে। আরেকজন বাজাচ্ছে তবলা। এই যন্ত্রদুটো ডেসমন চেনে। সিনেমাতে দেখেছে। অন্যেরাও অনেক কিছু বাজাচ্ছে কিন্তু সেগুলো ডেসমন জানে না কী। এই উঠতি অন্ধকারের মুখে এই লোকগুলো টিলার ওপরে উঠেছে কেন? বাজাচ্ছেই বা কার জন্য? আর কী সেই সুর! যেমন তার ঝংকার, তেমন নেশা। শুনতে শুনতে মাথার ভেতর ভোঁ ভোঁ করে। মনে হয় এই সুরের ভেতর ডুবে যাচ্ছে। তখন নড়াচড়া করতেও ইচ্ছে করে না, কারণ এই ডুবে যাওয়া অবস্থায় আচমকা ঝাঁকুনিতে যে তরংগ সৃষ্টি হবে তা যেন এই সুরময় শান্তিকে তছনছ করে দেবে। ছায়ামুর্তিগুলো তন্ময় হয়ে বাজাচ্ছে। কে দেখছে আর কে শুনছে সেই দিকে কোনও নজরই নেই। ডেসমন পাথরের মুর্তির মত নিষ্পন্দ বসে রইল। শান্ত এ পৃথিবী। ঝিঁঝির ডাকটুকুও কানে আসছে না এখন। আকাশের গায়ে গাঢ় ঘোলাটে আঁচ পড়েছে। টুপটাপ ডাকবাংলোর টালিতে ঝরে পড়ছে বুনো ফুলেরা। আর এই ভরভর উগরে পড়া সন্ধ্যের চরাচর ভাসিয়ে বয়ে চলেছে সুর।
বহুক্ষণ ধরে গান চলল। ঘন অন্ধকার চারপাশ ঢেকে দিল। সাগেন ফিরে এসে কখন ডেসমনের পাশে বসে টুকটাক কাজ করছে, খেয়ালও করেনি সে। একসময় ধীরে ধীরে সুর ক্ষীন হয়ে থেমে গেল। যারা বাজাচ্ছিল তারা কোথায় গেল এই অন্ধকারে বোঝা গেল না। ডেসমন অনেকটা সময় ধরে চুপ করে থাকার পর, একসময় চটকা ভাংল। সাগেনের দিকে ফিরে বলল, ‘এসব সগগের দূতেরা বাজায়, বুঝলি?’
সাগেন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী?”
“আরে হারামজাদা, আবার বলে কী! এতক্ষণ ধরে কী শুনলি? টিলার ওপরে গান বাজল শুনিস নাই?”
সাগেন ভ্যাবলার মত একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে “তোর দিমাকটাই গেছে গান গান করে”। রগের কাছে আংগুল ঘুরিয়ে দেখায়, “ইস্কুপ ঢিলা”।
“গান রে গান ! এতক্ষণ ধরে তাহলে কী শুনলি?”
“আরে ধুর বাপো, কোথায় গান কোথায় কী? আমি তো বসে বসে পুরান লণ্ঠনগুলার ঝুল সাফ করলাম, আর তুই ঝিম মেরে পাশে বসে থাকলি। গান কোথায়?”
ডেসমনের মাথায় ধাঁধা খেলে যায়। সাগেনের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে রংগ করছে না। সত্যিই শোনেনি। এটা কেমন হল? একই জায়গাতে বসে থেকে সে শুনল আর সাগেন কিছুই বুঝল না? সে সাগেনকে আবার ধরে “আচ্ছা, টিলার ওপর কাউকে দেখলি না?”
“কাকে দেখব? এ শালা আজ সকাল থেকেই চড়িয়েছে। কে থাকবে টিলার ওপর, ডেসমন দাদা? কেউ তো নাই!”
অস্থির ডেসমন মাথার চুল খামচে ধরে। তবে কি ভূত? সকলে বলে বটে ওখানে কারা সব থাকেন, কিন্তু কেউ তো দেখেনি তাঁদের! আজ ডেসমনকেই তাঁরা দেখা দিলেন কেন?
সারারাত্রি ঘুম হয় না। পরদিন ভোরেই টিলার ওপর ছুটে যায় ডেসমন। না, কেউ কোত্থাও নেই। গতকাল যে এখানে একদংগল মানুষ গানবাজনা করেছে তার কোনও চিহ্ন নেই কোথাও। এখানে ওখানে টুরিস্ট পার্টির ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক, জলের বোতল, মদের বোতল এক দুখানা, একটা কাপড়ের ব্যাগ এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু না, আর কিছু নেই। এখান থেকে নিচে তাদের ডাকবাংলোটা দেশলাই বাক্সের মতন দেখায়। মাথার ওপর থেকে ধোঁয়া উঠছে। এখনও কুয়াশা কাটেনি ভাল করে। একদিকে ডাকবাংলো, অন্যদিকে ঘন জংগল। দুইদিকের রাস্তাই খুঁটিয়ে দেখে সে। কিছুই বুঝতে পারা যায় না।
এবং সেদিন দুপুরবেলা আবার গান শুরু হয়। ডেসমন তখন দুপুরের খাবার খেয়ে হাতের কাজ গোছাচ্ছিল। টুরিস্ট পার্টি চলে গেছে। আজ কেউ নেই। সারাদিন ধরে তার মন উচাটন হয়ে আছে। কাজে ভুল হয়েছে বারবার। অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। পুরোটাই তার কল্পনা কি না সেটাও বুঝতে পারছিল না। তাই আবার কানে সুর ভেসে আসতেই সে কানে আংগুল ঢুকিয়ে ঝাঁকিয়ে নেয় ভাল করে। চোখ কচলে নেয় বারবার। না, ওই তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে টিলার মাথায় কয়েকজন। আজ কেউ গিটার বাজাচ্ছে, কেউ বাঁশি। আগের দিনের থেকে একদম অন্যরকম বাজনা, কিন্তু শুনলে মনে হয় স্বর্গের থেকে প্রভু যীশুর মেষশাবকেরা নেমে এসেছেন এই টিলার মাথায়। তাঁদের জন্য বয়ে যাচ্ছে এমন অপার্থিব সুর। উত্তেজিত ডেসমন এক লাফে বাগান পেরয়। ছুটে গিয়ে সাগিনের ঘরের দরজা ধাক্কায় “খোল শালা কালাচোদা! দরজা খোল”।
সাগিন ঘুমোচ্ছিল। ধড়মড় করে উঠে আসে। তার বউ-এর ভীতচকিত চোখ একবার উঁকি মেরে যায় দরজার ফাঁক দিয়ে। সাগিন চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলে, “কী হইছেটা কী? চিল্লাছ কেন?”
‘চিল্লাছি? আয়। শুনে দেখ’। সাগিনের ঘাড় ধরে বারান্দায় তুলে টিলার দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দেয়। “শোন এবার নিজের কানে। কাল তো বলছিলি খুব, আমার নেশা চরেছে। আজ শুনছিস কি না?”
সাগিন ঘুরে ডেসমনের দিকে তাকায়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত আস্তে আস্তে মেপে নিয়ে বলে “তোমার কি শরীর জুতের নাই? ডাগদার দেখাবে?”
“ডাগদার? কেন কেন ডাগদার ক্যান?” ডেসমন মারমুখী হয়।
“কোথাও কিছু নেই তুমি গান শুনছ কোত্থেকে?” সাগিন বড় বড় চোখে ডেসমনের দিকে তাকায়, “তোমায় কি ডাইন ধরল নাকি? আমার বুড়ি ঠাগমাকে ডাইন ধরেছিল একবার। সে নাকি কত কী শুনতে পেত। দেখতে পেত। দেখত সমুদ্দুরের রঙ টকটকে লাল হয়ে তার মধ্যে দিয়ে কালিঠাকুরের পেরতিমা উঠে আসছে। শেষে গুণীন এসে মন্তর পরে ঝাঁটা দিয়ে ডাইন তাড়ায়”। সাগিন এগিয়ে এসে খপ করে ডেসমনের হাত ধরে। বড় ঝাঁকুনি দেয় একটা। “ডেসমনদাদা, তুমি আর মানুষ নাই গো!”
ডেসমন ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়। একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মৃদু গলায়, অনেকটা অসহায় সুরে বলে, “আমি যে গান শুনি সাগিন! আমি যে দেখতে পাচ্ছি টিলার ওপরে কত কী বাজছে!”
সাগিন এক পা এক পা পিছিয়ে যায়। ধপ করে বারান্দার সিঁড়িতে বসে পড়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় “এখনও শুনতে পাচ্ছ?”
ডেসমন টিলার ওপর তাকিয়ে দেখে, ছায়ামুর্তিগুলো বাজিয়েই চলেছে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়।
সাগিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “তোমার মাথার ঠিক নাই গো! তুমি পাগল হয়ে গিছ”।
“সাগিন, ভাই আমার। একটা কথা রাখবি?”
সাগিন তাকিয়ে থাকে। উত্তর দেয় না।
“এই কথাটা আর কাউকে বলিস না। সকলে যদি জানে আমার মাথার দোষ, এই কাজটা যাবে। কোথায় যাব বল আর?” ডেসমন মাটিতে বসে দুই হাত জোড় করে, “আমি তো কারোর খেতি করছি না! নিজের মত থাকি। যন্তর বাজাই। গান গাই। কেউ জানলে আমাকে তাড়িয়ে দেবে। খেতে পাব না তখন। আমাকে তাড়িয়ে দিস না সাগিন”। ডেসমনের গলা কেঁপে যায়।
সাগিন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “সাত বচ্ছর তোমাকে দেখছি। কখনও তো বেচাল দেখিনি কিছু! থাকতে চাইলে থাকো। কিন্তু যদি দেখি যে সত্যি সত্যি ডাইন ধরেছে, আমার মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না। বউ বাচ্চা নিয়ে ঘর করি ডেসমনদাদা। আমারও তো জানের ভয় আছে! দূরে থাকো। আমার ঘরে আর এসো না”।
ডেসমন মাথা নিচু করে উঠে যায়। হাতে তখন নিশ্চুপ ঘামছিল। মাউথ অর্গান।
সেই থেকে প্রতিদিন ডেসমনের জন্য বাজতে থাকে গান। ডেসমন ভোর থাকতে থাকতে উঠে কাজকর্ম করে। সাগিন ঝামেলা করেনি আর, কিন্তু বিশেষ মেশে না। কথা বলে কম। দূরে দূরে থাকে, আড়চোখে তাকায়। ডেসমনও ঘাঁটায় না বিশেষ। সারাদিন কাজের শেষে বিকেলবেলা সে এসে বসে বারান্দার সিঁড়িতে। সে আজকাল বুঝে গেছে কখন গান শুরু হবে। ঠিক নির্দিষ্ট সময়টুকুতেই কানে সুর ভেসে আসে। ডেসমন মুখ তুলে দেখে, টিলার ওপরে জড়ো হয়েছে তারা। সে নিশ্চল হয়ে বসে বসে শোনে। একটু পর গান থেমে যায়। ডেসমন সন্ধ্যের রান্না সেরে নিজের কুঁড়েঘরের দিকে হাঁটা লাগায়।
কখনও গান বাজে গভীর রাত্রে। যেদিন ডেসমনের অনেক কাজ থাকে, দুপুরবেলা বাবুদের খিদমত করতে করতে আর কোনওদিকে মন দেবার সময় হয়না, সেদিন গানওয়ালারাও যেন বুঝে যায় যে এখন ডেসমনের গান শোনবার সময় নেই। সেদিন রাত্রিবেলা করে তার কানে ভেসে আসে অপার্থিব সুর। সে বাংলোর সিঁড়িতে এসে বসে। অন্ধকারে টিলার ওপর কিছু দেখা যায় না, কিন্তু সে তাদের উপস্থিতি বুঝতে পারে। কখনও কখনও সারারাত গান চলে। ডেসমন নড়তে পারে না। তার শরীর থেকে তখন ঘুম, খিদে তেষ্টা সব উবে যায়। প্রতিটা লোমকূপ দিয়ে শুষে নেয় সুর। নিস্তব্ধ অরণ্যের গাছেরা শোনে, ঘুমভাংগা ভ্যাবাচ্যাকা পাখি শোনে, আর শোনে গম্ভীর পাহাড়। তারা সাক্ষী থেকে যায়।
সাগিন যখন দেখে যে ডেসমন আর কোনও গোল পাকায়নি, সে-ও আস্তে আস্তে সহজ হয়। আগের মত পুরোটা হতে পারে না এবং সে যে ডেসমনকে আর নিজের ঘরে ঢুকতে দেয় না এই অপরাধবোধটাও সম্ভবত থেকে থাকবে। কিন্তু টুকটাক অকাজের কথাও শুরু করে। জানতে চেষ্টা করে ডেসমন আর গান শোনে কি না। ডেসমন এড়িয়ে যায়। তবে সাগিন বোঝে, যখন দুপুরবেলা নিশ্চল মুর্তির মত ডেসমন বারান্দার সিঁড়িতে বসে থাকে। সে বোঝে যে ডেসমনের তখন ভর হয়েছে। সেই সময়ে সাগিন ডেসমনকে ঘাঁটায় না। মন থেকে যে সে পুরোটা মেনে নিয়েছে এমন নয়। কিন্তু সময়ের সংগে সংগে দুজনেই একটা শান্তিপূর্ন সহাবস্থানের সমীকরণ তৈরী করে নিয়েছে।
তবে মানুষের পেটে কথা বেশিদিন চাপা থাকে না। আর সে মানুষ যদি মাতাল সাগিন হয় তাহলে তো কথাই নেই। গ্রামের ছেলে বুড়ো আস্তে আস্তে সাগিনের কাছ থেকে জেনে যায় যে ডেসমন ভূত দেখে। সে ভূতেদের গান শুনতে পায়। বেশিরভাগই হেসে উড়িয়ে দেয়। তবে কয়েকজন ডেসমনকে জিজ্ঞাসা করতে ছাড়ে না।
“কী রে ডেসমন, আজ কার গান শুনলি?”
ডেসমন ফ্যাকাশে হেসে এড়িয়ে যায়। কিন্তু তাতেও কথা চাপা দিতে পারে না। লোকজন জেনে যায় যে ডেসমনের মাথার ব্যামো আছে।
“কোন গাঁও?”
“চকোইচালং”।
“কোন বাংলো?”
“গরমেন্ট”।
“সে তো চার ঘণ্টার রাস্তা। বেলাবেলি থাকতে বেরিয়ে পড়েন। আর শোনেন, ওখানে ডেসমন বলে এক পাগল বুড়ো থাকে। তার গায়ের চামড়া ঝুরঝুর করছে, তার গালে বরফসাদা দাড়ি। তার কিন্তু মাথার ব্যামো আছে। সে ভূত পিরেত দেখতে পায়। তাদের বাদ্যি শোনে”।
“কেমন দেখে? সে নিজেই ভূত নয় তো?”
“তাও হতে পারে। ডাইন ভর করলে সে নিজে ডাইন হয়ে যায়। তবে এ লোক এমনিতে কাউকে কিছু বলে না। কারোর গুয়াতেও লাগতে যায় না। নিজের মনে থাকে, বিড়বিড় করে। একটা মুখচাপা যন্তর আছে, সেটাকে বাজায়। আর পশ্চিমের টিলার দিকে মুখ করে বসে থাকে। সেখানে নাকি ওর জন্যে গান বাজে”।
ডেসমন নিজেও বোঝে যে তার মাথার ব্যামো। বেশ কয়েকবার গান শুরু হতেই সে ছুটে চলে গেছে টিলার দিকে। হাঁচড়-পাঁচড় করে ওপরে উঠে দেখেছে কেউ নেই কোথাও, সব ভোঁ ভাঁ। চারদিক শান্ত, নিঃঝুম। ডেসমন বুঝেছে যে সে কল্পনা করেছে পুরোটাই। সেদিনকার মত আর গান বাজেনি। পরদিন বেজেছে। সে আবছা একটা যুক্তি নিজের মনে খাড়া করেছে-- যেদিন যেদিন সে টিলার দিকে ছুটে গেছে, সেদিন তার মনের ভেতর অবিশ্বাস ছিল। সেই অবিশ্বাস তার কল্পনার ভিতকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। তার কানের ভেতর গান বাজতে পারেনি। সেই থেকে ডেসমন সাবধান হয়ে যায়। দরকার নেই যুক্তির, দরকার নেই প্রমাণের। হোক সে পাগল। তার এমনিতেও তিনকূলে কেউ নেই, ঘরবাড়ি নেই, সে পাগল হলেও কারওর কিছু এসে যাবে না। তার তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর জীবনের এই একটাই পাওনা। কারা যেন এসে তাকে গান শুনিয়ে যায় প্রতিদিন। সেটা যদি সত্যি না হয়, পাগলের প্রলাপই হয়, কার কী ক্ষতি?
বারে বারে সে নিজের মাউথ অর্গান তুলে নিয়েছে ঠোঁটে। যা যা সুর শুনছে, সেগুলোকে নকল করবার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সবসময় পারেনি। কিন্তু কোনও কোনও মুহূর্তে তার সুর হুবহু টিলার মাথার সুরের সংগে মিলে গেছে। রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে তার সারা শরীর। আর যখনই এটা হয়েছে, ডেসমন দেখেছে টিলার মাথায় লোকগুলো গান বাজনা থামিয়ে দিয়েছে। থামিয়ে দিয়ে তার দিকে যেন তাকিয়ে থেকেছে। ডেসমনের গায়ে কাঁটা দিয়েছে। আপনা হতেই চুপ হয়ে গেছে তার মাউথ অর্গানও। তারপর সে দেখেছে, লোকগুলো সকলে যেন কোমরের ওপর থেকে শরীর একটু ঝুঁকিয়েছে তার দিকে। তারপর আবার শুরু করেছে গান। লোকগুলো কি তাকে অভিবাদন জানাল? ডেসমন ঠিক বোঝে না, তবে এরকম ভংগী সিনেমাতে দেখেছে। দেখেছে মাথায় টুপি কালো কোট আর মাছি গোঁফওয়ালা একটা লোকের সিনেমাতেও। কাউকে সম্মান জানাতে হলে মানুষ এমন ভাবে নুয়ে পড়ে। ডেসমনও মাথা ঝোঁকায়। প্রণাম করে মনে মনে। তারপর আবার মাউথ অর্গান তুলে নেয়।
অনেকগুলো বছর ঝরে গেল। ডেসমনের চোখের ঘোলাটে মণি থেকে টুপটাপ আলোময় দিনগুলো পড়ে গেল একে একে। সে এখন একটু ঝুঁকে হাঁটে। বেশি কাজ করলে হাঁফ ধরে। গির্জাঘরের দোতলা বানানো হল। সাগিন মরে গেল একদিন হঠাৎ, আর তার বউ ছেলে কাঁদতে কাঁদতে আরেক নিরুদ্দেশের পথে হাঁটা লাগাল। গ্রামের বাচ্চা ছেলেপুলের হাতে মোবাইল ফোন বলে একটা জিনিস আসল, যার থেকে গান বেরোয়। কিন্তু জংগলের রাস্তা পাকা হল না। তাতে বাসও চালু হল না। আর একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল পশ্চিমের টিলা। তার বিনাশ নাই।
একদিন এক শান্ত সকালে ডেসমনের চাকরিটা না হয়ে গেল। সে ক্যাজুয়াল থেকে কখনও পাকাপাকি হয়নি। তার ওপর বুড়ো হয়ে যাবার কারণে আর কাজও করতে পারত না। বড় অফিসার এসে অনেক ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করল। তারপর ডেসমনকে ডেকে হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলল, “অ্যাকাউন্টসকে বলা আছে। টাউনের অফিসে গিয়ে তোমার পাওনা যা টাকা পয়সা আছে নিয়ে নাও। এই চিঠিতে একটা টিপছাপ দিয়ে ওখানে জমা করে দিও। আর সামনের মাস থেকে আসতে হবে না”।
বুড়ো ডেসমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার মাথাতেই ঢুকছিল না কী বলবে। অফিসার চলে যাচ্ছিলেন, ফিরে এসে বললেন, “ঘরের জিনিসপত্র একটু আগে থেকে সরিয়ে রেখো। নতুন লোক যে আসছে, সে এখানেই থাকবে”।
ডেসমন ধীরে ধীরে বাংলোর বাইরে বেরিয়ে বাগানে আসল। বসে পড়ল কাঠবাদাম গাছের তলায়। শূন্য দৃষ্টিতে টিলার দিকে তাকিয়ে রইল, আর হাতের চিঠিটা ধরে মোচড়াতে থাকল। দলা করে গুটি পাকিয়ে মোচড়াতেই থাকল।
চলে যাবার দিন এগিয়ে আসল। এই গ্রামে ডেসমনের কেউ নেই, আর ঘর তোলার জন্য নিজস্ব কোনও জমিও নেই। যে কটা দিন পড়ে আছে, বেঁচে থাকার জন্য কাজ খুঁজতে হবে। টাউনের দিকে হাঁটা লাগানো ছাড়া গতি নেই। ওখানে নাকি জংগল কেটে বড় কারখানা হচ্ছে। কিছু কাজ মিলতে পারে।
তো, যে গল্পের শুরু হয়েছিল কার্তিকের এক হিমাভ বিকেলে, তার উপসংহার হতেই পারত বহু বছর বাদের আর এক ডিসেম্বরের শেষ দিনে। ডেসমন হাঁসদা টাউনের দিকে হাঁটা লাগিয়েছিল কি না, অথবা টাউনে গিয়ে একটা কাজ জুটিয়ে নিয়ে কোনওরকমে তার ফ্যাকাশে জীবনটুকুকে হিঁচড়োতে পেরেছিল কি না, সেই জানায় গল্পের বিশেষ দায় বা উৎসাহ কোনওটাই নেই। আমরা জানি ডেসমন টাউনে না গেলেও পাশের গ্রামে যাবেই, অথবা আরেকটু দূরের কোনও লোকালয়ে। এই পৃথিবীর ডেসমনদের জন্য এখনও কোথাও না কোথাও কিছু নগণ্য খড়-পাতা-কাঠ অপেক্ষা করেই থাকে, যেগুলো তাদের আধাখ্যাঁচড়া ভ্যাবাচ্যাকা অস্তিত্বকে শীতের রাত্রিবেলা একটুকরো আগুনের ব্যবস্থা করে দেয়, অন্ততঃ এই ভরসাটুকু না থাকলে এই গল্পের জন্মেরই কোনও মানে থাকত না। তাই আমাদের আর দায় নেই এই আখ্যানকে এগিয়ে নিয়ে যাবার।
তবুও গল্পটা আর একটু এগিয়েছিল। কথক ছাড়াই।
চলে যাবার আগের সন্ধ্যেবেলায় ডেসমন এই বাংলোকে বিদায় জানিয়ে শেষবারের মত টিলার ওপরে উঠেছিল। যেদিন থেকে তার চাকরি ছাড়ার নোটিস এসেছে সেদিন থেকে আর গান বাজেনি। ডেসমন কারণটা জানত। তার বিকল মন আর তেমন শক্তিশালী কল্পনার জন্ম দিতে পারেনি এই কয়েকদিনে। আর সম্ভবত কোনওদিনও গান বাজবে না। ডেসমনের মাউথ অর্গানও ভেংগে প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। কতদিনের হয়ে গেল এই যন্ত্র! কত অবহেলা সয়েছে, ছেঁড়া মলিন পকেটের অযত্ন—তবুও ভালবেসে থেকে গিয়েছিল শেষ অবধি। আজ তার শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। অ্যালুমিনিয়ামের চামড়া গা থেকে খসে পড়তে চায়। কফওঠা ঘ্যাসঘ্যাসে স্বর বেরোয়। কান্নার মত।
টিলার ওপর প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছিল ডেসমন। বুড়ো হয়ে যাবার পর থেকেই আর আসেনি। পাহাড়ি পথ ভাংতে কষ্ট হত। সেও কতকাল! মধ্য শীতের ঘন কুয়াশায় বহুদিন বাদে এই গম্ভীর নির্জন প্রান্তর দেখে ডেসমনের রোমাঞ্চ হয়। কুয়াশায় ঢাকা এ চরাচরে আবার যুবক হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। নিচে ঘন অরণ্য স্থির হয়ে আছে। আরো দূরে গ্রামের দিকে দৃষ্টি পিছলে দিলে দেখা যায় কুয়াশা ভেদ করে উঁকি মারছে গির্জার নির্জন ক্রশ। খেলনাবাড়ির ডাকবাংলোতে আলো জ্বলছে মিটমিট করে। হিমেল হাওয়া মেরুদণ্ডের নিচে খোঁচা মারে। ছেঁড়া সোয়েটারের ওপর র্যাপার জড়িয়ে নেয় শক্ত করে।
তার এই ভাঙাচোরা জীবনের একমাত্র আনন্দ এই টিলার মাথাতেই তৈরী হয়েছিল। হোক না সেটা তার মনের কল্পনা। তাতে কি মায়ার ভাগ কিছু কম পড়ে? এত এত রূপরসগন্ধময় সুর তার মত গরীব মানুষ আর কোথায় শুনতে পেত, যদি না ওই মাথার দোষটুকু থাকত?
অনেক অনেকক্ষণ টিলার ওপর বসে থাকার পর রাত জমাট বাঁধলে ডেসমন উঠে দাঁড়াল। কাল চলে যেতে হবে। আর এখানে আসা হবে না। স্বপ্ন! সে চোখ বন্ধ করে একবার হাসে। স্বপ্নই তো! হয়ত তার ঘুমের মধ্যে আবার এই টিলা আর তার অদ্ভূত সব ছায়ামুর্তিরা স্বপ্ন হয়ে হানা দেবে।
নিচে নামবার জন্য পা বাড়াল। হয়ত অভ্যেসবশতই মাটির দিকে তখন চোখ চলে গিয়েছিল তার। কী যেন একটা চকচক করছে না? ভাল করে দেখার জন্য একটু নিচু হল। আর মুহূর্তে চোখে অন্ধকার দেখল ডেসমন। সম্ভবত এক মুহূর্তকালের জন্য লোপ পেয়ে গেল তার সমস্ত বোধ এবং চেতনা।
বুনোঝোপের ওপর পড়ে আছে একটা ঝকঝকে মাউথ অর্গান।
ডেসমন বিদ্যুৎপৃষ্টের মতন ঘুরে তাকাল। না, কেউ কোথাও নেই।
শুধু দিগন্তবিস্তৃত চরাচরব্যাপী হা হা করে ছুটে যাচ্ছে পৌষের বাতাস।
অন্য কেউ কি লুকিয়ে আছে এখানে? না তো! কোথায় লুকোবে? আর কেনই বা? সে প্রাণপনে নিজের হাত মুঠো করল। এ হতে পারে না। এ তার মাথার ব্যামো।
চারদিক শুনশান। শুধু ঝিঁঝির ডাক। নিশ্চুপ অরণ্য আর পাহাড় তাকে ঘিরে বসে আছে।
ডেসমন মাউথ অর্গানটা হাতে তুলে নিল। আস্তে আস্তে সারা শরীরে হাত ঘসল, গন্ধ শুঁকল যেমন কুকুরেরা করে। এও কি মিথ্যে, তার গানওয়ালাদের মত? না তো! এই তো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। একদম নতুন, যেন প্যাকেট খুলে বার করে আনা হয়েছে আজই।
কিছুই বাস্তবে ছিল না তো! এই স্বপ্ন, এই কল্পনা—তবু, তবুও, এই নির্জন টিলার মাথায় তার জন্য মাউথ অর্গান এল কোথা থেকে?
হাহাকার নিঃসীম চরাচরে ডেসমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।