নােবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক Orhan Pamuk তার The Museum of Inno Conle উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বলেছেন নানা আকর্ষণীয় প্রসঙ্গ খুঁজতে খুঁজতে, সেসব বিষয়ে পড়তে পড়তে, তারপর সেইসব বর্ণনা করতে করতে তার এই উপন্যাসটি একসময় লেখা হয়ে যায়। জাদুঘর আর উপন্যাসে বিষয় একপ্রকার এবং জটিল। এ দুটোই Cabinets of curiosities. জাদুঘর যেমন সংরক্ষণ করে প্রসঙ্গাবলি, উপন্যাস ও preserves the nuances, tones and colors of language, expressing in colloquial terms people's ordinary thoughts and the haphazard way in which the mind skips from one topic to the next. বাঙালি ঔপন্যাসিক অমর মিত্রের ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘দশমী দিবসে’ উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে এটি যেন এক জাদুঘর, এখানে রয়েছে একাধিক ক্যাবিনেটস অফ কিউরিয়সিটিজ। তিনি পাঠকদের জন্য ধরে রাখেন ভাষার সূক্ষ্ম তারতম্য, স্বরভঙ্গিসমূহ; বর্ণালি, প্রবল ভঙ্গিতে জনসাধারণের সাধারণ ও অসাধারণ ভাবনাসমূহ আর এলােমেলাে মন এক একটি প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলতে থাকে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে পূর্বোক্ত উপন্যাসদুটিতে সাদৃশ্য আছে। আমি শুধু লিখনভঙ্গির সাদৃশ্যর (শুধু এই ক্ষেত্রে) কথাই বলতে চাচ্ছি।
পাঠক দশমী দিবসে’উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বুঝতে পারবেন উপন্যাসটির কেন্দ্রে আছে উনবিংশ শতাব্দীর ব্যতিক্রমী মহান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনের সাম্প্রতিক মূল্যায়ন। তবে তা কখনােই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিরচিত কালীপ্রসন্ন সিংহকে কেন্দ্রে রেখে ‘এই সময়’ উপন্যাসের মতাে নয়। দুটো উপন্যাসের স্টাইল একেবারেই আলাদা। মধুজীবনীর নতুন মূল্যায়নের পাশে পাশেই অমর ধরতে চান ৪৭ সালের বঙ্গদেশ ভাগের বিষাদকে, উদ্বাস্তু সমস্যা ও যথােচিত গুরুত্ব পায়। অতীত কবি জীবনের কতিপয় চরিত্র দেখা দেয় বর্তমানে। বীরাঙ্গনা নামা প্রৌঢ়া 'বীরাঙ্গনা' নামক পত্র কাব্যপাঠে প্ৰবল করে প্রবৃত্তকে। বেলগাছিয়া নাট্যশালা, মধুকবির নাট্য জীবনের সূচনা পাঠককে আকৃষ্ট করে। ধূলি মলিন মাইকেলের কবরস্থান ও স্বরচিত এপিটাফ উপেক্ষিত। সর্বোপরি অমরের সাতক্ষীরা ও কপােতাক্ষ ছেড়ে কলকাতা ও অন্যান্য স্থানে বসত ধ্রুবপদের মতাে ঘুরে-ফিরে আসে এই উপন্যাসে, আরাে নানা উপন্যাস ও গল্পে।
শুরুতেই লেখক বলে নেন – এই উপন্যাসের কথা ভেবেছিলাম বহুবছর আগে ২০০০ সালে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে, যশাের জেলার সাগরদাড়ি গ্রামের কপােতাক্ষকূলে বসে বিদায়ঘাটের কথা শুনে। ... সেই বিদায়ঘাটই আমাকে প্ররোচিত করে এই উপন্যাস লিখনে। ... (আর) 'দেশ ভাগে সমস্ত দেশই বয়ে ওঠে বিদায়ঘাট' এভাবেই এই উপন্যাসটি লেখকের মতাে পাঠকের কাছেও হয়ে উঠতে থাকে ক্যাবিনেট অফ কিউরিয়সিটিজ। পাঠকদের একাংশ নিশ্চয়ই আশ্চর্য লিখন শৈলীতে আবিষ্ট হয়ে মধুজীবনীর নানান পাঠে, মধু রচনার নানা শব্দ বিষাদে আত্মসমর্পণ করবেন আর সাতচল্লিশের দেশভাগ নিয়ে বহমান বিতর্কের দিকে দৃষ্টি দেবেন। আর অন্তর্গত চরিত্রগুলি, হিন্দু বা মুসলমান, বিত্তবান বা বিত্তহীন, খ্যাপা, কল্পনাপ্রবণ ও গতানুগতিক চরিত্রগুলি তাদের যাবতীয় কালাে ভাগ্য ও বর্ণিলতা নিয়ে পাঠককে আগ্রহী করে তুলতে প্রতীক্ষা করে।
বাষট্টি অধ্যায়-বিশিষ্ট ৩৩৬ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির পট উত্তোলিত হয় বীরাঙ্গনা দাসীর প্রসঙ্গায়নে। বীরাঙ্গনা নামটি আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় মাইকেল সৃষ্ট বীরাঙ্গনা কাব্যের শকুন্তলা, তারা, রুক্মিণী, কেকয়ী, সূর্পনখা, দ্রৌপদী, ভানুমতি, দুঃশলা, জাহ্নবী, উর্বশী, জনাকে। এই বীরাঙ্গনা ওপার থেকে এপারে এসেছে, পুত্র বা কন্যার সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল; কিন্তু কলকাতা, বসিরহাট, অনায়াস যাতায়াত করেছে। তার নিরন্তর পথিক বৃত্তি, সবাইকে হাস্যমুখ করানাের চেষ্টা বিস্মিত করে। কিন্তু সাদা থান, সেমিজ, বগলে পুঁটলি নিয়ে প্রৌঢ়া কপােতাক্ষ স্বপ্নে বিভাের, মধুসূদনের রচনা, মধুজীবনী সে লােকজনকে শুনিয়ে বেড়ায়, মধুজীবন ও রচনা পাঠে বালক বৃদ্ধ সকলকে উৎসাহ জোগায়। তার এই নিরন্তর মাইকেলচর্চা নিজের ও অন্যের দুঃখ ভােলায়। ইনি নাকি মাইকেলের দৌহিত্রী, সবার কাছে মাইকেল দিদিমা। আর অসম্পৃক্ত পাঠকের কাছে বীরাঙ্গনা মাইকেল প্রসঙ্গের চারণ কবি, ফরাসী এবাদুরদের মতােই। পুত্র কোর্টের মুহুরি, মেয়ের শ্বশুর বাড়ি দিল্লিতে। পথপরিক্রমা জীবনেরই, বুড়ি বীরাঙ্গনাকে মাইকেল উদ্বুদ্ধ করে, কপােতাক্ষ তাকে দেয় স্নেহ ও বিষাদ। তবে বিরলে ছাড়া এ অনুভব জাগে না। নিরন্তর তার চোখ ছলছল করে - "কেমনে ফিরিব—হায়রে কে কবে মােরে, ফিরিব কেমনে শূন্য লঙ্কাধামে আর।' বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ-দুটোই শূন্য হয়ে গেছে তার মতে। দিদিমা অভিরামের বেলগাছিয়ার বাড়িতে প্রায়ই এসে ওঠে, যেন আপনজন। হাবুলের পাকিস্তান মানি না জেহাদ বুড়ি মানে না। চারপাশের লোককে সময়ে অসময়ে সে মধুজীবন, মধু রচনা শোনায়। ফণীকে সে বিয়ে দিতে চায়, মনে করে দুঃখ করলেই দুঃখ যায় না। বিষণ্ণ কবিকে সে শোনায় কপোতাক্ষ প্রশস্তি, এমন কি দিল্লি থেকেও সে ভোররাতে কপোতাক্ষ স্টিমারের ভোঁ শুনতে পেত। চরিত্ররা প্রায় সকলেই কল্পনাপ্রবণ, অনুভবে আন্দোলিত। বীরাঙ্গনার কথাবার্তায়, আবৃত্তিতে মধুজীবন, দেশভাগ তাৎপর্য পায়। লেখকের মতে, ‘সাগরদাড়িকে ওপার থেকে এপারে যেন তুলে এনেছে বীরাঙ্গনা দাসী।’ তার বিশ্বাস নদীর জল কথা বলবে মানুষের সঙ্গে। বীরাঙ্গনা যেন ঔপন্যাসিকের রিলায়েবল ন্যারেটর, যার সঙ্গে লেখকের পারস্পেকটিভ জড়িয়ে আছে। ফণীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মানকুমারী বসুর কথা ওঠে। তিনি মন্বন্তরের বছরে চোখ নিমীলিত করেন। ফণী বােঝে বীরাঙ্গনা মাসির কথা মধুর এবং বাস্তব—দুইই। দাঙ্গা, ভিটে ছাড়া মানুষের অভিজ্ঞতা তার আছে। মাসি 'জীবনের সব ঘটনার সঙ্গে মিশিয়ে দেয় মধুসূদনকে।' তাই অন্তরঙ্গজনদের কাছে সে আখ্যাত হয় মাইকেল দিদিমা রূপে। দ্রষ্টা বীরাঙ্গনা তেতাল্লিশের ও সাতচল্লিশ পরের মন্বন্তর দেখেছেন। দিদিমার কথায়—মধু দুঃখ পেয়েছে, দেশবাসী দুঃখ পেয়েছে তার জন্য। একসময় হাবলুর মতাে সেও বিশ্বাস করত দেশভাগ সত্য নয়। বীরাঙ্গনা বলে- ব্যক্তিকে, দেশকে, ভাষাকে ভালােবাসাই ভালােবাসা। ছায়ারানী থেকে বীরাঙ্গনা, তা ভেঙে অঙ্গনা, আবার হাবলুর কাছে একসময় মরিয়মও হয়ে যায়। ২৮ নং অধ্যায়ে বীরাঙ্গনার বাড়িতে দারিদ্র, কোর্টের মুহুরি ছেলে, জমিজিরেত, ঘােরাফেরা কিছু কথা জানা যায়। বুড়ির উৎসাহ অপরিসীম, লােকাল ট্রেনে বনগাঁ চলে যায়, সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে। পরিত্যাগ করে আসা দেশের জন্য এমনকি প্রকাশ্যেও কেঁদে ওঠে। দুঃখ মধুর, ফণীর, হাবলুর, বীরাঙ্গনার, একদল দুঃখী বিষাদাচ্ছন্ন মানুষ আঁকেন বিষাদময় লেখক। চরিত্রচিত্রণে তার আশ্চর্য নৈপুণ্য। চরিত্রচিত্রণে shifting, বর্তমান অতীত মিশিয়ে দেবার এই নৈপুণ্য অমরের সমসাময়িকদের মধ্যে আর কারাের নেই। হাবলুর সঙ্গে তার মধু নিয়ে, যুদ্ধ নিয়ে, শাসক ইংরেজ নিয়ে, ধর্ম নিয়ে কথা হয়। বীরঙ্গনা, রেবেকা সাক্ষাৎ এককথায় মার্ভেলাস।
দুটো সরল কিন্তু একসেন্ট্রিক চরিত্র এনেছেন লেখক। ফণিভূষণ বয়সে কিঞ্চিৎ বড় অবিবাহিত, মাড়ােয়ারির দোকানে কাজ করে, হাঁটাহাঁটি করে খুব। নাগরা জুতাে পরার শখ, বীরাঙ্গনাকে চিঠি দিয়েছিল নাগরা আনতে। দমদমে থাকে, রাতে প্রায়ই রান্না করে না। সে ও কপােতাক্ষ প্রশস্তি শােনে। বীরাঙ্গনা তাকে সংসারী করার জন্য জোর করে। একবার মেয়ে দেখতে বনগাঁও যায়। কিন্তু কথা এগােয় না। একাকিত্ব। পড়ার মাথা থাকলেও পড়া হল না আর। সে ভেবেছিল নির্ভার মানুষ সে, একা পেট চালানাে সােজা। কিন্তু বিয়ে করতে ভয় পায়। সে ওপার থেকে এসেছে নিঃস্ব হয়ে। বুঝেছিল পার্টিশনের পর আর ওদেশে থাকা হবে না। একসময় বিয়ের জন্য বাসনা জাগে, প্রত্যাখ্যাত হয়ে দুঃখ পায়। জীবনযুদ্ধের কথা তার কাছে ভয়ের। বস্ত্ৰ সংকট-এর কথা বলে মালিকের ছেলেকে. জানে দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, দেশভাগ, উচ্ছেদ, রায়ট এসেছে হাত ধরাধরি করে। ফণিভূষণ সরল ভিতু মানুষ, অ্যাভারেজ মানুষের ধাঁচ, আর দেশপ্রীতি, মধুপ্রীতি তাতে যুক্ত হয়। সে উপন্যাসের কাঠামােয় নিষ্পাপ মানুষের প্রতিভূ। অন্যজন হাবলু। সে একটু বেশি মাত্রায় একসেন্ট্রিক। অভিরামের আশ্রিত হাবলু। সে পার্টিশনে, পাকিস্তানে বিশ্বাস করে না। দু’দেশ জুড়ে যাবে বলে সে বিশ্বাস করে। মাঝে মাঝে ওপারে মার কাছে যায়। নেতাজি ফিরবে বিশ্বাস করে। ইচ্ছে করে দিল্লি লাহাের করাচি যাবে। টিয়ার সঙ্গে তার খুনশুটি। টিয়া উপন্যাস পড়ে,হাবলু তাকে খ্যাপায়। আর চুপ করে মধু কথা, কপােতাক্ষ কথা, সাগরদাঁড়ি কথা শােনে বীরাঙ্গনার কাছে। হাবলু খােকনকে নিয়ে টালা পার্কে যায় যুগের যাত্রী ক্লাবের ফুটবল প্র্যাকটিস দেখতে। নিশীথদার কোচিং-এ ঢুকিয়ে দিতে চায় খােকনকে।
হাবলু বিশ্বাস করে আকাশে বর্ডার নেই, উপরে উঠলে কপােতাক্ষ পর্যন্ত দেখা যাবে। সে নাকি দুঃখ দেখতে পায় – দুঃখ ‘মুখ আঁধার করে থাকে, একা একা ঘােরে। মাঝে মাঝে গড়ের মাঠে গিয়ে শুয়ে থাকে। টিয়া জানে 'হাবলুর মাথায় গােলমাল। হাবলু মনে করে উপন্যাস পড়ার বদলে মনােতােষ রায়ের ব্যায়ামের বই পড়া ভালাে। গড়ের মাঠের বিছানা তার কাছে আরামের। বলে ব্যস্ত সে, ‘এখন আমার কাজ বর্ডার ভেঙে দেওয়া; পাকিস্তান রদ করা।’ আবার বেড়ালকে জেরা করতে চায়, বেড়ালের কানের কাছে ঠোঙা ফাটাতে চায়। সে সবাইকে রাজি করিয়ে পার্টিশান রদ করাবে। টিয়া অবাক হতে হতে একসময় হাবলুকে ভালােবেসে ফেলে। হাবলু একসময় ময়রমকে ভালােবেসে ছিল। অনুরক্ত হয়ে টিয়াকে ময়রম বলে সম্বােধন করে। হাবলু অভিরামকে বলে সে চাকরি করবে না, দিল্লি যাবে পার্টিশান রদ করতে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে। বারবার তার কথার পারম্পর্য হারিয়ে যায়। সে শুনেছে জার্মান দেশও ভাগ হয়ে গেছে। সে বিশ্বাস করে তার বাবা মেঘের গন্ধ পায়, বলতে পারে বৃষ্টি কখন হবে। হাবলুরা চার বােন দুই ভাই। বনগাঁয় জ্যাঠার বাড়িতে থাকে এক বােন, যার বিয়ে দিতে চায় সে। ফণীকে পাত্র করতে বলে বীরাঙ্গনা। হাবলুর পাকিস্তান রদ করার ঘােষণা বাজারে তাপ ছড়ায়। সে পালিয়ে আসে। সব পুজো-আচ্চা ভুলে গেলে সমস্যা থাকবে না। একসময় সে বুঝেছে ‘ভালােবাসা হলি ধম্মাে থাকে না।’ তার মাথা কেমন, তাই আচমকা গােলমেলে কথা বলে ফেলে। টিয়ার সঙ্গে অনুরাগের দৃশ্য (প, ১৫৯, ১৬৭) অপূর্ব নৈপুণ্যে লেখক হাজির করেছেন। এই দুটি চরিত্র উপন্যাসটির সিরিয়াস প্রসঙ্গের উপর, কঠিন বাস্তবের ওপর মায়ার আস্তরণ আনে। এ কঠিন কাজে লেখক অভাবনীয়ভাবে সফল।
পূর্বেই বলেছি উপন্যাসটির কেন্দ্রে আছে মধুজীবনীর অংশ। তার সাহিত্য বিচার নয়, সামাজিক প্রসঙ্গ তেমন নয়, ধর্মান্তরিত হওয়ার পর মাতৃভূমি ত্যাগ, মাদ্রাজ গমন এবং পরে রেবেকা ও হেনরিয়েটা প্রসঙ্গ। এ প্রসঙ্গ শুরু করা হয় মধুকবি রচিত এপিটাফ উদ্ধৃত করে। ১৪ পৃষ্ঠায় মেঘনাদ বধ কাব্য উল্লেখ হয় (১ম সর্গ); বীর বাহুর মৃত্যু, প্রমীলার আর্তি ইত্যাদি। ২৭ পৃষ্ঠায় মেঘনাদের মৃত্যুতে রাবণরাজার কান্না, মধুর পূর্বজ মানিকরামের প্রসঙ্গ, তার প্রেম ইত্যাদি। অর্থাৎ কাব্য ও ব্যক্তি জীবন, সৃষ্টি ও জীবন ব্যবহৃত। বারংবার আসছে কপােতাক্ষ, বিদায়ঘাট, অশ্রুঘাট। এখানে ঔপন্যাসিক কল্পনাকে উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করেছেন। মধু সাগর পার হয়ে যাবে রাবণের লঙ্কা পুরীতে। তাকে আটকাবার কেউ নেই। পৃ. ৪৯ থেকে জানছি মধু মাদ্রাজ যায় ১৮৪৮-এ, মেঘনাদ বধ লেখা হয় ১৮৬১তে। মধু গতানুগতিক স্রোতের বিপরীত যাত্রী মাছের মতাে (পূ, ৫০) জাহ্নবীর সতীন কথা, মধুর ধর্মত্যাগ।
অনেকগুলি মধু জীবনীর মধ্যে আমি ব্যবহার করছি গােলাম মুরশিদ রচিত (‘আশার ছলনে ভুলি', ১৯৯৫) বইটি। জানতে পারছি মধুর বাবা রাজনারায়ণ ছিলেন কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল। কাকা জ্যাঠারা আইনের লােক। মধুর প্রপিতামহের তিন ছেলের কনিষ্ঠ মানিকরাম সাগরদাঁড়িতে বাসা বাঁধেন। মধুর জন্ম ১৮২৪, ২৫ জানুয়ারি। জাহ্নবী দেবী মধুকে রামায়ণ মহাভারত কবিকঙ্কণ চণ্ডী, অন্নদামঙ্গল পড়ে শােনাতেন। বালক বয়স থেকেই মধু কবিতাপ্রিয়। কলকাতায় স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার পর সাগর পাড়ি দিয়েছেন একাধিকবার, তবে গ্রামের সঙ্গে বাইরের বন্ধন আপাতদৃষ্টিতে আলগা হয়েছিল। (পু. ২৩) তবে শিকড়ের টান অব্যাহত। মধুর কলকাতার ছাত্রজীবন উপন্যাসে নেই, কারণ উপন্যাসের পারস্পেকটিভে তা জরুরি নয়। মধু যে মদ, মাংস, হুঁকো খেতেন সেটাও জরুরি নয়। মধু পােপের আপ্ত বাক্য - কবিতার জন্য দরকার হলে বাবা-মাও পরিত্যাজ্য-- ধ্রুব সত্য বলে মানতেন। তমলুকে আঠারাে দিন কাটানাের পর ছেলের মতিগতি বদলাতে বাবা তার বিয়ে দেবেন ঠিক করেন। বিয়ে এবং প্রেম সম্পর্কে দারুণ রােমান্টিক হলেও এ বিয়ে তাকে উদ্বিগ্ন, বিচলিত করে। বিয়ে ভণ্ডুল করার জনা, বিলেত যাবার জন্য, ইংরেজিতে কবিতা লিখে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য মধু খ্রিস্টান হবেন মনস্থ করেন। (পূ, ৫৯) রাজনারায়ণ পুত্রকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন ও ব্যর্থ হন। অগত্যা পিতা আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেন। ফলে ধর্মান্তরিত মধু বাড়িতে ও কলেজে ঢুকতে পারলেন না, আর্থিক কারণে কলেজও ছাড়তে হল। তবে তার মনে স্বজন হারানাের বেদনা ছিল তীব্র। (পৃ. ৭৩) অভাবের জন্য বই ও অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি শুরু (পৃ. ৮৮)। অগত্যা কলকাতা ত্যাগের ও মাদ্রাজ যাবার চেষ্টা। পাঠক বুঝতে পারবেন অমর তার প্রয়ােজনমতাে কবিজীবনের তথ্য ব্যবহার করেছেন। আমাদের সব সময়ই মনে রাখতে হবে অমরের সিদ্ধান্ত - উপন্যাসের পৃথিবী আমার নির্মাণ। মধুর পূর্বপুরুষ কবি, ব্যবহারিক জীবনে উদাসীন, কবিতা তাকে শেষ করেছে’ ইতিহাসের অন্তর্গত। তবে মানিকরাম ময়রমকে না পেয়ে সাধু হয়ে গেল। এই প্রেম, ঘরছাড়া, এ উপন্যাসে পরবর্তী জীবন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। মধুর দাম্পত্যে সামান্য নজর দেওয়া যাক। উপন্যাসের ৪৫নং অধ্যায়ে রেবেকার কথা এসেছে টিয়ার ভাবনায়। ‘রেবেকার কষ্ট কে বুঝল'- একথা সত্য। 'অনাথিনী রেবেকা ভেবেছিল ওই কালােমানুষ তার বড় সহায় হলাে। 'কী সুন্দর এই মানুষটি। কী রােমান্স ওর ভিতরে।' (পৃ. ২২৫) টিয়া খােকনকে বলে এই প্রেমিকা রেবেকাকে মধু ত্যাগ করে। রেবেকাকে ত্যাগ করে মধুকবি যে হেনরিয়েটাকে গ্রহণ করল তা কি অন্যায় নয়? (পৃ. ২৩৫) ঔপন্যাসিক সঙ্গতভাবেই এ প্রশ্ন তুলেছেন, যে প্রশ্ন মধুকবির অন্য প্রসঙ্গের তলায় চাপা পড়ে গেছে। বীরাঙ্গনা হাবলুকে নিয়ে যখন পার্ক স্ট্রিটের কবরখানায় মাইকেলের সমাধি দেখতে যায় তখন রেবেকার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। রেবেকা বলে – ‘আই, বীড়া, বীড়াঙ্গনা, লেডি উইথ কারেজ, টুমি আসিবে আমি জানিতাম, আয়াম ওয়েটিং ফর ইউ সিনস এইট্টিন নাইনটি টু'। (পৃ. ২৬০) ১২২ বছর আগের কথাকে ঔপন্যাসিক কী সুন্দরভাবে তুলে স্থাপন করেন ২০১৪তে। দু'কথায় রেবেকা প্রসঙ্গ উত্থাপন চমৎকার। ফেমিনিস্টদের ব্যাখ্যান যেন তার লিখন স্বরে। একান্ন অধ্যায়ে রেবেকা ও বীরাঙ্গনার কথাবার্তায় রেবেকার জীবনদুঃখ প্রতিভাত হয়। স্বভাবতই উঠে আসে হেনরিয়েটার কথা। নর্দান প্রভিন্সে রেবেকা চলে যাওয়ায় তার সর্বনাশ ঘটে। মধু বলেছিল হেনরিয়েটাকে তুমি সখী করে নাও। বার্থ, তাদের কন্যা কাঁদতে থাকে, তার চোখ জ্বলে, শিশু জেমস হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসে বারান্দায়। ৫২তম অধ্যায়েও রেবেকার কথা – মধুর ক্রুয়েলটির কথা। শুনতে শুনতে বীরাঙ্গনা মধু রচিত শর্মিষ্ঠা নাটকে রাজা যযাতির দুই প্রেম দেবযানী আর শর্মিষ্ঠার কথা মনে করে। ২৭২ পৃষ্ঠায় দেখান কবরে প্রয়াত কবি মধুর সঙ্গে মধুর কথােপকথন, মধুর ক্ষমা প্রার্থনা, গােপনে রেবেকাকে প্রেম নিবেদনের কথা। গােলাম মুরশিদ-এর মধুজীবনে বােঝা যাবে ঔপন্যাসিক এখানে বিশ্বস্ত, এখানে উল্লেখিত কবিতাও সেখানে আছে। তবে ঔপন্যাসিক তাঁর নিজের মতাে করে প্রসঙ্গগুলি ব্যবহার করেন, অতীতকে বর্তমানের সঙ্গে মিশিয়ে দেন, তার কৃতিত্ব অবশ্যই বারংবার উল্লেখ করার মতাে। ২৭৭ পৃষ্ঠায় লেখক বলেন –
‘মধুকবি আর হেনরিয়েটা দুদিন আগে পিছে করে প্রায় একসঙ্গে মারা গিয়েছিল, খুব কষ্ট পেয়েছিল তারা। একেবারে সত্যি কথা। জীবনী পড়লে এসব বিস্তারে জানা যাবে। উপন্যাসে অবশ্য ভার্সাইতে হেনরিয়েটাকে, গর্ভবতী স্ত্রী, শিশুদের ফেলে কলকাতা এসে ব্যারিস্টার কবির ধার করে বাবুয়ানির কথা নেই। এ আর এক দুঃখের গল্প। এ প্রসঙ্গ অধিক গুরুত্ব পেলে উপন্যাসটি পথভ্রষ্ট হত বলেই মনে হয়।
উপন্যাসটির নাম – দশমী দিবসে'। মেঘনাথ বধ কাব্যের শেষ অর্থাৎ নবম সর্গের একেবারে শেষে সমুদ্র তীরে মেঘনাদের চিতাশয্যা। দেব রক্ষ সবাই হাজির। দাহ শেষে ভেজা চোখে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে সবাই ফিরছে দশমী দিবসে। তারপর সাত দিন রাত সমগ্র লঙ্কার বিষাদ কান্না। সাতচল্লিশের দেশভাগের রাজনৈতিক পাশাখেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছে, মরেছে, বাস্তুভিটে ত্যাগ করে যাবতীয় সম্পদ ও স্বপ্ন ত্যাগ করে গেছে ভিন দেশে। এ হল সামাজিক বিসর্জন, চোখের জল কখনই মােছার নয়। উপন্যাসটির নাম তাই সঙ্গত হয়েছে বলেই পাঠক, তিনি যে বঙ্গেরই হােক, লেখনীগুণে পড়তে পড়তে তাঁর দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
মধু ভাগ্যের চক্রান্তে দেশছাড়া হয়েছিল, কলকাতা ফিরলেও সাগরদাঁড়ি ফিরতে পারেনি। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাখেলায় লক্ষ লক্ষ লােক বাস্তুচ্যুত হয়, লুষ্ঠিত হয়, পথে-ঘাটে মারা যায়, উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসীর লাথি ঝাটা খেয়ে একাংশ বেঁচে যায়। বাস্তুভিটায় আর ফেরা হয়নি। লেখক নিজেও আর সাতক্ষীরায় স্থায়ী ভাবে ফিরতে পারেন নি, যদিও স্মৃতির দরজায় নিরন্তর কড়ানাড়া থেকে যায়।
একজন বড়াে মাপের লেখকের মতাে অমর একটা জায়গায় দেশভাগ সংকট না তুলে নানা জায়গায় নানা জনের কথায় তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। খােকনের মা বলে তার দাদা-দিদিরা পার্টিশনের সময় রােগে মরেছে, দাঙ্গায় নয়, কলেরায়, খারাপ জ্বরে। অভিরাম বলে ওপারে অসুবিধে হচ্ছে, থাকা যাবে না। হাবলু বলে, তার বাবা এপারে আসতে ভয় পায়। হাবলু পাটিশান রদ হয়ে যাবে এসব ভাবে, নেহরু বা আয়ুবের সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে, এসব উদ্ভট কল্পনা করে। রেলগার্ড হাবলুকে বলে ওদিকের লােক এদিকে ভর্তি। আকাশে বর্ডার নেই, পাখিরা বর্ডার মানে না, উঁচুতে উঠলে কপােতাক্ষ পর্যন্ত দেখা যাবে। মান্টোর টোবা টেক সিংকে মনে পড়ে। হাবলু ইন্ডিয়া পাকিস্তান মানে না। দেশভাগে হিন্দুস্তান পাকিস্তান অশ্রুঘাটে ভরে গেছে। ফণী বলে, পাটিশন কত চেনা লােককে দূরে ঠেলে দিয়েছে, আবার অচেনা লােককে কাছে এনে দিয়েছে। সে বুঝেছে পার্টিশনের পরে বেঁচে থাকার যুদ্ধ কাকে বলে। রায়ট লাগতে পালপাড়া, কামারপাড়ার বামুন পাড়ার সব চলে এল এক কাপড়ে। পাটিশন হল মানে পাকিস্তান জন্ম নিল, হিন্দু-মুসলমান সকলেরই দুঃখ শুরু হল নতুন করে। পার্টিশনে দু দিকেই জমি বাড়ি বিনিময় হচ্ছে। রিফুইজি ক্যাম্পের কথা আছে। মন্বন্তর তেতাল্লিশে, এখন অর্থাৎ দেশভাগে আরও বড়াে মন্বন্তর, আর কারণে-অকারণে হিন্দুদের অপমান করা। রিফুইজিরা পথে, স্টেশনে, যেখানে থাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে যায়, বাংলাদেশেও অত্যাচার হয়। পাটিশনের পর বরিশাল এক্সপ্রেসে আত্মীয়স্বজন এসে পড়ে স্টেশনে, বাড়িতে। চালের দাম বাড়ল হু হু করে। ব্যবসায়ী আগরওয়াল বুঝেছে – ‘পার্টিশনের পর কলকাতা টাল খেয়ে গেছে, বেঙ্গল টাল খেয়ে গেছে। অত রিফুজি এল, অত মানুষ গাঁ ছেড়ে, ঘরবাড়ি ছেড়ে, ব্যবসা খেতি ছেড়ে চলে এল এপারে। আগে এই মুলুকে অনেক উপায় ছিল, এখন রিফুজি এসে যাওয়ায় কাম কাজ নিয়ে টানাটানি পড়ে গেছে। দুর্ভিক্ষ, বস্ত্রাভাব, পার্টিশন, উচ্ছেদ, রায়ট – দশটা বছরে দেশ মানুষ বিপর্যস্ত। পাটিশনের পর মানুষ হয়ে পড়ল বেশি মাত্রায় স্বার্থপর। নতুন নতুন মানুষ রিফুজি হয়েই চলেছে, সফিউদ্দিনের মতাে। দেশভাগ হয়ে প্রেম ভালােবাসা দুটোই চরিত্র বদলাচ্ছে।
ইতিহাসের বইপত্রে আমরা দেখব ঔপন্যাসিক যা বলতে চাইছেন নানা দর্পণে তা সমর্থিত হয়। এলােমেলা কিছু তথ্য তুলে ধরা যাক। ১৯৪৮-এর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় কলেরা মহামারী হল, মার্চে বাড়ল, ১৩২৬ জন মরল কলেরায়, ৪৮৬১ জন স্মল পক্সে। উদ্বাস্তুর ঢল নামল, উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলােতে তৈরি হল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। প্লেগের আক্রমণও ছিল। উদ্বাস্তুদের কলেরা প্রতিরােধে এ শহর প্রস্তুত ছিল না। ১৯৪৮ জুনের মধ্যে, প্রফুল্ল চক্রবর্তীর হিসেব অনুযায়ী ১,১০০,০০ উদ্বাস্তু এল পশ্চিমবঙ্গে। সরকারি হিসেব ১,২০০,০০০ সে বছর, যাদের ৬৬ শতাংশ কলকাতাতেই থেকে গেল বাদবাকিদের ছড়িয়ে দেওয়া হল ১৩টি জেলায়, বড়াে অংশ গেল নদিয়ায়। যারা কলকাতায় থাকল তাদের ৯৫ শতাংশ ভদ্রলােক শ্রেণীর, বাদ বাকি চাষি ও কারুশিল্পী। ভদ্রলােকরা। গেল আত্মীয় বাড়ি, খাবারে টান পড়ল। অন্যরা গেল সরকারি উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। শত শত. মানুষ পড়ে রইল শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। ৭০০০০ উদ্বাস্তু, বেশিরভাগই চাষি, কারুশিল্পী নবদ্বীপে গেল যেখানে যুদ্ধের আগে বাসিন্দা ছিল মাত্র ৩০,০০০। সুতরাং চাপ বাড়ল। চাকরির সুযােগ এল না, সরকারি রিলিফ নামমাত্র। ফলে মে ১৯৪৮-এ অনাহারে মৃত্যুর খবর এল নবদ্বীপ থেকে। উদ্বাস্তুরা ১৯৪৬-এর নােয়াখালি দাঙ্গার পর আসছিল পূর্ববাংলা থেকে। ফলে শরণার্থী আসা বন্ধের কথা উঠল। কিন্তু ব্যাপারটা চলল দিন প্রতি ২০০০ থেকে ৩০০০, আইনি ও বেআইনিপথে। একসময় জানা গেল ধর্মবিদ্বেষ ছাড়াও অর্থসংকট দেশত্যাগের কারণ হল। ১৯৫০, সেপ্টেম্বরে সরকারি হিসেব মতে ৪,০০০, ০০০ উদ্বাস্তু এসেছিল পশ্চিমবঙ্গে, সরকার পুনর্বাসন দিয়েছে ১,১০০,০০০ জনকে, খরচ হয়েছে ৬০,০০০,০০০ টাকা।
("Decolonization in South Asia, Sekhar Bandyapadhayay' pg. 3134) শেখরের এই বিবরণের সংক্ষিপ্তসার উপন্যাসপ্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে মােটের উপর মিলে যায়। তবে আন্দামান, দণ্ডকারণ্য, মরিচঝাপির বিবরণ এ বইতে নেই। আর একজন লেখক বলছেন খুলনা জেলায় (খুলনা সাতক্ষীরা বাগেরহাট) ছিল অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা, যা পরে বদলেছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে দফায় দফায় হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। কিন্তু পশ্চিমবাংলা থেকে মুসলমানরা সেইভাবে পূর্ব পাকিস্তানে যাননি। ১৯৭১-এর মুক্তিসংগ্রামের কালেও ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থী আগমন বন্ধ হয়নি। সাংবাদিক মাস কারেনহাস বলেন – হিন্দুদের এদেশ থেকে তাড়ানাে এবং হত্যা করা ওদের সুপরিকল্পিত। মার্কিন এক পত্রিকা জানায় ৮ মিলিয়নের থেকে বেশি পূর্ব পাকিস্তানি, বেশিরভাগই হিন্দু, তারা ভারতের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে ভিড় করে। বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিন লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন সাচ্চা পাকিস্তানীদের হাতে। শরণার্থী সমস্যাই ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়েছিল এটা অস্বীকার করা যায় না। (দেশভাগ সংখ্যালঘু সংকট বাংলাদেশ’ - কঙ্কর সিংহ, আমরা ঃ এক সচেতন। প্রয়াস’-এর পক্ষে, শুভ্রপ্রতিম রায় চৌধুরী, উল্টোডাঙা, কলকাতা – ৬৭)।
এই শেষােক্ত অংশের কিছু কথা তাে আভাসে উপন্যাসটিতে আছে। হাবলু " গল্প, হিন্দুর গল্প, সফিউদ্দিনের উদ্বাস্তু হয়ে চলে যাওয়া মুসলমানের গল্প। সবশেষে বলব উপন্যাসটির unity এবং coherence এর কথা। সেই কবে পার্সি লাবক তার 'The Craft of Fiction (1921) বইতে বলেছিলেন ঔপন্যাসের narrative method নির্বাচন, তার point of view যেদিকে লক্ষ রেখে তিনি গল্প বলে চলেন, যা চূড়ান্ত ভাবে অভিঘাত সৃষ্টি করে উপন্যাসের ঐক্য, গুরুত্ব, জোড়কলম-এর ওপর। তার অনেক অনেক আগে ঔপন্যাসিক হেনরি ফিল্ডিং বলতে চেয়েছিলেন উপন্যাসের ডিজাইনে যেন কোনাে কিছু বেখাপ্পা ব্যাপার এসে না খায়। দশমী দিবসে’ উপন্যাসটিতে আছে মধুসূদনের জীবন ও কাব্যের পুনর্বিচার একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে, দেশভাগের দেশত্যাগের বিষাদ, কয়েকটি নারী চরিত্রের অতীত ও বর্তমানের। ইতিপূর্বে অনালােচিত প্রসঙ্গের দিকে গুরুত্ব আরােপ, ঔপন্যাসিকের দেশত্যাগ দেশপ্রীতির বেদনা ও বিষাদ। এইসব কটি প্রসঙ্গ সহযােগে ঐক্য ও জোড়বয়ান বড়াে কঠিন কাজ। একজন বাইরের পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে এ উপন্যাসে বেখাপ্পা কোনাে কিছুই থেকে যায়নি, ডিজাইনের বয়নে নির্মিত হয়েছে এক বিস্ময়কর সামঞ্জস্য। লেখক আমাদের জানিয়েছেন। কপােতাক্ষ কুলের বিদায়ঘাট তাকে প্ররােচিত করে এই উপন্যাস লিখনে।তার ঔপন্যাসিক দৃষ্টিতে সমস্ত দেশই হয়ে ওঠে বিদায়ঘাট'। উপন্যাসটিতে এক চারণের মতাে বীরাঙ্গনা বলে বেড়ায় দেশত্যাগের বাধ্যতা ও বেদনাকে। দ্বিতীয়ত, এই বহুমাত্রিকতা প্রায়শই যাত্রা করেছে সময় থেকে সময়ান্তরে। এই স্টাইলের বলগা অমর মিত্র যেভাবে দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে রাখেন যে তা কখনোই বিচ্যুত হয় না।
একটা সূক্ষ্ম কথা বলি। দিদিমা বীরাঙ্গনা অভিরামের বাড়িতে এসেছে, যদিও এ বাড়ির সে কেউ না। তার মেয়ে, ছেলে, আত্মীয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সমগ্র ভারতে। কোথাও তার মন বসে না। অভিরামের বাবা বলত, বীরা মধু কবির কথা শুনাও দেখি। বুড়ি খুশি হয়ে বলে মধুকবির কথা অমৃত সমান/বীরাঙ্গনা দাসী কহে শুনে পূণ্যবান। টিয়ার মন বসে না মেঘনাদ বধ কাব্যে, কিন্তু কানে যখন আসে - বেশ। গল্প পারিবারিক কুশল জিজ্ঞাসা থেকে চলে যায় মেঘনাদ বধ কাব্যে। একটা ধ্রুবপদের মতাে বীরাঙ্গনার মুখে উঠে আসে মধুরচিত কপােতাক্ষ বন্দনা - 'সতত হে নদ তুমি পড় মাের মনে'। মনে পড়ে দেশভাগ দেশত্যাগের কথা যখন বিরলে ভাবনায় চলে আসে 'দুগ্ধ স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে’র কথা। এই শিফটিং নৈপুণ্যে আমাকে বিস্মিত করে। ৭নং অধ্যায়ে ফণীকে কপােতাক্ষ প্রশস্তি শােনাতে শােনাতে গল্প চলে যায় জাহ্নবীর কাছে মধু আসার সংবাদে, নগেন তাদের প্রজা, কিন্তু মধুর আগমনবৃত্তান্ত মধুর বাবা রাজনারায়ণকে বলতে ভয় পায়। অতীত থেকে বর্তমানে, বর্তমান থেকে অতীত গল্প কেবলই চলতে থাকে।
দ্বিতীয়ত, এই চলিষ্ণুতায় বীরাঙ্গনা কখনও খেপা হাবলুর কাছে হয়ে ওঠে মরিয়ম, কখনও টিয়া হয়ে ওঠে মরিয়ম। কপােতাক্ষ তটচ্যুত মধুর গল্প দণ্ডকারণ্য বাঁকুড়া বীরভূম, রানাঘাট, ক্যাম্পে অস্থির উদ্বাস্তুতে চলে যায়। কথার পারম্পর্য ইচ্ছে করে সরিয়ে সরিয়ে দেন কিন্তু আবার সমে ফিরিয়ে আনেন। ১৯ নং অধ্যায়ে অভিরামের আত্মীয়স্বজনের কথা চলতে চলতে বীরাঙ্গনা কপােতাক্ষর চোখে মানুষের চোখের জল দেখেন। ঘুরেফিরে ঘুরে আসে ত্যাগ করে ফেলে আসা দেশের জন্য বাকুলতা। ২১নং অধ্যায়ে কলিম প্রসঙ্গে ফ্রেশ আইটেম আনলেও তা ফিরে আসে কপােতাক্ষে, টালা পার্কে। কবিতাংশ উচ্চারণ সূত্রে লেখক চমৎকার বলেন কপােতাক্ষর মাথায় সব সময় মেঘ, অবশ্য বীরাঙ্গনার জবানিতে। কথার ভার, দুঃখের ভার, মনের ভার মানুষকে বােবা করে দেয়। তখন দরকার কথাগুলাে কাউকে বলা। বলে ফেললে ভার কমে।(পৃ. ১১৫) – এ দুঃখ শুধু বীরাঙ্গনার নয়, লেখকেরও। ‘মাসি শুধু আনতি পেরেছে তার ঠাকুর্দা মধু কবিরে, আর সাগরদাঁড়ি, কপােতাক্ষ’ (পু, ১১৭) – এই মেটাফরিক্যাল এক্সপ্রেশন তাই বেমানান হয় না এ উপন্যাসে। ১২১ পৃষ্ঠায় আমরা দেখব, অন্যত্রও আছে লেখক নানা প্রসঙ্গকে একটা পার্টিকুলার কনটেক্সট-এ বাঁধার বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। পৃ. ১৪২ হাবলু গল্পে গল্পে বীরাঙ্গনাকে ডাকে ময়রম বলে, তখন গল্পে চলে এল ময়রম বৃত্তান্ত – telling নয় showing ভঙ্গিতে। এ উপন্যাসে তাই ময়রম-এর গয়না বেড়াল যখন লেজ তুলে নাচতে থাকে মােহনবাগান ইস্টবেঙ্গল বলে তখন তা বেমানান হয় না। (পৃ. ১৪৩) এক জায়গায় দেখব – টিয়া ধীরে ধীরে ময়রম হয়ে যাচ্ছে, ময়রম প্রতীক্ষা কাতর মানিকরামের জন্য, টিয়া ভাবে হাবলুর কথা। (পৃ. ১৬৪-৬৫) অন্যত্র দেখি কবি মধুসূদন যেন ‘একাই নিরস্ত্র মেঘনাদ একাই সর্বহারা রাবণ’ (পৃ. ২৫১) আসলে বিপন্নতার কনটেক্সট-এ। তাই লেখক যখন লেখেন সারা দেশটায় বীর ইন্দ্রজিতের চিতা জ্বলতে লাগল (পৃ. ২৫২) তা বেমানান লাগে না। বুড়ি বীরাঙ্গনাও একসময় হয়ে যায় মা জাহ্নবী। (পৃ. ২৫৫) মধুবৃত্তান্ত তাই মানকুমারীর পঙক্তি, ম্যাকবেথের পঙক্তি বেমানান হয় না। হাবলু বসে আছে স্বপ্নে দেখা প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সঙ্গে কথা বলছে এ তাে অসম্ভব ফ্যান্টাসি, কিন্তু ফ্যান্টাসিতে ধরা থাকে প্রত্যাশার কল্পনা। | যে ইউনিটি যে কোহেরেন্স-এর কথা বলছিলাম তা বড়াে কঠিন পরীক্ষা। উপন্যাসের মধ্যে একাধিক জায়গায় বীরাঙ্গনা বলেছে কবিতা লেখা বডাে সাহসের ব্যাপার। কবিরা হয় দুঃখী। আর কবিরা হয় সাহসী, সার্থক কবি হয় অকুতােভয়। অকুতােভয় না হলে বড়ো কাব্যরচনা সম্ভব হয় না। ঔপন্যাসিক অমর মিত্র, আমার মতে কঠিন পরীক্ষায় জয়ী। অকুতােভয় তিনি। তাঁর দশমী দিবসে’ নিঃসন্দেহে বড়াে মাপের কাজ।