পঞ্চম অধ্যায়
দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার অপমৃত্যু – দেশি ধান বনাম বিলিতি ওক
The conquest of India was a conquest of knowledge.
— Bernard S. Cohn, Colonialism and Its Forms of Knowledge: The British in India
দেশ জুড়ে যে সময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু হচ্ছে রমরমিয়ে, তখন ঠিক কিসের বিনিময়ে আমরা এই শিক্ষাকে বরণ করে নিয়েছিলাম বা নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেটা দেখে নেওয়া জরুরি। এমন নয় যে দেশে তখন লেখাপড়ার চল ছিল না, কিংবা যেটুকু লেখাপড়া হত তা প্রয়োজনের তুলনায় অল্প ছিল বলেই ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন হয়েছিল। বরং ১৮১৩ সালের নতুন সনদে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার জন্য, কোম্পানির পরিচালকবর্গ তৎকালীন ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সমীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই মোতাবেক ১৮২২-এ মাদ্রাজ ও পরের বছরে বোম্বেতে সমীক্ষার কাজ শুরু হয়।
১৮২৬-এর ১০ মার্চ মাদ্রাজের ছোটলাট টমাস মুনরো (Thomas Munro) বিভিন্ন জেলার কালেক্টরদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানান, তাঁর প্রদেশের জনসংখ্যা ১,২৩,৫০,৯৪১ জন এবং দেশজ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১,৭৫৮টি ও কলেজের সংখ্যা ৭৪০টি। সেখানে শিক্ষাগ্রহণ করে ১,৫৭,৬৬৪ জন ছাত্র ও ৪,০২৩ জন ছাত্রী।১ এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের বাড়িতে শিক্ষাগ্রহণের প্রথা প্রচলিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মাদ্রাজের কালেক্টর জানাচ্ছেন যে তাঁর জেলায় এমন শিক্ষার্থী ২৬,৯৬৩ জন। মালাবারের কালেক্টর জানান, তাঁর জেলায় গৃহশিক্ষকদের কাছে ১,৫৯৪ জন ছাত্র শিক্ষালাভ করছে ধর্মতত্ব (Theology), আইন, জ্যোতির্বিদ্যা, অধিবিদ্যা (Metaphysics), নীতিবিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্র।২ ১৮২৩-এ বোম্বের গভর্নর এলফিনস্টোন (Mountstuart Elphinstone)-এর তত্ত্বাবধানে, দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সমীক্ষা করা হয়। ১৮২৪ থেকে ১৮২৯ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলা কালেক্টররা সমীক্ষা চালিয়ে জেলা জজদের কাছে জমা দেন। রিপোর্ট প্রকাশিত হলে জানা যায়, ১৮২৯ সালে প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ৪৬,৮১,৭৩৫ জন এবং ছাত্রসংখ্যা ৩৫,১৫৩ জন।৩
মাদ্রাজ ও বোম্বেতে দেশজ শিক্ষা নিয়ে সমীক্ষার কাজ শেষ হওয়ার অনেক পরে, বাংলাতে সে ব্যাপারে কাজ শুরু হয়। ওই দুটি প্রদেশে গোটা সমীক্ষার দায়িত্বে সেই প্রদেশের গভর্নর ও বিভিন্ন জেলার কালেক্টররা থাকলেও, বাংলার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে। সরকারি প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৮৩৫-এর ২০ জানুয়ারি, লর্ড বেন্টিঙ্ক বাংলা ও বিহারের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সমীক্ষা চালানোর জন্য উইলিয়াম অ্যাডামকে অনুমতি দেন। ওই বছরের ১ জুলাই, অ্যাডাম তাঁর প্রথম প্রতিবেদনটি তদানীন্তন শিক্ষা সংসদের সভাপতি মেকলেকে সরকারিভাবে জমা দেন। তিনি তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রতিবেদন জমা দেন, যথাক্রমে ১৮৩৫-এর ২৩ ডিসেম্বর ও ১৮৩৮-এর ২৮ এপ্রিল। মেকলে অবশ্য অ্যাডামের প্রতিবেদনগুলিকে ‘the best sketches on the state of education that had been submitted before the public’৪ বলে প্রশংসা করতে ভোলেননি।
পাশ্চাত্য শিক্ষা পুরোমাত্রায় চালু হওয়ার আগে বাংলার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার মতো প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা কেন্দ্রীভূত ছিল না। বরং এখানে চালু ছিল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারা। প্রথম ধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির জন্য সংস্কৃত ও আরবি-ফারসি শিক্ষা। বাংলার রাজা-জমিদাররা পণ্ডিত-মৌলবিদের যে নিষ্কর লাখেরাজ ও বদদ্-ই-মাশ ভূমি দান করতেন, মূলত তার আয়ের ওপর এই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল। উত্তর ভারতে সংস্কৃত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ‘চতুষ্পাঠী’ হিসেবে গণ্য হত এবং সেখানে বেদবিদ্যা অধ্যয়ন আবশ্যিক ছিল। তবে বাংলার টোলগুলিতে, প্রধানত নব্যন্যায়ের পরাক্রমের কারণেই বেদ পাঠের তেমন প্রচলন ছিল না।
সংস্কৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মতোই, বাংলার ফারসি শিক্ষার বিদ্যালয়গুলোও ঠিক মাদ্রাসার পর্যায়ভুক্ত ছিল না। মূলত রাজভাষা ফারসি শেখার গরজেই এগুলি গড়ে উঠেছিল। মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে, সরকারের উচ্চপদগুলি বাংলার ফারসি জানা হিন্দুদের হাতে আসে। ফলে হিন্দুদের মধ্যেও ফারসি শেখার রেওয়াজ ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছেন:
আজিকালি [১৩৩৩ বঙ্গাব্দ] যেমন ইংরেজ সরকারের চাকুরী কিম্বা আদালতে ওকালতি করিয়া জীবিকা উপার্জনের জন্য লোকে ইংরেজী শিখিয়া থাকে সেকালে সেইরূপ যাহাদিগকে সচরাচর ভদ্রলোক বলে তাঁহারা যত্ন করিয়া ফার্সী শিখিতেন। এখন যেমন আইন আদালতের ভাষা হইয়াছে ইংরেজী, নবাবী আমলে সেইরূপ ফার্সী আমাদের দেশের রাজভাষা ছিল। যাঁহাদের রাজসরকারে চাকুরী করিবার লোভ ছিল তাঁহারা ফার্সী শিখিতেন।৫
সমাজের উচ্চশ্রেণির প্রয়োজনের তাগিদে এই বিদ্যালয়গুলি গড়ে ওঠার ফলে, পাঠশালার সঙ্গে এঁদের তেমন একটা সম্পর্ক ছিল না। বলা বাহুল্য, উচ্চ রাজপদ কুক্ষিগত করে রাখার বাসনা থেকেই এই উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির অভিজাতরা, যুগের চাহিদা বুঝে ফারসির বদলে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার সোচ্চার সমর্থক ছিলেন। লর্ড আমহার্স্টকে লেখা রামমোহন রায়ের চিঠি, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
অন্যদিকে দ্বিতীয় ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল, সাধারণ মানুষের অর্থে পরিপুষ্ট ও তাঁদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা, সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষায় লেখা, পড়া আর অঙ্ক শেখার ধারা। প্রথম ধারার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এই দ্বিতীয় ধারাটির কোনও পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল না। এখানে লেখাপড়ার জন্য প্রচলিত ছিল পাঠশালা ও মক্তব। তবে মক্তবগুলির শিক্ষাদান পদ্ধতি অনেক বেশি ধর্মীয় প্রভাবাধীন হলেও, পাঠশালার শিক্ষা ছিল প্রায় ধর্মনিরপেক্ষ। শুধু তাই নয়, পাঠশালার শিক্ষা যে পুরোপুরি ব্যবহারিক শিক্ষা ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। কৃষি, কুটিরশিল্প, কারিগরি আর ব্যবসাই ছিল তখন সাধারণ মানুষের প্রধান জীবিকা। চাকরির খুব একটা সুযোগ তাঁদের জন্য ছিল না। কিছু কৃষিজীবী একই সঙ্গে জমিদারি সেরেস্তায় বা মহাজনের খাতা লেখার কাজও করতেন, কারণ সরকারি কাজকর্মে ফারসি ভাষা চালু থাকলেও বাংলায় জমিদারি সেরেস্তায় রাজস্ব ও খাজনার হিসেব বাংলাতে রাখা হত। পাঠশালা শিক্ষা ছিল এই কৃষিজীবী, কারিগর, দোকানদার, জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারী ইত্যাদি সাধারণ শ্রেণির মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ এক সাধারণ শিক্ষাধারা।
পাঠশালার ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই শিক্ষাব্যবস্থায় জাতি বা ধর্মের কোনও ভেদাভেদ ছিল না। তাই পাঠশালার ছাত্র এবং শিক্ষক যে কোনও জাত বা ধর্মের হতে পারতেন। সেই নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনও রক্ষণশীল মনোভাব ছিল না। এই কথাকে সমর্থন করে মীর মশার্রাফ হোসেন লিখছেন –
চার বৎসর চার মাস চার দিন পর আমার হাতে তাক্তি (হাতেখড়ি) হইয়াছিল। গ্রাম্য শিক্ষক মুন্সী ভিন্ন পাশ করা মৌলবী আমাদের দেশে কেহ ছিল না। ...তবে কোন কোন গ্রামে গুরু মহাশয়ের পাঠশালা ছিল। মক্তাব মাদ্রাসার নামও কেহ জানিত না। ফারসী আরবি কেহ পড়িত না। অভিভাবকেরাও প্রয়োজন মনে করিতেন না। বাঙ্গলাবিদ্যা গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় সীমাবদ্ধ ছিল; ... গ্রামে আরবি ফারসী পড়ার নিয়ম নাই, প্রয়োজনও বেশী নাই। ...আমি নন্দী মহাশয়ের নিকট বাঙ্গালা অক্ষর লেখা শিক্ষা করিতে লাগিলাম। আরবি বর্ণমালা শিক্ষার অগ্রে বাঙ্গালার বর্ণমালা মুখস্থ হইল। তালপাতে অক্ষর লিখিতে শিখিলাম।৬
পাঠশালাগুলিতে সর্বসাধারণের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল, তাতে শেখানো হত দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রাথমিক শিক্ষা যথা – অক্ষর পরিচয়, বানান, নামতা, অঙ্ক, শুভঙ্করী আর্যা ইত্যাদি। এ ছাড়া ছিল জীবিকার জন্য শিক্ষা যেমন – জমি আর শস্যের মাপ, ওজনের হিসেব, দোকানদারির হিসেব, কড়া-গণ্ডা, কাঠা-ছটাক, টাকা-আনা-পাই, পথের মাপ, চিঠি লেখার ধারা প্রভৃতি। এছাড়াও ছিল জমিদারির হিসেব, জমির দলিল, খাজনা দাখিল লেখার কায়দা, গোমস্তার হুকুমনামা, খত ইত্যাদি নানারকমের মুসাবিদা। এমনকি ঘর তৈরি, পুকুর কাটা বা কুয়ো তৈরির মাপজোকও শেখানো হত পাঠশালায়।
শিবনাথ শাস্ত্রী পাঠশালার শিক্ষাপদ্ধতির নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন এই ভাষায় —
পাঠশালে পাঠনার রীতি এই ছিল যে, বালকেরা প্রথমে মাটিতে খড়ি দিয়া বর্ণ পরিচয় করিত; তৎপরে তালপাত্রে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, যুক্তবর্ণ, শটিকা, কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া প্রভৃতি লিখিত; তৎপর তালপাত্র হইতে কদলীপত্রে উন্নীত হইত; তখন তেরিজ, জমাখরচ, শুভঙ্করী, কাঠাকালী, বিঘাকালী প্রভৃতি শিখিত; সর্বশেষে কাগজে উন্নীত হইয়া চিঠিপত্র লিখিতে শিখিত। সে সময়ে শিক্ষা-প্রণালীর উৎকর্ষের মধ্যে এইটুকু স্মরণে আছে যে, পাঠশালে শিক্ষিত বালকগণ মানসাঙ্ক বিষয়ে আশ্চর্য পারদর্শিতা দেখাইত; মুখে মুখে কঠিন কঠিন অঙ্ক কষিয়া দিতে পারিত। চক্ষের নিমিষে বড় বড় হিসাব পরিষ্কার করিয়া ফেলিত। এক্ষণে যেমন ভৃত্যের দশ দিনের বেতন দিতে হইলেও ইংরাজী-শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের কাগজ ও পেন্সিল চাই, ত্রৈরাশিকের অঙ্কপাত করিয়া কাগজ ভরিয়া ফেলিতে হয়, তখন সেরূপ ছিল না।৭
পাঠশালাগুলি বসত সাধারণত কোনও চণ্ডীমণ্ডপ বা কারও বৈঠকখানা কিংবা কখনও খোলা মাঠে। গুরুমশাইরা পড়ুয়াদের দেওয়া বেতন ও সিধের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে সরকারি-বেসরকারি বিবরণ ও নথি থেকে বোঝা যায়, এ শিক্ষা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং বাংলা ও বিহারের অধিকাংশ গ্রামে এ ধরনের পাঠশালা ছিল।
অ্যাডাম তাঁর প্রথম প্রতিবেদনটিতে, মূলত বাংলার দেশজ শিক্ষার প্রকৃতি ও সুযোগসুবিধার বিষয়ে পূর্ববর্তী আমলের পাঁচটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনা করেন। এই পাঁচটি সুত্র ছিল যথাক্রমে – ১) ফ্রান্সিস বুকানন (Dr. Francis Buchanan)-এর প্রতিবেদন, ২) শিক্ষা সংসদ (General Committee of Public Instruction)-এর বিভিন্ন নথি, ৩) হ্যামিলটন (Walter Hamilton)-এর ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটিয়ার (১৮২৮), ৪) মিশনারিদের স্কুল-কলেজের নথিপত্র ও ৫) ফিশার (Fisher)-এর স্মৃতিকথা (১৮৩২)। এই প্রতিবেদনে দেশজ প্রাথমিক শিক্ষার বিদ্যালয়গুলির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অ্যাডাম লেখেন,
যে সব বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয় এবং যেগুলি দেশীয় লোকের সাহায্যে দেশীয় লোকের দ্বারা স্থাপিত অর্থাৎ যেগুলি কোনও ধর্মীয় সংস্থা বা দাতব্য সংস্থার সাহায্যে গড়ে ওঠেনি, সে সব বিদ্যালয়কে দেশজ প্রাথমিক বিদ্যালয় বলা হচ্ছে।৮
দ্বিতীয় প্রতিবেদনটিতে অ্যাডাম নিজে রাজশাহি জেলার নাটোর থানার মোট ৪৮৫টি গ্রামে সমীক্ষা করে যে তথ্য পান, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেন। এই প্রতিবেদনেই তিনি দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করে জানান:
My recollections of the village schools of Scotland do not enable me to pronounce that the instruction given in them has a more direct bearing upon the daily interests of life than that which I find given, or professed to be given, in the humbler village schools of Bengal.৯
সব মিলিয়ে নাটোরে শিক্ষিতের সংখ্যা ছিল ৬,১২১জন। তার ভিত্তিতে অ্যাডাম নাটোরে শিক্ষিতের হার বলেছেন ‘the proportion of the uninstructed to the instructed male adult population of Nattore is as 1000 to 114.6’ বা ১১.৪৬%।১০
অ্যাডামের তৃতীয় প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিবেদনে তিনি মুর্শিদাবাদের ৩৭টি থানার মধ্যে ২০টি থানা এবং বাংলার বীরভূম ও বর্ধমান এবং বিহারের দক্ষিণ বিহার ও ত্রিহুতের সমীক্ষার ফলাফল জানান। প্রতিবেদনটির শেষে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও সুপারিশও পেশ করেন। প্রথমে জেলাগুলির প্রত্যেকটি থানাতে তাঁর যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ‘the sudden appearance of a European in a village often inspired terror’১১ বুঝতে পেরে, সেই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন। অবশেষে প্রতিটি জেলার একটি থানাতে সমীক্ষা চালান অ্যাডাম স্বয়ং এবং বাকি থানাগুলিতে তাঁর নির্দেশ ও তাঁর নির্ধারিত নির্দিষ্ট প্রশ্নমালার ভিত্তিতে, তাঁর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারীরা তথ্য সংগ্রহ করেন। এই দেশজ শিক্ষাব্যস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে চিহ্নিত করে অ্যাডাম বলেছেন –
The Musalman teachers have Hindu as well as Musalman scholars; and the Hindu and Musalman scholars and the different castes of the former assemble in the same school-house, receive the same instructions from the same teacher, and join in the same plays and pastimes.১২
এ ছাড়া মেদিনীপুরের যুগ্ম জেলাশাসক ম্যালেট (O.W. Malet) নিজ উদ্যোগে ১৮৩৬ সালের মার্চ মাসে, সেই জেলার দেশজ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত সমীক্ষা করে অ্যাডামকে জানান।
অ্যাডামের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণগুলিকে ইচ্ছাকৃতভাবে পাশ কাটিয়ে, তাঁর প্রথম প্রতিবেদনে উল্লিখিত বাংলা ও বিহার মিলিয়ে এক লক্ষ দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়টি নিয়ে, ইংরেজি শিক্ষার সমর্থকেরা অকারণ বিতর্ক করে থাকেন। অথচ তাঁর প্রথম প্রতিবেদনটি খুঁটিয়ে পড়লেই স্পষ্ট হবে যে, এ কথা অ্যাডাম তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলেননি, বলেছিলেন সরকারি শিক্ষা সংসদের এক সদস্যের বয়ানের ভিত্তিতে। তিনি প্রতিবেদনে এ বিষয়ে লিখেছেন —
A distinguished member of the General Committee of Public Instruction in a minute on the subject expressed the opinion, that if one rupee per mensem were expanded on each existing village school in the Lower Provinces, the amount would probably fall little short of 12 lakhs of rupees per annum. This supposes that there are 100,000 such schools in Bengal and Behar, and assuming the population of those two Provinces to be 40,000,000, there would be a village school for every 400 persons.১৩
এই পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করে অ্যাডাম জানান:
The estimate of 100,000 such schools in Bengal and Behar is confirmed by a consideration of the number of villages in those two provinces. Their number has been officially estimated at 150,748, of which, not all, but most have each a school. If it be admitted that there is so large a proportion as a third of the villages that have no schools, there will still be 100,000 that have them.১৪
প্রসঙ্গত, এই বিষয়ে অ্যাডামের বহু আগে একই কথা উচ্চারণ করেছিলেন টমাস মুনরো। তিনি বলেছিলেন ‘there is one school to every 1,000 of the population; but as only a very few females are taught in school, we may reckon one school to every 500 of the population’।১৫ এমনকি বোম্বে এডুকেশন কমিটিও ১৮১৯ সালের একটি রিপোর্টে জানায় ‘There is probably as great a proportion of persons in India who can read, write, and keep simple accounts, as are to be found in European countries’। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ‘Schools are frequent among the natives, and abound everywhere’।১৬
অথচ প্রায় সবার নজরের আড়ালে চলে যাওয়া অ্যাডামের তৃতীয় প্রতিবেদনটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে, তদানীন্তন বাংলা ও বিহারে নিম্নশ্রেণির হিন্দু-মুসলমানদের সম্প্রীতি ও সদ্ভাব অনুভব করা সম্ভব। যেমন এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বীরভূমের ১৭টি জেলায় মোট ৪০৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ৮৬ জন ব্রাহ্মণ ও ২৫৬ জন কায়স্থ ছাড়াও অন্য বর্ণের শিক্ষক ছিলেন ৬৫ জন, যা মোট শিক্ষকসংখ্যার প্রায় ১৬%। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ১২ জন সদ্গোপ; ৮ জন বৈষ্ণব; ৫ জন করে গন্ধবণিক ও সুবর্ণবণিক; ৪ জন করে ভট্ট, কৈবর্ত ও ময়রা; ৩ জন গোয়ালা; ২ জন করে বৈদ্য, আগুরি, যুগি, তাঁতি, কলু ও শুঁড়ি এবং একজন করে স্বর্ণকার, রাজপুত, নাপিত, বাড়ুই, ছত্রী, ধোপা, মালো ও চণ্ডাল। বর্ধমানের ৬২৭ জন হিন্দু শিক্ষকের মধ্যে ১০৭ জন ব্রাহ্মণ ও ৩৬৯ জন কায়স্থ ছাড়াও অন্য বর্ণের শিক্ষক ছিলেন, মোট শিক্ষকসংখ্যার ২৪% বা ১৫১ জন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৫০ জন সদ্গোপ; ৩০ জন আগুরি; ১৩ জন বৈষ্ণব; ১০ জন তেলি; ৯ জন ভট্ট; ৬ জন গন্ধবণিক; ৫ জন কৈবর্ত; ৪ জন চণ্ডাল; ৩ জন করে কুমোর ও নাপিত; ২ জন করে সুবর্ণবণিক, গোয়ালা ও বাগদি এবং একজন করে নাগা, তাঁতি, দৈবজ্ঞ, বৈদ্য, যুগি, বাড়ুই, কামার, ময়রা, ধোপা, রাজপুত, কলু ও শুঁড়ি। এ ছাড়াও ছিলেন ৯ জন মুসলমান ও ৩ জন খ্রিস্টান শিক্ষক।
শিক্ষকদের মতো পড়ুয়ারাও ছিল বিভিন্ন ধর্ম বা বর্ণসম্প্রদায়ের। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ছাত্রের সংখ্যা মোট ছাত্রসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি ছিল না। বিহারের দুটি জেলায় এই সংখ্যাটা ছিল আরও কম, ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ। যেমন, বীরভূমে মোট ৬,১২০ জন পড়ুয়ার মধ্যে ১,৮৫৩ জন ব্রাহ্মণ ও ৪৮৭ জন কায়স্থ ছাড়াও অন্যান্য বর্ণের ছাত্র ছিল ৩৭৮০ জন বা প্রায় ৬২%। বর্ধমানের ৬২৯টি পাঠশালার মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল ১৩ হাজারের কিছু বেশি। এদের মধ্যে ৩,৪২৯ জন ব্রাহ্মণ ও ১,৮৪৬ জন কায়স্থ ছাড়া, বাকি সবাই ছিল সমাজের একেবারে নীচের স্তরের বিভিন্ন বর্ণের মানুষ। এ ছাড়াও পাঠশালায় ছিল ৭৬৯ জন মুসলমান ও ১৩ জন খ্রিস্টান ছাত্র। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, দক্ষিণ বিহার ও ত্রিহুতের আরবি-ফারসি বিদ্যালয়গুলির মোট ৭২৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৪ জন হিন্দু ছাড়া, বাকিরা ছিলেন মুসলমান। কিন্তু এই বিদ্যালয়গুলির মোট ৩,৬৬৩ জন পড়ুয়ার মধ্যে ২,০৯৬ জন ছিল হিন্দু।
অ্যাডামের প্রতিবেদনের আরও একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি রীতিমতো সারণি সাজিয়ে দেখিয়েছেন (চিত্র-১ দ্রষ্টব্য), বর্ধমানের ১৩টি মিশনারি স্কুলে পড়ত মাত্র একজন চণ্ডাল ও ৩ জন ডোম, অথচ সেখানকার পাঠশালাগুলিতে তাদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬০ ও ৫৮ জন। প্রথমোক্ত স্কুলে যেখানে ১৬টি নিম্নতম বর্ণের – প্রধানত চণ্ডাল, ডোম, বাগদি, মুচি, হাড়ি প্রভৃতি – ছাত্রসংখ্যা ছিল সাকুল্যে ৮৬, সেখানে পাঠশালাগুলিতে তাদের সংখ্যা ছিল ৬৭৪।১৭ কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও আর্থিক সাহায্য না পেয়েও সাধারণ মানুষ তাঁদের নিজেদের উদ্যমে, কেবল মাতৃভাষায় শিক্ষাচর্চা অব্যাহত রেখে যে ঐতিহ্যগত সম্প্রীতির নিদর্শন হাজির করেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য এবং প্রায় অকল্পনীয়।
https://i.postimg.cc/52PnpRGK/Burdwan-Chandals.jpg
তৎকালীন বাংলার উচ্চশিক্ষার চরিত্র সম্পর্কে অ্যাডাম তাঁর প্রথম প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ১৮১৮ সালে ওয়ার্ড (Mr. Ward) কলকাতায় ২৮টি সংস্কৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বলেন, যেখানে শিক্ষাগ্রহণ করত ১৭৩ জন (গড়ে ৬ জন)। নবদ্বীপে ছিল ৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্র ছিল ৭৪৭ জন (গড়ে ২৪ জন)। ১৮৩০-এ উইলসন (H.H. Wilson) ব্যক্তিগত সমীক্ষার ভিত্তিতে জানিয়েছেন নবদ্বীপের ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা, যেখানে পড়ত প্রায় ৬০০ জন পড়ুয়া।১৮ অ্যাডাম জানিয়েছেন, বাংলায় সংস্কৃত শিক্ষার তিন রকমের প্রতিষ্ঠান ছিল – এক ধরনের প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হত মূলত ব্যাকরণ, কাব্য ও অলঙ্কার এবং মাঝেমধ্যে পৌরাণিক কাব্য ও স্মৃতিশাস্ত্র; দ্বিতীয় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধানত স্মৃতিশাস্ত্র ও কদাচিৎ পৌরাণিক কাব্য এবং তৃতীয় ধরণের প্রতিষ্ঠানে মূল পাঠ্যবিষয় ছিল ন্যায়শাস্ত্র।১৯
তাঁর সমীক্ষা করা জেলাগুলির ভিত্তিতে অ্যাডাম সংস্কৃত শিক্ষা সম্পর্কে যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা সংক্ষেপে এইরকম — এই ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ৩৫৩ টি, সর্বোচ্চ বর্ধমানে ১৯০টি (১,৩৫৮ জন শিক্ষার্থী) এবং সর্বনিম্ন মুর্শিদাবাদে ২৪টি (১৫৩ জন)। ৩৫৫ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ৫ জন বৈদ্যকে বাদ দিলে বাকি সকলেই ছিলেন ব্রাহ্মণ। এখানে ছাত্ররা পড়ত – ব্যাকরণ (১,৪২৪ জন), ন্যায়শাস্ত্র (৩৭৮ জন), স্মৃতিশাস্ত্র (৩৩৬ জন) ও সাহিত্য (১২০ জন)। এছাড়াও তারা পড়ত পুরাণ (৮২ জন), জ্যোতিষশাস্ত্র (৭৮ জন), শব্দবিজ্ঞান বা Lexicology (৪৮ জন), অলঙ্কার (১৯ জন), চিকিৎসাশাস্ত্র (১৮ জন), তন্ত্রশাস্ত্র (১৪ জন) বেদান্ত (১৩ জন), মীমাংসা (২ জন) ও সাংখ্য (১ জন)। শিক্ষার মেয়াদকাল, শিক্ষা শুরু ও সমাপ্তির সময় ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার বিষয় অনুযায়ী ও জেলা অনুযায়ী তারতম্য ছিল। পাঠ্যপুস্তক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পড়তে হত ব্যাকরণে সভাষ্য মুগ্ধবোধ, পতঞ্জলির মহাভাষ্য, সিদ্ধান্তকৌমুদী ইত্যাদি; ন্যায়শাস্ত্রে সিদ্ধান্ত মুক্তাবলী; স্মৃতিতে রঘুনন্দনের বিভিন্ন তত্ত্ব; সাহিত্যে ভট্টিকাব্য, হিতোপদেশ, রঘুবংশ, নৈষধচরিত, শকুন্তলা, কুমারসম্ভব, মাঘ ও ভারবি; শব্দবিজ্ঞানে অমর কোষ; অলঙ্কারে কাব্যপ্রকাশ, কাব্যচন্দ্রিকা, সাহিত্যদর্পণ প্রভৃতি।২০
অন্যদিকে টমাস মুনরোর মিনিট থেকে জানা যায়, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কালেক্টররা মোট ১,০৯৪টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা জানান। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৭৯টি ছিল রাজামুন্দ্রিতে (শিক্ষার্থী ১,৪৫৪ জন); তারপর যথাক্রমে কোয়েম্বাটুর ১৭৩টি (শিক্ষার্থী ৭২৪ জন); গুন্টুর ১৭১টি (শিক্ষার্থী ৯৩৯ জন); তাঞ্জোর ১০৯টি (শিক্ষার্থী ৭৬৯ জন); নেল্লোর ১০৭টি; উত্তর আর্কট ৬৯টি (শিক্ষার্থী ৪১৮ জন); সালেম ৫৩টি (শিক্ষার্থী ৩২৪ জন); চিঙ্গলেপুট ৫১টি (শিক্ষার্থী ৩৯৮ জন); মসুলিপট্টম ৪৯টি (শিক্ষার্থী ১৯৯ জন); বেলারি ২৩টি; ত্রিচিনাপল্লি ৯টি (শিক্ষার্থী ১৩১ জন) এবং মালাবারের একটি প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (শিক্ষার্থী ৭৫ জন)। যে সব জেলায় এই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, সে সব জেলার কালেক্টরদের তথ্য থেকে জানা যায় যে সেখানে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বেদ, আইন (স্মৃতিশাস্ত্র), জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, নীতিবিদ্যা ইত্যাদির শিক্ষা গ্রহণ করছে।২১ এখানে রাজামুন্দ্রিতে পাঠ্যপুস্তক ও মাদ্রাজে প্রযুক্তি শিক্ষার দুটি চিত্র (চিত্র-২ ও ৩ দ্রষ্টব্য) সংযোজিত করা হল।
https://i.postimg.cc/SRCM5DrM/Books-in-Rajamundry.jpg
https://i.postimg.cc/tTVZZ28M/Technical-Education-in-Madras.jpg
ভারতবর্ষের পাশাপাশি উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর করলে দেখা যায়, ১৮০১-এ সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩,৩৬৩টি। ১৮৫১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬,১১৪তে।২২ পড়ুয়ারা কত বছর ওই সব স্কুলে পড়ত, সে বিষয়ে ডবস জানিয়েছেন ‘the average length of school life rises on a favourable estimate from about one year in 1835 to about two years in 1851’।২৩ এমনকি ১৮৩৪ সালেও অধিকাংশ জাতীয় স্কুলেই পাঠক্রম সীমাবদ্ধ ছিল, মূলত ধর্মীয় শিক্ষা এবং লেখা-পড়া-অঙ্ক (The three ‘R’s) শেখার ওপর। অনেক গ্রামীণ স্কুলে অমঙ্গলের আশঙ্কায় লেখা অবধি শেখানো হত না।২৪
অ্যাডামসন ইটনের মতো নামকরা স্কুলের চিত্র জানিয়ে বলেছেন:
In public schools like Eton, teaching consisted of writing and arithmetic (a number of English and Latin books were studied); while those in the fifth form also learnt ancient Geography, or Algebra.
আর যারা সেখানে বেশ কিছুদিন পড়ার সুযোগ পেত, তারা এর বাইরে অতিরিক্ত শিখত ‘part of Euclid’। তবে ‘not till 1851 that Mathematics became a part of the regular school work’।২৫ উনিশ শতকের শুরুতে বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র ছিল এই রকম –
…there were nineteen colleges and five halls in Oxford. There were about 500 fellows in the colleges, a few of whom were engaged in teaching in each college. In addition, there were nineteen professors in 1800. This total had increased to 25 by 1854.
১৮০৫ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে থাকা ছাত্রের সংখ্যা ৭৬০ থেকে ১৮২০-২৪ সালের মধ্যে বেড়ে হয় ১৩০০ জন।২৬
এই পরিস্থিতিতে অ্যাডাম তাঁর তৃতীয় প্রতিবেদনের উপসংহারে, দেশজ ভাষায় দেশজ শিক্ষার প্রচলনের জন্য জোরালো সওয়াল করে বলেন —
I, however, expressed the opinion that, as far as my information then enabled me to judge existing native institutions from the highest to the lowest, of all kinds and classes, were the fittest means to be employed for raising and improving the character of the people — that to employ those institutions for such a purpose would be “the simplest, the safest, the most popular, the most economical, and the most effectual plan for giving that stimulus to the native mind which it needs on the subject of education, and for eliciting the exertions of the natives themselves for their own improvement, without which all other means must he unavailing”.২৭ [নজরটান অ্যাডামের]
কিন্তু হায়! তার তিন বছর আগেই বাংলায় ইংরেজি শিক্ষা পুরোদস্তুর চালু হয়ে যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই অ্যাডামের এহেন সুপরামর্শে কান না দিয়ে, কলকাতার শিক্ষা সংসদ তাকে ‘almost impracticable’ তকমা দিয়ে ব্রাত্য করে রাখে।
শুধু তাই নয়, শিক্ষাক্ষেত্রে ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’-কে নির্লজ্জ সমর্থন করে তারা জানায় –
দেশে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, প্রচুর অভিজ্ঞতা ও বিবেচনাবোধই আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত পুরনো নীতিটিকে মেনে চলতে বাধ্য করেছে। তাই আমাদের প্রথম প্রচেষ্টা হবে, প্রধান প্রধান শহর বা জেলার সদর শহরগুলিতে শিক্ষাবিস্তারের বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। জনসাধারণের উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির শিক্ষার মান উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষাসংক্রান্ত সংস্কার, ক্রমশ নিচের দিকে গ্রামাঞ্চলের দেশজ বিদ্যালয়গুলির কাছে দ্রুত পৌঁছবে।২৮
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষা হয়ে ওঠে মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তের ক্রয়যোগ্য বস্তু। নিজেদের কতিপয় কেরানি-শিক্ষক-অধ্যাপক-উকিল-ডাক্তার-মোক্তার হওয়ার একচেটিয়া কারবারকে আরও একচেটিয়া করার অদম্য বাসনায়, তারা ‘দাস্যসুখে হাস্যমুখ’ হয়ে ব্রিটিশের ‘পাদুকাতলে পড়িয়া লুটি’ এই শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়।
এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চশ্রেণির বিশেষত নব্য ভদ্রলোক শ্রেণির পক্ষে যতটা প্রয়োজনীয় ছিল, নিম্নশ্রেণির পক্ষে ছিল ঠিক ততটাই অপ্রাসঙ্গিক। তাই ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক-মিডল-মাধ্যমিক স্কুল আর কলেজের ক্রমসম্পর্কিত ব্যবস্থা, স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার গোড়া ধরে টান মারে। উচ্চ ও নিম্নশ্রেণির জন্য একই কেন্দ্রীভূত শিক্ষাব্যবস্থায়, স্বভাবতই শিক্ষার আঙিনার বাইরে চলে যায় অগণন দরিদ্র অন্ত্যজ হিন্দু ও নিম্নশ্রেণির মুসলমান শিশু। সরকারি নিয়মের এক ঝটকায়, তারা হয়ে ওঠে ব্রাত্য ও অবাঞ্ছিত। আর সেই শূন্যস্থান ভরাট করতে, চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে থাকে অজস্র অ্যাংলো-বেঙ্গলি স্কুল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে অনাহারে মৃত্যু, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কৃষিজীবীদের জমির মালিকানা হস্তান্তর, কারিগরদের কর্মহীন অবস্থা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস, নিষ্কর ভূমির পরিমাণ ক্রমে কমে যাওয়া প্রভৃতি বিবিধ ঝড়ঝাপটার পরেও বাংলা-বিহার মিলিয়ে অসংখ্য কৃষিজীবী-কারিগর-ছোট ব্যবসায়ী-মালঙ্গীদের অর্থ ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশজ শিক্ষাব্যবস্থা, অবশেষে চরম অসম অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়ে তার স্বাভাবিক জীবনীশক্তি হারাতে থাকে। শুরু হয় দেশজ শিক্ষার ব্যাপক ও বিপুল সংকোচন প্রক্রিয়া।
১৮২৬-এ মাদ্রাজে দেশজ বিদ্যালয় ও কলেজের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১১,৭৫৮টি ও ৭৪০টি। অথচ ১৮৭৯-৮০ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে শিক্ষা সংসদ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় প্রাথমিক, মিডল, মাধ্যমিক, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কলেজ মিলিয়ে মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ১০,৫৫৩টি; তার মধ্যে কেবল প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যাই ১০,১০৬।২৯ আর অ্যাডামের প্রায় ৪৫ বছর পরে, লাহোর সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও পাঞ্জাব শিক্ষা সংসদের অস্থায়ী কার্যকারী সভাপতি লিটনার (Dr G. W. Leitner) পাঞ্জাবের দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সমীক্ষা করে জানান যে, ব্রিটিশের পাঞ্জাব দখলের সময়ে ‘3,30,000 pupils in the schools of the various denominations who were acquainted with reading, writing and some method of computation’ অথচ ১৮৮২-তে এই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ‘little more than 1,90,000’।৩০
দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার এই সঙ্গীণ পরিস্থিতি উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৬ সালে তিনি লেখেন —
আপন ভাষায় ব্যাপকভাবে শিক্ষার গোড়াপত্তন করবার আগ্রহ স্বভাবতই সমাজের মনে কাজ করে, এটা তার সুস্থ চিত্তের লক্ষণ। রামমোহন রায়ের বন্ধু পাদ্রি এডাম সাহেব বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেন তাতে দেখা যায় বাংলা-বিহারে এক লক্ষের উপর পাঠশালা ছিল, দেখা যায় প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই ছিল জনসাধারণকে অন্তত ন্যূনতম শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। এ ছাড়া প্রায় তখনকার ধনী মাত্রেই আপন চণ্ডীমণ্ডপে সামাজিক কর্তব্যের অঙ্গরূপে পাঠশালা রাখতেন, গুরুমশায় বৃত্তি ও বাসা পেতেন তাঁরই কাছ থেকে। আমার প্রথম অক্ষরপরিচয় আমাদেরই বাড়ির দালানে, প্রতিবেশী পোড়োদের সঙ্গে। মনে আছে এই দালানের নিভৃত খ্যাতিহীনতা ছেড়ে আমার সতীর্থ আত্মীয় দুজন যখন অশ্বরথযোগে সরকারি বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার পেলেন তখন মানহানির দুঃসহ দুঃখে অশ্রুপাত করেছি এবং গুরুমশায় আশ্চর্য ভবিষ্যৎদৃষ্টির প্রভাবে বলেছিলেন, ঐখান থেকে ফিরে আসবার ব্যর্থ প্রয়াসে আরো অনেক বেশি অশ্রু আমাকে ফেলতে হবে। তখনকার প্রথম শিক্ষার জন্য শিশুশিক্ষা প্রভৃতি যে-সকল পাঠ্যপুস্তক ছিল, মনে আছে, অবকাশকালেও বার বার তার পাতা উল্টিয়েছি। এখনকার ছেলেদের কাছে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হব, কিন্তু সমস্ত দেশের শিক্ষা-পরিবেষণের স্বাভাবিক ইচ্ছা ঐ অত্যন্ত গরিব-ভাবে-ছাপানো বইগুলির পত্রপুটে রক্ষিত ছিল — এই মহৎ গৌরব এখনকার কোনো শিশুপাঠ্য বইয়ে পাওয়া যাবে না। দেশের খাল-বিল-নদী-নালায় আজ জল শুকিয়ে এল, তেমনি রাজার অনাদরে আধমরা হয়ে এল সর্বসাধারণের নিরক্ষরতা দূর করবার স্বাদেশিক ব্যবস্থা।৩১
কিন্তু তাঁর এই উপলব্ধিতে, উনিশ শতকে বাংলার প্রান্তিক মানুষদের কোনও লাভই হয়নি।
কারণ তার আগেই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সফল করার লক্ষ্য নিয়ে, বাংলার দেশি ধানের মাঠে বিলিতি ওকের চারাগাছ রোপনের জন্য, বিপুল বিক্রমে নেমে পড়বেন বিদ্যাসাগর। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল কিংবা কলেজে দেখা যাবে, কতিপয় উচ্চবর্ণের অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীর দৃপ্ত উদ্ধত স্বার্থপর পদচারণ। নানাবিধ ‘সংস্কার’-এর পরেও তাঁর শিক্ষার অঙ্গন থেকে একই রকমের ব্রাত্য, অবাঞ্ছিত থেকে যাবে দরিদ্র অন্ত্যজ হিন্দু ও নিম্নশ্রেণির মুসলমান ছাত্রছাত্রীরা। জনশিক্ষা বিস্তারের প্রশ্নে, তাঁর মুখে শোনা যাবে অবিকল শাসকের সুর। আর অ্যাডামের শিক্ষাপদ্ধতিকে অনুসরণ করার নির্দেশকে নস্যাৎ করে তাঁর ‘মডেল’ স্কুল স্থাপনের কয়েক বছরের মধ্যে, শাসকরা বুঝতে পারবে তাদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল’। অবশেষে বিস্তর কেঁচে গণ্ডুষের পরে ১৮৮১-৮২ সালে, তত দিন টিকে থাকা প্রায় ৫০ হাজার পাঠশালাকে৩২ পুনরায় শিক্ষা বিভাগের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সে সব কাহিনি শুরু হবে পরবর্তী অধ্যায় থেকে, যেখানে ফিরে ফিরে আসবেন যুগপৎ অ্যাডাম ও রবীন্দ্রনাথ।
************************************************************
উল্লেখপঞ্জী:
১. Education Commission Report by the Madras Provincial Committee 1884; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree: Indigenous Indian Education in the Eighteenth Century, Goa, 2000, p. 352-53। এর পরে কেবল Dharampal, The Beautiful Tree লেখা হবে।
২. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 26
৩. তদেব, পৃ. ৩৭৭
৪. Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, Calcutta, 1941, p. xxiv
৫. বিপিনচন্দ্র পাল, সত্তর বৎসর, কলিকাতা, ১৩৬২, পৃ. ২৭
৬. মীর মশার্রাফ হোসেন, আমার জীবনী, কলিকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৭৮-৮০
৭. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, কলকাতা, ২০১৯, পৃ. ২০
৮. Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, Calcutta, 1941, p. 6। এর পরে কেবল Anathnath Basu (ed.), Adam’s Reports লেখা হবে।
৯. Anathnath Basu (ed.), Adam’s Reports, p. 146
১০. তদেব, পৃ. ২০৮
১১. তদেব, পৃ. ২১৪
১২. তদেব, পৃ. ২৫১
১৩. তদেব, পৃ. ৬
১৪. তদেব, পৃ. ৭
১৫. Minute of Sir Thomas Munro, March 10, 1826; H. Sharp (ed.), Selections from Educational Records, Part I, 1781-1839, Calcutta, 1920 p. 73
১৬. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 375
১৭. Anathnath Basu (ed.), Adam’s Reports, p. 241
১৮. তদেব, পৃ. ১৭
১৯. তদেব, পৃ. ১৮
২০. তদেব, পৃ. ২৫৪-৭২
২১. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 34-35
২২. House of Commons Papers, 1852-53, Vol. 79, p.718; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree, p. 10
২৩. A. E. Dobbs, Education and Social Movements 1700-1850, London, 1919, pp. 157-58; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree, p. 10
২৪. A. E. Dobbs, Education and Social Movements 1700-1850, p.158; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree, p. 10
২৫. J.W. Adamson, A Short History of Education, Cambridge, 1919, p. 226; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree, pp. 10-11
২৬. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 12
২৭. Anathnath Basu (ed.), Adam’s Reports, pp. 349-50
২৮. তদেব, পৃ. ৪৮২-৮৩
২৯. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 71
৩০. তদেব, পৃ. ৫৭
৩১. ‘শিক্ষার সাঙ্গীকরণ’; রবীন্দ্র রচনাবলী, একাদশ খণ্ড, কলকাতা, ১৩৬৮, পৃ. ৭০৫-০৬
৩২. W.W. Hunter, Report of the Education Commission of India, Calcutta, 1884, p. 69; উদ্ধৃত পরমেশ আচার্য, বাংলার দেশজ শিক্ষাধারা, পৃ. ১১২
এলেবেলে আপনি কিন্তু অহেতুক আমাকে ব্যক্তি-আক্রমণ করলেন। অবশ্য আপনার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি। এই পর্বের আলোচনা অংশের গতিপ্রকৃতি ক্রমেই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে আপনি দেবাশিস ও শিবাশিস বাবুকে কাউন্টার করতে পারছেন না। আর পারছেন না বলেই কে কোন নামে কাকে কি বলেছিল, কে কোন নাম নিয়ে লিখছে, কে কার ফেসবুক পোষ্ট থেকে কপি করছে ইত্যাদি “হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল, সাদাকে বলছিলি লাল?" জাতীয় অসার কথাবার্তার উদ্ভব ঘটাচ্ছেন।
আমি বরং ওঁদের বক্তব্যগুলোর একটা সারসংক্ষেপ করবার চেষ্টা করি। হয়তো আপনার সুবিধা হতে পারে।
১) স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে অ্যাডাম সাহেবের একলাখ পাঠশালার অঙ্কটা সম্পূর্ণরূপে গোঁজামিল কারণ ওর সোর্সের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এবং আপনি নিজেই নাকি অতীতে এই একলাখ পাঠশালার গাওনা গেয়েছেন। দেবাশিস বাবু পরিস্কার জানিয়েছেন, আধুনিক শিক্ষার বিরোধীরা মানে আপনারা এ নিয়ে অকারণ মিথ্যে বলেন।
২) দেবাশিস বাবু দাবী করছেন, "অ্যাডাম-এর নিজের প্রতিবেদন অনুযায়ীই, তৎকালীন দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সাক্ষরতার হার ছিল পুরুষদের ক্ষেত্রে ছয় শতাংশ, মহিলাদের ক্ষেত্রে শূন্য শতাংশ, এবং ফলত, সব মিলিয়ে তিন শতাংশ"। আপনি প্রতিবাদ করতে পারেন নি।
৩) শিবাশিস বাবুর দাবী, বাংলার তিনটে বড় জেলার পাঠশালাগুলিতে নিচু জাত ও মুসলমান ছাত্রের শতাংশ হার মাত্র দুই শতাংশ ও পাঁচ শতাংশ। শিক্ষকদের অবস্থা আরও করুণ - যথাক্রমে তিন শতাংশ ও এক শতাংশ। ওনার তথ্য ঠিক হলে আপনার যুক্তি ভিত্তিহীন হয়ে যাচ্ছে।
৪) শিবাশিস বাবু বলেছেন, পাঠাশালাগুলির সিলেবাস আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিবিহীন ছিল, "এককথায় বদ্ধ জলা বিশেষ"। দেবাশিসবাবুও একই প্রসঙ্গে লিখেছেন, আধুনিক বিজ্ঞান গণিত প্রযুক্তিবিদ্যা চিকিৎসা ইত্যাদি শিক্ষার প্রশ্নই উঠত না, কারণ দেশীয় সমাজে সে জ্ঞানের অস্তিত্বই ছিল না, এ ব্যাপারে ভদ্রলোক-ছোটলোক-ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলেই সমান অজ্ঞ ছিল। রমেশ মজুমদার ও প্রফুল্লচন্দ্রের বক্তব্যও মোটামুটিভাবে একইরকম। আপনি এই বক্তব্যের কাউন্টার করতে পারেন নি।
৫) শিবাশিসবাবু ওই দেশজ পাঠশালাগুলির ভয়াবহ শাসনপদ্ধতি তুলে ধরেছেন। পক্ষান্তরে আমরা জানি, কি সংস্কৃত কলেজ, কি মেট্রোপলিটান স্কুল, কি মডেল স্কুল - সবজায়গাতেই বিদ্যাসাগর মহাশয় ছাত্রদের দৈহিক শাস্তি নিষিদ্ধ করেছিলেন। আপনি এ বিষয়েও চুপ।
আপাতত এইটুকুই।
ইন্দ্রনীল মিত্র, আপনার যদি মনে হয় যে আমি আপনাকে ব্যক্তি আক্রমণ করেছি, তো সরাসরি আপনার কাছে দুঃখপ্রকাশ করলাম। কিন্তু আপনি বাকিদের ব্যক্তি আক্রমণ নিয়ে নীরব কেন? সব প্রশ্নগুলো দেবাশিস্-শিবাশীষ জুটির কেন? পাল্টা আমি যে প্রশ্নগুলো রেখেছি যেগুলো এড়িয়ে গেছেন তাঁরা, সেগুলোকে সাম আপ করে তাঁদের কাছে রাখছেন না কেন? আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেব। তার আগে আমি আমার প্রশ্নগুলো সাম আপ করে দিই, যেগুলোর উত্তর আপনার দে-শি জুটি দেবেন। কেমন?
১) বাংলা ব্যাকরণ লেখার মুরোদ হ্যালহেডের ছিল কি না? যদি থাকে, তাহলে সেটা সংস্কৃতগন্ধী হল কেন? কেন সেই ব্যাকরণ থেকে বেছে বেছে আরবি-ফারসি-হিন্দুস্তানি শব্দ বাদ গেল? ভাষার এই sansrikitization এবং otherization তারা করেছিল কেন? তাদের এই প্রকল্প কারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিল? সংস্কৃতগন্ধী বাংলা ব্যাকরণ যে হয় না, সে কথা খোদ সুকুমার সেন বলেছেন। ভদ্রলোক কম্পারেটিভ ফিলোলজিতে এম এ, মাথায় রাখবেন।
২) সংস্কৃততে বিশুদ্ধ মূর্খ জোন্স ১৭৮৬-তে কেন হঠাৎ সংস্কৃতর সঙ্গে ল্যাটিন-গ্রিকের মিল পেল? তখন তাঁর সংস্কৃত শিক্ষার বয়স কত দিন (বছর দূরের কথা)? তারপরে ওই মূর্খতা নিয়ে সে মনুসংহিতা অনুবাদ করে কীভাবে? তার বিষময় ফল সম্পর্কে দে-শি জুটি আদৌ কিছু জানে-টানে? সেখানে ডায়াক্রনিক লিঙ্গুইস্টিক্স-এর প্রসঙ্গ আসছে কেন বারবার জোন্সের অপকর্মকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য?
৩) নাটোরের শিক্ষিতের হার ছিল ১৮৩৫-এ ১১.৪৬%। ঠিক না ভুল? যদি ঠিক হয়, তাহলে সেই নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই কেন?
৪) টমাস মুনরো বলেছেন ৫০০ জন পিছু একটা স্কুল। বোম্বে এডুকেশন কমিটি বলেছে 'Schools are frequent among the natives, and abound everywhere'। আলোচনা হচ্ছে না কেন? অ্যাডামের হিসেবে যদি অতই গোঁজামিল তাহলে ১৮৮২তে ৫০ হাজার পাঠশালার অস্তিত্ব কোথা থেকে আসছে? সেটা চ্যালেঞ্জড হয়েছে?
সর্বোপরি আমি আবারও বলছি, অ্যাডাম ফুরিয়ে যাননি। তিনি পুনরায় অষ্টম অধ্যায়ে আসবেন। তখন দেখতে পাবেন অ্যাডাম ঠিক ছিলেন না ভুল। এবং তার পরের অধ্যায়গুলোতেও আসবেন। আর রবীন্দ্রনাথ তো আসবেনই। ইন ফ্যাক্ট এই অধ্যায়ের শিরোনামটি তাঁরই একটি প্রবন্ধ থেকে নেওয়া, যেখানে তিনি লিখেছেন --- এ দেশে ধান জন্মে আর বিলাতে জন্মায় ওক। এখানকার দেশী ভাষা বাংলা, ইংরেজি নহে। যদি কর্ষণ করিয়া সম্যক্ ফললাভ করিবার ইচ্ছা হয় তবে বাংলায় করিতে হইবে, নতুবা ঠিক কালচার হইবে না।
ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রই যদি না থাকবে, তো বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃতের গন্ধ কেন থাকবে, আর সংস্কৃতের সঙ্গেই বা গ্রিক-ল্যাটিনের মিল পাওয়া যাবে কেন ? সত্যি, প্রশ্ন বটে ! ও বাড়ির গজেন নস্কর যদি ওঝা ডেকে তুকতাকই না করবে, তো মহাষ্টমীর সক্কালবেলায় এ বাড়ির রমেন চক্কোত্তির পশ্চাতে খামোখা টসটসে ফোঁড়া গজাবে কেন ? বুদ্ধিশুদ্ধির বিকাশ যদি প্রাগৌপনিবেশিক পাঠশালার হতভাগ্য শিশুর স্তরে আটকে থাকে, তাহলে এইসব প্রশ্নকে জগতের সবচেয়ে দরকারি প্রশ্ন বলে মনে হবারই কথা ।
'শিক্ষিতের হার' বস্তুটি কী, সেটা জানতে গেলেও কিছু ন্যূনতম শিক্ষা থাকতে হয়, এলেবেলে লেখকদের যা থাকে না । '১১.৫' শতাংশ শিক্ষা-হারকে কেন খুব উৎসাহজনক মনে হল, আর সব ছেড়ে দিয়ে 'নাটোর' জায়গাটিকেই বা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হল, সেটা বুঝিনি (একাধিক স্থানে ওর চেয়ে বেশি ছিল) । বনলতা সেনের টান কিনা, সেটা গবেষণা-সাপেক্ষ । যাইহোক, লেখক নাটোরের যে সংখ্যাটিকে 'শিক্ষিতের হার' বলছেন, সেটা যদি অ্যাডামের প্রতিবেদন থেকেই পেয়ে থাকেন, তো ওটা হচ্ছে আসলে ওই এলাকায় ওই সময়ে স্কুলে ভর্তি হবার যোগ্য বয়সে উপনীত পুরুষ-শিশুদের মধ্যে যে অংশটি সত্যি সত্যি পাঠশালাতে ভর্তি হতে পেরেছিল, তার শতাংশ হিসেব । পুরুষ-নারী মিলিয়ে সব শিশু ধরলে ওটা হয়ে যাবে প্রায় তার অর্ধেক, ৬.৫ !
এর সঙ্গে 'শিক্ষিতের হার' বস্তুটির কী তফাৎ, সে ধারণা এলেবেলে পণ্ডিত রাখেন না । আর, মোট শিক্ষা-হার যদি খুব কম হয়, এবং তার মধ্যে কোনও একটি বিশেষ জায়গায় যদি কোনও কারণে হার উচ্চ হয়, তো তার জন্য সংখ্যাতত্ত্বের নিয়মে বাকিগুলোর দশা যে আরও শোচনীয় হতে হবে, সে বোধও তাঁর থাকার কথা না ।
১৮৮২-তে আশি হাজার পাঠশালার তথ্য যাচাই করার সুযোগ আমি এখনও পাইনি, কাজেই ওটাকে আপাতত সত্যি বলেই ধরে নিচ্ছি । তবে, তাতে করে অ্যাডামের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত এক লক্ষ পাঠশালা/টোল ইত্যাদির গল্প মোটেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, কারণ ছটি জেলার সাতটি অঞ্চলে করা তাঁর সত্যিকারের সমীক্ষাগুলোর ফলাফল থেকে তেমন ইঙ্গিত আদৌ পাওয়া যায় না, যেমনটি ফিলিপ হার্টগ হিসেব করে দেখিয়েছিলেন । এর সহজ সরল অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, উনিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে ওই শতকের আশির দশক পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ দশকের ব্রিটিশ আমলে গ্রামীণ পাঠশালার সংখ্যা আদৌ কমেনি, বরং বেড়েছে । মানে, ব্রিটিশ কর্তৃক গ্রামীণ দেশীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা ধ্বংসের কাহিনীটি হচ্ছে গণ্ডমূর্খদের উত্তপ্ত কল্পনার ফসল মাত্র ।
তার বিরুদ্ধে লেখক অবশ্য দুটি সারণির ছবি দিয়েছেন, যদিও তার সঙ্গে কোনও তথ্যসূত্র বা 'আর্গুমেন্ট' (ব্যাখ্যামূলক যুক্তি) এসব কিছুই দেন নি । সারণি দুটির তাৎপর্য তিনি নিজে বোঝেন কিনা, আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারিনি । যাইহোক, এ ব্যাপারে পরে আরেকটু বলব, কিন্তু তার আগে 'তুহিন মালাকার টুকলিফিকেশন' কেসটা নিয়ে বকেয়া কতাবাত্রাগুলো হয়ে যাক ।
আর তারও আগে, অ্যাডামের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় ফলাফল গুছিয়ে তৈরি করা তিনটি সুসংহত সারণির ছবি এখানে সেঁটে যাক । আমি যেহেতু এলেবেলে পণ্ডিত নই, কাজেই ছবির সাথে নির্দিষ্ট তথ্যসূত্র থাকবে ।
ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রই যদি না থাকবে, তো বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃতের গন্ধ কেন থাকবে, আর সংস্কৃতের সঙ্গেই বা গ্রিক-ল্যাটিনের মিল পাওয়া যাবে কেন ? সত্যি, প্রশ্ন বটে ! ও বাড়ির গজেন নস্কর যদি ওঝা ডেকে তুকতাকই না করবে, তো মহাষ্টমীর সক্কালবেলায় এ বাড়ির রমেন চক্কোত্তির পশ্চাতে খামোখা টসটসে ফোঁড়া গজাবে কেন ? বুদ্ধিশুদ্ধির বিকাশ যদি প্রাগৌপনিবেশিক পাঠশালার হতভাগ্য শিশুর স্তরে আটকে থাকে, তাহলে এইসব প্রশ্নকে জগতের সবচেয়ে দরকারি প্রশ্ন বলে মনে হবারই কথা ।
'শিক্ষিতের হার' বস্তুটি কী, সেটা জানতে গেলেও কিছু ন্যূনতম শিক্ষা থাকতে হয়, এলেবেলে লেখকদের যা থাকে না । '১১.৫' শতাংশ শিক্ষা-হারকে কেন খুব উৎসাহজনক মনে হল, আর সব ছেড়ে দিয়ে 'নাটোর' জায়গাটিকেই বা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হল, সেটা বুঝিনি (একাধিক স্থানে ওর চেয়ে বেশি ছিল) । বনলতা সেনের টান কিনা, সেটা গবেষণা-সাপেক্ষ । যাইহোক, লেখক নাটোরের যে সংখ্যাটিকে 'শিক্ষিতের হার' বলছেন, সেটা যদি অ্যাডামের প্রতিবেদন থেকেই পেয়ে থাকেন, তো ওটা হচ্ছে আসলে ওই এলাকায় ওই সময়ে স্কুলে ভর্তি হবার যোগ্য বয়সে উপনীত পুরুষ-শিশুদের মধ্যে যে অংশটি সত্যি সত্যি পাঠশালাতে ভর্তি হতে পেরেছিল, তার শতাংশ হিসেব । পুরুষ-নারী মিলিয়ে সব শিশু ধরলে ওটা হয়ে যাবে প্রায় তার অর্ধেক, ৬.৫ !
এর সঙ্গে 'শিক্ষিতের হার' বস্তুটির কী তফাৎ, সে ধারণা এলেবেলে পণ্ডিত রাখেন না । আর, মোট শিক্ষা-হার যদি খুব কম হয়, এবং তার মধ্যে কোনও একটি বিশেষ জায়গায় যদি কোনও কারণে হার উচ্চ হয়, তো তার জন্য সংখ্যাতত্ত্বের নিয়মে বাকিগুলোর দশা যে আরও শোচনীয় হতে হবে, সে বোধও তাঁর থাকার কথা না ।
১৮৮২-তে আশি হাজার পাঠশালার তথ্য যাচাই করার সুযোগ আমি এখনও পাইনি, কাজেই ওটাকে আপাতত সত্যি বলেই ধরে নিচ্ছি । তবে, তাতে করে অ্যাডামের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত এক লক্ষ পাঠশালা/টোল ইত্যাদির গল্প মোটেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, কারণ ছটি জেলার সাতটি অঞ্চলে করা তাঁর সত্যিকারের সমীক্ষাগুলোর ফলাফল থেকে তেমন ইঙ্গিত আদৌ পাওয়া যায় না, যেমনটি ফিলিপ হার্টগ হিসেব করে দেখিয়েছিলেন । এর সহজ সরল অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, উনিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে ওই শতকের আশির দশক পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ দশকের ব্রিটিশ আমলে গ্রামীণ পাঠশালার সংখ্যা আদৌ কমেনি, বরং বেড়েছে । মানে, ব্রিটিশ কর্তৃক গ্রামীণ দেশীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা ধ্বংসের কাহিনীটি হচ্ছে গণ্ডমূর্খদের উত্তপ্ত কল্পনার ফসল মাত্র ।
তার বিরুদ্ধে লেখক অবশ্য দুটি সারণির ছবি দিয়েছেন, যদিও তার সঙ্গে কোনও তথ্যসূত্র বা 'আর্গুমেন্ট' (ব্যাখ্যামূলক যুক্তি) এসব কিছুই দেন নি । সারণি দুটির তাৎপর্য তিনি নিজে বোঝেন কিনা, আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারিনি । যাইহোক, এ ব্যাপারে পরে আরেকটু বলব, কিন্তু তার আগে 'তুহিন মালাকার টুকলিফিকেশন' কেসটা নিয়ে বকেয়া কতাবাত্রাগুলো হয়ে যাক ।
আর তারও আগে, অ্যাডামের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় ফলাফল গুছিয়ে তৈরি করা তিনটি সুসংহত সারণির ছবি এখানে সেঁটে যাক । আমি যেহেতু এলেবেলে পণ্ডিত নই, কাজেই ছবির সাথে নির্দিষ্ট তথ্যসূত্র থাকবে ।
দুঃখিত, একই পোস্ট দুবার হয়ে গেল, সম্ভবত আমার মাউস-এর গণ্ডগোলে । যাইহোক, সারণির ছবিগুলো দিচ্ছি এক এক করে ।
এলেবেলে আমাকে উদ্দেশ্য করে আপনার প্রশ্নটা, কিছু মনে করবেন না ওই নাগপুরিয়া গোছের হয়ে গেল। ২০২০তে সংখ্যালঘু হত্যার প্রতিবাদ করলে ওরা যেমন বলে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে কেন প্রতিবাদ করিনি, এই গোছের। আপনার পোষ্টে আপনি আমার উদ্দেশ্যে কেন কুকথা বলছেন এই অভিযোগ করেছিলাম। রামশ্যাম আপনাকে কি বলছে তা দেখার দায়িত্ব আমার নয়।
যাক গে, আপনি দুজনের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন সাজিয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই সে উত্তর দেবেন, একজন দেখলাম দেয়া শুরুও করেছেন। কিন্তু আপনার সুদীর্ঘ উত্তরে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব পেলাম না। আশা রাখি পরবর্তী কোনো মন্তব্যে তা পাব।
আপাতত এইটুকুই।
আশির দশক আর তিরিশের দশক লিখলেন? লিখতে পারলেন আপনি? শিক্ষিত হয়ে? ব্যস, হয়ে গেল আপনার।
এন এল বসাক মানে নৃত্যলাল বসাক? কলকাতা ইউনিভার্সিটির ১৯৬৫-র ডি. ফিল.?
তুহিন মালাকারের যে বইটি নিয়ে কথা হচ্ছিল তার নাম হচ্ছে --- "সমকালীন শ্রেণীসংগ্রামের বাস্তবতায় ঈশ্বরচন্দ্র এবং বাংলার বুদ্ধিজীবী" । প্রকাশক - "নয়াগণতন্ত্র", প্রকাশকাল - ১৯৯৫ । ১৬৭ পৃষ্ঠা এবং বেঁটেখাটো আকারওয়ালা ছোট্ট ঝাঁঝাল রাজনৈতিক বই ।
পরিষ্কার করে বলে রাখি, বইটির থেকে কিছু কথা ও ধারণা লেখক গ্রহণ করেছেন --- শুধুমাত্র এইজন্যেই যে একে আমি টুকলি বলছি, এমন নয় মোটেই । আমি এ অভিযোগ করছি এই কারণেই যে, বহু বড় বড় মহাপণ্ডিতের নাম করলেও, লেখক তুহিন মালাকারের নাম একবারও করেননি । অথচ, বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্মের যে ব্যাখ্যা তিনি এখানে দিতে চাইছেন, তা আছে একমাত্র ওই বইটিতেই, অন্য কোনও বিদ্যাসাগর-গবেষকই এমন কথা বলেননি ।
লেখক মহাশয় ঘোষণা করেছেন, বইটি 'তুচ্ছ' । কাজেই, বইটির অস্তিত্ব ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি যে ওয়াকিবহাল, এ নিয়ে সন্দেহ করার উপায় নেই ।
বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব না, এবং তার দরকারও নেই । শুরুর 'প্রস্তাবনা' অংশের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা অনুযায়ী, বইটি প্রকাশের সময় নাগাদ তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে যে 'সাক্ষরতা' অভিযান চলছিল, তার বিরোধিতার জন্যই বইটি লেখা হয়েছে । সাক্ষরতা এক ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্র, এবং বিদ্যাসাগরই সাক্ষরতার মূলে, অতএব এই ভদ্রলোকের মুখোশ উন্মোচন করলে সমস্যার মূলে যাওয়া যাবে, এই ছিল তাঁর বক্তব্য ।
বইটিতে প্রস্তাবনা বাদ দিয়ে মোট নটি অধ্যায় থাকলেও, সেগুলোকে তিনটি মোটা বিভাজনে ফেলা যায় । এক, রবীন্দ্রনাথ ও রামেন্দ্রসুন্দর থেকে শুরু করে ইন্দ্রমিত্র-স্বপন বসু-বদরুদ্দিন উমর-বিনয় ঘোষ পর্যন্ত সমস্ত বিদ্যাসাগর-গবেষকরাই এক সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসেবে যে বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্মকে কার্যকারণহীন অলৌকিকতায় মণ্ডিত করতে চেয়েছেন, সেইটা দেখানো (অধ্যায় - ২) । দুই, অলৌকিকতার জাল ছিন্ন করে বিদ্যাসাগরের জীবন-চিন্তা-কর্মের পেছনের 'প্রকৃত' সামাজিক-ঐতিহাসিক-অর্থনৈতিক কার্যকারণকে উন্মোচিত করা (অধ্যায় - ৩) । এবং তিন, বিদ্যাসাগরের কর্মকাণ্ডের নানা দিক (বিধবাবিবাহ-শিক্ষা-মানবতা-শাস্ত্রবিচার ইত্যাদি) সংক্রান্ত তথ্যকে বিশ্লেষণ করে তিন নম্বর অধ্যায়ে বিবৃত তত্ত্বের সঙ্গে 'ফিট' করানো, যাতে তত্ত্বটি তথ্যদ্বারা 'প্রতিষ্ঠিত' হয় ।
বোঝা যাচ্ছে, তিন নম্বর অধ্যায়টিই তত্ত্বগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । এখানে তাঁর বক্তব্য, উনিশ শতকের গোড়ায় ব্রিটেনে বণিকপুঁজিকে ছাপিয়ে শিল্পপুঁজি শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে, এবং এখান থেকে পণ্য নিয়ে ওখানে বিক্রি করার বদলে ওখানের কলে তৈরি পণ্য এখানে বেচবার দিকে তাদের ঝোঁক বাড়তে থাকে, এবং সেই কারণে বিলিতি পণ্য-রুচি-মূল্যবোধের প্রতি ভারতীয়দের মানসিক অনভ্যস্ততা-কুণ্ঠা-জড়ত্ব কাটাবার ও আনুগত্য বাড়াবার জন্যেই নাকি ইউরোপীয় শিক্ষার আমদানি, এবং সেই ব্যবস্থা এখানে চালু করার জন্যই বিদ্যাসাগরের মত লোককে তারা বানিয়ে নিয়েছিল । লেখকের মতে, ১৮১৩ সালের পর থেকেই নাকি এ সব ঘটতে থাকে, যখন দেশীয় বাণিজ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একাধিপত্যকে আইনের সাহায্যে খর্ব করা হয় ।
ব্রিটেনে শিল্পপুঁজি আর বণিকপুঁজির অনুপাত দিয়ে কলকেতায় এক ঐতিহাসিক ব্যক্তির আবির্ভাব নির্ধারণ করতে পারার দাবি করার মত তত্ত্বরচনা যে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের নিরিখে কতখানি অত্যাশ্চর্যরকমের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প, সে কাণ্ডজ্ঞান লেখকের ছিল না, তিনি 'বুর্জোয়া', 'সামন্তবাদ', 'সাম্রাজ্যবাদ' ইত্যাদি কয়েকটি শব্দচুষিকাঠি মুখে পুরে আপনমনে চুষতে পারলেই খুশি । ব্রিটেনে উভয় ধরনের পুঁজির আপেক্ষিক শক্তি কখন কেমন দাঁড়াচ্ছে এবং তার সাপেক্ষে এ দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতিই বা কখন কেমন দাঁড়াচ্ছে, লেখক এর চিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ কোনও সময়-ভিত্তিক সারণি হাজির করেন নি । সেটা করাটা যে জরুরি, সে বোধেরও একান্ত অভাব ছিল তাঁর । এবং, স্বভাবতই, সময় এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় শিক্ষার বিষয়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের তৎপরতা বাড়লেও, ১৮১৩ সালকে ঘিরে আদৌ বিরাট কিছু নাটকীয় পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় না । বিদ্যাসাগরের জন্মই তার সাত বছর পরে, এবং শিক্ষা বিষয়ে তাঁর সক্রিয়তার শুরু মোটামুটি ১৮৫০ সাল নাগাদ । ফলত, সময়ের নিরিখে কোনও অনিবার্য অর্থপূর্ণ সম্পর্ক খুঁজে বার করা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে ।
এখন, আমাদের এলেবেলে লেখক মহাশয়ের লেখার একেবারে গোড়াতেই 'ভূমিকা' অংশের সঙ্গে তুহিন মালাকারের দ্বিতীয় অধ্যায়টি মেলালেই দুটোর সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে আমার ধারণা । আর, তিন নম্বর অধ্যায়ের তত্ত্বকাঠামোতেই যদিও গোটা লেখাটি চলছে, তবু সে আলোচনা এখনও সবিস্তারে আসেনি, শিগগিরই আসবে বলে আমার ধারণা । ইতিমধ্যে, থ্রেডের একটি মন্তব্যে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে । চতুর্থ পর্বের থ্রেডে তিনি বলেছেন,
"ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেই দেখুন। ১৮১৩-র সনদে মিশনারিদের ওপরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হল। মানে ততদিনে হ্যালহেড-জোন্স-উইলকিন্স-কোলব্রুকদের দিয়ে যা করিয়ে নেওয়া দরকার, সব সাঙ্গ হয়ে গেছে। তাঁরা এবারে ফালতু বিবেচিত হলেন। উঠে আসল মিশনারিরা। তারা পাশ্চাত্য শিক্ষার শিঙে ফুঁকতে শুরু করল। সঙ্গে রইল ধামাধারী দেওয়ান-বেনিয়ানরা।
১৮৩৩-এর সনদে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য রসাতলে গেল। এখন নিজেদের মাল বাজারজাত করার তাগিদ। এতদিনে যা লুঠ করার লুটে নেওয়া গেছে। এবারে বানিজ্য থেকে লুঠে নেওয়ার পালা। কারণ শিল্প পুঁজির যুগ এসে গেছে। টুক করে চালু করে দেওয়া গেল ইংরেজি সাহিত্য। যেটা কি না তখনও অবধি খোদ অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজে আলাদা বিষয় হিসেবে পড়ানো হয় না। এদিকে মধুসূদন মিলটনে মজছেন!"
ন্যাল্যাখ্যাপা, আপনার যাবতীয় ন্যাল্যাখ্যাপামি শেষ হলে একবার ঘোষণা করে দেবেন যে আপাতত এই পর্বের জন্য আপনার যা যা বলার, তা হয়ে গেছে। চৌকির তলায় সযত্নে রেখে দেওয়া History of Vernacular Education in Bengal (1800-1854): A Review of the Early Trends and Experiments, by N.L.Basak বইটা যে বেরোবে, এটা মানে জানতামই। এই নিয়ে তো টেবিল তিনটে কমবার দেখলাম না! এই শিয়ালছানা তিনটে বাদে স্টকে আরও কিছু থাকলে সেগুলোও বার করতে থাকুন। তারপরে একেবারে উত্তর দেব।
জমজমাট হচ্ছে। মন্তব্য বিভাগ অতি আগ্রহোদ্দীপক, লেখাগুলোও সব পড়ে ফেললাম। চলুক।
ন্যাল্যাখ্যাপা, অনেক দিন ধরেই মানে লেখাটির প্রায় প্রথম থেকেই আপনি অকারণে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছেন। আমি আপনার মতো পাল্টা ব্যক্তি আক্রমণে যাব না, কোনও ছ্যাবলামির আশ্রয় নেব না এবং ফারদার উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করব না। প্রচুর ফুটেজ পেয়েছেন, আর নয়। স্রেফ উত্তরটুকু দেব এবং পরিশষে যা বলার বলব।
১) আপনার বক্তব্য থেকে পরিষ্কার আপনি এন এল বসাক পড়েননি। এই না পড়াকে প্রাণপণে ঢাকছেন ভাষাগত কিছু ওপরচালাকি আর নিপাট ব্যক্তি আক্রমণের মাধ্যমে। আপনি নিজে বলেছেন বটে ‘লেখক অবশ্য দুটি সারণির ছবি দিয়েছেন, যদিও তার সঙ্গে কোনও তথ্যসূত্র বা ‘আর্গুমেন্ট’ (ব্যাখ্যামূলক যুক্তি) এসব কিছুই দেন নি’, যদিও যে তিনটে ছবি এখানে সেঁটেছেন তার কোনও ব্যাখ্যামূলক যুক্তি আপনি নিজেও দেননি। দ্বিতীয়ত এন এল বসাকের লেখাটি একটি গবেষণাপত্র, যার রেজিস্ট্রেশন হয় ৫৬ সালে এবং প্রায় তার দশ বছর পরে ১৯৬৫-তে সেটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা পড়ে। এই গবেষণাপত্রটির আদ্যোপান্ত আমার পড়া এবং সেখানে টেবিল তিন ছাড়া বাকি টেবিল দুটোর অস্তিত্ব নেই। হ্যাঁ, নেই। ওটি বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার পরে সংযোজিত হয়েছে। যাই হোক, গবেষণাপত্রটির ৭৬ পৃষ্ঠায় পরিষ্কার লেখা আছে – If this interpretation be accepted, then there would be little justification for the adverse criticism of Hartog against Adam’s statement that Bengal had 1 lakh of schools in his time। ইন্টারপ্রিটেশন লেখক নিজেই দিয়েছেন এবং হার্টগের আপত্তিকে সোজা নস্যাৎ করে দিয়েছেন।
২) আমি টেকনিক্যালি খুব পোক্ত নই। তাই ছবির সঙ্গে তার পরিচিতি সেঁটে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য তার প্রয়োজনও দেখি না। আমি ছবিটি দিয়েছিলাম বিখ্যাত বই Syed Nururllah ও J. P. Naik লিখিত History of Education in India: During the British Period থেকে। প্রসঙ্গত বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৩-এ এবং তার দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণটি ১৯৫১ সালের অর্থাৎ এন এল বসাকের গবেষণাপত্রটির অনেক আগে। সেখানেও একই ছবি ধরা পড়েছে অর্থাৎ চারশো জন পিছু একটি বিদ্যালয়ের কিঞ্চিৎ বেশি, যা এক লাখ পাঠশালা নিয়ে ১৯৩১ সালে ফিলিপ হার্টগের আপত্তিকে নাকচ করে দিয়েছে।
৩) //উনিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে ওই শতকের আশির দশক পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ দশকের ব্রিটিশ আমলে গ্রামীণ পাঠশালার সংখ্যা আদৌ কমেনি, বরং বেড়েছে । মানে, ব্রিটিশ কর্তৃক গ্রামীণ দেশীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা ধ্বংসের কাহিনীটি হচ্ছে গণ্ডমূর্খদের উত্তপ্ত কল্পনার ফসল মাত্র ।//
যথাসময়ে এই বিষয়ে আমার লেখা কথা বলবে। আপনার ধারণার গোড়ায় অকারণে ধোঁয়া দেওয়ার প্রয়োজন দেখছি না। র্যাদার এইসব আগাম প্রেডিকশন হাস্যকর – খালি এটুকু বলতে পারি।
৪) //'শিক্ষিতের হার' বস্তুটি কী, সেটা জানতে গেলেও কিছু ন্যূনতম শিক্ষা থাকতে হয়, এলেবেলে লেখকদের যা থাকে না । যাইহোক, লেখক নাটোরের যে সংখ্যাটিকে ‘শিক্ষিতের হার’ বলছেন, সেটা যদি অ্যাডামের প্রতিবেদন থেকেই পেয়ে থাকেন, তো ওটা হচ্ছে আসলে ওই এলাকায় ওই সময়ে স্কুলে ভর্তি হবার যোগ্য বয়সে উপনীত পুরুষ-শিশুদের মধ্যে যে অংশটি সত্যি সত্যি পাঠশালাতে ভর্তি হতে পেরেছিল, তার শতাংশ হিসেব । পুরুষ-নারী মিলিয়ে সব শিশু ধরলে ওটা হয়ে যাবে প্রায় তার অর্ধেক, ৬.৫ !//
এটা স্পষ্ট প্রমাণ করছে আপনি অ্যাডামও পড়েননি। পড়লে জানতেন যে দ্বিতীয় রিপোর্টের একেবারে শেষে অ্যাডাম স্বয়ং লিখেছেন Assuming that the 39 teachers of Hindu Learning, the 88 learned men who are not teachers, the 397 students of Hindu Learning, the 3,255 persons who have received a degree of instruction superior to mere reading and writing, and the 2,342 who can merely sign their names or read imperfectly, in all 6,121 individuals, constitute the whole of the instructed male adult population of Nattore; then the proportion of the uninstructed to the instructed male adult population or Nattore is as 1000 to 114.6. এই বিষয়ে আপনার ‘আসলে ওই এলাকায় ওই সময়ে স্কুলে ভর্তি হবার যোগ্য বয়সে উপনীত পুরুষ-শিশুদের মধ্যে যে অংশটি সত্যি সত্যি পাঠশালাতে ভর্তি হতে পেরেছিল, তার শতাংশ হিসেব’ শব্দগুলো এই অজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবেই দেখছি।
৫) আপনি যে ধরমপাল আদৌ পড়েননি, তা ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে আপনি যখন সমকালীন ইংল্যান্ডের স্কুলচিত্র সম্পর্কে বারেবারেই পিছলে পালাচ্ছেন। ১৮৫১তে ‘আলোকিত’ ইংল্যান্ডে সরকারি-বেসরকারি স্কুল মাত্র ৪৬,১১৪টা অথচ ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ পরাধীন ভারতবর্ষের বাংলা-বিহারে পাঠশালা এক লাখ – এই আঁকাড়া তথ্যটি পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রেমীদের কাছে শাঁখের করাতের মতো। ফলে পিছলে যেতে হয়, নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়। আর প্রাইমারি শিক্ষার হাল যে কহতব্য ছিল না, সেটা তো লেখাতেই স্পষ্টরূপে প্রতিভাত।
৬) আমি এই লেখার একটি অধ্যায়ের উল্লেখপঞ্জীতে একটি গবেষণাপত্রের উল্লেখ করেছি। সেটি হল Joshua Ehrlich, The East India Company and the Politics of Knowledge, Cambridge, 2018। কাজেই এলেবেলে নিকে লিখছি মানে এলেবেলেই, এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। আজ অবধি বাংলা ভাষায় বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত আলোচনায় এই লেখাটি ব্যবহার করার মুরোদ কারও হয়নি। যেমন হয়নি হ্যালহেড-জোন্সের সংস্কৃত চর্চার হাঁড়ির হাল নিয়েও। ফলে আপনি তুহিন মালাকার নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকুন এবং আতস কাচ নিয়ে পরবর্তী অধায়গুলো মিলিয়ে যেতে থাকুন, ওই ওঁচাস্য ওঁচা বইয়ের একটি বাক্য এমনকি একটি শব্দও ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। ফালতু বাক্বিস্তারে আগ্রহী নই।
এই লেখাতে আপনি একজন ব্লগারকে এক পাতি পাঠক হিসেবে এতদিনে যা যা বিশেষণে ভূষিত করেছেন, সেগুলি যথাক্রমে এই – মহামূর্খ, নির্লজ্জ, ক-অক্ষর-গোমাংস, গোমুখ্যু, অন্ধকারের জীব, দালাল, জোচ্চোর, প্রতারক, অশিক্ষিত, বুজরুক, অসংলগ্ন কথাবার্তা, ছিটগ্রস্ত উন্মত্ততা, পেঁচো মাতাল, পাগলাগারদে বসে বসে লেখক নিজেই লিখলেন, বিশুদ্ধ মূর্খ এলেবেলে উন্মাদ এবং সিজোফ্রেনিক।
ভবিষ্যতে আমার ব্লগে এই জাতীয় একটি শব্দের পুনরাবৃত্তি করলে পরিণাম সম্পর্কে আগাম ভেবে রাখবেন। এর আগে একজন ঠগ বলে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন, সেটা ভুলে যাবেন না।
আমি একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এলেবেলে মহাশয়। পারলে একটু বুঝিয়ে দেবেন। আপনার এবং অ্যাডাম সাহেবের একলাখ পাঠশালার তত্ত্ব ধরুন মেনে নিলাম। কিন্তু এরপর দেখছি শিবাশিস বাবু লিখেছেন,
"বস্তুত, ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গ-বিহারের একাধিক জেলা পরিভ্রমণ করে অ্যাডাম যখন তৃতীয় রিপোর্টটি লেখেন তাতে তিনি স্বীকার করে নেন, 'Many villages did not contain a single person able to write, or even to count.' এবং 'Two pandits followed me to Calcutta from the Burdwan district to communicate the details respecting their schools, of which when in the district itself I had not been able to find any trace.'"
এবং তিনি আরও লিখেছেন,
"প্রকৃতপক্ষে ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গদেশের তিনটি বৃহৎ জেলায় ব্যক্তিগতভাবে সার্ভে করে অ্যাডাম সাহেব যে পাঠশালার সংখ্যা পেলেন তা হল, মুর্শিদাবাদ - ১১৩, বীরভূম - ৫৪৪ এবং বর্ধমান - ৯৩১ অর্থাৎ মোট ১৫৮৮টি। এর মধ্যে বাংলা, হিন্দী, ফারসি, আরবি ও গোটাকয়েক ইংরেজি পাঠশালাও আছে। এছাড়া মিঃ অ্যাডামের সহকারি জনৈক মিঃ ম্যলেট মেদিনীপুরে ৭৭৮টি পাঠশালার সন্ধান পেয়েছিলেন যদিও সেগুলির সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রিপোর্টে নেই।"
তাহলে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবিহারের চারটে বড় জেলায় অ্যাডাম সাহেবের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট পাঠশালা দাঁড়াচ্ছে ২৩৬৬। অন্যান্য জেলাগুলো তো তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল। তাহলে কি আপনি বলতে চান বঙ্গবিহারে ১৬০-১৭০টা জেলা ছিল?
ওই ভদ্রলোকও তো মনে হয় অ্যাডাম সাহেবের বই পড়েই তথ্য দিয়েছেন!
তাহলে সত্যিটা কি?
আর হ্যাঁ সময় পেলে দয়া করে আমার বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি দেন।
ইন্দ্রনীল মিত্র, আপনাকে এটাই আমার শেষ উত্তর। প্রচুর ভদ্রতা করেছি, কিন্তু আর নয়।
আজ সকাল থেকে আই অ্যাম ড্যাম সিরিয়াস। এই নিয়ে ইতিমধ্যে আমি অনেক দূর অবধি চলে গেছি, শুধু এটুকু জানিয়ে রাখছি। এটা আউট অ্যান্ড আউট একটা অ্যাকাডেমিক লেখা। তাই আজ থেকে আমার ব্লগে কাউকে খেউর করার বা অ্যাজেন্ডা পুশ করার আসর বসাতে দেব না।
আপনি আমার লেখাটাই পড়েননি। কারণ পাঠশালা একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। সঙ্গে গৃহশিক্ষা বলে একটা বস্তু ছিল। টমাস মুনরোর রিপোর্টে তার বিস্তারিত উল্লেখ আমি করেছি। আর এক লাখ পাঠশালাটা 'ধরে নেওয়ার' কিছু নেই। ওটা বাস্তব এবং আঁকাড়া তথ্য, যেমন বাস্তব চারশো জন পিছু একটি পাঠশালার অস্তিত্ব, যেমন আঁকাড়া তথ্য ১৮৫১-র ইটন।
কোনও ব্যক্তির প্রশ্নের ক্রস রেফারেন্সের উত্তর আমি দেব না। আপনি যার কথা উল্লেখ করেছেন, তিনি হয় অ্যাডাম পড়েননি কিংবা তার ইংরেজি লেখার অর্থ বোঝেননি। কারণ রিপোর্টগুলো পড়লে কেউ এই কথা লিখতে পারে না যে নিম্নবর্ণের ছাত্রের সংখ্যা কম ছিল। এন এল বসাকের গবেষণাপত্রটির ৯১ পৃষ্ঠায় এটি লেখা আছে।
দেখে নিন এবং আপনি নিজে বরং অ্যাডামস রিপোর্টস পড়ে নিন।
সাইবার সেলে অভিযোগ করার সুবিধার কারণে, আজ থেকে কোনও ব্যক্তি লগ ইন করে মন্তব্য না করলে, পাল্টা উত্তর দেব না।
এটা আগেই লিখব ভেবেছিলাম, লেখা হয়নি। গুরুতে, মানে এই সাইটে, আমরা একটা জিনিস খুব জোর দিয়ে বলি, যে, এখানে মতের অমিল হয়, উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্কও হয়, কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়না। অর্থাৎ, যাকে বলে ট্রোল করা, সেটা এখানকার, এখনও পর্যন্ত চালু রীতি না। এলেবেলে র এই লেখায় কিছু মনোজ্ঞ আলোচনা তর্কবিতর্ক হলেও মাত্রাতিরিক্ত কিছু ট্রোলও হচ্ছে। এটা করবেননা। কারণ, সংস্কৃতি একটা লেখার চেয়ে বড় ব্যাপার। একবার শুরু হলে বাঁধ দিয়ে আটকানো যায়না। আপনারা তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা করুন, তর্ক বিতর্ক করুন, এমনকি সবচেয়ে ভালো হয়, নিএজেদের পাতা খুলে সম্পূর্ণ বিপরীত মতের লেখা লিখুন। কোনো সমস্যা নেই। তাতে পাঠক সমস্ত মত পড়ে বেছে নিতে পারে। কিন্তু ট্রোল করবেননা।
এলেবেলেকেও অনুরোধ, আপনি একটা লেখা লিখছেন, যদি মনে হয় ব্যক্তিগত আক্রমণ হচ্ছে, তাহলে এড়িয়ে যান। আপনি একটা লেখা লিখছেন, সেটা অনেক লোকে পড়ছে। তাতে নানারকম মন্তব্যও আসবে। যেগুলোর উত্তর দেওয়া অর্থহীন মনে হয়, সেগুলোর উত্তর দেবেননা। দিলে গুরুত্ব বাড়ানো হয়।
এই সাইটে সে অর্থে কোনো অ্যাডমিন নেই। বাজে মন্তব্য এলে কেউ পাত্তা দেয়না, ডুবে যায়। এইভাবেই চলছে এতদিন। আশা করা যায় এইভাবেই চালানো যাবে।
এত আলোচনায় একটা জিনিস বুঝলাম না, ফিলিপ হার্টগের অথোরিটি কতটা। অ্যাডামস ও হার্টগের মধ্যে যে কোনো একজন ঠিক, সেটা নির্ণয় হবে কী করে? এই একটাই প্রশ্নে আটকে আছে দেখছি সবাই। এটার সমাধান হলে ভালো হয়।
জয়র্ষি, বস্তুতপক্ষে অ্যাডামের প্রতিবেদনে উল্লিখিত এক লাখ পাঠশালার পরোক্ষ উল্লেখ নিয়ে ফিলিপ হার্টগ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি আপত্তি জানাননি। প্রায় একই পরিসংখ্যান টমাস মুনরোর প্রতিবেদনে উল্লিখিত হওয়ার পরে, সেই নিয়ে কোনও প্রতিবাদই হয়নি। অ্যাডামের পরিসংখ্যানের পক্ষে রীতিমতো হিসেব কষে তাঁর পরিসংখ্যানকে সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন নুরুল্লা ও নায়েক। পরবর্তীকালে একই কথা বলেন এন এল বসাক ও ধরমপাল।
আমি এর আগে নুরুল্লা-নায়েকের বই থেকে অ্যাডাম স্বয়ং যে ছ'টি স্থানে নিজে সমীক্ষা করেছিলেন, তার পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছিলাম অ্যাডাম-কথিত ৪০০ জন পিছু একটি পাঠশালা খুব কষ্টকল্পনা কিছু ছিল না। আজ একই বই থেকে সেখানকার ছাত্রসংখ্যার একটা ছবি দিচ্ছি, যাতে বিষয়টি আবারও প্রমাণিত হবে। সর্বোপরি পরবর্তীকালে অ্যাডামের নির্দেশিত পথে, বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থার চালু করার নির্দেশ দেন খোদ বড়লাট ডালহৌসি । সেই প্রসঙ্গটি বিশদে অষ্টম অধ্যায়ে আলোচিত হবে।
সাম ইন্দ্রনীল মিত্র একটা সাধারণ প্রশ্ন করেছিলেন। এলেবেলে মশাই চারটে নাম বলে এড়িয়ে গেছেন জয়র্ষি।
প্রশ্নটি হল, "বঙ্গবিহারের চারটে বড় জেলায় অ্যাডাম সাহেবের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট পাঠশালা দাঁড়াচ্ছে ২৩৬৬। অন্যান্য জেলাগুলো তো তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল। তাহলে কি আপনি বলতে চান বঙ্গবিহারে ১৬০-১৭০টা জেলা ছিল?"
তাহলে কোন অঙ্কের কোন নিয়মে এই তথাকথিত একলাখ পাঠশালার অস্তিত্ব থাকতে পারে এটা কেবল উনি বুঝিয়ে দিন। নিজের বাড়িতে বসে নিজের ছেলেকে পড়ানোটা যদি পাঠশালা ধরা হয়, তাহলে আলাদা কথা !
আর অ্যাডামটা আমি পড়েছি।
মুশকিলটা হচ্ছে পাঠশালা বিষয়টাকে দেখা হচ্ছে পাশ্চাত্যের চশমা দিয়ে। ফলে বারেবারে সমস্যাটা আসছে। পাঠশালা সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে -
১. স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, ২. কেন্দ্রীভূত নয় অর্থাৎ সর্বত্র একই পাঠ্যক্রম, একই পাঠ্যসূচী, একই পাঠ্যপুস্তক, একই পাঠ্য সময় নয়, ৩. ফ্লেক্সিবিলিটি - সময়ের ক্ষেত্রে গ্রীষ্ম-শীত নির্বিশেষে এগারোটা-চারটে নয়। পরিস্থিতি বুঝে কখনও সকালে, কখনও দুপুরে, ৪. স্থায়ী নয় - চণ্ডীমণ্ডপ, খোলা মাঠ, কারও বাড়ি সবখানেই পাঠশালা বসতে পারে, হতে পারে, ৫. যারা তথাকথিত পাঠশালার পড়ুয়া তারা গরিব, তাই পাঠশালায়, ৬. যারা তাদের থেকে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল, তারা গৃহে শিক্ষাগ্রহণ করে। সেটা অনেকে মিলে একটা বাড়িতে হতে পারে (এখনকার প্রাইভেট টিউশনের মতো), ৭. গুরুমশাইদের নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক নেই, ৮. জাতপাত এবং ধর্মের বেড়াজাল নেই, ৯. ফলে পাঠশালার অন্তর্ভুক্ত হবে গৃহশিক্ষাও। কারণে সেই গুরুমশাই এবং সেই একই শিক্ষাপদ্ধতি। ওটাকে আলাদা ধরার প্রশ্নই নেই।
এখন অ্যাডাম তাঁর প্রথম প্রতিবেদনে শিক্ষা সংসদের যে সদস্যের বক্তব্য উদ্ধৃত করেন সেখানে লেখা ছিল --- This supposes that there are 100,000 such schools in Bengal and Behar, and assuming the population of those two Provinces to be 40,000,000, there would be a village school for every 400 persons.
এখানে 'স্কুল' অর্থে ইংল্যান্ডের স্কুল নয়, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা। সেখানে মোদ্দা বক্তব্য চারশো জন পিছু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই বাংলা-বিহার মিলিয়ে জনসংখ্যা ৪ কোটি হলে পাঠশালা হবে ৪ কোটি / ৪০০ = এক লাখ।
অ্যাডাম নিজে যে ছ'টি স্থানে সমীক্ষা করেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে মোট জনসংখ্যা ৪,৯৬,৯৭৪ জন এবং 'domestic instruction' ধরে মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২,২১০টি। অর্থাৎ ৪,৯৬,৯৭৪ জন/২,২১০্টি = ২২৫ জন পিছু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ৪০০ জনের যে হিসেব শিক্ষা সংসদের যে সদস্য বলেছিলেন, বাস্তবে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। তবুও অ্যাডাম দু লাখ পাঠশালা বলেননি, তিনি বিনীতভাবে 'there will still be 100,000 that have them' বলেছিলেন।
অ্যাডাম এই 'domestic instruction' গোনার নির্দেশ বাকি থানাগুলিতে দিলে, সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হত। কিন্তু অ্যাডামকে প্রথম থেকেই বাংলার সরকার মাদ্রাজ বা বোম্বের মতো সরকারি সহায়তা দেওয়া হয়নি। কারণটাও খুব স্পষ্ট। তার কিছুদিনের মধ্যে মেকলে তাঁর 'বিখ্যাত' মিনিটটি পেশ করবেন!
অঙ্কে ভুল হচ্ছে কি না, সেটা সামান্য হিসেব করলেই ধরা পড়বে। তাই ছবিটা আরও একবার দিলাম।
আচ্ছা, ইটনের হিসেবটা ঠিক আছে? কিংবা ১৮৫১-তে ইংল্যান্ডে মোট সরকারি-বেসরকারি স্কুলের সংখ্যাটা? জানার ইচ্ছে রইল।
এলেবেলে কি এটা দেখেছেন যে মুর্শিদাবাদ জেলার যে তথাকথিত ১৭৪৭টি ডোমেস্টিক ইনস্টিটিউশনের হিসেব তিনি দিয়েছেন তাতে কতজন ছাত্র পড়তো?
২৪১৪ জন।
অর্থাৎ ইনস্টিটিউট প্রতি ১.৩৮ জন।
আগেই বলেছিলাম, নিজের বাড়ির শোওয়ার ঘরে বসে নিজের ছেলেকে পড়ানোটা পাঠশালা বলে চালাতে গেলে আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ কোটি পাঠশালার সন্ধান পাওয়া যাবে !
এলেবেলে মহাশয়ের আদেশে :
১) অ্যাডাম সাহেব তাঁর তৃতীয় রিপোর্টে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম এবং বর্ধমান, এই তিনটি জেলায় ধর্ম ও জাতিগত ভেদে শিক্ষক ও ছাত্রদের সংখ্যার বিস্তারিত পরিসংখ্যান দিয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, তিনটি জেলার বাংলা পাঠশালায় শিক্ষকদের ৯৮.৩৯% হচ্ছেন হিন্দু, ১.২৫% মুসলমান এবং তথাকথিত নিচু জাতের শিক্ষকের শতাংশ ২.৯৫%। একইভাবে ছাত্রদের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ৯৪.৫৭% হিন্দু ছাত্র, ৫.২৪% মুসলমান ছাত্র এবং মাত্র ১.৮২% তথাকথিত নিচু জাতের ছাত্র। এর পরেও কি মেনে নিতে হবে বঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা সার্বজনীন ছিল?
২) শিবনাথ শাস্ত্রীর বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বঙ্গজ পাঠশালার ছাত্রদের কি বিভৎসভাবে ট্রিটমেন্ট করা হত তার ফিরিস্তি দিয়েছিলাম। আপনি কি মনে করেন এটা একটা সুস্থ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল?
৩) টোল প্রদত্ত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা মধ্যযুগীয় রক্ষণশীল স্মার্ত পণ্ডিতদের রচনা তখনও ছাত্রদের পাঠ্য। রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের ন্যায়, সাংখ্যের গবেষণা যা স্রেফ ব্রাহ্মণ ও কিছু সীমিত শিক্ষার্থীর কাছে অধিগম্য ছিল, তার মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারার কোনও প্রতিফলন ছিল না, তাই-ই দিনের পর দিন পড়ানো হত। যে দেশে একসময় গণিতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল, সেই দেশেই গণিত শিক্ষা সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আর্যা আর শুভঙ্করীতে। পড়ানো হত একাদশ শতকে ভাস্করাচার্যের রচিত বীজগণিত আর লীলাবতী ! আপনার কি এই সিলেবাস যুগোপযোগী লাগছে?
আদেশ ছিল না, অনুরোধ ছিল।
১. //মুর্শিদাবাদের ডোমেস্টিক ইনস্টিটিউশনের ছাত্রসংখ্যা ইনস্টিটিউট প্রতি ১.৩৮ জন।//
এর জন্য হিসেবটা সামান্য আলাদা। আরেকটা ছবি দিচ্ছি। আপনি পাঠশালা নিয়ে এত চিন্তিত অথচ টোলও তো গৃহশিক্ষা। সেটাকে হিসেবে ধরছেন অথচ পাঠশালায় আলাদা করছেন কেন?
মাত্র পাঁচটা জেলায় সমীক্ষা। তার মধ্যে আবার মুর্শিদাবাদের ২০টা থানা। সব জায়গাতে একই চিত্র হতে পারে না হওয়া সম্ভব? তাতেও কিন্তু ছাত্রসংখ্যাটা পাঠশালার মোট ছাত্রের ৫০% এর বেশি। মনে রাখতে হবে এর মধ্যে ঘটে গেছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং কৃষক-কারিগরদের করুণ আর্থিক অবস্থা।
২. //অ্যাডাম সাহেব তাঁর তৃতীয় রিপোর্টে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম এবং বর্ধমান, এই তিনটি জেলায় ধর্ম ও জাতিগত ভেদে শিক্ষক ও ছাত্রদের সংখ্যার বিস্তারিত পরিসংখ্যান দিয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, তিনটি জেলার বাংলা পাঠশালায় শিক্ষকদের ৯৮.৩৯% হচ্ছেন হিন্দু, ১.২৫% মুসলমান এবং তথাকথিত নিচু জাতের শিক্ষকের শতাংশ ২.৯৫%। একইভাবে ছাত্রদের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ৯৪.৫৭% হিন্দু ছাত্র, ৫.২৪% মুসলমান ছাত্র এবং মাত্র ১.৮২% তথাকথিত নিচু জাতের ছাত্র।//
অ্যাডামের তৃতীয় প্রতিবেদনের পৃষ্ঠাসংখ্যা বলুন তো যেখানে উনি বলেছেন ‘তথাকথিত’ নিচু জাতের শিক্ষক ২.৯৫% আর ছাত্র ১.৮২%। এই ‘তথাকথিত’ নিচু জাতটা কি? মানে তখনকার দিনে নিচু কিন্তু আজকের দিনে উঁচু? যাই হোক, পৃষ্ঠাসংখ্যা দেবেন। তারপরে আমার উত্তর দেব।
আর মুসলমান ছাত্র মোশার্রফ হোসেন। তাঁর কী বক্তব্য? বিদ্যাসাগর নিজে কোথায় পড়েছিলেন? তাঁর গুরুমশাই সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা ছিল? কেন ছিল? আর বাংলার তিনটে জেলা নিলেন অথচ বিহারের দুটো জেলা বাদ কেন? মুসলমান শিক্ষকের সংখ্যা বেড়ে যাবে বলে! নাকি ১৮৩৮ সালে বিহার বাংলায় ছিল না?
৩. শিবনাথ শাস্ত্রী এবং শাস্তি। ছিল তো বুঝলাম কিন্তু দু-চারটে রেফারেন্স দেবেন তো, যেখানে ছাত্ররা এই শাস্তি পেয়েছিল। শিবানাথ নিজে কিংবা কার্তিকেয়চন্দ্র বা বিদ্যাসাগর অথবা রামমোহন এমনকি রবীন্দ্রনাথ-জগদীশচন্দ্র। পাঠশালার শাস্তি আর শিবনাথ, তাই তো? আর বিদ্যাসাগর হচ্ছেন কর্পোরাল পানিশমেন্টের তীব্র বিরোধী – তাই না?
বেশ, তাহলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যাক। শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৫৬ সালে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। তিনি লিখেছেন,
কলেজে আমরা তাঁহাকে [বিদ্যাসাগরকে] ভয়ের চক্ষে দেখিতাম, এবং তাঁহা হইতে দূরে দূরে থাকিতাম। ছেলেরা দুষ্টুমি করিলে তিনি ধরিয়া নিজের ঘরে লইয়া যাইতেন, কোণে দাঁড় করাইয়া রাখিতেন, এবং বইয়ের পাতকাটা স্লাইসের দ্বারা তাহাদের পেটে মারিতেন। আমার যেন মনে হয়, আমার কোনও দুষ্টামির জন্য আমাকে ধরিয়া লইয়া আমার ভুঁড়িতে মারিয়াছিলেন, ও আমাকে কোণে দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছিলেন।
কলেজ, শিবনাথ এবং বিদ্যাসাগর – কিছু বলবেন?!!!
৪. //টোল প্রদত্ত উচ্চশিক্ষা//
বিদ্যাসাগর নিজে সংস্কৃত কলেজে তার চেয়ে বেশি কিছু পড়েছিলেন না শিখেছিলেন? তিনি যখন অধ্যক্ষ তখনকার ছাত্ররা? তবু তো সংস্কৃত কলেজের সেরা তিন ছাত্র তারানাথ-বিদ্যাসাগর-মদনমোহন। বিদ্যাসাগরের আমলে সংস্কৃততে সেরা তিন? ‘যুগোপযোগী’ শিক্ষা পাওয়ার পর ইংরেজিতে সেরা তিন? বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী অবদান রেখেছেন এমন সেরা তিন? কিংবা সেরা তিন অঙ্কবিদ?
তাহলে কী করে বোঝা গেল বিদ্যাসাগরের আমলে বিশাআআআআআআল পরিবর্তন হয়েছিল?
৫. ইয়ে মানে ইটন আর ১৮৫১-র ইংল্যান্ডের প্রাইমারি শিক্ষা নিয়ে কি মৌনব্রত অবলম্বন করলেন? খুব ব্যথার জায়গা, না?
ছবিটা, দেখেন যদি বুঝতে পারেন।
ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ছাত্রসংখ্যা জনসংখ্যার নিরিখে নেহাৎই কম। পাঠশালার সংখ্যা হয়তো অনেক বেশী ছিলো, কিন্তু অনেক বেশী ছাত্র পড়তো, এমন কি বলা যায়? আমার তো এই তথ্য দেখে মনে হচ্ছে না।
সম্ভবত, এই পর্ব থেকেই সরাসরি ঈশ্বরচন্দ্রের শিক্ষা সংস্কারে ঢুকে যাচ্ছি! এবার টানটান উদগ্রীব বসলাম। অপেক্ষা।