সন্ধেবেলা দয়াময়ীর এই কথাটুকু মনে পড়ল দয়াময়ীর দয়াময়ী ছাড়া কেউ নেই। আজানে তখন আকাশ ফেটে গেছে, গলে গলে নামছে অন্ধকারের প্রথম দিককার রঙ। পেয়ারা ফুলের মতো মুখ নিয়ে ও কান পেতে শুনল সরসর করে কোথাও কিছু একটা বাজছে। বোঝা গেল, একেবারে একা একটা তালগাছ মাঠের মাঝখানে হাওয়ায় পাতাদের কাঁপাচ্ছে।
ভাত খেতে বসে ওঁর বুক উদাস হয়, একজন কেউ থাকলে ভালো হত। এই এতবড়ো নীলসাদা রঙীন বাড়ি,দেওয়ালে সদ্য চুনকামের গন্ধ বুকে উঠে আসে। চিরকাল মাটির ঘরে, পাতার ঘরে দিন কেটেছে। সরকারি প্রকল্পের একা একা বিধবার মতো ফাঁকা বাড়িতে অস্বস্তি হয়, সন্ধ্যামালতী ফুলের চেয়েও নরম মা দেখে যেতে পারল না এই ঘরদোর।
নিজেকে নিজের জল গড়িয়ে নিতে হলে, ভাতের পাতে কাঁচালঙ্কা-নুন বারবার আনতে যেতে হলে ভালো লাগে না। এতো যত্নে করা রান্নাবান্না অর্থহীন হয়ে পড়ে যতোক্ষণ না কেউ সেই খাবার খেয়ে একমুখ হাসিতে তারিফ করে ওঠে। চিংড়ি মাছের মাথার চচ্চড়ি তারিফ না করলেও মুখ তুলে অন্তত বলুক বিচ্ছিরি হয়েছে খেতে, এ রান্না খাওয়া যায় না। পরের দিন সে সব মায়ামমতা ঢেলে এমন মোচাঘন্ট রাঁধবে সেদ্ধ ছোলার তুক কাজে লাগিয়ে যে, কর্তাকে থালা অবধি চেটে খেতে হবে।
বিয়ের বয়েস ঢিবি থেকে গড়াতে শুরু করেছে। সাতাশের কোঠায় বয়েস, শীর্ণ হাত দুটো, চোখে পশুপাখির মায়া মাখানো। কেউ না থাকার ছায়ামাখা বাড়িতে তপ্ত রোদে খালি পা ফেলে ফেলে অনেক সন্ন্যাসীরা আসবে আজ।
সুতির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ভোরবেলা অনেক সময় নিয়ে চান করে সমস্ত শীতল ফলমূল কাটা সারা, গতরাতে ভেজানো আছে ছোলা ও মুগ , সকালে অঙ্কুরিত হবে, এবারে আমছেঁচাটা করে নিলেই হয়ে যাবে যোগাড়।
ওদের পাড়ায় একেক দিন একেক বাড়ি ঘুরে ঘুরে গাজন সন্ন্যাসীরা সেবা নেয়। কতোজন আসবে বলা হয় না। আমবাগানের মাঝে যে ঠান্ডা জলের পুকুর সেখানে একেকজন সন্ন্যাসী স্নান শেষ করলেই ঢাক বেজে ওঠে।
এভাবে ওই বাদ্য শুনে শুনে দেওয়ালে দাগ কেটে রাখতে হয়। চারজনের সোজা দাগ হয়ে গেলেই পাঁচ নম্বরে পেট বরাবর দাগ টেনে দিতে হয়, এভাবে অদ্ভূত আঁকচিত্রে বোঝা যায় কতোজন আসবে দুপুরে।
পাথরের হামানদিস্তায় কাঁচা আম, গুড়ে কুটে তৈরি হল দেহ ঠান্ডা রাখার আমছেঁচা। সবাই আনন্দ করে খেল ফলমূল। জয় দিল শিবের নামে। তারপর ফিরে গেল চড়ক তলায়। পাড়ার বাচ্চারাও আঁজলায় প্রসাদ নিয়ে ফিরে গেছে, শুধু যায়নি রমা, পাশের বাড়িতে থাকে। বিষধুতুরা ফুলের মতো থুতনি, তুতলে তুতলে কথা বলে, মুখ দিয়ে লাল ঝরে। ভারি ন্যাওটা।
- এ পিতি, মেলায় ককন যাবি? একনি আমায় নিয়ে চ।
রমা বলে। দয়া ওর মাথার চুলে বিলি কেটে কিছু বলে না।
- আমাল এট্টা বনদুক তাই, ঢিক ঢিক কলে থবাইকে মালব, এ পিতি।
দয়া বলে - ঠিক আছে বিকেলে রোদ কমলে যাব, এখন বাড়ি যা।
- আমাল ভূতের ভয় কলে বালি যেতে।
- দিনেবেলা কীসের ভয় খেপি! ঠিক আছে দিয়ে আসি চ, বলে বাড়ির কাছাকাছি হাত ধরে দিয়ে আসে একরত্তি মেয়েটাকে।
সারা উঠোন ছেয়ে আছে বয়স্ক পাতায়। পা ধোয়ানো একটু জলে কয়েকটা ছাপ। বাকি জল বসুমতী শোঁ করে পান করেছে।
বাইরের দরজা ভেজিয়ে ও উঠোনে খুঁজতে লাগল খগেন দার পায়ের ছাপ। খগেন দা এখন সন্ন্যাসী সেজেছে। শ্যামলা ছিপছিপে চেহারা। দিনের অনেকভাগ সাইকেল চালিয়ে যায়। শহর থেকে একা গিয়ে পাইকারি রেটে মাল খরিদ করে আনে। বাজারে বসে ফল বিক্রি করে। ওর ভালোমানুষ বউ, প্রথম সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে, দ্বিতীয়টা মেয়ে, রমার সঙ্গে খেলতে আসে মাঝে মাঝে উঠোনে, দেখলে দয়ার বুক টাটিয়ে ওঠে।
খগেন চৈত্রমাসটা কামায়। আজ তরমুজের ফালি শালপাতার বাটিতে দিতে গিয়ে বয়স্ক চোখে দয়া দেখেছে ওর লোমহীন বগল, গভীর নাভি, খেটে খাওয়া শিরা ওঠা হাত। ওই হাত অল্প বয়সে জগদ্ধাত্রী পুজোর রাতে দয়াকে মধুর করেছিল।
পুজোর রাত। চারিদিকে অল্প অল্প কুয়াশা। ইস্কুলের পাশে ছমছমে বারান্দায় ওকে শুইয়ে ঝাঁকড়া চুলো মাথাটা বুকে একবার রেখেছিল। খগেনের প্যান্ট তখন কিছুটা নেমে গেছে কোমর থেকে। সারা বুক, পেট ও পেটের নীচে ঘন চুলের দীর্ঘ বনজঙ্গল। সারা গা থেকে ঘুরে ঘুরে দিশি কমলালেবুর কাঁচা ও টক গন্ধ উঠছে। সেই কোন ছোট বয়সের ভয় ও অবশ ভালোলাগার স্মৃতি। ওইটুকু প্রথম পুরুষ স্পর্শ, ওইটুকুই শেষ।
দয়াময়ী ছড়ানো ছিটানো কাজ সেরে আবার একবার চান করল। নিজের সেলাই করে জমানো টাকা, মায়ের বিধবা ভাতার পুরোনো টাকা গুনেগেঁথে ফলাহার করে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে বেলা পড়ে গেল। মাথার কাছে অন্ধকার। রমা ডেকে ফিরে গেছে, মেলা থেকে কেনা লাল আইসক্রিম, পাঁপড়ভাজা দিয়ে গেল মায়ের সঙ্গে এসে।
ভালো করে সন্ধে হয়েছে। আজ আবার রাঁধতে ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ধরে আছে। দুয়োর বন্ধ করতে করতে দয়াময়ীর আবার মনে পড়ল দয়াময়ীর দয়াময়ী ছাড়া আর কেউ নেই।
অবেলায় কিন্তু শোয় না দয়া। আজ শুয়ে ঠান্ডা আইসক্রিম টা মুখে নিল। শরীরে শিহরণ হল। মুখ থেকে বের করে বুক উদলা করে নালঝোল মাখা আইসক্রিম চোখ বন্ধ করে বুকে রাখল। আবার মুখে নিল। বুনো ফলের উগ্র গন্ধ। শরীর শিরশির করছে। লাল রঙের দশটাকা দামের সস্তা আইসক্রিম ওঁকে সুখ দিচ্ছে। এইবার দুই বৃন্তে রঙীন বরফ চেপে ঘোরাতে লাগল চির-আইবুড়ো মেয়ে। দয়ার চোখ জল। শরীর-বিছানা ভিজে গেছে ও ভেসে গেছে। বুকে একটি চ্যাপ্টা রঙের কাঠি পড়ে আছে। কাঠিটা রমার মতো পাতলা। বুক স্নেহে ব্যথা করে।
কাঠিটাকে ছুঁয়ে দয়াময়ী ফিসফিস করে বলে-খোকা, তোর মা মরে গেলে মুখে আগুন দিস, আমগাছটা বিক্রি করে গয়ায় পিণ্ডিদান করিস, ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ানোর কষ্ট আমি বইব না রে। এই একা একা বেঁচে থাকার দুঃখ আবার মরে গেলেও একলার কষ্ট আমার আর সইবে না রে।
এরপর দয়া শুয়ে শুয়ে কেমন করে যেন গুমরে গুমরে হাসে। দক্ষিণ দিক থেকে গাছের বাজনা শোনা যায়। সাপ বেরিয়েছে গর্ত থেকে গায়ে বাতাস লাগাতে। অনেক রাত হয়ে গেছে।