এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বইপত্তর

  • পঞ্চতন্ত্র পঞ্চনামা : বিষ্ণুশর্মা থেকে মেকিয়াভেলি

    Chayan Samaddar লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৪৯০ বার পঠিত
  • পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট (১৫৩৬-১৬০৫) অত্যন্ত বিরক্ত। নিকোলো মেকিয়াভেল্লির রচনাগুলো সর্বনাশ করছে ক্রিশ্চিয়ান সমাজের। এ কেমন জীবনধারার কথা বলছেন তিনি? অর্থ উপার্জন, পার্থিব সাফল্য - অবস্থা অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ? ক্ষেত্রভেদে ভালো ও মন্দ সমার্থক? অসম্ভব। লোভের দেবতা ম্যামনের কাছে নিজেকে বেচে দিয়েছিলেন নিশ্চয়ই মেকিয়াভেল্লি। শয়তানের কাছেও হতে পারে। তাঁর রচনাকে নিন্দা করছে পবিত্র চার্চ। কোনও ধর্মনিষ্ঠ ক্রিশ্চিয়ান তাঁর লেখা পড়লে নিশ্চিত নরকগামী হবে।

    মেকিয়াভেল্লি কিন্তু মতের স্বপক্ষে যুক্তি দিতে পারতেন। জানাতে পারতেন, তাঁর দর্শন বিশ্বের এক প্রাচীনতম দর্শনকে অনুসরণ করে, যেখানে অর্থ আর ধর্ম জীবনচর্যার দুই অভিন্ন অঙ্গ। বলতে পারতেন কূটনীতিতত্ত্ব। উদ্ধৃত করতে পারতেন এক দীর্ঘ শ্লোক।

    ন সা বিদ্যা ন তদ্ দানং ন তচ্ছিল্পং ন সা কলা।
    ন তৎ স্থৈর্যং হি ধনিনাং যাচকৈর্যন্ন গীয়তে।।

    ইহ লোকে হি ধনিনাং পরোহপি স্বজনায়তে।
    স্বজনোহপি দরিদ্রাণাং সর্বদা দুর্জনায়তে।।

    অর্থেভ্যোহপি হি বৃদ্ধেভ্যঃ সংবৃত্তেভ্যস্তঃস্ততঃ।
    প্রবর্তন্তে ক্রিয়াঃ সর্বাঃ পর্বতেভ্য ইবাপগাঃ।।

    পূজ্যতে যদপূজ্যোহপি যদগম্যোহপি গম্যতে।
    বন্দ্যতে যদবন্দ্যোহপি স প্রভাবো ধনস্য চ।।

    অশনাদিন্দ্রিয়াণীব স্যুঃ কার্যাণ্যখিলান্যপি।
    এতস্মাৎ কারণাদ্ বিত্তং সর্বসাধনমুচ্যতে।।

    অর্থার্থী জীবলোকোহয়্ং শ্মশানমপি সেবতে।
    ত্যক্ত্বা জনয়িতারং স্বং নিঃস্বং গচ্ছতি দূরতঃ।।

    গতবয়সামপি পুংসাং যেষামর্থা ভবন্তি তে তরুণাঃ।
    অর্থেন তু যে হীনা বৃদ্ধাস্তে যৌবনেহপি স্যুঃ।।

    অর্থাৎ কি না –

    হেন কলা নেই, হেন শিল্প না,
    হেন বিদ্যা না, না হেন দান,
    ধৈর্য হেন না, যেটি ধনীর না
    অর্থপ্রার্থী করবে গান।।

    টাকা থাকে যার, দুনিয়ায় তার
    পরও আপনজন।
    যার নেই টাকা –ঢের আছে দেখা-
    স্বজনও কী দুর্জন!

    বিরাট পাহাড়, ঢালু বেয়ে তার
    আপনি নামে না ঝরনা?
    বাড়তে বাড়তে টাকা হলে চুড়ো
    ভাবনা নেই কো কর্ম-সুরুরও
    কী করতে চাও কর না।।

    মোটেও মানী না, তবু মান পায়।
    যাওয়ার মতো না, তবু লোকে যায়।
    অতি অখদ্যে বাহা বাহা তবু
    করে লোকে, আহা টাকার কী জাদু।।

    পেটে কিছু গেলে ইন্দ্রিয় খোলে।
    কিছু আটকায় টাকাটি থাকলে
    ট্যাঁকে? কোনও কাজ? তাই মহাজন
    টাকাকে বলেছে সর্বসাধন।।

    টাকার আশায় মানুষ মশায়
    শ্মশানেও থাকে পড়ে।
    নিজের নিঃস্ব বাপকে দূর ছোঃ
    ফেলে চলে যায় দূরে।।

    বয়েস গিয়েছে?
    তাতে কী হয়েছে?
    যদি টাকা থাকে তুমি জোয়ান।
    টাকা না থাকলে-
    এ হে হে হে হে গেলে
    যৌবনে বুড়ো তোমার নাম।।

    কিন্তু, এ সব কিছুই বলেননি মেকিয়াভেল্লি। দুটো কারণে। প্রথমত, নিকোলো মেকিয়াভেল্লি (১৪৬৯-১৫২৭) পোপ অষ্টম ক্লেমেন্টের জন্মের ন’বছর আগে মারা যান। দ্বিতীয়ত, তিনি সেই সুপ্রাচীন দর্শন সম্বন্ধে প্রত্যক্ষভাবে কিছুই জানতেন না। তাহলে? তাহলে, আমাদের সেই বইটা নিয়ে কথা বলতে হবে, যেখান থেকে এই বিশাল উদ্ধৃতিটি দেওয়া হলো – পঞ্চতন্ত্র ।

    সম্ভবত খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের পরে কোনও এক সময় পঞ্চতন্ত্র লেখা হয়েছিল। তারপর তা হারিয়ে যায়। গৌরী ধর্মপাল-এর মতে, সেই হারানো পঞ্চতন্ত্র –এর বংশের যে আদিপুরুষদের সন্ধান পাওয়া যায়, তারা হলো, ১) আনুমানিক ২০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে লেখা কাশ্মীরী তন্ত্রাখ্যায়িকা। ২) ৫৭০ খৃষ্টাব্দে কৃত পহ্লবী অনুবাদের মূল লুপ্ত উত্তর পশ্চিম ভারতীয় পাঠ (এই পাঠ নিয়ে একটু পরেই বিস্তারিতভাবে বলতে হবে আমাদের)। ৩) বৃহৎকথার অন্তর্ভুক্ত প্রাচীন পঞ্চতন্ত্র-এর কিছুটা লুপ্ত কিন্তু বৃহৎকথামঞ্জরীতে ও কথাসরিৎসাগরে শ্লোকাকারে রক্ষিত ৪) দক্ষিণভারতীয় সংক্ষিপ্ত পঞ্চতন্ত্র । ৫) নেপালী পঞ্চতন্ত্রশ্লোকসংগ্রহ। গৌরী ধর্মপাল আরও জানাচ্ছেন,

    পণ্ডিতদের অনুমান, খৃষ্টীয় নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে বর্তমানে প্রচলিত পঞ্চতন্ত্র রূপ পায় সম্ভবত কোনও জৈন লেখকের হাতে। ১১৯৯ খৃষ্টাব্দে লেখা জৈন সাধু পূর্ণভদ্র-সূরির পঞ্চাখ্যানক তারই উপ্সকৃত অলঙ্কৃত রূপ। প্রাচীন ও আধুনিক গুজরাতী, মারাঠী, ব্রজভাষা, তামিল, বাংলা ইত্যাদি ভারতীয় ভাষায় অনূদিত বা পুনঃকথিত হয়ে নাবালক এবং সাবালক উভয় সাহিত্যেরই জমিকে উর্বর করে চলেছে পঞ্চতন্ত্র সুদীর্ঘকাল ধরে।

    পঞ্চতন্ত্র গল্পের আদলে রাজনীতি শেখায়। ছোটোদের জন্য লেখা মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র বইয়ে গৌরী ধর্মপাল নিজেই তাকে বলেছেন বীভৎস রাজনীতি। মিত্রভেদ, মিত্রপ্রাপ্তি, কাকোলূকীয়, লব্ধপ্রাণাশ আর অপরীক্ষিত-কারকাণি – এই পাঁচটা বড়ো গল্প শেখায় কী করে বন্ধুতা ভাঙতে হয়, কী করে সমঝোতা করতে হয়, যুদ্ধ আর শান্তিরক্ষা কোন কোন উপায়ে করা সম্ভব, যা পেয়েছি তা হারাতে বসলে কী করতে হবে এবং হঠকারী আচরণকে এড়াতে হয় কী করে। এক কথায়, আজকাল যাকে পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ারস্‌ বলে, তারই নির্যাস ধরে রেখেছে পঞ্চতন্ত্র ।

    কেমন ভাবে রাজনীতিকে বোঝে পঞ্চতন্ত্র? একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে মনে হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে অধিকতর শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যখন যুদ্ধ্ব চলছে তখন শান্তি বজায় রাখা উচিত না লড়ে যাওয়া উচিত? কাকোলূকীয় উত্তর খোঁজে। কাক-রাজ মেঘবর্ণ আর পেচক-রাজ অরিমর্দনের মধ্যে অশান্তি চলছে। প্রতিরাতে কাকদের বটগাছ দুর্গ আক্রমণ করছেন অরিমর্দন। কাকেরা মারা পড়ছে। এই অবস্থায় মন্ত্রীসভার অধিবেশন ডাকলেন বায়সরাজ। জানতে চাইলেন, কিং যুজতে সন্ধি-বিগ্রহ-যান-আসন-সংশ্রয়-দ্বৈধীভাবানাং মধ্যাৎ - এই অবস্থায় সন্ধি, যুদ্ধ, পালানো, বসে থাকা, অন্য কারও আশ্রয় নেওয়া আর ছলনা – এর মধ্যে কোনটা করা উচিত? এরকম জটিল পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য মন্ত্রীমণ্ডলী রাজাকে যে পরামর্শ দিলেন সেটা হলো একটা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং গড়ে তোলা। কাক সাম্রাজ্যের বাইরে ও ভেতরে যে সব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি ক্রিয়াশীল সেগুলো সম্বন্ধে ভালো করে জানতে হবে। জানতে হবে শ্ত্রুর অন্ধিসন্ধি। তবেই মজবুত রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা যাবে। মহামন্ত্রী স্থিরজীবী রাজাকে বলেন –

    গন্ধেন গাবঃ পশ্যন্তি বেদৈঃ পশ্যন্তি বৈ দ্বিজাঃ।
    চারৈঃ পশ্যন্তি রাজানশ্চক্ষুররভ্যামিতরে জনাঃ।।

    গোরু দেখে গন্ধ দিয়ে, বেদ দিয়ে দেখে ব্রাহ্মণ।
    রাজা দেখে চর দিয়ে, চোখ দিয়ে জনসাধারণ।।

    প্রশ্ন হলো, বিভিন্ন মূল্যবোধ, আদর্শ ও নীতির স্থান বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোথায়? উত্তরটা খুব সোজা। কোনও এথিক্স-এর জায়গা নেই এখানে। আছে পলিসির। নিপুণভাবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে শিখতে হবে। রাজা যদি প্রজাদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে যা যা দরকার (প্রয়োজন হলে দ্বৈধীভাব বা ছলনার আশ্রয় নেওয়াও তার মধ্যে পড়ে) তা না করেন, তবে রাজা হিসেবে তাঁর টিঁকে থাকা মুশকিল হতে পারে।

    যদি ন স্যন্নরপতিঃ সম্যঙ্‌নেতা ততঃ প্রজা।
    আকর্ণধারা জলধৌ বিপ্লবেতেহ নৌরিব।।
    ষড়িমান্‌ পুরষো জহ্যাদ্ভিন্নাং নাবমিবার্ণবে।
    অপ্রবক্তা রমাচার্যমনধীয়ানমৃত্বিজম্‌।।
    অরক্ষিতারং রাজানং ভার্যাং চাপ্রিয়বাদিনীম্‌।
    গ্রামকামং চ গোপালং বনকামং চ নাপিতম্‌।।

    প্রজাদের ঠিক পথে রাজা না চালালে
    মাঝিহীন তরীহেন
    ডোবে তারা সমুদ্রসলিলে।।
    যে গুরু ভালো বলেন না, যে ঋত্বিক করে নাকো বেদ-অধ্যয়ন,
    যে রাজা করে না রক্ষা, যে ভার্যার মুখে সদা অপ্রিয়বচন,
    যে রাখাল ভালোবাসে গ্রাম, আর যে নাপিত ভালোবাসে বন,
    সাগরে ভাঙা না-’হেন মানুষ করবে ত্যাগ - এই ছয়জন।

    নীতিশাস্ত্র মতে মানুষ হিসেবে যতই ভালো হোন না কেন, শাসক যদি শাসকের মতো আচরণ না করেন, তবে শাসক পদ অধিকার করে থাকলেও তিনি শাসকই নন। তখন আর তাঁর ঐ পদে থাকার কোনও অধিকার নেই।

    গল্পের স্তরে স্তরে রাজনীতি জড়িয়ে থাকার ফলে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের কাছেই পঞ্চতন্ত্র অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠে। গত দু’হাজার বছরে পৃথিবীর কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ে তা। Johannes Hertel দেখিয়েছেন যে, পঞ্চাশটা ভাষায়, দু’শ-র ওপর তর্জমা বা প্রতি তর্জমা হয়েছে পঞ্চতন্ত্র-এর। আর তার মধ্যে তিন চতুর্থাংশই ভারতের বাইরে। Winternitz বলেছেন একমাত্র বাইবেল ছাড়া আর কোনও বই পঞ্চতন্ত্র-এর মতো রাজসমারোহে বিশ্বভ্রমণ করেনি।

    আর এগোনোর আগে, একটা বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া যাক। পঞ্চতন্ত্র-এর রচয়িতা হিসেবে বিষ্ণুশর্মার নামটা চলে আসছে। এখন, এ বইয়ের অনেক গল্পই জাতক বা তারও আগেকার লোককথা থেকে নেওয়া। কিছু গল্প পরে জোড়া হয়েছে। কিছু গল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কিন্তু, গল্পের কাঠামোকে জ্যান্ত করে তোলার মধ্যে এক অসাধারণ লেখকের হাতের ছোঁয়া আছে,তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গৌরী ধর্মপালের ভাষায়,

    ‘তৃপ্ত পাঠক তাঁকেই নাম দিয়েছে বিষ্ণুশর্মা- ব্যাবৃত্ত- সর্বেন্দ্রিয়ার্থ অশীতিপর এক বৃদ্ধ, যিনি তাঁর সারাজীবনের পাণ্ডিত্য প্রজ্ঞা আর রসের সঞ্চয় নিয়ে সরস্বতীকে নিয়ে খেলায় বসেছেন…
    আশ্চর্য লেখক। আশ্চর্য বই। বই নয়, যেন একখানি দর্পণ। হাতে ধরিয়ে দিয়ে সকৌতুকে বলছেন, দেখো দেখো, মানুষ দেখো, দুনিয়ার হালচাল দেখো।’

    এবার তাহলে একদম গোড়ার কথাটায় ফিরে যাওয়া যাক। ভারতের বিষ্ণুশর্মার এই মায়ামুকুর ফ্লোরেন্সের মেকিয়াভেল্লির কাছে গিয়ে পৌঁছয় কী করে?

    পঞ্চতন্ত্র-এর পশ্চিমবিশ্বের দিকে যাত্রা আরম্ভ হয় এর ৫৭০ খৃষ্টাব্দে করা পহ্লবী বা মধ্য-পারসিক ভাষায় করা অনুবাদের হাত ধরে। পারসিক রাজা খোসরু আনুশিরভান (৫৩১-৫৭৯) রাজবৈদ্য ব্রুজুর কাছ থেকে ভারতভূমির গল্পের আকারে ধরে রাখা রাজনীতি চিন্তার কথা জানতে পেরে তাঁকে কাহিনিগুলিকে পহ্লবী ভাষায় অনুবাদ করতে বলেন। ব্রুজু মিত্রভেদ-এর দুই প্রধান শৃগাল চরিত্রের নাম অনুযায়ী তাঁর অনুবাদের নাম দেন করটক ও দমনক । এই নামেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয় পঞ্চতন্ত্র ।

    যে বছর পহ্লবী অনুবাদটি করা হয় সে বছরই প্রাচীন সিরীয় ভাষায় তার অনুবাদ করেন বাদ। নাম দেন কলিলগ ওয়া দিমনগ । ৭৫০ খৃষ্টাব্দের আশেপাশে এই বইয়ের আরবী অনুবাদ করেন আবদুল্লাহ্ ইবন্ মোকাফা। বইয়ের নাম হয় কলিলা ওয়া দিমনা। পহ্লবী অনুবাদটির অন্যান্য আরবিক অনুবাদ থাকলেও আবদুল্লাহ্ ইবন্ মোকাফার অনুবাদটিই জনপ্রিয়তম ছিল এবং এর নানা পাণ্ডুলিপি এবং মুদ্রিত রূপের খবর পাওয়া যায়।

    পশ্চিমি দুনিয়া পঞ্চতন্ত্র-কে চেনে মুখ্যতঃ এই আরবী অনুবাদের মাধ্যমে। ১০৮০ সালের কাছাকাছি সময়ে স্তেফানিতেস কাই খেন্‌লাতেস নামে আরবী পঞ্চতন্ত্র-এর একটি গ্রীক অনুবাদ করেন সিমিওন বেন সেথ। এই বইয়ের ওপর নির্ভর করেই পরবর্তী কালে রচিত হয় ল্যাটিন, ইটালিয়ান, জার্মান ও ফরাসী অনুবাদগুলি।

    ১২৫০ সালে কলিলা ওয়া দিমনা-র হিব্রু অনুবাদ করেন রাব্বি জোএল। আর, কবি জেকব বেন্‌ এলিয়েজর হিব্রুতে বইটির এক ছন্দবদ্ধ রূপ রচনা করেন।

    জোএল-এর হিব্রু পঞ্চতন্ত্র-এর ওপর নির্ভর করেই ১২৭০ সালে জিওভান্নি দে কাপুয়া রচনা করেন Liber Kalilae et Dinae : Directorium Humane Vitae,alias Parabolae antiquorum Sapeintium [ মানব জীবনের দিগ্দর্শক বা প্রাচীন ঋষিদের প্রবচন ]। এই বই পশ্চিমি বিশ্বের এক মাস্টার টেকস্ট হয়ে দাঁড়ায়। ১৩১৩ সালে Liber de Dina et Kalia নাম দিয়ে এর দ্বিতীয় স্প্যানিশ অনুবাদ প্রকাশ করেন রেইমন্দ দে বেজাইয়ারস। প্রথম অনুবাদ হয়েছিল ১২৫১তে। ১৪৮০তে আন্টোনিয়াস ভন্ পফ্‌র এর জার্মান অনুবাদ করেন। নাম দেন Buch der Beispeile der Allen Weisen। ১৫৫২ সালে আন্তোনিও ফ্রানসেসকো দোনি লেখেন লা মোরাল ফিলোসোফিয়া । পঞ্চতন্ত্র-এর ইটালিয়ান রূপ।

    এতক্ষণে আমরা মেকিয়াভেল্লির কাছাকাছি আসতে পেরেছি বোধহয়। ১৫১৩তে তাঁর বিশ্বখ্যাত ইল্ প্রিনসিপে (রাজপুত্র) বা ১৫১৭ তে ডিসকোর্সেস রচনার অনেক আগে থেকেই ইউরোপ গ্রীক, হিব্রু, ল্যাটিন, স্প্যানিশ আর জার্মান ভাষায় পঞ্চতন্ত্র-এর অনুবাদকে পেয়েছিল। এটাও লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে পশ্চিমি দুনিয়ায় অনুবাদগুলো কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজাদের আদেশে করা হয়। অর্থাৎ, সাহিত্যিক মূল্যের চেয়েও পঞ্চতন্ত্র-এর রাজনৈতিক মূল্য ছিল অনুবাদের মূল কারণ। সংস্কৃত থেকে পহ্লবীতে যে প্রথম অনুবাদ - তা রাজাদেশের ফল। আবার, কাস্তিলের রাজা দশম আলফানসোর আদেশে ১২৫১তে পঞ্চতন্ত্র প্রথমবার স্প্যানিশে অনূদিত হয়। যেখানে সরাসরি রাজাদের আদেশে অনুবাদ হয়নি, সেখানেও অনুবাদক এ বই উৎসর্গ করেছেন শাসক শ্রেণীর কাউকে। যেমন ১৩১৩তে করা দ্বিতীয় স্প্যানিশ অনুবাদ উৎসর্গ করা হয় নাভারের রাজা জনকে; জিওভান্নি দে কাপুয়া তাঁর ল্যাটিন পঞ্চতন্ত্র উৎসর্গ করেছেন কার্ডিনাল মাত্তেও ওরসিনিকে। অর্থাৎ, ভারতীয় কূটনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন এবং তার প্রয়োগ বিষয়ে পঞ্চতন্ত্র-এর বিভিন্ন অনুবাদের মাধ্যমে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ।

    Facets of Panchatantra নামের এক প্রবন্ধে John Alphanso Karkala বলছেন যে, যেহেতু মেকিয়াভেল্লি ফ্লোরেন্সের প্রতিনিধি হিসেবে জার্মানী, ফ্রান্স ও স্পেনে গেছেন; দেখা করেছেন জার্মানীর সম্রাট প্রথম ম্যাকসিমিলিয়ান, ফ্রান্সের রাজা দ্বাদশ লুই, প্রমুখের সঙ্গে, ঐসব দেশের ভাষার কিছুটা জ্ঞান তিনি নিশ্চয়ই আয়ত্ত করেছিলেন। ফলে পঞ্চতন্ত্র-এর দর্শনের সঙ্গে তাঁর ওইসব দেশে পরিচিত হওয়া খুবই সম্ভব। শুধু তাই নয়; ১২৭০-এ লেখা জিওভান্নি দে কাপুয়ার বহুল অনূদিত ল্যাটিন পঞ্চতন্ত্র ইটালিতে দু’বার ছাপা হয়। ১৪৮০তে একবার, ১৪৮৩তে দ্বিতীয়বার। মেকিয়াভেল্লির কৈশোরকালে বইটা অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। সুতরাং পঞ্চতন্ত্র বা ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কিছু না জানলেও গল্পের মোড়কে ঢাকা শাসনতন্ত্র পরিচালনা করার রীতি নীতি নিয়ে যে একটা ডিসকোর্স তাঁর সমসাময়িকতার মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছিল, তার প্রভাব মেকিয়াভেল্লির ওপরও পড়েছিল এমনটা হওয়া খুবই সম্ভব।

    উদাহরণ হিসেবে John Alphanso Karkala ইল প্রিনসিপে-র অষ্টাদশ অধ্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। মেকিয়াভেল্লি মনে করেন যুদ্ধ করার দু’টো রাস্তা আছে। একটা আইনি, অন্যটা গা জোয়ারির। দ্বিতীয়টাতেই কাজ দেয় বেশি। তাই, আদর্শ রাজকুমারের মধ্যে মানুষ আর জন্তু দুইয়ের বাস প্রয়োজন। জন্তুর মধ্যে দুটি প্রাণীর কথা উল্লেখ করছেন মেকিয়াভেল্লি- সিংহ আর শেয়াল। সিংহ ফাঁদে পড়ে আর শেয়াল নেকড়েদের সঙ্গে লড়তে পারে না। তাই রাজকুমার শেয়াল ও সিংহ দুইই হবেন। যাতে তিনি ফাঁদেও না পড়েন, আবার নেকড়েদের সঙ্গে লড়তেও পারেন। রাজ্য চালনার জন্য কোনও নীতি আঁকড়ে থাকলে চলবে না। যদি কথা না রাখলেই সেই মুহূর্তে সুবিধে হয়, তো তাই সই। শিখতে হবে বিশ্বাসযোগ্য অজুহাত দেওয়া। অবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলাবে অবস্থান। যতটা সম্ভব ভালো থাকার চেষ্টা নিশ্চয়ই করা উচিত, তবে অবস্থা যদি বলে তথাকথিত মন্দই বিধেয়, তবে তিলমাত্র দ্বিধা না করে মন্দ উপায় অবলম্বন করাই উচিত।

    কাক-রাজ মেঘবর্ণ আর তাঁর মন্ত্রীসভাকে মনে পড়ছে? আরও স্পষ্ট করে এর প্রতিধ্বনি পাওয়া যাবে মিত্রভেদ-এ। শৃগাল ভ্রাতৃদ্বয় করটক আর দমনক-এর কথোপকথনে। বৃষ সঞ্জীবক আর সিংহ পিঙ্গলকের মধ্যে বিবাদ ঘটানোর উপক্রমের সময় দমনক তার ভাইকে বলে

    উপায়েন হি যৎ কুর্যাৎ তন্ন শক্যং পরাক্রমৈঃ।
    কাক্যা কনকসূত্রেণ কৃষ্ণসর্পো নিপাতিতঃ।।

    কৌশলে যা পারবে তা গায়ের জোরে হয় না।
    কাকী মারলে কেউটে সাপ দিয়ে সোনার গয়না।।

    মেকিয়াভেল্লি রাজনীতি বলতে যা বুঝছেন দেখা যাচ্ছে, তাকে স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করে দমনক মিত্রভেদ-এর একদম শেষ শ্লোকে। ক্ষমতার লজ্জাহীন নগ্নরূপ প্রকাশ করেছেন বলে পাঁচ’শ বছর ধরে গাল খেয়ে আসছেন মেকিয়াভেল্লি। দমনকের দেওয়া রাজনীতির সংজ্ঞাটা একবার শোনা যাক –

    সত্যানৃতা চ পরুষা প্রিয়বাদিনী চ
    হিংস্রা দয়ালুরপি চার্থপরা বদান্যা।
    ভূরিবায়া প্রচুরবিত্তসমাগমা চ
    বেশ্যাঙ্গনেব নৃপনীতিরনেকরূপা।।

    সত্যবাদিনী, মিথ্যাবাদিনী, রুক্ষ, প্রিয়ংবদা-ও
    নৃশংসা, দয়াময়ী। বদান্যা, টাকা-দাও-টাকা-দাও।
    ঢালাও খরচ করছে, অঢেল টাকাও আসছে নিতি-
    বহুরূপী বারনারী- এই হলো গিয়ে রাজনীতি।

    আপনার আমার দেশের মাটিতে জন্মানো রাজনীতির তত্ত্বে কি কম নগ্নতা? শুধু তাই নয়, দুয়ের মধ্যে বিস্ময়জনক মিল। আর বোধহয় সন্দেহ করা চলে না যে মেকিয়াভেল্লির রাজনীতি চেতনার উৎসমুখের নাম পঞ্চতন্ত্র ।

    ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ এই চতুর্বগের সাধক ভারতভূমিতে হাজার খানেক বছর আগে তাঁর ক্ষুরধার মেধা আর লিখনক্ষমতা নিয়ে জন্মালে কৌটিল্যের সমতুল্য এক কুটনীতিজ্ঞ বলে শ্রদ্ধেয় হতেন যিনি, মধ্যযুগের ক্রিশ্চিয়ান জগৎচিন্তার সঙ্গে সংঘাতে তাঁকে নিন্দিত হতে হলো। মেকিভেলিয়ান শব্দটা একটা গালির রূপ নিল। তবে, বর্তমান চিন্তনজগৎ অনেক উদার। আজ আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি বিষ্ণুশর্মা থেকে মেকিয়াভেল্লি এক বহুমাত্রিক কিন্তু অনবচ্ছিন্ন জ্ঞানতত্ত্বের অংশভাক।

    ঋণস্বীকার :
    ১) পঞ্চতন্ত্র – অনুবাদ গৌরী ধর্মপাল (প্রতিটি শ্লোকের অনুবাদ তাঁরই করা)
    ২) Facets of Panchatantra – John B. Alphonso Karkala

    (খোয়াবনামা ১৪২৫ বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • বইপত্তর | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৪৯০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    রণছোড় - Chayan Samaddar
    আরও পড়ুন
    মালিক - Chayan Samaddar
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৬:২৬498200
  • বেশ হয়েছে।
  • santosh banerjee | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১২:৪৭498311
  • সমৃদ্ধ হলাম। বর্তমান শাসক গন( সে ইহদেশীয় বা বিদেশীয়) সেই মেচিয়াভেলী সুলভ আদর্শে অনুপ্রাণিত নন কি ? মিল খুঁজে পাই ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন