বাবার দেওয়া নামটাকে প্রকাণ্ড এক ঠাট্টা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না রণবিজয়ের। জীবনের রণক্ষেত্রে পরাজয় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না তিনি। হ্যাঁ, তিনি ইতিহাসের পণ্ডিত, বিদেশের জার্নালে তাঁর লেখা ছাপা হয়, কলেজের অধ্যাপক, বাবার রেখে যাওয়া বসতবাড়ি আর সম্পত্তিও আছে। তবু, তিনি একেবারে একা। মা চলে যাওয়ার পর তো আরও বেশি। ছেলের বিয়ে দিয়ে যেতে পারেননি বাবা, মা কেউই। রণবিজয় সহপাঠিনী রত্নাকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু, মনের কথা বলবেন কী করে ঠিক করে উঠতে উঠতেই রত্নার ছেলের অন্নপ্রাশনের কার্ড এসে পৌঁছলো। এই একটি কারণের জন্যই রণবিজয় মনে করেন তাঁর নাম পরাজয় বা পরাস্তকুমার রাখলে ভালো করতেন বাবা। তিনি অসম্ভব লাজুক আর মুখচোরা। তাঁর ছোটোখাটো, মিষ্টি চেহারাটি মানুষের মনে আর যে ভাবেরই উদ্রেক করুক, সম্ভ্রমের জন্ম দেয় না। কেউ তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। কলেজের ছেলে মেয়েরা তো জাস্ট পাত্তা দেয় না। সেদিনের সেই হেনস্থার কথা মনে পড়লে, আজও কান-মাথা ঝাঁঝাঁ করে তাঁর।
পাস ক্লাসে এমনিতেই প্রচুর ছেলে মেয়ে, তার ওপর রণবিজয়ের ক্লাসে সবাই নিজের মতো কথা বলে, ঘোরাফেরা করে। কোনওদিকে না তাকিয়ে লেকচার দিয়ে যান তিনি। সেদিন তাঁর ডেইস থেকে একদম শেষ গ্যালারির কোণার দিকে চোখ গেল। একটা হীরো হীরো মার্কা ছেলে, মিষ্টি দেখতে একটি মেয়ের কানের ভেতর ঠোঁট গুঁজে কীসব বলছে। মেয়েটার মুখে লালিমা আর আবেশ। প্রেম নিয়ে কোনও গোঁড়ামি নেই রণবিজয়ের। বস্তুটিকে শরীর ও মনের বল ও স্ফূর্তিবর্ধক বলেই তিনি মনে করেন। তবে, ইতিহাস পাস ক্লাসে, বঙ্গীয় নবজাগরণে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা সংক্রান্ত লেকচার শুনতে শুনতে প্রেম করা চলে কিনা, এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে বলে ভাবলেন তিনি। গলা ঝেড়ে, জোর দিয়ে ডাকলেন।
- ইউ দেয়ার!
হেলদোল নেই।
- ইউ কুইং পিজিয়ন! লাভি ডাভি! ইউ কানে ঠোঁট!
শড়া অন্ধার মতো মাতৃভাষা কাজ করলো। ছেলেটা আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো।
- আমাকে ওলচেন স্যার?
- হ্যাঁ। আমি কী পড়াচ্ছিলাম?
- বিদ্যাসাগরের জীবন।
- কী বলছিলাম?
- বিদ্যাসাগর হেব্বি মহান ছিলেন। পরের জন্য প্রাণ কাঁদতো। বিধবা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
উলটে পড়তে পড়তে সামলে গেলেন রণবিজয়। একমাত্র মৃত্যুই বিদ্যাসাগরের ইজ্জত বাঁচাতে পারে বুঝে প্রশ্ন করলেন,
- বিদ্যাসাগর কবে মারা যান? .
- এ তো সবাই জানে স্যার।
-:তবু শুনি।
- যথেষ্ট বেশি বয়সেই মারা যান।
রীতিমতো ধন্দে পড়লেন রণবিজয়। কী বলবেন এই উত্তরকে? ভুল? তাহলে তো মেনে নিতে হয় বিদ্যাসাগরের অকালমৃত্যু হয়েছিল। ইতিহাস তো তা বলে না। ছেলেটা মিটিমিটি হাসছে। হম কিসিসে কম নহি হাবভাব। তাকে ভেবড়ে দেওয়ার জন্য মাথায় যে প্রশ্ন এল, করে বসলেন রণবিজয়।
- বাবরের বাবার নাম বলো।
ছেলেটা একটুও ঘাবড়ালো না।
- মুন্না মিঞা।
- হোয়াট?
- ডাক নাম স্যার।
একেবারে বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন রণবিজয়। তাঁর এরিয়া অফ এক্সপার্টিজ হলো হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালি। মিডিয়েভল ইন্ডিয়া নিয়ে লেটেস্ট ডিসকাভারি সম্বন্ধে ততটা আপ টু ডেট নন তিনি। মীর্জা ওমরের ডাকনাম যদি সত্যিই আবিষ্কার হয়ে থাকে? ভাবতে ভাবতেই ঘন্টা পড়লো। নিশিপাওয়ার মতো হেঁটে স্টাফ রুমে এলেন রণবিজয়। ল্যাপটপ খুলে পাগলের মতো ব্রাউজ করে চললেন। কোথায়? কোথায় মুন্না মিঞা? নাই! নাই! সে পথিক নাই! তাঁর পাগল পাগল ভাব সহকর্মীদের চোখ এড়ালো না। অগ্রজপ্রতিম সুপ্রতীক হাজরা উঠে এসে পিঠে হাত রাখলেন।
- কী হয়েছে রে রণো?
লাইফলাইন পেলেন রণবিজয়। সুপ্রতীকদাই তো মিডিয়েভেল ইন্ডিয়া স্পেশালিস্ট!
- বাবরের বাবার ডাকনাম কী সুপ্রতীকদা'?
- মানে?
- কোনও নতুন ডিসকাভারি...?
এক নিমেষে সবটা বুঝলেন সুপ্রতীক। সংক্ষেপে বললেন,
- আয় তো আমার সঙ্গে। যেতে যেতে সব শুনছি।
সে ছোকরাকে বয়েজ কমনরুমে পাওয়া গেল। সুপ্রতীক ডাকলেন,
- লাগা রহে থে মুন্নাভাই? ভরে ক্লাসরুমমে?
ছেলেটা মুখ লাল করে ফেলল কেন বুঝলেন না রণবিজয়। তবে, তুতলে গিয়ে বলল,
- দ্দে দেখুন স্যার, বেসি...
- চোপ!
ঘরে বোমা পড়ল যেন। ছেলেটার কলার চেপে ধরেছেন সুপ্রতীক।
- পিস্তল নিয়ে পুলিশ যখন তাড়া করে, শিরদাঁড়া দিয়ে শিরশিরে স্রোত নামে জানিস? জানিস না। আমি জানি। সেরকম বাড়িতে জন্ম আমার! ব্লাডি লুম্পেন! পড়ার সঙ্গে সম্পর্ক নেই শিক্ষকের সঙ্গে ইয়ার্কি মারতে শিখেছ? চল্ ইউনিয়ন রুমে। এই তোরা কেউ তোদের জি.এস কে ডাক। আমি অর্জুনদাকে ফোন করছি। রণবিজয় তুই প্রিনসিপলকে ডেকে আন। এই ছোকরা পড়াশোনা করে কী করে দেখে নিচ্ছি আমি!
ছেলেটা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিল। কান ধরে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইয়ে ছেড়েছিলেন সুপ্রতীক। নিঃশ্বাস ফেললেন রণবিজয়। সুপ্রতীকদার মতো মানুষরাই আসলে জয়ী। ব্যক্তিত্ব, পারসোনালিটি! এটা ছাড়া জীবনের কোনও অর্থই হয় না!
সামনে পাসের পরীক্ষার খাতা। একের পর এক মৌলিক উত্তর। সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক? স্যার হরপ্পা। সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ? ওখানকার নারীরা বন্ধ্যা ছিল বলে। পাণিপথের যুদ্ধের বিবরণ? পানির নীচে বাবর আর লোদী হেব্বি ক্যালাকেলি করেছিল। পানির নীচে জলকেলি চলতে পারে, ক্যালাকেলি কী বস্তু? ১৯৪৯ সালে অনেক সাহেব মেম মিলে ন্যাংটো সই করে? ন্যুডিজম ইন ফর্টিনাইন? এরকম কোনও প্রশ্ন এসেছে? ওহো! কবে, কারা ন্যাটো চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন! উত্তরের ল্যাবিরিন্থ দিয়ে ভালোই এগোচ্ছিলেন রণবিজয়। হঠাৎ, ওয়াটারলুতে গিয়ে পড়লেন। সম্রাট অশোক ভেরীকুমার ঘোষকে নিশারাণী ঘোষে পরিণত করেন? দুহাতে কপাল টিপে ধরলেন। অশোকের সময়ে বা তার আগে সার্জারি অনেক উন্নতি করেছিল। জীবক ব্রেইনে অপারেশন করতে পারতেন। অশোক নিজে বিরাট পশু হাসপাতাল খোলেন। কিন্তু, সেক্স চেঞ্জ করা হতো কি? তার ওপর দুটো নিখাদ বাঙালি নাম। রণবিজয়ের জ্ঞান বলছে, অশোকের সময় বাংলাভাষার জন্মই হয়নি! তবে? এ কী রহস্য? একটু ভাবতে স্পষ্ট হলো ব্যাপারটা। অশোক যুদ্ধের ভেরীঘোষ কে সদ্ধর্মপ্রচারের ধর্মঘোষে পরিণত করেন। পরীক্ষার্থী জানে কুমার ছাড়া নাম হয় না। অতএব ভেরী কৌমার্যপ্রাপ্ত হয়েছে। এরপর ধর্মঘোষ - পিতার কালে অশ্রুত নাম! সুতরাং, ঘোষযাত্রা করে পছন্দমতো একটি নাম সে বসিয়ে দিয়েছে।
রহস্যভেদের পর কেমন যেন অস্থির লাগতে লাগলো রণবিজয়ের। এক বোতল জল খেয়ে ফেলে, তাঁর মনে হলো একটু ফ্রেশ এয়ার দরকার। রণবিজয়দের মোহনলাল স্ট্রিটে বিরাট বাড়ি। পুরনো পাড়া। খুব অদ্ভুত ভাবে, অবলুপ্তপ্রায় কিছু জিনিস এখনও এখানে দেখা যায়। তার মধ্যে একটা হলো মার্বেল খেলা। অস্থির-চঞ্চল রণবিজয় কোনওদিকে না তাকিয়ে রাস্তায় নামা মাত্র একটা সমবেত হাঁ হাঁ ধ্বনি ঊর্ধ্বাকাশে ধাবিত হলো কেন, তা বোঝার আগেই বাড়ির সামনে ছড়ানো বাবলু-ভল্টু-বুম্বা-টুকাইদের মারবেলে পা দিলেন তিনি। এবং বোঁ করে ছুটলেন পাঁচমাথার মোড়ের দিকে। সচরাচর এসব ক্ষেত্রে পপাত চ -ই হয়ে থাকে। কিন্তু, রণবিজয়ের অধঃপতন প্রতিহত হলো বড় বিচিত্র উপায়ে। তিনি সরাসরি ধাক্কা মারলেন একটি মানুষকে, এই সংঘাতে সামান্য দুলে উঠলেও যাঁর পদস্খলন হলো না। দুটি সবল অথচ ভারী নরম হাত রণবিজয়কে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। একটা বাঁশির মতো মিষ্টি গলা প্রশ্ন করলো
- আপনার লাগেনি তো?
রণবিজয় দেখলেন তাঁর চেয়ে একমাথা উঁচু বরতনু। রণবিজয় দেখলেন সাদা শার্ট, ব্লু ডেনিম। রণবিজয় দেখলেন পানপাতা ছাঁদের মা দুগগার মতো মুখ। রণবিজয় দেখলেন টানা টানা চোখে মুগ্ধতা আর সর্বনাশের ইশারা। তাঁর বক্ষ দুরু দুরু করে উঠলো।
- আমি শম্পা বর্মণ। আপনি?
রণবিজয়ের সন্দেহ হয়, তিনি নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। সেদিনের ধাক্কার পর প্রেম নিবেদন করতে শম্পা সময় নিয়েছিল ঠিক সাতদিন। তারপর এই ছ'মাস স্বপ্নের মতো কেটে গেল। শম্পা গল্ফগ্রীণে একটা ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। রণবিজয়ের এত বড় ফাঁকা বাড়ি হাসি, গান, হুল্লোড়ে ভরে দেয় শম্পা। ঝোড়ো আদরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রণবিজয়ের মুখ বুকের খাঁজে চেপে ধরে বলে,
- আমার বুজু! ছোত্ত মনাতা! আমার নরমসরম খরগোসতা!
নিজেকে শম্পার হাতে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে আবেশে চোখ বোজেন রণবিজয়। ভেবে আশ্চর্য হন, যে যে কারণে তিনি এতদিন নিজেকে হেরোভূত ভেবে এসেছেন, শম্পার কাছে ঠিক সেগুলোই আকর্ষণীয়। আজ শম্পা একটু গম্ভীর। রণবিজয় বললেন, - কিছু হয়েছে?
- হয়নি কিছু বুজাই। শুধু তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না আর। বিয়ে করব।
লাফ দিয়ে উঠলেন রণবিজয়।
- রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে একমাসের নোটিসের ব্যবস্থা করি?
- ধ্যাৎ খেপু! বাবাকে বলতে হবে না?
ক্ষীণ কন্ঠে রণবিজয় বললেন,
- আমাকে?
এরকম প্রতিক্রিয়ার কারণ আছে। শম্পার বাবা রিটায়ার্ড কর্নেল রুদ্রদমন বর্মণ, থাকেন বাদুতে। বিশাল বাড়ি। শম্পা আলাপ করিয়ে দিয়েছিল গতমাসে। মেইনল্যান্ড চায়নায় লাঞ্চ করতে করতে কর্নেল যখন জানলেন, রণবিজয় উত্তর কলকাতার এক পুরনো বাড়িতে থাকেন, রুদ্রদমন প্রথম ভালো করে নজর করলেন তাঁকে। তারপর জানতে চাইলেন, রণবিজয়ের বাড়ির আলসেতে কী জাতীয় পায়রা বাসা বেঁধেছে? ঘুলঘুলিতে পেঁচা থাকে কি না; থাকলে কী জাতীয়। একটি প্রশ্নেরও সদুত্তর না পেয়ে, নিমেষমধ্যে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। আসলে, খেচরজগৎ ছাড়া আর কিছুতেই আগ্রহ নেই রুদ্রদমনের। পাখি দ্বিপদ, মানুষও। তাহলে, মানুষের কেন ডানা নেই - এই দার্শনিক চিন্তা তাঁকে আকুল করে।
শম্পা হেসে বলল,
- বাবা কাল কলকাতা আসছেন। কালই বলো। কাল ডিনার করবো একসঙ্গে। পিটার ক্যাট।
ফর্কে চেল্লো কাবাবের টুকরো বিঁধিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন কর্নেল। রণবিজয় সদ্য জানিয়েছেন তিনি শম্পার পাণিপ্রার্থী। বুকের ধুকপুকুনি শুনতে শুনতে অপেক্ষা করছেন রুদ্রদমনের উত্তরের। কিন্তু, কর্নেল যখন মুখ খুললেন, বেরিয়ে এল একটা বিদকুটে শব্দ।
- জাটিঙ্গা!
- আজ্ঞে?
- জাটিঙ্গা ইয়াংম্যান! ভেবে দেখ! আলো জ্বলছে! আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ছে পাখি। ওরা মরতে আসছে? বাজে কথা! মারা হচ্ছে! খুন! কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার! থামানো উচিত নয়? তুমি কী বলো?
- আপনি কী বলছেন কিছু বুঝছি না স্যার!
রুদ্রদমনের মুখটা অবিকল বাজপাখির মতো দেখাতে লাগল। তারপর ঝড়ের গতিতে তিনি যা বললেন, তার থেকে মোটামুটি বোঝা গেল যে, আসামের ডিমা হাসাও জেলাতে, বর্ষার ঠিক পরপর, মাটিতে আলো জ্বেলে রাখে খাসিয়ারা। নানা প্রজাতির পাখি আলো দেখে মাটিতে নেমে আসে, তখন তাদের বাঁশের চটায় ধরে, পিটিয়ে মারা হয়। পাখিরা আত্মহত্যা করে বলে একটা মিথ চলে আসছে দীর্ঘদিন। এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পর্যন্ত জানে না যে মুর্খ, সে রুদ্রদমনের কন্যাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখে কোন সাহসে?
- বাপি!
শম্পা ডাকলো। কর্নেলের মুখ হয়ে উঠলো সোনালী ঈগলের মতো।
- বড় হয়েছ। স্বাবলম্বী। বিয়ে করতেই পারো। তবে, সেক্ষেত্রে আমি আত্মহত্যা করবো।
ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেলেন কর্নেল। বজ্রাহত হবু বর - কনে। শম্পাই সামলে নিলো আগে। হেসে বলল,
- বুজু, আমি কদিন বাবার কাছে গিয়ে থাকছি। ওখান থেকেই গাড়িতে অফিস করব। একটু অসুবিধে হবে। কী আর করা! শোনো, তোমায় একটা অ্যাড্রেস দিচ্ছি। নোঅল কোর্স। ওরা যে কোনও বিষয়ে করেসপন্ডেন্স কোর্স করায়। খুব ফাস্ট রেজাল্ট আসে শুনেছি। ঝট করে ওরনিথোলজি মানে পাখপাখালি বিদ্যের একটা কোর্স করে চলে এস বাদুতে। ফোন করে দিও একটা।
পা টেনে টেনে বাড়ি ফিরছেন রণবিজয়। হঠাৎ এক বজ্রনির্ঘোষে তাঁর ভেতর পর্যন্ত কেঁপে উঠল। ছোট থেকে আজ অবধি এই গলাকে ভয় করেন তিনি।
- রণবিজয়!
ত্বিষাম্পতি বেদান্ততীর্থ। তাঁদের প্রতিবেশী এবং স্কুলে তাঁর সংস্কৃত আর বাংলার শিক্ষক। এমনটি নয়, তিনি কোনওদিন মেরেছেন বা বকেছেন রণবিজয়কে। ভয়ের কারণ অন্য।
- স্যার!
- চিত্তবৈকল্য ঘটেছে। মুখমণ্ডল বিবর্ণ। কেন এই ক্লিন্নতা? তুমি ব্রহ্মস্বরূপ। আনন্দাদ্ধেব খল্বিমানি...
টানা একঘন্টা বজ্রকন্ঠে বেদান্তভাষ্য শুনিয়ে যখন রেহাই দিলেন পণ্ডিতমশাই, তখন চোখের সামনে বর্ণময় সর্ষে ক্ষেত দেখছেন রণবিজয়। কোনওমতে বাড়ি ফিরে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলেন তিনি।
দু'মাস কেটে গেছে। নোঅলের অফিসের সামনে রণবিজয়। ভেতরে ঢুকলেন। বেয়ারাটা খইনি টিপছে।
- ক্যা মাংতা?
- মালিকসে মুলাকাত মাংতা।
- মিটিংমে হ্যায়।
- একটি চড়ে বদন বিগড়ে দেব! আমাদের টাকায় মাইনে পাও বুঝেছ? সোজা আঙুলে ঘি উঠবে, না চিটিংবাজির জন্য মালিক সমেত ঘানি ঘোরাবার বন্দোবস্ত করবো?
চ্যাঁচামেচিতে মালিক বেরিয়ে এসেছেন।
- হোয়াটস দ্য ম্যাটার?
- জাস্ট দিস, ইউ পীপল আর আ বাঞ্চ অফ কাটথ্রোটস! আয়্যাম গোইং টু ইনফর্ম দ্য মিডিয়া, দেন ইউ আর গোইং টু হীয়ার ফ্রম মাই লইয়ার!
- প্লিজ সার! একটু শান্ত হোন। আমার অফিসে এসে বসে বলুন কী হয়েছে।
- আমি আপনাদের কাছে ওরনিথলজির কোর্স করতে চেয়েছিলাম। দু'মাস ধরে মেটিরিয়াল আসছে। মাইনিউটলি ফলো করছি। কিন্তু, পাখি সম্বন্ধে কিছুই জানি না আমি! এ কী চালাকি নাকি? সব কাগজ পত্র দেখে দ্রুত ডেস্ক টপের কী বোর্ডে আঙুল চালাচ্ছেন মালিক।
- ছি ছি ছি! বিশ্রী ভুল হয়ে গেছে ডঃ শর্মা! একদম অন্য কোর্স মেটিরিয়াল চলে গেছে আপনার গেছে। তবে, আমাদের এফিসিয়েন্সি কিন্তু মানতেই হবে আপনাকে! দু'মাসের মধ্যে এরকম ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট! জাস্ট ভাবা যায় না! - রেজাল্ট? - আপনি কিসের ট্রেইনিং পেয়েছেন জানেন? কী করে কনফিডেন্স আর সেল্ফ এস্টিম বাড়াতে হয়!
রণবিজয় হুংকার ছাড়বেন বলে হাঁ করেছিলেন। মুখটা হাঁ-ই রইল। ধীরে ধীরে তাঁর মনে পড়তে লাগলো, ইদানীং তিনি মাথা উঁচিয়ে, বুক ফুলিয়ে হাঁটেন। লোকে পথ করে দেয়। একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। উঠে বেরিয়ে যেতে যেতে, মোবাইলে শম্পার নাম্বার ডায়াল করলেন তিনি।
বাদুর বাড়ির গেটে শম্পা দাঁড়িয়েছিল। হাসল।
- দীনুকা, এই দাদাবাবু আজ রাতে থাকবেন। ওঁর জিনিস পত্তর আমার ডান পাশের ঘরটায় রেখে দাও। যেটায় কাকু থাকবেন সেটায় নয় কিন্তু।
রণবিজয় প্রশ্ন করলেন,
- কাকু মানে?
- বাবার পঞ্চাশ বছরের বন্ধু। আজ বিকেলে আসবেন।
- চলো, তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করে আসি। কোথায় তিনি?
- পেছনের বাগানে।
একটা ঝুপসি বটগাছের সামনে চোখে দূরবীন কষে দাঁড়িয়ে রুদ্রদমন। মেয়ের ডাক শুনে ফিরে তাকালেন। তাঁর মুখ অপছন্দসই ইঁদুর খাওয়া প্যাঁচার মতো দেখাতে লাগলো।
- সেই ছোকরা না?
- কর্নেল বর্মন!
চাবুকের শপাং-এর মতো স্বরটা শুনে চমকে অ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে পড়লেন কর্নেল।
- সাঃ!
- অ্যাট ইজ কর্নেল। কল মি ডকটর।
- সাঃ?
- ডকটর রণবিজয় শর্মা। পি এইচ ডি। বেলিয়ল কলেজ। অক্সফোর্ড।
হাতুড়ি দিয়ে ঠোকার মতো করে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করা হচ্ছে। শম্পার মুখ হাঁ।
- হরিদেবপুরের জমিদার ছিলাম আমরা। নীল বিদ্রোহের সময় আমার প্রপিতামহ নীলকুঠি জ্বালিয়ে, রাতারাতি সেখানে একটা কলাবাগান বসিয়ে দেন। চৌগাছায় তখন...। চৌগাছার খবর রাখেন?
বোবা আতঙ্ক নিয়ে মাথা নাড়লেন রুদ্রদমন।
- নিজের ঘরের মানুষের রক্তমাখা ইতিহাস জানেন না এক সৈনিক পুরুষ! কী বলব আপনাকে?
সৈনিক পুরুষের মুখ নীচু।
- শুনুন। শম্পাকে আমি বিয়ে করছি। এবং আপনি কোনও গোলমাল করছেন না। কোই শক?
- নো সা!
- কান্ট হিয়ার ইউ!
- সাঃ! নোঃ সাঃ!
- গুড ম্যান!
হাসিমুখে পেছনে ফিরে রণবিজয় দেখলেন শম্পা সেখানে নেই। বাড়ির সামনের লনে পাওয়া গেল তাকে। রণবিজয় হেসে বললেন,
- তোমার বাবা বিয়েতে রাজি
- ছি!
- মানে?
- কাকে বিয়ে করব? কে তুমি? এরকম উগ্র, রুক্ষ, হামবড়া? আমার বুজু কই? সেই ফুলের মতো মনের মানুষটা? আমার খরগোশ? তাকে ফিরিয়ে দাও!
ফুঁপিয়ে কেঁদে ছুটে চলে গেল শম্পা। রণবিজয় স্তম্ভিত। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখলেন শম্পা একটা ঘরে ঢুকলো। গিয়ে সাধবেন? ইমপসিবল্! সারাদিন কারও সঙ্গেই দেখা হলো না। ডাইনিং হলে একা লাঞ্চ করলেন। তারপর ঠিক করলেন, ওপরে গিয়ে নিজের ব্যাগটা নিয়ে চলে যাবেন। কর্নেলকে বলে যাওয়া দরকার। দীনুকা বলল, তিনি বাগানেই লাঞ্চ করে, ওখানেই আছেন। বাইরে এলেন রণবিজয়। গেট খুলল। কে একজন ঢুকছে। চোখে সূর্যের আলো পড়ছে দেখা যাচ্ছে না ভালো।
- রুদ্র!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপাদমস্তক কেঁপে উঠলেন রণবিজয়। ত্বিষাম্পতি স্যার! ইনিই তবে সেই বন্ধু? তাঁর না বিকেলে আসার কথা ছিল? অবশ্য কবেই বা প্রত্যাশামতো কাজ করেছেন স্যার? ঘোরবর্ষায় যখন রেইনি ডে-র ব্যবস্থা পাকা করে আনা হয়েছে, পণ্ডিতমশাই হেড স্যারকে বুঝিয়ে স্পেশাল সংস্কৃত ক্লাস নিয়েছেন, তিন ঘন্টা। নোঅলের কোর্স চলার সময় স্যার কাশী গিয়েছিলেন। কিন্তু, এই বজ্রগর্জনে তো তাঁর হৃদয় আর কম্পিত নয়। এখনই গিয়ে তিনি মুখোমুখি হবেন স্যারের।
- অয়ম অহম ভো! রুদ্র!
অকুতোভয় রণবিজয় লক্ষ্য করলেন তিনি উন্নতশিরে আগুয়ান। তাঁর পা চলছে। কিন্তু, কোনও এক নিগূঢ় কারণে, তাঁর চরণযুগল অতিদ্রুত চলেছে সেই দিকে, যে দিকে ত্বিষাম্পতি বেদান্ততীর্থ নেই! বিকেল থেকে সন্ধে বাইরে বাইরে কাটল। রাতের দিকে সুট করে বাড়ি ঢুকে গেলেন রণবিজয়। গেট খোলা ছিল। পেছনের বাগানে বটগাছের পেছনে লুকিয়ে কাটল আরও সময়। গেট বন্ধ হলো। একতলার দরজা খোলাই রয়েছে। ভেতরে ঢুকলেন রণবিজয়। একবার ব্যাগটা তো নামিয়ে আনা যাক। ওই হলো শম্পার ঘর। ডানদিকের ঘর মানে ওইটা। মার্জারচরণে ঘরে ঢুকলেন। দরজা বন্ধ করলেন। আলোর সুইচ কোনদিকে? দেওয়াল হাতড়ে খুঁজতে লাগলেন। - ওরে বাবা! হাঁটুটা খটাং করে লেগেছে একটা রকিং চেয়ারের গায়ে। এভাবে কেউ চেয়ার রাখে?
- কে? কস্ত্বং? তস্কর অস্তি! চোর! চোর! পাকড়ো! বন্দুক, রুদ্র লাও! আরে দ্যুৎ! কী বলে গিয়ে, রুদ্র বন্দুক লাও!
বজ্রনাদে কাঁপছে চারদিক। ঊর্ধ্বশ্বাসে পালানোর সময় রণবিজয় অনুধাবন করলেন দীনুকার ডান-বাঁ জ্ঞান নেই। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পাশের ঘরের দরজা খুলে সোজা বিছানায় ডাইভ দিলেন রণবিজয়। ঘুমন্ত শরীরটা আঁকড়ে হাঁফাতে লাগলেন। এই ছোঁয়া, এই গন্ধ বড় চেনা। খুট করে বেডসাইড ল্যাম্প জ্বলে উঠলো।
- বুজু?
কাঁপা গলায় রণবিজয় বললেন,
- আমায় লুকিয়ে রাখো বুলু! আমার গা কেমন করছে!
- অলেএএএ! এইত্তো আমার সোনাই, আমার বুজাই, আমার খরগোস! ভয় কি সোনা? তোমার বুলু আছে না? তুমি এখানেই থাকো। বাবা এসে দেখুক। বাবাকে তো চিনি! এরপর বিয়ে না দেওয়ার কথা ভাবতেই পারবে না! আর শোনো, কলকাতা ফিরে গিয়েই নোঅলের কাছ থেকে কোর্স ফী রিটার্ন চাইবে তুমি।
ভঙ্গুর হাসলেন রণবিজয়।
- পারবো না সোনা! স্যারের এক হাঁকে আমার ব্যক্তিত্ব এতটাই কমে গেছে যে, রিটার্ন চাওয়ার সাহস আর নেই।
(পি.জি. ওডহাউসের দ্য ভয়েস ফ্রম দ্য পাস্ট গল্পের প্রচ্ছায়া অবলম্বনে।)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।