আনন্দে নাচছেন মহেশ্বর। মৃদঙ্গে তাল তুলছেন নন্দী।কার্তিকের ময়ূর এই নৃত্যের ছন্দে যোগদিতে দৌড়চ্ছে। শিবের সাপ ময়ূর দেখে ভয়ে লুকতে গিয়ে গণেশের নাকে অর্থাৎ শুঁড়ে ঢুকে পড়েছে।সাথে সাথে শুড়শুড়িতে গণেশের মারাত্মক হাঁচি। - অষ্টম শতকের কবি ভবভূতি হিন্দুদের আরাধ্য গণপতিকে নিয়ে এমন ব্যাঙ্গত্মক ছবি আঁকলেন মালতী মাধব নাটকের ' মঙ্গলাচারণ' শ্লোকে। গুজরাটের বৈষ্ণবরা জরাসন্ধ্রের সাথে এঁটে না উঠে পালিয়ে আসা কৃষ্ণকে ' রণছোড়' বলেই ডাকে। আজ যদি কোন উগ্র হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী ' মালতী মাধব' এর সব কপি পুড়িয়ে দিতে সাওয়াল করে, যদি গুজরাটি বৈষ্ণবদের মুন্ডকাটার খেলায় মাতে - তাহলে আমরা কি বলব? এই উদ্মাদনার নাশ হোক? নাকি বলব কেন ওঁরা দেবতাদের অপমান করল? রসবোধের পক্ষাঘাত দেখে এই সতর্ক প্রশ্নতোলার সাথে জড়িত থাকে দেখার দৃষ্টি ও মননের সম্পর্ক।
কয়েকদিন ধরে ফ্রান্সের একটি কদর্য, কুৎসিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বেদম তর্ক করেছি। ব্যাথিত হয়েছি যখন ধর্মান্ধ কোন গোষ্ঠীর অনেকে মুক্তচিন্তক শিক্ষক হত্যাকে সমর্থন করেছেন। কেন তিনি তাদের আরাধ্য নবীর কার্টুন প্রদর্শন করবেন? কার্টুন একটি শিল্প মাধ্যম। ধর্মের নামে অন্ধ হয়ে যাওয়া লোকজন এতটা বোধশূণ্য হন যে শিল্প দেখলেও আতঁকে ওঠেন? অবশ্য বিপরীত মতপথের যত পুঁথি নানা শতকে পুড়েছে তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কোন জায়গা পাচ্ছি না। গুজরাটে কোন ধর্মান্ধ হিন্দু জঙ্গী কোন ভ্রুনস্থ শিশুকে ত্রিশূলে গেঁথে উল্লাস প্রকাশ করে, তার নেপথ্যে থাকে - আমাদের পূর্বজদেরও মুসলিম শাসকরা এভাবেই হত্যা করত।লাখ লাখ ' হিন্দু ' নারী খান বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশে এভাবে অত্যাচারিত ও খুন হয়েছে। কর সেবকদের এভাবেই জ্বলন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। অতএব এই হত্যা বৈধ। হত্যা, নৃশংসতার এই ন্যারেটিভ আমাদের আঁতকে দেয়, দিয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষকহত্যার পর একই ন্যারেটিভের প্রতিস্বর কানে এল। কাজাগের অমুক দিন এত ধর্মভাইকে তমুকে মেরেছে- অতএব শিক্ষক হত্যা পবিত্র কর্তব্য। ধর্মের নামে হত্যার এই বৈধতাকরণেই টিকে থাকে বিদ্বেষ, বিভাজন এবং তার মূল ধর্মনামক প্রতিষ্ঠানটি।
শিক্ষক কেন মহম্মদের কার্টুন দেখিয়ে বিতর্ক করলেন? অতএব খুন তো হবেন।এমন সাফাই দেওয়ার সময় মনে রাখা জরুরি - সেটা ধর্ষিতার পোষাককে দোষ দেওয়ার মত মনোবিকারের প্রকাশ। আমার ধর্ম, আল্লা, গড, ঈশ্বরই শ্রেষ্ঠ এমন মানসিকতাকে দেবনামপ্রিয় অশোক বলেছিলেন - আত্মপাষন্ড। গিরনারে প্রাপ্ত অশোকের ১২ নং শিলালেখতে অশোক বলেছিলেন - বহুভাষা, বহুধর্মের সমাজে যে নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন তিনি ' আত্মপাষন্ড'। অতএব আমার আরাধ্যই শ্রেষ্ঠ, তার ব্যাঙ্গ হলে আমি খুন করতে পারি - এই মাসকিতা ' আত্মপাষন্ড' জাত।
শার্লি এবেদো ১৯৭০ সাল থেকে ক্যাথলিক ও ইসলাম ধর্মের অনড়তাকে ব্যাঙ্গ করে লোক খেপিয়ে আসছে। ২০১৫ তে শার্লি এবেদোর দপ্তরে আক্রমণের কিছুদিন আগে তারা ক্যাথলিক সন্ন্যাসীদের দ্বারা শিশু পায়ূচিত্রের কার্টুন এঁকেছিলেন। তাতে হয়ত অনেক ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান ব্যথিত হয়েছেন। অনেকে সেই সব যাযক, পুরোহিতদের নিতান্ত পেডোফেলিক বলে এড়িয়ে গেছেন। কার্টুন দপ্তরে হামলা করেননি। আসলে "ক্ষমতাশীলরা ক্ষমা করতে সক্ষম। অক্ষমরা প্রতিশোধ নেয়"।( শান্তিপর্ব, মহাভারত, ২১৯/২৬)
অপরাধ, হিংসার নেপথ্যে পাশ্চাত্য দন্ডনীতিশাস্ত্র তিনরকম মত প্রকাশ করে। যথা-
১) ডেটারেন্ট, ২) রিফর্মেটিভ, ৩) রেট্রিবিউটিভ। এর মধ্যে সকল উগ্র ধর্মিক রেট্রিবিউটিভ নীতির কোলে ঢলে পড়েন। রেট্রিবিউটিভ প্রতিহুংসার পক্ষাঘাতে ধর্মপ্রাণদের মনন- যিক্তি অসার।
পিটার ফ্রেঞ্চ নামক পাশ্চাত্য দার্শনিক তাঁর - " Cow boy metaphysics ' (২০০২) এ লেখেন - ধর্মচারির কাছে প্রতিহিংসা শুধু অনুমোদনীয় নয়, প্রতিহিংসা তার কাছে জরুরি সদ্গুণ।
কোরাণ, হাসিদেও একাদিক জায়গায় এই ধর্মীয় গুণকে উৎসাহিত করা আছে।
সূরা আল আনফিল -৩৯ এ বলা আছে -' তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না... আল্লাহর সব হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়।'
সূরা আল আনফাল -১৭ তে বলা -" তোমরা তাদের হত্যা করনি, আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছে।" সুতরাং নবীর কার্টুন প্রদশর্ন করা শিক্ষককে হত্যাকারী ধর্মান্ধ জঙ্গী ভাবতেই পারে, তার কাজ জায়জ। সে তো করেনি। এই মনবিকারেরই ছায়া কয়েকদিন নানা বয়ানে ধরা পড়ল।
যীশু যতই বলুন শত্রুকে ভালো বাসো, 'ওল্ড টেস্টামেন্ট' এ প্রতিহিংসার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। psalms 58:10/11 এই প্রাচীনভাগে বলছে - ' ধর্মনিষ্ঠ সদ পুরুষ প্রতিশোধ দেখলে পরে উল্লসিত হবেন।'
মহাভারত যতই বলুক -" ন তৎ পরেষু সন্দধ্যাৎ প্রতিকূলং যদাত্ননঃ।" - তুমি যে আচরণ সহ্য করতে পার না, তেমন আচরণ কোরো না। অথচ মহাভারত জুড়ে প্রতিহিংসা। ভীম দুঃশাসনের রক্তে দ্রোপদীর চুল ভেজানোর সময় সেই একই ' ধর্মীয় সদগুণে' তাড়িত হন। তখন ফ্রীজে গোমাংস আছে কিনা, কেউ সরস্বতীর স্বল্পবাসনা ছবি আঁকলেন কিনা - তার খোঁজ পড়ে। বিধর্মীকে শাস্তি দেওয়ার তাড়নায় ' অনুক্রোশ' জন্মায়।
' চন্ডীমঙ্গল' কাব্যে দেবাদিদেব উপবেশন করছেন অজিনে।গৌরীকে নানাবিধ ব্যঞ্জন রাঁধার নির্দেশ দিচ্ছেন।গৌরী জানালের রান্নার সরঞ্জাম বাড়ন্ত। তারপরই গৌরীর জবাব -
" আজিকের মতো যদি বান্ধা দেহ শূল।
তবে সে আনিতে নাথ পারি হে তন্ডুল।" - ' ত্রিগুণের অধিপতি ' মহাদেবকে ত্রিশূল বন্ধক দিতে হবে।তবেই খাওয়া। এই নির্মম রসিকতা শিবভক্তেরও কাব্যরস পিপাসাকে তৃপ্ত করে এসেছে। আজ কোন হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী যদি বলেন শিবের অপমানকারী মুকুন্দ চক্রবর্তীর মুন্ড চাই - আজকের ভারতে বসে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
একই কথার স্বর শুনি সূরা আত তাওবাহ -১৩ তে -" যুদ্ধ কর ওদের সাথে, আল্লাহ তোমাদের হস্তে তাদের শাস্তি দেবেন।" - ধর্মনীতিতে হিংসা জায়েজ সদগুণ হিসেবে এভাবেই প্রতিভাত হয়ে এসেছে, আসছে। মানুষের মানবিকতা ক্ষয়প্রাপ্ত হলেই জন্মায় এমন বিকার। মানুষ কিসে মানুষ হয় - কান্ট সারাজীবন এই প্রনের উত্তর খুঁজেছেন। ' লজিক' বক্তৃতামলার শুরুতে কান্ট বলছেন -"
১) আমরা কি জানতে পারি?
২) আমাদের কি করা উচিত?
- পৃথিবীতে যুগে যুগে ধর্মের নামে, অসহিষ্ণুতা আর পরকে নিকেশ করার খেলায় মানুষ মাতে। পরধর্ম সহিষ্ণুতার ঔচিত্য থেকে সরে যায় বিধর্মীকে নিকেশকরার ' কর্তব্যে'।
একালের কবি জয় গোস্বামী তাঁর কবিতায় এমন অমোঘ প্রশ্ন তোলেন -
" মারের মুখে মার দাঁড়াবে? শোকের মুখে শোক?
এই তাহলে উপায়?"( মা নিষাদ, পৃ -৩৫)
এই প্রশ্ন যতক্ষণনা জাগবে আমরা আত্মপাষন্ডের পিড়নে তাড়িত হব। আমার ' পবিত্র ' আরাধ্যকে নিয়ে কিছু বললে জিঘাংসায় 'জায়েজ' খুঁজে চলব।
দাঙ্গাবিধ্বস্ত সময় জীবনানন্দ ১৯৪৬-৪৭ কবিতায় আক্ষেপের সাথে উচ্চারণ করেছিলেন -" জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে ; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।" জিঘাংসা, ধর্মের জিগির সত্য। জানি শেষ সত্য নয়। সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ' কথা লেখার অধিকার ' এ দেখিয়েছেন -" যদি আমাদের সত্যের শিস্ না ভেঙে গিয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পেন্সিল অনেক জালিয়ানওয়ালাবাগের থেকে বেশি শক্তিশালী। " পরদেশ, পরধর্মকে গ্রাস করার সর্বৈব মিথ্যার মোহচ্ছন্নতা ছিন্ন হবে এই সত্যবোধ ও চেতনা জাগ্রত থাকলে- কান্টের ভাষায় আমরাও বলতে পারব - আমরা এর থেকে আর কি আশা করতে পারি?
আশা করতে পারি একদিন কোন স্যামুয়েল প্যাটি, আখলাক, অভিজিৎ রায়কে আর খুন হতে হবে না। একদিন পৃথিবীর সব জিঘাংসক বিষন্ন হয়ে যাবে, ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্লান্তস্বরে বলবে - " আমরা আসি"। বহু মত বহু ভাষা ও ধর্মের বহুমাত্রিক পৃথিবীতে উত্তর আধুনিক সময়ে রক্ত, হত্যার ধর্মান্ধ বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে আমরা আশা করতে পারি -" তার হৃদয়ের ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম করে চেতনার বলয়ের নিজগুণ রয়েগেছে বলে মনে হয়।"
এই অসম্ভব দরকারি কথাগুলো সঠিক উচ্চারণে বলার জন্যে সৈকত মিস্ত্রির জন্যে টুপি খুললাম। কার্টুনগুলো প্রকাশের জন্যে গুরুর কর্তৃপক্ষ ধন্যবাদের পাত্র।
আগুন দিয়ে আগুন নেভে না । কোন অজুহাতেই মানববধ সমর্থনযোগ্য নয়।
@ Ranja Ray আপনাকে ধন্যবাদ।
মানব বধের যুক্তি ও প্রতিযুক্তি নিয়ে আর একটা বড় প্রবন্ধ বোধহয় আপনার থেকে আমরা আশা করতে পারি। বিশ্বাসেরও বিবর্তন হয়। কীভাবে হয় সে-বিষয়ে বলুন, আমরা শুনব। এই লেখায় শুধু কাঠামো আছে; মূর্তি বানান, দেখতে চাই।
খুব সমৃদ্ধ হলাম সৈকত।
অসংখ্য ধন্যবাদ