আচ্ছা বলুন তো, হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা বলুন তো, কোন সবজেক্টে ব্যাবাক মানুষে, মানে ভারত তথা বাংলা তথা গুরুচন্ডালীর সব্বাই, যাকে বলে একেবারে হুলিয়ে পন্ডিত? মানে যাকে বলে প্রাজ্ঞ?
না, না, ফুটবল নয়, পোলিটিক্স নয়, সাহিত্য বা ক্যালকুলাসও নয়। আসলে সবাই যে ব্যাপারে মতামতে ভর্পুর এবং অভিজ্ঞতায় উপছে পড়েন সেটা হচ্ছে বিরিয়ানি।
একবার হাটে হাঁড়ি ভেঙেই দেখুন না, ঘটি বাঙাল, বাসী, প্রবাসী বা অ্যান্টিবাসী, তরুন বা বুড়োটে, সব সব রকমের জেন্ডার - মানে সকলেই তাদের অফুরন্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ভান্ডার নিয়ে হাজির হবেন। তক্কো জুরে দিবেন, কোনটি খাঁটি আর কোনটি বর্ণ সংকর দুষ্ট, কে অথেন্টিক, কে নকল নবীস। শেষ কথা কে কবে?
এতো খুঁটি নাটি থেকে বিপুল তফাৎ। একটি পুর্ণাংগ বিরিয়ানিকোষ লিখলে (সোনার অক্ষরে ছাপা নাম, ডবোল ডিমাই, অক্টাভো) তো সেটা সাইজে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাকেও ছাড়িয়ে যাবে।।
প্রায় তিন দশক হল দক্ষিণ ভারতে প্রবাসী - সেই আদি যুগে যখন কলকাতায় ছিলাম তখন বিরিয়ানি পাওয়া যেতো শুধু মুসলমান পাড়ায়। "দাদা বৌদি" বা "পিসী ভাইপো" বিরিয়ানি গোছের নাম শুনলে লোকে তওবা তওবা করতো। মুর্গী বা মাটন ছাড়া অন্য কোনো বিরিয়ানির খোঁজ' ও জানতাম না। দক্ষিণ ভারতের বিরিয়ানি? শুনলে অবাক হয়ে যেতাম। ম্যাড্রাসীরা তো পিওর ভেজ খায়। ইডলি, ধোসা.... এইসব। মাটন চিকেনের মর্মকথা ওরা আর কী জানবে? আরে, খাস কলকাতায় হিন্দু পাড়াতেও পাওয়া যেতো না সহজে। সাহেব পাড়াতে গিয়ে তো শুধু চপ কাটলেট পুটিং বা নিতান্ত চ্যাং ব্যাং পাওয়া যেতো। মাল্টি কুজিন তখনো জেঁকে বসে নি। বিরিয়ানি খেতে হলে ঐ একটা দুটোই রেস্তোরা ছিল। অ্যাম্বার যেরকম।
তখন কুল্লে বিশ্বায়নের শুরু - লোকে প্রথমে একজন দু’জন - পরে ঝাঁকে ঝাঁকে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়বে কয়েক বছরের মধ্যেই। বাইরের দুনিয়াটা আস্তে আস্তে প্রকাশ্য হচ্ছে।
ব্যাঙ্গালোরে এসে বিরিয়ানির রমরমা দেখে তো পুরো অবাক হলাম। এবং যেরকম আশঙ্কা করেছিলাম, কারিপাতা লাঞ্ছিত, তেঁতুলে উজ্জীবিত - না মোটেই সেরকম নয়। আদৌ নয়। তবে টমেটো একটু বেশিই থাকে আর যেটা অদ্ভুতুড়ে- সেটা হচ্ছে বিরিয়ানির সাথে সাইড ডিশ হিসেবে একটা বিদিকিশ্রি বেগুনের ঝোল দেয়। একটি নিটোল সেদ্দো ডিমও বিরিয়ানির কোলে। কলকাতায় এটা দেখি নি। আরো একটা ব্যাপারও বিস্ময়কর ছিল - বেশ কয়েকটি বিরিয়ানির দোকান রাত দেড়টা দুটো এমন কি সারা রাতও খোলা থাকতো। অথচ সে সময়কার ব্যাঙ্গালোর বেশ অলস শহর ছিল। পাড়ার দোকানগুলো খুলতেই খুলতেই দশটা সাড়ে দশটা বাজাতো। হপ্তায় একদিন বন্ধ থাকতো। রাত্রেও নটা সাড়ে নটায় সব শুনশান। আর সেখানেই মাঝে মধ্যেই "সারা রাত্রি ব্যাপি বিরিয়ানি উৎসব" ও চলতো।। কোল্কাতায় এমনটা দেখিনি। রাত বিরেতে বিরিয়ানি খাবার সখ চাগবেই বা কেনো? কারা খায়?
সে রহস্য জানি না। তবে আরো একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে - কিছু বিরিয়ানির দোকান একবারই খোলে। সেটা ভোর রাতে - এই ধরুন চারটে কি পাঁচটা নাগাদ; ছটা নাগাদ স্টক ফুরিয়ে যায় - আর তারাও ঝাঁপ বন্ধ করে সারাদিনের জন্য। সব থেকে নামকরা এই ধরনের "ভোরের বিরিয়ানি" দোকানটি হসকোটেতে - মানে শহর থেকে প্রায় কুরি কিলোমিটার দূরে। রাত তিনটে/চারটে থেকেই লাইন লেগে যায়। রাতজাগা লোকে ধোঁয়াওঠা বিরিয়ানি খেয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
আর বোলবো কি? ফেসবুক ঘেঁটে দেখুন না, Bangalore Biriyani Club গ্রুপের ছেষট্টি হাজার সদস্য। মাঝে মধ্যেই Biriyani walkও হয়। নিত্য আলোচোনায় রমরম। আর কোথাও আছে না কি এরকম বিরিয়ানি গ্রুপ? সেখানেই এক প্রাজ্ঞ মানুষ জানালেন যে প্রেয়াক্টিকালি প্রতি ৫০ কিলোমিটার হাঁটলেই বিরিয়ানির স্বাদ বদলে যায়। আরে, সে তো হবেই। চিৎপুরে রয়াল থেকে এসপ্লানাডের নিজাম থেকে পার্ক সার্কাসের গোল্ডেন সিরাজ- হাঁটতে হাঁটতেই টেস্ট বদলে যায়।
এক মিনিট - আমার কলকাতার অভিজ্ঞতা কিন্তু তিন দশক আগের তাই এখন যে কলকাতায় শয়ে শয়ে নতুন দোকান হয়েছে সেসবের ততো খবর রাখি না। পুরোনো দোকানগুলোও হয়তো নাম বদলে অন্য কিছু হয়ে গেছে।
দাঁড়ান, যাঁরা আমাকে অলরেডী হাড়ে হাড়ে চেনেন, তাদের কথা আলাদা। বাকীরা জানবেন আমি এক নির্ভীক, সত্যবাদী নিপাট ভালোমানুষ মাত্র। দোষের মধ্যে বড্ডো বেশি বিনয়ী ও নিরহংকারী। এটা কেনো লিখলাম? কেনো কী (মানে as because) আমার খেতে ভালো লাগলেই সেটা ভালো লাগে। ব্যাস,ব্যাস। সেটা বিশুদ্ধ বিরিয়ানী কি না, জজে মানবে কি না, পাণিনি কী বলবেন - এইসব কূট তর্কে আমি যেতে চাই না। পড়ে টড়ে নাক কুঁচকে বলবেন কিন্তু ওটি কি শাস্ত্রসম্মত বিরিয়ানী? সে আমি জানিও না, মানি ও না। ভালো লাগলেই মোক্ষলাভ, না হলে নয়। সে যতোই ঐতিহ্যশালী হোক না কেনো।
খাঁটি বিরিয়ানিতে তো, এমনকি চিকেনও থাকার কথা নয়। আর এখন দেখুন হুলিয়ে বিক্কিরি হচ্ছে ফিস, প্রণ, মাশরুম এমনকি কাঁঠালের বিরিয়ানিও। দাপুটে নির্লজ্জতায় ঢাক পিটিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েই বিক্রি হচ্ছে। তো আপনাদের না পোষালে এগুলোকে বিরিয়ানি বলবেন না। বেশ। বাজে লাগলে কুমড়োপটাশ বলুন, ভালো লাগলে প্রাণেশ্বর। বয়ে গেছে।
তবে কর্ণাটকের বিরিয়ানির তেমন নাম ডাক নেই। দু-একটা লোকাল ভ্যারাইটি তো আছেই, যেমন ডন্নে বিরিয়ানি (শালপাতার ডোঙায় পরিবেষণ করে - সেই জন্যেই ঐ নাম। ডন্নে মানে শালপাতা)। আরেকটা হচ্ছে বিয়ারি (Beary) বিরিয়ানি - গুচ্ছের কাঁচালংকা আর নারকেল দিয়ে রাঁধা হয়। ঝালের ভয়ে কখনো খাই নি যদিও। তবে সেই ভাবে কোনো স্থানীয় ডাকসাইটে ভ্যারাইটি নেই।
কর্ম সূত্রে চেন্নাইতেই বছর তিনেক ছিলেম। ট্যুরে বা বেড়াতে তো বহু বহুবার, কিন্তু গ্যাঁট হয়ে না থাকলে, মানে না বসবাস করলে ঘাঁতঘোত ঠিক মালুম হয় না। ওখানেও বিরিয়ানি দারুন জমজমাট। বহু স্বনামধন্য লোকাল বিরিয়ানি আছে,আম্বুর, ডিন্ডিগুল, চেট্টিনাদ .... ও আরো বেশ কয়েকটা। পুরো দক্ষিণেই বিরিয়ানিতে সচরাচর লম্বা দানার বাসমতী চাল দেয় না। ছোট্টো খুদে চাল (সীরগা সাম্বা রাইস) , কখনো জিরা রাইস (আমাদের গোবিন্দভোগ চালের মতন, তবে অতো সুগন্ধী নয়)। আর মাংসের পিস- কলকাতার সাবেক বিরিয়ানির মতন ঢামসা এবং একটাই পিস নয়। ছোটো করে কাটা অনেকগুলো থাকে।
শেষ করি (সেসময়ের) অন্ধ্র দিয়ে। হাইদ্রাবাদ শহরের প্যারাডাইস তো ভুবন বিখ্যাত। তবে কসমোপলিটান স্বাদ মেনে মোটামুটি কম ঝালের। চাকুরীসূত্রে ছিলাম বছর খানেক। তাই ছোটো শহরের বিরিয়ানিও খেয়েছি প্রচুর- মানে খেতে বাধ্য হয়েছি। বাপরে বাপ। সে যা ঝাল। খাওয়া তো দূরস্থান- প্রাণ নিয়ে ফিরলেই যথেষ্ট।
প্যারাডাইস কিন্তু বিরিয়ানি রসিকেরা ছোঁবেন ও না - তা জনপ্রিয় কোনো কিছুই তাঁদের ভালো লাগে না। এমন কি শারুখ খানকেও না। আশ্চর্য্য ! ভাবুন - চার না পাঁচতলা বাড়ি - একই সাথে হাজার দুয়েক লোক খেতে পারে এবং নিয়মিত খায়ও পাত পেড়ে। একটা ডেলিভারি পয়েন্ট খুলেছে এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে। খুবই স্ট্রয়াটেজিক - লোকে গাড়ী থেকে নেমে কয়েক মিনিটের মধ্যেই অর্ডারী খাবার পেয়ে যাবেন- এবং দারুন প্যাকিং'এ।
আমার লাইফের বেস্ট বিরিয়ানি?
ব্যাঙ্গালুরুর এক বিয়ে বাড়িতে- অবশ্যই খানদানী মুসলিম। ঐ রাঁধুনে শুধুমাত্র বিরিয়ানিই রাঁধেন অ্যান্ড নাথিং এল্স এবং তার জাঁকজমকও চমৎকার। রহস্য শুধুই তার গোপন মসল্লায় নয় (না কি ষাঠ সত্তর রকমের উপাদানে তৈরি), যেটা গেম চেঞ্জার সেটি হছে দুম্বা খাসী। এদের নিতম্বটি চর্বিতে ভরপুর আর দামও সাধারণ খাসীর প্রায় তিনগুন, কখনো আরো বেশি।
যাগ্গে, নানান কিসিমের বিরিয়ানি কম তো খেলাম না- কিন্তু এখনো মনটা হু হু করে। সেই কলকাতার বিরিয়ানি খেয়ে বড়ো হলাম। মনে মনে বলি "আমি বাংলায় কথা কই, গাই বাংলার গান, খাই খাই করি বাংলায় বসে বিহারীর বিরিয়ানি"। ঢাকা খুললেই সেই গোলাব জলের সুঘ্রাণ, এক রসভরা মাংসের স্বাস্থ্যবান পিস, সুদীর্ঘ বাসমতির ব্যাক্তিত্বময় নিজস্বতা ও স্বর্ণাভ দ্যুতি, মশলার মৃদু সুবাস আর আলু ? এক নিটোল উপস্থিতি- যেনো পথভোলা এক মাখনের দলা।
তাও শেষ করি এক ট্র্যাজিক অভিজ্ঞতা দিয়ে।
ব্যাঙ্গালোরে দিব্বি কোলকাতার বিরিয়ানি পাওয়া যায়। নিজাম, লাজীজ, আর্সেনালের ব্রান্চ আছে। এ ভিন্ন নানান বিরিয়ানির দোকান বা ক্লাউড কিচেনে "কোলকাতার বিরিয়ানি" পাওয়া যায়। তো, সেরকমই একদিন "ক্যালকাটা বিরিয়ানি" এনে খাওয়ালাম আমার মেয়ের বন্ধুকে। সে মালয়ালী তরুণ এবং খুবই লেফট লিবেরাল। অবশ্যই দাড়ি আছে , টাট্টূ আছে আর কানে দুলও পরে।
দু এক চামচ বিরিয়ানি মুখে দিয়েই সে তো আর্ত্তনাদ করে ওঠে। "ঈক্কি,ঈক্কি? বিরিয়ানি কই? এ তো একটা হলদেটে ভাতে এক পীস সেদ্দো মাংসো দিয়েছে"। তার অনুযোগ শেষই হয় না, "মশল্লা নেই, ঝাল নেই। আবার ঐ দ্যাখো, একটা আখাম্বা হোঁত্কা আলুও দেছে। ইইঃ, কীরম আবার ভুরভুরিয়ে গন্ধো বেরোচ্ছে দ্যাখো যেন গোলাপ বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছি। হিপোক্রিট"। রাগে, ক্ষোভে তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে।
আমরাও খুব অনুতপ্ত বোধ করি। পরিতাপে দগ্ধ হই। মুখ ফুটে বলতেও পারি না, বছর দশেক আগে কোভালামের নাম করা হোটেলে অথেন্টিক মালাবারী বিরিয়নি মুখে দিয়েই আঁৎকে উঠেছিলাম।। নারকেল তেলের গন্ধে ভরপুর- খাচ্ছি না স্নান করছি? এটা ডাইনিং হল না বাথরুম? সেই থেকে আর কখনোই কেরলের বিরিয়ানি খাওয়ার চেষ্টাও করি নি।
তাই, ঐ যে কইলাম- পসন্দ আপনার নিজের নিজের। ব্যাকরণ মেনে কি আর খাওয়া এনজয় করা যায়?