তাই আজ আমাকে আসতে হয়েছে। না এসে উপায় ছিল না।
চারদিন আগে পর্য্যন্ত উনি রোজ রায়পুরের আম্বেদকর হাসপাতালে আমাকে দেখতে গেছেন। ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে কথা বলেছেন। হাসপাতালের সমস্ত বিল চোকানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
আজ উনি আমাকে রায়পুর থেকে বিলাসপুর নিয়ে আসার জন্য পুলিশ বিভাগ থেকে একটি গাড়ি ঠিক করে দিয়েছেন।
সাদা রঙের মারুতি জিপসি। তাতে করে দেড় ঘন্টায় বিলাসপুর পৌঁছে গেলাম। গাড়ি আমাকে স্যারের “ওয়াচ অ্যান্ড সিকিউরিটিজ” অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ভেতরে ঢুকতে গিয়ে টের পেলাম এখনও শরীর পুরোপুরি সারেনি। পা একটু যেন টলমল করছে।
ভেতরে যেতে গিয়ে চাপরাশি দামলের সঙ্গে মুখোমুখি। এমন ভাবে তাকালো যেন ভূত দেখছে।
আমি সামান্য হেসে বললাম- কোসলে স্যার আছেন? আসতে বলেছিলেন।
ও ধরা গলায় বলল— ভেতরে যান ভাইয়া।
ভেতরে গিয়ে আরেক বার ধাক্কা খেলাম।
বেলা সাড়ে এগারটা। কিন্তু সিমরন ওর টেবিলে কম্পিউটারের সামনে বসে নেই।
তবে ওর চেয়ার খালি নেই। সেখানে বসে একটি মেয়ে কম্পিউটারে দ্রুত কিছু টাইপ করছে।
আমি হলঘরে পা রাখায় ও আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর নিজের কাজে ডুবে গেল।
সোনালী মিশ্র।
আমি কোনরকমে টেবিলের একটা কোনায় হাত রেখে নিজের ব্যালান্স সামলে নিলাম।
শুকনো গলায় বললাম –স্যার কোথায়?
--একটু কাজে বেরিয়েছেন, এই এলেন বলে।
--সিমরন?
--জানি না।
মাথাটা একটু একটু ঘুরতে শুরু করেছে। আমি ধপ করে কাছের চেয়ারটায় বসে পড়ে একটু হেলান দিয়ে চোখ বুজলাম।
বন্ধ চোখের পাতায় গত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো ফার্স্ট ফরওয়ার্ড হতে লাগল।
অগ্নিকুণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাল মহম্মদের চোখ রাগে কুঁচকে গেছে।
আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘এটা কী কোন মির্যাকল নাকি যে আজ যেখানে ‘নয়া খাই’ উৎসবের সময় আমাদের লোক এককাট্টা হয়েছে সেখানেই পুলিশ পৌঁছে গেছে?
আর এত বড় বিরাট ফোর্স, মানে ওদের কাছে কিছু পাক্কি খবর ছিল। কে খবর দিল?
এটা কোন রুটিন টহলাদারি টুকড়ি নয়। তাহলে খবর কী করে ওদের কাছে গেল?
তোমার কী মনে হয়, কমরেড?
এবার প্রশ্নটা সোজাসুজি সোনালীকে।
সোনালী বেশ চিন্তায় পড়েছে।
--দেখিয়ে কমরেড লাল। আজ ঢের সারে লোগ আয়ে থে। সঙ্ঘম তো বটেই, কয়েকজন দলমের লোককেও চিনতে পেরেছি। এদের অনেকের কাছেই মোবাইল আছে।
আর ওদের মধ্যে কেউ ধরা পড়েনি। রেইডের আগেই সরে গেছে।
তাহলে এইমুহুর্তে কী করে বলা যাবে যে কে সিকিউরিটি ফোর্সকে খবর পাঠিয়েছে?
এর জন্য সময় নিয়ে তদন্ত করা দরকার। নইলে জাঁতাকলে গমের সাথে ঘুণপোকাও পিষে যাবে।
লাল চুপ করে অসীম মনোযোগে কিছু ভাবছে।
তারপর বলল—দেখ, খবরটা কী করে গেল সেটার সম্ভাবনা একটা একটা করে খুঁটিয়ে দেখে নাও। তাহলেই বোঝা যাবে কে বা কারা খবর পাঠাতে পারে।
আমরা সবাই আগুনের সামনে বসে পড়ি।
একটা লোক আগুনে চড়ানো হাঁড়িতে হাতা নাড়ছিল। তারপর একটু খাবার তুলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে খানিকটা ঠান্ডা করে চাখতে লাগল।
শরতের শেষ। টিলার উপরে খোলা পরিবেশে হাওয়ায় একটু হিমেল ভাব।
আমাদের সবার সামনে এলুমিনিয়ামের মগে করে খানিকটা মহুয়া ঢেলে দেওয়া হল। সঙ্গে এল শালপাতার দোনায় তিনটুকরো করে মাংস।
দিয়ে গেল সেই লোকটা, যে রান্না করছিল—কমরেড মহীপাল, যাকে কিছুদিন আগে টাঙি হাতে এগিয়ে আসতে দেখেছিলাম। ও কি লাল মুহম্মদের বডিগার্ড?
আমার ইতস্ততঃ ভাব দেখে সোনালী বলে—ওষুধ ভেবে একটু একটু করে খেয়ে নিন। শীতের ভাবটা কেটে যাবে।
আমি আদেশ পালন করি।
কিন্তু আমার শীতভাব কাটে না। কারণ সেটা শরীরে নয়, আমার একেবারে ভেতরে সেঁধিয়ে গেছে। ভয়ের আর রান্না মাংসের গন্ধ কেমন মিলে মিশে যাচ্ছে।
সবার খাওয়া প্রায় শেষ, মহীপাল কিন্তু মহুয়া একটু বেশি খাচ্ছে। হঠাৎ ও হেসে উঠল।
সবাই ওর দিকে তাকাচ্ছে দেখে কোনরকমে হাসি সামলাতে গিয়ে ওর হেঁচকি উঠে গেল।
কমরেড লাল বেশ বিরক্ত, হচ্ছেটা কী?
মহীপাল বলল—একটা মজার কথা মনে পড়েছে কমরেড।
শিক্ষাকেন্দ্রের দিকে ট্রান্সফর্মার আছে, বিজলী আছে, ইন্টারনেট আছে। কিন্তু সোনালী দিদি আর এই লোকটা যে পথ ধরে সুকমা এসেছে সেদিকে অন্ততঃ তিরিশ কিলোমিটার জুড়ে কোন বিজলী খাম্বা নেই, ইন্টারনেট নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।
তাই পুলিশের কাছে খবর যায়নি, মানে যেতে পারে নি। কিন্তু দিদির গাড়ি যেই শিক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছল, তার তিনঘন্টার মধ্যে সিকিউরিটি ফোর্সও পৌঁছে গেল।
সোনালী খেপে গেল।
--বোল ক্যা রহে হো কমরেড? আমি পুলিশকে ডেকে এনেছি?
--আরে না না দিদি। সওয়াল হী নহীঁ। প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আপনার এই সঙ্গীটির আচরণ সন্দেহজনক।
--আচ্ছা! কিন্তু ও খবরটা দিল কীভাবে?
--সেটাই তো কথা দিদি! ওর কায়দাটা বুঝতে পারলে ওকে কী আর বসিয়ে খাওয়াতাম?
কখন সামনের নিমগাছের ডাল থেকে লটকে দিতাম। তবে ওর সঙ্গে তো মোবাইল আছে। নেট ওয়ার্ক পেয়ে গেলে--
লাল মহম্মদ হাত তুলে ওকে থামিয়ে দেয়।
-
-ছোটে জাসুস! তোমার মোবাইলটা দাও তো দেখি।
আমার হাত পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে।
নতুন হ্যান্ডসেট, তাতে কোসলে স্যার ট্র্যাকার লাগিয়ে দিয়েছেন। এরা কি সেটা বুঝতে পারবে?
আর পারলে –শুনেছি পুলিশের খোচরদের মাওবাদীরা মারার আগে বড় যন্ত্রণা দেয়।
--কী হল! বের করে দাও। ভয় পাচ্ছ কেন?
আমি অবশ হাতে কোনরকমে নতুন মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে এগিয়ে দিই।
কমরেড লাল ওটা নিয়ে উলটে পালটে দেখে।
--‘এটা তো একটা আনকোরা নতুন হ্যাণ্ডসেট দেখছি, হুম্ । আগেরটা ছিল সাদামাটা নোকিয়া, এটা তো স্মার্টফোন! ছবি তোলা যায়। কী ব্যাপার! হঠাৎ নতুন ফোন? বেশ দামি। কে কিনে দিল বাবুমশায়?
দাঁড়াও, আরেকটু দেখি। আরে, বেশ কিছু ছবি তুলেছ দেখছি।
উম্ দন্তেওয়াড়া, বীজাপুর, সুকমা, সলওয়া জুড়ুম ক্যাম্প। শিক্ষাকেন্দ্রের বোর্ড লাগানো? কী ব্যাপার? এই ছবিগুলো কোথায় পাঠাচ্ছ? ইরাদা ক্যা হ্যায়?
তোমার মতলবটা কী খুলে বলত’?
ছোটবেলায় দেখা একটা স্বপ্ন আবার দেখছি।
আমি জলে ডুবে যাচ্ছি, সাঁতার জানি না। আশেপাশে কেউ নেই। প্রাণপণে জল খেয়ে একবার ঘাই মেরে জলের উপর উঠতে চেষ্টা করি।
--বিশোয়াস কীজিয়ে, কিসীকো নহীঁ ভেজা। কাউকে পাঠাইনি, আপনারা নিজেরাই সেন্ট ফাইল চেক করুন, হোয়াটস অ্যাপ চেক করন।
লাল মহম্মদ আমার মোবাইলটা মহীপালের দিকে বাড়িয়ে দেয়। দেখ তো, কোথাও কিছু লোচা আছে কিনা।
মহীপালের চেহারায় উল্লাস ফেটে পড়ছে।
--কমরেড, এ এক নম্বর হারামী। এই দেখুন, এর ডাবল সিম রয়েছে। একটাতে নিশ্চয়ই ট্র্যাকার লাগানো রয়েছে।
তাই ও যেখানে যায় সেখানে ওর পিছে পিছে ফৌজ ভী আ জাতে।
বাহ রে হোঁশিয়ারচন্দ! ক্যা দিমাগ! বুদ্ধি আছে বটে!
ঠহরিয়ে , মুঝে বাকি চীজ চেক করনে দীজিয়ে। ফির ইসকী খাটিয়া খড়ি করতা হুঁ। ব্যাটাকে এখানেই খাটে তুলছি।
সোনালী বিরক্ত হয়েছে।
--শুনুন, কমরেড লাল মুহম্মদ। উইথ ডিউ রেস্পেক্ট, একটা কথা বলি। ছেলেটা জীবনে প্রথম স্মার্ট ফোন হাতে পেয়েছে। ওর আগের ফোনে কোন ক্যামেরা ছিলনা। মনের আনন্দে কিছু ছবিছাবা তুলেছে। নতুন খেলনা হাতে পেয়ে বাচ্চারা যা করে।
এর মধ্যে অস্বাভাবিক কী দেখছেন? আপনাদের কারও ফটো থোড়ি তুলেছে?
--কমরেড সোনালী, এই ঢিলেঢালা মনোভাব, এই অতিরিক্ত লিবারেলিজম আমাদের ক্ষতি করে। এ’বছর গড়চিরৌলির হামলায় কী বিরাট ক্ষতি হল! ওরা আমাদের গড়ের মধ্যে ঢুকে মেরে দিয়ে গেল। এসবের মূলে ওই ঢিলেঢালা মনোভাব।
সোনালী চুপ করে যায়। তারপর মহীপালের দিকে তাকায়। কী হল? কিছু পেলে?
মহীপাল কিছু বলে না। একমনে মোবাইলটা খুলে আবার লাগায়। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছায় বলতে থাকে—না, কোন ফোটো বা মেসেজ কোথাও পাঠায়নি।
একটাই কল দেখছি কাল রাতে, সেটা সোনালী দিদিকে।
--হ্যাঁ, রাতে পুলিশের বড়কর্তা সার্কিট হাউসে আসায় ওকে মালপত্তর শুদ্ধ বের করে দিয়েছিল। তখন আমাকে ফোন করেছিল।
দেখুন কমরেড, আবারও বলছি। বাইরের লোকের কথায় স্রেফ সন্দেহের বশে কমরেড লোকেশকে এলিমিনেট করে দেওয়া হল।
লাভ কী হল? বিলাসপুর ইউনিট ধ্বংস হয়ে গেল। ওই ঝারখণ্ডের রেনেগেড পাসোয়ান আসলে আমাদের বোকা বানিয়ে বিলাসপুর দখল করে নিল।
--তুমি কী বলতে চাইছ লোকেশ পুলিশের মোল ছিল না? তাহলে কে সেন্ট্রাল কমিটি মেম্বার বিক্রমের বিলাসপুরের দিকে মুভমেন্টের খবর পুলিশকে দিল?
--অনেকে দিতে পারে। সেই ডাবল এজেন্ট কিস্টাইয়া কি যথেষ্ট নয়? এখনও শুধু সন্দেহের বশে আপনি একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন? কোন এভিডেন্স নেই তবু--
সোনালী রাগে এবং হতাশায় হাত ঝাঁকায়।
মিনিট খানেক কেউ কথা বলে না।
এমন সময় আবার মহীপাল মাথা তোলে। শান্ত স্বরে বলে—এভিডেন্স পেয়েছি। বড় জোরদার এভিডেন্স। এটা দেখলে দিদিও মানতে বাধ্য হবেন। এই দেখুন।
ও উঠে এসে লাল মুহম্মদের হাতে মোবাইলটা তুলে দেয়। তাতে আমার ফটোর অ্যালবামের অ্যাপ খোলা।
--দেখুন কমরেড, একে চিনতে পারছেন?
লালের চোখ বড় বড়।
--একী? এ তো চেতরাম অটামী। এর জন্যে আমরা কবে থেকে তক্কে তক্কে রয়েছি।
--হ্যাঁ, কমরেড। এ হল চেতরাম অটামী। আমরা মহেন্দ্র কর্মাকে শেষ করার পর এই হচ্ছে সলওয়া জুড়ুমের স্পেশ্যাল পুলিশ ফোর্সের চিফ কম্যান্ডার ।
আমাদের লিস্টে এর নাম সবচেয়ে ওপরে।
আরও দেখুন, এ ব্যাটা চেতরামের সঙ্গে বৈঠক করেছে কাল বিকেলে, ছবি তোলার টাইমটা খেয়াল করুন।
--সোনালী, আর কিছু বাকি আছে ? বেশ, আগে ফটো দেখে নাও।
সোনালী কিছু বলে না। এক নজরে দেখে নিয়ে মোবাইল ফেরত দিয়ে দেয়। একবারও আমার দিকে তাকায় না। মনে পড়ল, কাল ও আমাকে সাবধান করেছিল—চেতরাম অটামীর সঙ্গে বসে চা খেলেন? ভাল করেন নি। দেয়ালেরও কান আছে।
--হুঁ, ছোটে জাসুস। কাল অটামীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলে? আর আজ পেছনে পুলিশ নিয়ে ঘুরছ? এই তোমার রিসার্চ? আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল।
ওর গলার স্বর খাদে নেমে আসে।
--কী কথা হয়েছিল ওই কুত্তাটার সঙ্গে। বলে ফেল।
--আমি জীবনে ওই নামের কাউকে জানতাম না। বড় হয়েছি মানা ক্যাম্পে আর বিলাসপুরে। বস্তারে কখনও পা রাখি নি। আপনি বিশ্বাস না করুন, এই রিসার্চটা আমি মন দিয়ে করছিলাম। ভাবছিলাম, যদি এখানে পার্মানেন্ট করে দেয়।
--তাহলে বেছে বেছে ওর সঙ্গেই দেখা করে ফটো খিঁচলে কেন ?
এবার আমার ভেতরে সেই পুরনো রাগ বমির মত ঠেলে উঠতে থাকে।
--শুনুন কমরেড, আপনি বা আপনার চ্যালা কী ভাবছে তাতে আমার কিস্যু এসে যায় না। আমি সলওয়া জুড়ুম সেন্টারে ঘুরে ঘুরে ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম।
একটা বাড়ির সামনে কিছু আর্মড গার্ড দেখে সরে যাচ্ছিলাম, লোকটা খাটিয়া থেকে উঠে আমায় ডেকে বলল—আমারও ইন্টারভিউ নিন, নইলে আপনার রিসার্চ একতরফা হয়ে যাবে। তখন
আমি ওর কথা শুনে নোটস নিয়েছি, তারপর ওর অনুরোধে ফটো তুলেছি।
লাল আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
তারপর সোনালীকে বলে—সবগুলো ঘটনা একসাথে এবং পরপর ঘটছে, এগুলোকে নেহাৎ সমাপতন বলে মেনে নেব?
দেখ, কাল বিকেলেই সলওয়া জুড়ুম দলের কম্যান্ডারের সঙ্গে ওর বৈঠক হয়। আবার কাল রাত্তিরেই দন্তেওয়াড়ার সার্কিট হাউসে বাইরে থেকে আসা পুলিশের স্পেশাল বাহিনীর বড় কর্তার সঙ্গে ওর বৈঠক হয়।
আর আজ সন্ধ্যেয় ঘন জঙ্গলের মধ্যে সুকমার শিক্ষাকেন্দ্রে পুলিশ হানা দেয়। এবং ও রওনা হওয়ার ঠিক আধাঘন্টা পরে।
এসবের মধ্যে কোন যোগ নেই বলতে চাও?
--আমি পুলিশের বড় মেজ কোন কর্তার সঙ্গে কাল বৈঠক করি নি। ওরা আমাকে বের করে দিয়েছিল। তারপর আমি সোনালীকে ফোন করি। আমার আর ওর কল লিস্ট চেক করুন।
আমি এবার মরিয়া। ভয় পেয়ে মাথা খুলছে, উকিলের মত যুক্তি সাজাচ্ছি।
--সোনালী, তুমি যখন ওকে সার্কিট হাউসের সামনে নামিয়ে দিলে আর ও যখন তোমাকে ফোন করল তার মধ্যে সময়ের ফারাক কতখানি? কল লিস্ট দেখে বল।
সোনালীর নিরাসক্ত জবাব এল—পনের মিনিট।
--হুঁ, এটুকু ছোটে জাসুসকে অর্ডার দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বড়কর্তা তো ওকে অর্ডারই দেবে, নাকি ওর সঙ্গে গম্ভীর মন্ত্রণা করবে?
কমরেড মহীপাল , এর হাতদুটো শক্ত করে বাঁধ, পিছমোড়া করে --- পালাতে না পারে।
তারপর আমি দেখছি কী করে ওর পেট থেকে কথা বের করতে হয়। মেরে ফেললে ক্লু হারিয়ে যাবে।
মহীপাল ঠিক এরকম কিছু আশা করছিল। একটা লতামত দিয়ে বেশ শক্ত করে বাঁধল, হাতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি শেষ চেষ্টা করি।
--কমরেড লাল, একটা কথা ভাবুন। আমি যদি পুলিশের লোক হতাম আর কোন প্ল্যান করে কাল ওই অটামি না কী, ওর সঙ্গে দেখা করতাম, তাহলে কি মোবাইলে ওর ছবি তুলে আপনার হাতে অমন মোক্ষম প্রমাণ তুলে দিতাম?
আপনারা তো জানতেও পারতেন না।
লাল আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর ভুরু কুঁচকে উঠেছে।
আমার সাহস একটু বেড়ে যায়।
--আর পুলিশের কেউ হোমরা চোমরা সার্কিট হাউসে এসে উঠেছে এসব না বলে যদি সোনালীকে বলতাম যে কোন সরকারী আমলা এসেছে। সেইজন্যে আমাকে আগের কথামত ঘর খালি করে দিতে হচ্ছে—তাহলে আপনারা আমাকে আজ এত কথা শোনাতে পারতেন?
মহীপাল চেঁচিয়ে ওঠে।
--কমরেড, ওর লচ্ছেদার ডায়লগবাজিকে পাত্তা দেবেন না।
আমি সমান জোরে চেঁচাই—চুপ! একদম চুপ! পহলে বাত পুরা করনে দো! ফির ভোঁকতে রহেনা।
আগে আমার কথা শেষ হোক, তারপর যত খুশি ঘেউ ঘেউ কর গে’।
--কী বলতে চাস, বলে ফেল।
লাল মহম্মদের গলার আওয়াজ নীরস কর্কশ। আমি ইশারায় এক গেলাস জল চাই। লাল একটা বোতল এগিয়ে দেয়। আমার হাত খোলা হয় না।
মহীপাল অবজ্ঞার সঙ্গে বোতল খুলে আমার মুখে ধরে। অনেকটা জল বাইরে পড়ে যায় , আমার শার্টের সামনে ভিজে যায়।
আমি গলা ভিজিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে নিই। আড় চোখে দেখি এই শ্যারাডে ক্লান্ত হতাশ সোনালী আনমনে নিজের রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এবার বড় তাস খেলি।
--‘দেখুন, প্রথমে ভাবলেন স্মার্টফোন কেন? তারপরে ডাবল সিম, মেসেজ, ছবিছাবা আর ট্রেকার।
খোঁজাখুঁজি করে কী পেয়েছেন? নতুন ফোন কেনায় দোকান থেকে ‘এক খরিদ নে পর দো’ স্কীমে দ্বিতীয় সিম ফাউ দিয়েছে। আমি ব্যবহারই করি নি। পরে হয়তো করব।
ছবিগুলো নির্দোষ দৃশ্য, কিছু আমার স্টাডির জন্য জরুরি। আমি যে ঘরে বসে রিসার্চ করি নি তার প্রমাণ। ওগুলো রিপোর্টের সাথে জমা দিতে হবে, নইলে অফিস আমার বিল পাস করবে না’।
লাল মুহম্মদের মুখের ভাব একটু নরম। বলগুলো ঠিকঠাক খেলেছি। আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে।
আমি এবার স্টেপ আউট করে সিক্স মারতে চেষ্টা করি।
-‘আর আমার ফোনে ট্রেকার থাকায় যদি পুলিশ আসছে বলে আপনাদের মনে হয় তাহলে এতক্ষণে তো এখানেও এসে যেত। আমরা আপনাদের ডেরায় আসার পর প্রায় তিনঘন্টা হয়ে গেছে।
কিন্তু লাইন মিস করলাম, ক্লীন স্টাম্পড্!
ঘন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার কাঁপিয়ে বেজে উঠেছে হুইসল, সামনে থেকে । না , ডানদিক থেকেও। তারসঙ্গে গুলির আওয়াজ।
দ্রুত পেছনের কামরা থেকে বেরিয়ে আসে দুটো ইনশাস রাইফেল এবং একটি পিস্তল। সোনালী পিস্তল তুলে নিয়ে আমার দিকে তাক করে।
আমি চোখ বুজে ফেলি।
--নো, আওয়াজ শুনলে পুলিশ আমাদের পজিশন টের পেয়ে যাবে। এখন নয়।
অনেকগুলো পায়ের শব্দ এদিকে দৌড়ে আসছে।
এরা চটপট বাড়ির আড়ালে গিয়ে পজিশন নেয়।
কিন্তু দৌড়তে দৌড়তে এসেছে দুটো অল্পবয়েসি ছেলে, ওদের হাতে মাস্কেট। ওরা আগুনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে, হাঁফাতে থাকে, এদিক ওদিক তাকায়।
--কমরেড লাল, আপনি কোথায়? সর্বনাশ হয়ে গেছে। দুশমন জবরদস্ত হামলা করেছে। সামনে আর ডানদিক থেকে। টিলার উপর পয়েন্ট থ্রি পজিশনে ওরা পৌঁছে গেছে। হিড়মা মারা গেছে। টেকাম একটা দিক ঠেকিয়ে রেখেছে। আমাদের এই পজিশন ছাড়তে হবে।
লাল হুকুম দেয়।
--সোনালী, তুমি বাঁদিক দিয়ে বেরিয়ে যাও, মনে হচ্ছে ওদিকে পুলিশ নেই। ১০০ গজ দূরে কোসম গাছের নীচে একটা বড় গর্ত কেটে রাখা আছে, ইস শালে কো লেকর ওহি দুব জাও। ঘাপটি মেরে থাক।
আমরা পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। লাল সেলাম!
সোনালী কোন কথা বলে না। ও আবেগে থর থর করে কাঁপছে। সোজা গিয়ে লাল ও মহীপালকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে।
ডানদিকে বেশ কাছ থেকে গুলির আওয়াজ। ওরা চমকে উঠে আলাদা হয় এবং অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
আমার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, চলতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সোনালী আমার শার্টের সামনেটা খিমচে ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কানের কাছে ফিস ফিস,-- যা বলছি মেনে চল, কোনরকম চালাকি করলে মরবে।
গুলির শব্দ আরও কাছে, তার সঙ্গে অনেকগুলো জোরালো টর্চের আলো। সোনালী আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়, নিজেও পাশে শুয়ে পড়ে। দশ মিনিট হবে, গুলির শব্দ দূরে সরে গেছে।
এবার কী করব?
আবার কি ইঁদুরকলে আটকে পড়লাম? আমি একটি আধা সরকারি সংস্থার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমি যদি পুলিশের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিই? আমার কোন ক্ষতি হতে পারে না। রায়পুরে ডায়রেক্টর এবং বিলাসপুরে পুলিশের শ্রীবাস্তব স্যার, কোসলে স্যার আমার সাক্ষী।
আমি কেন মাওবাদী সোনালীর সঙ্গে ধরা পড়ব?
আমি উঠে পড়ি। অন্ধকারে সরে যাব, দৌড় লাগাবো? হাত যে বাঁধা! চেষ্টা করতে দোষ কি ? কিন্তু তার আগেই মাথায় একটা শক্ত জিনিসের বাড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাই।
অন্ধকার, বড় অন্ধকার। ভেতরে বাইরে সর্বত্র।
ডিজেলের পোড়া গন্ধ এবং ঝাঁকুনির চোটে জ্ঞান ফিরল।
জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটা খোলা ট্রাক ছুটে চলেছে, রাস্তাটা এবড়ো খেবড়ো পাথুরে।
আমি উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। চিৎ হতে চেষ্টা করি, , সে হবার নয় । কারণ আমার হাত এখনও পিছমোড়া করে বাঁধা।
তবে চোখ পুরো খুলতে পারছি। একটা অপরিচিত আঁশটে গন্ধ । গা গুলিয়ে উঠছে। সোনালী কোথায়?
টের পাই , আমার পাশে আরও কয়েকজন শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে? নাকি আমার মতই জ্ঞান হারিয়েছে। তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে।
গড়িয়ে পাশ ফেরার চেষ্টায় একজনের শরীরের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। ওর জামায় আমার নাক ঘষে গেল আর গা গুলিয়ে উঠল। বরফের মাছের মত উত্তাপহীন ঠান্ডা শরীর।। রক্তে ভেজা জামায় ঠিক মাছের বাজারের আঁশটে গন্ধ।
বমি উঠে আসছে, আবার উপুড় হবার চেষ্টায় হড় হড় করে খানিকটা বমি বেরিয়ে এল। অনেকটাই আমার গায়ে।
আবার জ্ঞান হারালাম।
এটা সেই দন্তেওয়াড়ার সার্কিট হাউস যেখান থেকে আমার জিনিসপত্র বের করে দেওয়া হয়েছিল। এখন ভরা দুপুর। রৌদ্রে ভেসে যাচ্ছে বারান্দা। চারদিকে অনেক ফটোগ্রাফার, প্রেসের লোকজন।
সমানে খচাখচ ছবি উঠছে।
আমি এবং সোনালী দেওয়ালে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে আছি। আমার হাত আর দড়ি দিয়ে বাঁধা নেই। কিন্তু দুজনেরই হাতে হাতকড়া। দুজনেরই গায়ে সবুজ রঙা পোশাক।
মনে পড়ল, সোনালী বলেছিল না যে একযাত্রায় পৃথক ফল হবে না।
বুঝতে পারলাম যে আমরা নই, ফটোগ্রাফারদের আসল লক্ষ্য আমাদের থেকে দশ ফুট দূরে বারান্দায় শোয়ানো তিনটে বডি।
তড়িঘড়ি একটা প্রেস কনফারেন্স শুরু হচ্ছে। বডিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে তিনজন ভারিক্কি চেহারার পুলিশ অফিসার। একজন অল্পবয়েসি মাইকে অনেক কিছু বলে চলেছে। আমার মাথায় কিছুই রেজিস্টার হচ্ছে না।
এবার প্রশ্নোত্তরের পালা।
একজন জিজ্ঞেস করল আপনারা দাবি করছেন যে এই এনকাউন্টারে কুখ্যাত মাওবাদী নেতা বিক্রম ওরফে লাল মহম্মদ ওরফে অমুক ইত্যাদি দু’জন সঙ্গী সমেত মারা গেছে।
ভাল কথা, বডি শনাক্ত করেছে কে? যতদূর জানি, আপনাদের ডোসিয়ারে বিক্রম ওরফে লাল মহম্মদের কোন ফটোগ্রাফ ছিল না। তাহলে?
অল্পবয়েসিটি একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে তার বসের দিকে তাকায়।
তিনি বোকা ছাত্রের প্রশ্ন শুনে বিজ্ঞ মাস্টারমশায়ের মতন হাসেন এবং বলেন—আপনাদের সামনে ফের বডি শনাক্ত করিয়ে দিচ্ছি। এই যে দুজন মাওবাদী এনকাউন্টারের সময় সারেন্ডার করেছে ওরাই আপনাদের সামনে আবার বলবে।
উনি আমাদের দিকে ফেরেন—সোনালী , সত্যি কথা বল। তাহলে তোমার কেস সরকার একটু নরম ভাবে বিবেচনা করবে। এই বডিটা ওর চেহারা ভাল করে দেখ। সাংবাদিকদের সামনে বল—একে চিনেছ?
--হ্যাঁ।
--এটা কার বডি?
সোনালীর ক্লান্ত নিরাসক্ত উত্তর—কমরেড লাল মুহম্মদের। এবার আমার হ্যান্ডকাফ খুলে দিন। বাথরুমে যাব।
দুজন মহিলা পুলিশ ওর হ্যান্ডকাফ খুলে ওকে নিয়ে চলে যায়।
এবার আমার পালা।
--আমি মাওবাদী নই, আমি সৌরভ বিশ্বাস, রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমার মাথায় বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। হাত খুলে দিন।
উনি হাসেন। --হ্যাঁ, ধরা পড়লে সবাই অমন বলে। তোমার হাত খুলে দিচ্ছি। কাছে এসে ভাল করে দেখে বল একে চেন কিনা?
তারপর তোমাকে রায়পুরের বড় সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। তুমি সেরে উঠবে। এবার ভাল করে দেখে সত্যি কথাটা বল।
আমি চাদর সরিয়ে ভাল করে তাকাই।
বাঁ দিকের চোখটা খুবলে নেওয়া হয়েছে। বুকে তিনটে ছুরি বা বেয়নেটের ক্ষত। কিন্তু চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না। মুখটা খোলা, মাছি উড়ে আসছে। তবে ঝকঝকে সাদা দাঁত যেন হাসছে।
--হ্যাঁ, ইনি কমরেড লাল মুহম্মদ।
একজন সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করে—বিক্রম নয়?
--আমি এনাকে লাল মুহম্মদ নামেই জানি।
সাংবাদিকেরা নিশ্চিন্ত, ওরা জানে যে বিক্রম এবং আল মহম্মদ একই ব্যক্তি।
অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন বেজে উঠছে।
পরের দিন রায়পুরের হাসপাতালের বিছানায় যখন চোখ খুললাম দেখি আমার বিছানার পাশে বসে আছেন কোসলে স্যার।
--কেমন লাগছে রে? খেল দেখালি বটে! আরেকদিন এখানে থাক। পরশু সকালে ডিসচার্জ করে দেবে।
আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি সকাল ১১টা নাগাদ বিলাসপুরে আমার অফিসে চলে আসবি।
বসে আছি আধাঘন্টা হল। কোসলে স্যার এখনও এলেন না? বড্ড জল তেষ্টা পাচ্ছে। সোনালী প্রিন্ট আউট বের করে কম্পিউটার বন্ধ করে দেয়।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে—কেমন আছ?
--জল খাব।
ও উঠে গিয়ে এক গেলাস জল নিয়ে আসে। আচ্ছা, আগেও কয়েকবার আমাকে এমন জল গড়িয়ে দিয়েছিল না? কোথায় যেন!
--এটা কী লিখছিলে?
--ভোপালে একটা ইউনিতে ফেলোশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করছি। ওখানে একটা এনজিওতে কাজ জুটিয়ে নিয়েছি। ছত্তিশগড়ে আর নয়।
--কেন ?
সোনালী কিছু বলার আগেই হাঁক ডাক করে ঘরে ঢুকে পড়েছেন কোসলে স্যার, দলগঞ্জন সিং কোসলে, ওয়াচ অ্যান্ড সিকিউরিটির মালিক।
--তোদের দুজনকে দেখে যে কী ভাল লাগছে? কী খাবি বল? আর আজকে তোদের সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। তাই সিমরনকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। এখন কেমন আছিস, সৌরভ? কবে নাগাদ জয়েন করতে পারবি?
আমি একটু কষ্ট করে হাসি। এখনও দুর্বলতা পুরোপুরি যায় নি।
--ঠিক আছে, ঠিক আছে। আরও পনের দিন ছুটিতে থাক, উইথ ফুল পে।
সত্যি, তোরা দু’জন যা করলি! তোদের জন্যেই অমন একটা কঠিন অপারেশন সম্ভব হল।
আর সোনালি, তুই আমার এখানে জয়েন করবি তো বল। কাজ বাড়ছে, ট্যালেন্টেড লোক চাই।
সোনালী কোন উত্তর দেয় না।
জগন্নাথ দামলে কফির থার্মোফ্লাস্ক, তিনটে কাপ এবং বেকারির বিস্কুট টেবিলে রেখে যাবার সময় দরজাটা ভাল করে ভেজিয়ে দিয়ে যায়।
কোসলে স্যারের চেহারা এবং গলার স্বর পালটে গেল।
একবার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে উনি শুরু করলেন—শোন, দন্তেওয়াড়ায় প্রেস মিটের সময় তোরা দুজন বিক্রম উর্ফ লাল মুহম্মদের বডি আইডেন্টিফাই করেছিলি না? ওটা বেশ বড়সড় করে দন্তেওয়াড়ার লোক্যাল নিউজ পেপারে বেরিয়ে যায়।
কিন্তু তারপরেই বাঁধল ঝামেলা।
পরের দিন একতা পার্টির পাসোয়ান মর্গে এসে বডি দেখে উত্তেজিত। বলল— সাহেব, মস্ত ভুল করেছেন, এটা বিক্রমের বডি নয়।
ও আই জি সায়েবকে বলল –বডিটা একেবারেই লাল মহম্মদ বা বিক্রমের নয়। আমি ওকে কোলকাতা থেকে চিনতাম, ভাল বন্ধু ছিলাম। ওর লাল মহম্মদ নাম আমিই দিয়েছিলেম। কারণ ওর মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় ফাইমোসিস হয়েছিল। ফলে সার্জিক্যাল অপারেশন করাতে হয়েছিল, একেবারে সুন্নতের মত। তাই মজা করে মুসলিম নাম দিলাম। সেটা পরে পুলিশকে কনফিউজ করতে কাজে লেগেছিল।
আজ ও আপনাদের আবার বোকা বানিয়েছে। এই দেখুন।
কমলেশ পাসোয়ান একটানে সরিয়ে দেয় মৃত দেহের গায়ের কাপড়। উলঙ্গ শরীর, কোন হিন্দু পুরুষের । সুন্নতের চিহ্নমাত্র নেই।
--এ তাহলে কে?
--এ হল ওর বাঁহাত—পুরন্দর রাও।
এরপর রায়পুর অফিস আমার সঙ্গে কথা বলল, আমাকে রিপোর্ট পাঠাতে হবে তোরা কী করে এমন ভুল করলি?
--স্যার, আমি এই লোকটাকেই দেখেছি। দন্তেওয়াড়ায় এই লোকটা নিজে থেকে আমাকে কমরেড লাল মহম্মদ বলে পরিচয় দিয়েছিল।
আমার কেন ভুল হবে? বাকি সুন্নত-ফুন্নত আমার জানার কথা নয়।
--ওকে, কিন্তু সোনালী, তুমি তো বিক্রমকে নিজের বাড়িতে রেখেছিলে। খবর আছে এর সঙ্গে তোমাদের বিলাসপুর ইউনিটে মিটিং করেছিলে, তাহলে?
--কোসলে স্যার, এই লোকটাকেই আমার বাড়িতে রেখেছিলাম। একেই বিক্রম উর্ফ লাল মহম্মদ বলে জানতাম। এখন মনে হচ্ছে আসল বিক্রম আগেই অন্যপথে বেঙ্গল চলে গেছে। এ বোধহয় ওর ডেকয় ছিল, আমাদের ধোঁকা দিতে। এদের বুদ্ধি আছে, মানতে হবে।
আমি অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিলাম।
--একটা কথা, ওরা কিন্তু টেকনিক্যালি খুব একটা স্ট্রং নয়। আপনারা আমার নতুন হ্যান্ডসেটে ট্র্যাকার লাগিয়ে দিলেন, অথচ ওরা ধরতে পারে নি।
ওদের কমরেড মহীপাল কিছু একটা সন্দেহ করছিল, কিন্তু ধরতে পারে নি।
--ওহ্ ট্র্যাকার?
কোসলে স্যারের যে কী হল খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগলেন, হাসি আর থামেই না। দামলে দরজায় নক করে গলা বাড়াল। কোসলে ওকে জল আনতে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।
দেখি সোনালীও মুচকি হাসছে।
--শোন, সৌরভ, ট্র্যাকার তোর মোবাইলে ছিলই না। তাই ওরা ধরতে পারে নি। ট্র্যাকার লাগানো ছিল সোনালীর মোবাইলে।
তুই ছিলি ডেকয়, যাতে ওদের সন্দেহ সোনালীর দিকে না যায়, বুঝলি।
আমি উঠে পড়ি।
খুব বুঝেছি। ওনারা বাঘ শিকার করবেন বলে ছাগল টোপ দিয়েছিলেন, আমি সেই ছাগল। মুখের স্বাদ তেতো হয়ে যায়।
স্যার ফোন করে দিয়েছেন। রায়পুরে নিয়ে যাবার জিপসি গাড়ি এক্ষুণি এসে যাবে, পাঁচ মিনিট ।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে সোনালীকে বললাম—চল, তোমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিই। তারপর রায়পুরে ফিরে যাব।
এবার কিন্তু কিন্তু করে বলি—একটা কথা বুঝতে পারছি না। তুমি তো জানতে এ বিক্রম নয়। তুমি আসল বিক্রমকে চেন, মিটিং করেছ। তাহলে কেন মিথ্যে বললে? তোমার লাভ?
সোনালী হাসে। উত্তর দেয় না ।
আমি উত্তেজিত । আরে টিলার উপরে লাল মহম্মদ তোমাকে বলেছিল না --"তাহলে কে সেন্ট্রাল কমিটি মেম্বার বিক্রমের বিলাসপুরের দিকে মুভমেন্টের খবর পুলিশকে দিল"?
তার মানে বিলাসপুরে আসল বিক্রমই ছিল! তাহলে কেন এরকম করলে?
--বুঝতে পারলে না? কমলেশ পাসোয়ান বিক্রমকে মিথ্যে চুকলি করে লোকেশকে মেরে ফেলল। আমি বিক্রমদের বস্তার ইউনিটে বড় ড্যামেজ করালাম।
কিন্তু কমলেশ পাসোয়ান আসল বেইমান। পুলিশকে বুঝিয়েছিল এবারের অপারেশনে বিক্রম ধরা পড়বে।
পাসোয়ানের ব্যবহারে কিছু সন্দেহ করে বিক্রম বর্ষার মধ্যেই বস্তার ছেড়ে কোলকাতা চলে গেছল।
এখন ওই প্রেস কনফারেন্সের পর কমলেশ পাসোয়ানকে পুলিশ বিভাগ ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেবে না। এবার আমার বদলা সম্পূর্ণ হল।
জিপসী গাড়িটা বাঁক নিচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।
(সমাপ্ত)