১৫ আগস্ট থেকে বারবার মহান হিন্দি কবি সর্বেশ্বর দয়াল সাক্সেনার একটি বিখ্যাত কবিতার কথা আমার মনে পড়ছে।
‘দেশ কাগজে আঁকা মানচিত্র নয়’ কবিতাটি আমার চৈতন্যে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। আমার দেশ যখন স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করছিল, তখন গোধরা জেল থেকে ১১ জন ধর্ষক ও খুনিকে মুক্তি দেওয়া হয়! দেশব্যাপী যখন ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উড়ছিল, তখন অপরাধীদের গলায় মালা পরিয়ে তাদের বরণ করে নেওয়া হল! কবি আমার মনে প্রশ্ন জাগিয়ে দিলেন, যেন কবিতাটি তিনি ৫০ বছর আগে নয়, বরং এই ২০২২ সালেই রচনা করেছেন!
যদি তোমার বাড়ির
একটা ঘরে আগুন লাগে
তুমি কি তখনও
পাশের ঘরে শুয়ে থাকবে?
যদি তোমার বাড়ির কোনো একটি ঘরে
পড়ে থাকা লাশ পচে যেতে থাকে
তুমি কি তখনও
পাশের ঘরে প্রার্থনায় মগ্ন থাকবে?
যদি তোমার উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’
তাহলে তোমাকে আমার
আর কিছু বলার থাকে না।
স্বভাবতই, আমি ‘হ্যাঁ’ বলতে পারিনি। এক ঘরে আগুন লাগলে, পাশের ঘরে মানুষ ঘুমোতে পারে না। পাশের ঘরে মৃতদেহ পড়ে থাকলে কোনো সাচ্চা উপাসক প্রার্থনা করতে পারে না। একইভাবে, যে দেশে ধর্ষক ও অপরাধীদের মহিমান্বিত করা হয়, সে দেশে প্রকৃত দেশপ্রেমিকেরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না। এর কারণটাই কবিতার পরবর্তী স্তবকে তুলে ধরা হয়েছে —
দেশ কাগজে আঁকা
কোনো মানচিত্র নয় যে
একটি অংশ ছিঁড়ে গেলে
বাকি অংশ একই থেকে যাবে
এবং নদী, পাহাড়, শহর, গ্রাম
একইরকম নিজ নিজ জায়গায়
উদাস থেকে যাবে।
মনে করুন, বিমলা দেবী নামে ২১ বছর বয়সী এক মহিলা আছে। যিনি পাঁচ মাস ধরে অন্তঃসত্ত্বা। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোনো এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছেন। যাওয়ার জন্য সবাই একটা ট্রাকে উঠেছেন। হঠাৎ একদল লোক গাড়িটিকে থামাল। গাড়ির মধ্যে থাকা সকল পুরুষ সদস্যকে খুন করা হল! বিমলা দেবীর চোখের সামনে তাঁর তিন বছরের কন্যাকেও রাস্তায় নামিয়ে নৃশংসভাবে খতম করা হল! একে একে গণধর্ষণ করল বিমলা দেবীকে! অবশেষে তারা বিমলা দেবীর নগ্ন শরীরটিকে ফেলে রেখে চলে গেল!
কবি চিৎকার করে বলছেন —
এই দুনিয়ায় মানুষের জীবনের থেকে বড়
আর কিছুই নেই
ঈশ্বরও নয়
জ্ঞানও নয়
কোনো নির্বাচন নয়
কাগজের বয়ান
ছিঁড়ে যেতে পারে
আর মাটির নিচে পাতালে
গড়িয়ে যেতে পারে গাড়ি।
কিন্তু সিনেমার গল্পের মতোই আশ্চর্যজনকভাবে বিমলা দেবী মারা যাননি! কোনো একভাবে তিনি চেতনা ফিরে পান। নিরাপদ স্থানেও পৌঁছতে পারেন। যথারীতি, পুলিশ তাঁর অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। কোনোক্রমে অভিযোগ দায়ের করা গেলেও, সঠিকভাবে এই ঘটনার তদন্ত হয়নি!
কোনোভাবে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছয়। সঠিক বিচারে জন্য এই মামলাটি অন্য রাজ্যে স্থানান্তরিত করার ব্যাপারে নির্দেশ জারি হয় সর্বোচ্চ আদালত থেকে — যাতে অপরাধীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে বিচার সম্পন্ন হতে পারে। অবশেষে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে ১১ জন অপরাধীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
না, গল্প এখানেই শেষ নয়। জেলে থাকা সত্ত্বেও, এই সমস্ত অপরাধীরা বারবার প্যারোলে বেরিয়ে আসতে থাকে। সাজাপ্রাপ্ত হয়েও ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে এসে রীতিমতো ফুর্তি শুরু করে দেয় এই দাগি অপরাধীরা। এমনকি রাজনৈতিক দলের সমাবেশেও যোগ দিতে দেখা যায় তাদের। ফলস্বরূপ, এই কুখ্যাত আসামিদের থেকে ক্রমাগত হুমকির শিকার হতে হয় বিমলার পরিবারকে। পুলিশ, প্রশাসন ও সরকার মৃদু হাসে। এবং তারপর সাজা শেষ হওয়ার আগেই সরকার একটি কমিটি গঠন করে, যারা এই জঘন্য অপরাধীদের ‘ভালো আচরণ ও মানবতা’-র যুক্তি দেখিয়ে মুক্তি দেয়। এভাবেই ১৫ আগস্টের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হল!
এবার কবিতাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় —
মনে রেখো
একটি শিশুর হত্যা
এক নারীর প্রাণ কেড়ে নেওয়া
একজন মানুষের
গুলিবিদ্ধ শরীর
শাসনতন্ত্রের নয়
বরং এসবই
দেশ ডুবে যাওয়ার
নজির
এত রক্তধারায়
মাটি না ভিজলে
আকাশে উড়ন্ত
পতাকাটাও কালো হয়ে যায়
আমি আকাশে উড়ন্ত তেরঙা পতাকা দেখি। পতাকার সংখ্যাও বেড়েছে। ক্রমশই উঁচু হয়েছে ঝান্ডা। কিন্তু এই কবিতা কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছে না। বিমলা দেবীর ধর্ষকদের জেল থেকে বের করে আনতে আইনের নানা প্যাঁচকে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কবি আমাদের সতর্ক করছেন,
লাশ পড়ে থাকতে দেখেও
বিবেকহীনের মতো
দাঁড়িয়ে থাকে যে মানুষ
সে অন্ধ।
বিমলা দেবী বলেছিলেন, “আমি নীরব হয়ে গেছি। আমার চেতনা কাজ করছে না। শুধু এ কথা বলতে পারি, একজন নারীর সঙ্গে এই চূড়ান্ত বে-ইনসাফি কীভাবে ঘটতে পারে? আমি সর্বোচ্চ আদালতকে বিশ্বাস করেছিলাম। আমি সিস্টেমের ওপর আস্থা রেখেছিলাম। আমি আমার জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়েও বাঁচতে শিখেছিলাম। কিন্তু এখন আমার শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে। ন্যায়বিচারের প্রতি আমার বিশ্বাস নড়ে গেছে।” এটা বিমলার কণ্ঠস্বর।