মুর্শিদাবাদের কেল্লা নিজামতের ভেতরে ছোট ছোট নানান দর্শনীয় বিষয় ছিল যার অধিকাংশই আজ নষ্ট হয়ে গেছে, বিশেষ করে কেল্লার ভেতরের যেসব দৃষ্টি নন্দন বাগান ছিল আজ সেসব গভীর জঙ্গলে ঢাকা পরে আছে, যেমন আজ সেদিনের কেল্লার ‘মহল সেরা’ এলাকায় গেলে দেখা যাবে একটি বিরাট অঞ্চল জঙ্গলে পরিণত হয়েছে অথচ নবাবী আমলে এই এলাকাতেই ছিল দেশ বিদেশের দামি সুগন্ধি ফুলের বাগান, আজও অবশ্য সেই জঙ্গলের ভেতরে নবাবী আমলের কিছু ফুলের গাছ দেখা যায়। এছাড়া ওয়াসিফ মঞ্জিলের সামনেও খুব সুন্দর ফুলের বাগান ছিল সেটিও আজ নষ্ট হয়ে গেছে, হাজারদুয়ারীর পিছন দিকে বিশেষ করে নবাব ঘাটের কাছে কৃত্রিম পাহাড় ও পাহাড় সংলগ্ন ফুলের বাগান ছিল, সেই কৃত্রিম পাহাড় থেকে নাকি ঝর্নার জল পড়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল, সেই বাগানে ছিল সাদা মার্বেল পাথরের বহু নারী মূর্তি যা বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত। আজ অবশ্য এসবের কিছুই নেই কেল্লার ভেতরে।
মুর্শিদাবাদের কেল্লা নিজামতের পূর্ব গৌরব আজ অস্তমিত হয়েছে, নিজামত পরিবারের বেশ কিছু প্রবীণ মানুষদের কাছে শুনেছিলাম নবাব ফেরাদুন জার আগে কেল্লার পরিধি নাকি আরও বড় এলাকা নিয়ে ছিল, পরবর্তী সময় নানান কারণে কেল্লার আভিজাত্য ও এলাকা ছোটো হতে হতে কেল্লা আজ এই রূপ ধারণ করেছে, এক সময় যা কেল্লার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত এমন অনেক নিদর্শনই আজ আর খুঁজে পাওয়া যায়না। আজ সেই কৃত্রিম পাহাড়টি দেখা যায় জৌলুশহীন হয়ে পড়ে থাকতে। কেল্লার বহু সুরম্য প্রাসাদও কালের নিয়মে বিলীন হয়ে গেছে।
এক সময় কেল্লার ভেতরে ভাগীরথীর পাড় বরাবর বাদ্যযন্ত্র বাজানোর জন্য ছোট, বড় বেশ কয়েকটি ব্যান্ড স্ট্যান্ড ছিল, আজও সেগুলি অক্ষত রয়েছে, কিন্তু বর্তমানে সেগুলি লোক মুখে নতুন নাম পেয়েছে 'হাওয়া মহল'। অবশ্য নবাবী আমলে কেল্লার ভেতরে নানান কাজে আগত মানুষজনরা এই ব্যান্ড স্ট্যান্ডে বসে বিশ্রাম নিতেন। কারণ ব্যান্ড-স্ট্যান্ড শুধুমাত্র বছরের বিশেষ দিন গুলিতেই ব্যবহার করা হতো, বাকি দিন গুলিতে এগুলি ফাঁকাই পড়ে থাকত। আজও মানুষজন গরমের দিনে এই ব্যান্ড স্ট্যান্ডে বসে থাকেন ভাগীরথীর মিষ্টি হওয়া খেতে।
কেল্লার ভেতরে বর্তমানে চারটি মসজিদ রয়েছে, যার একটি রয়েছে ইমামবাড়ার ভেতরে, বাকি তিনটি মসজিদের মধ্যে দুটি মসজিদ নবাব সিরাজের নির্মিত। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই দুটি মসজিদ সোনা মসজিদ ও মোতি মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। সোনা মসজিদটি বর্তমানে জুরুদ মসজিদ বা হলুদ মসজিদ নামেই অধিক পরিচিত, মসজিদটি হাজারদুয়ারীর সন্নিকটে ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত। অন্যদিকে মোতি মসজিদটি বর্তমানে ওয়াসিফ মঞ্জিলের কাছে অবস্থিত। মসজিদটি তার সাদা রঙের জন্য সফেদ মসজিদ নামেই অধিক পরিচিত। নবাবী আমলে ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত নবাব সিরাজ নির্মিত সাদা ও হলুদ রঙের মসজিদটি মোতি ও সোনার মত ঝকঝক করত তাই এই মসজিদ দুটির এমন নামকরণ করা হয়ে ছিল। আজও দিনে পাঁচ বেলা এই মসজিদ দুটিতে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এই দুটি মসজিদ ছাড়াও কেল্লার মহলসেরা এলাকায় জঙ্গলে ঢাকা আরও একটি সাদা রঙের মসজিদ রয়েছে, এই মসজিদটি নবাব আলি জা এর বেগম দুলহিন বেগম নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও হাজারদুয়ারীর মাঠে নবাব সিরাজের তৈরি একটি মদিনা রয়েছে, অনেকেই এটিকে মদিনা মসজিদ বলে থাকলেও এটি আসলে সিরাজ নির্মিত ইমামবাড়ার কেন্দ্রীয় কক্ষ। পুরো ইমামবাড়াটি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেলেও তাঁর কেন্দ্রীয় কক্ষটি রয়ে গেছে। নিজামত ইমামবাড়া বাদেও কেল্লার ভেতরে আরও কয়েকটি ছোট ইমামবাড়া রয়েছে। যেগুলিতে নিয়মিত ধর্মীয় কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
এগুলি ছাড়াও কেল্লা নিজামতের দক্ষিণ দরজার পাশে রয়েছে একটি বিরাট লোহার ঘণ্টা, খুব সম্ভবত নবাবী আমলে নবাবী সেপাইদের জন্য এই ঘণ্টা ব্যবহার করা হত ঘড়ি হিসেবে, নিদিষ্ট সময় অনুযায়ী এই ঘণ্টা বাজানো হতো। নবাব পরিবারের কিছু প্রবীণ মানুষের সাথে কথা বলে জেনেছিলাম যে, একটি বড় দড়ির একপ্রান্ত ঘণ্টার সাথে বাঁধা থাকত এবং দড়ির অন্য প্রান্ত রাখা থাকত দক্ষিণ দরজার উপরে, সেখানে দড়ি টানার জন্যও দু’জন কর্মচারী নিযুক্ত থাকত। জনশ্রুতি আছে এই ঘণ্টার আওয়াজ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত।
ঘণ্টা ছাড়াও কেল্লার ভিতরে সময় দেখার আরও দুটি ব্যবস্থা ছিল, একটি ছিল সূর্যঘড়ি, অন্যটি ছিল ক্লক টাওয়ার। সূর্যঘড়িটি বর্তমানে হাজারদুয়ারীর পিছন দিকে রয়েছে, যদিও সেই ঘড়িটি এখন অচল, অন্যদিকে হাজারদুয়ারী ও ইমামবাড়ার মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে ক্লক টাওয়ার। কথিত রয়েছে এক সময় এই ক্লক টাওয়ারে সময় অনুযায়ী ঘণ্টা পড়ত। ঘণ্টার সেই আওয়াজ নাকি ভাগীরথীর পশ্চিমপার থেকেও শোনা যেতো। জাফরাগঞ্জ পরিবারের প্রধান মুখ নবাব ড: রেজা আলী খান সাহেবের মুখে শুনেছিলাম যে, এই ক্লক টাওয়ারের ঘণ্টার আওয়াজ নাকি তাদের জাফরাগঞ্জ প্রাসাদ থেকেও শোনা যেত, কিন্তু আজ দীর্ঘদিন এই ক্লক টাওয়ারটিও বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।
এছাড়াও কেল্লার চক গেটের কাছে বহুদিন থেকেই একটি কারুকার্য খচিত ভাঙ্গা বাড়ি দেখতাম, স্থানীয় মানুষদের বলতে শুনতাম সেটি পাওয়ার হাউস কারণ কেল্লায় ইংল্যান্ড থেকে জেনারেটর এলে এই বাড়ির একটি কক্ষে সেটি রাখা হয়েছিল, ফলে পুরো বাড়িটি কেল্লার পাওয়ার হাউস নামেই পরিচিতি পেয়েছে, কিন্তু আমার সন্দেহ হতো এতো কারুকার্যময় বাড়ি শুধুমাত্র পাওয়ার হাউসের জন্য নির্মিত হবে? নিশ্চয় এই বাড়ি প্রথমে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল, আমার কৌতূহল নিবারণ করেছিলেন নবাব পরিবারের প্রবীণ সদস্য বাকের আলী মির্জা সাহেব। তিনিই আমাকে জানিয়েছিলেন এই প্রাসাদে এক সময় কোনো এক বেগম বসবাস করতেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর এই বাড়ি পূর্ব জৌলুশ হারালে বাড়িটিতে নিজামত কেল্লার পাওয়ার হাউসে পরিণত করা হয়।
কেল্লার ভেতরে প্রবেশের জন্য মোট চারটি দরজা ছিল সেগুলি হল রৌনক আফজা দরজা, দক্ষিণ দরজা, চক দরজা এবং ইমামবাড়া দরজা। রৌনক আফজা এবং দক্ষিণ দরজার উপরে নহবতখানা ছিল যেখানে সকাল বিকাল সানাই বাজান হতো, সেই সানাইয়ের সুর কেল্লা ছাড়িয়েও বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত।
কেল্লার ভেতরে একটি সাধারণ লঙ্গরখানাও ছিল। হাজারদুয়ারীর পিছন দিকে যে রাস্তাটি পাহাড় বাগানের পাশ দিয়ে যায় সেই রাস্তাতে পাহাড় বাগানের সন্নিকটেই এই লঙ্গরখানাটি পড়ে। বর্তমান নবাব পদের বৈধ উত্তরাধিকারী নবাব আব্বাস আলী মির্জা সাহেব এই লঙ্গরখানা সম্পর্কে বলেন যে, নানান কাজে কেল্লায় আগত ক্ষুধার্ত মানুষদের এই লঙ্গরখানা থেকে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করা হতো। তাছাড়া নিজামত পরিবারে হঠাৎ কোনো অতিথি এলেও এই লঙ্গরখানা থেকেই খাবার নিয়ে এসে অতিথিদের পরিবেশন করা হতো। সেই লঙ্গরখানা বন্ধ হয়ে গিয়ে আজ সেখানে মানুষ বসবাস করছে। তবে লঙ্গরখানার পুরোনো গঠন একই রয়ে গেছে।
এছাড়াও কেল্লার ভেতরে আরও একটি দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্য রয়েছে। দক্ষিণ দরজা থেকে যে রাস্তাটি হাজারদুয়ারী পর্যন্ত গিয়েছে সেই রাস্তার দুই ধারে দুটি করে মোট চারটি পাথরের স্তম্ভ রয়েছে যার মাথায় লোহার ঈগল বসানো রয়েছে, এই স্তম্ভ দুটির একটি রয়েছে সফেদ মসজিদের কাছে এবং অপরটি রয়েছে মোতি মহল ঘাটের কাছে। আরও কিছুটা এগিয়ে অধুনা অবলুপ্ত নবাব ঘাটের কাছে রাস্তার দুই পাশে নাকি এমন আরও দুটি স্তম্ভ ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
কেল্লার ভেতর নিজামত পরিবারের মানুষদের প্রচুর বসবাসের বাড়িও রয়েছে। অনেক পুরোনো বাড়ি সংস্কার করে আজ তাঁরা সেখানে বসবাস করছেন। শুধু নিজামত পরিবারই নয় বর্তমানে বহু সাধারণ মানুষও কেল্লায় বসবাস করছে,বহু অসহায় মানুষ কেল্লার ভেতরে পুরোনো প্রাসাদে নিজদের ঠিকানা তৈরি করেছে, এছাড়াও কেল্লার ভেতরে গড়ে উঠেছে বহু দোকানপাট, নিজামত পরিবারের বহু কর্মচারীও আজ কেল্লার ভেতরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, এছাড়াও মুর্শিদাবাদ শহরে বসবাসকারী ইরানি সম্প্রদায়ের একটি অংশও কেল্লার ভেতরে বসবাস করছে বহু বছর ধরেই।
এক সময় সমগ্র কেল্লা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল আজ সেসব প্রাচীরের সামান্য কিছু অংশই অবশিষ্ট রয়েছে। এসব বড় বড় প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ গুলিও নবাবী কেল্লার অস্তিত্বের জানান দেয়, না হলে কেল্লা নিজামত কে আলাদা ভাবে বোঝার তেমন উপায় থাকত না, কারণ সাধারণভাবে কেল্লা বলতে যা বোঝায় বাংলার নবাবী কেল্লা তার চেয়ে কিছুটা অন্য রকম, ফলে মুর্শিদাবাদে আগত অধিকাংশ পর্যটক কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করেও আলাদা করে কেল্লার অস্তিত্ব বুঝতে ব্যর্থ হন, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পর্যটকরা হাজারদুয়ারী, ইমামবাড়া মদিনা, বাচ্চাওয়ালি তোপ, ক্লক টাওয়ার দেখেই ফিরে যান।
কেল্লা নিজামতের সৌন্দর্য যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাও ধীরে ধীরে নষ্ট হতে বসেছে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষণের বাইরে যেসব নিদর্শন গুলি রয়েছে, সেগুলি একবার নষ্ট হলে আর মেরামত করা হচ্ছে না, এভাবেই অবহেলায় কেল্লার ভেতরের বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে। কেল্লা নিজামতের যে রূপটি এখনও পর্যন্ত অক্ষত রয়েছে, সেটুকুও যদি ভালোভাবে সংরক্ষণ না করা যায়, তবে অদূর ভবিষ্যতে কেল্লা নিজামত বলে আলাদা করে দেখানোর মত কিছুই হয়তো আর অবশিষ্ট থাকবে না।