

সেদিন অফিসে সকালের দিকে কাজ করছি, এমন সময়, অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করে – এক বাঙালি দাদা এসে বলল, “কাল সকালে আমার সাথে একটু অফশোর চল, ভাইটি আমার।” যাঁরা অফশোর শব্দটির সাথে পরিচিত নন, তাঁদের জন্য একটু বলে রাখি – এই অফশোর বলতে সমুদ্রতীর থেকে দূরে (দূর মানে বেশ কয়েকশ’ কিলোমিটারও হতে পারে, আবার ৫০ কিলোমিটারও হতে পারে) গভীর সমুদ্রের মাঝে, তেল তোলার প্ল্যাটফর্মগুলিকে বোঝানো হয়। অনেকেই দেখেছেন মনে হয় – বোম্বে থেকে দেখা যায় ‘বোম্বে হাই’ যেমন। যাঁরা দেখেননি, তাঁদের বোঝার সুবিধার জন্য সঙ্গে ছবি দিয়ে দিচ্ছি। মনে করুন, সমুদ্রের মাঝে খুঁটি / পিলার পুঁতে কেউ তার উপরে বাড়ির মত বানিয়েছে।
দাদার রিকোয়েস্ট শুনে জিজ্ঞেস করলাম, “আবার কি হল, যে কালকেই যেতে হবে?” দাদা যা বলল, তাতে বুঝলাম আমার ‘এক্সপার্ট’ ওপিনিয়ান এবং হেল্প চাই – কিছু কাজ হচ্ছে অফশোর প্ল্যাটফর্মে। ঘটনা হল, এই অফশোর যেতে আমার একদম ভালো লাগে না – তার মূল কারণ ওই হেলিকপ্টার বা জাহাজে করে যাওয়া। হেলিকপ্টারে চাপা আমি রীতিমত অপছন্দ করি – এর থেকে অ-ভরসাযোগ্য বাহন মানুষ এখনো পর্যন্ত আর বানায়নি। তাই নিতান্তই জরুরী দরকার না হলে এড়িয়ে চলি। জাহাজে করে যাওয়ার প্রধান বিরক্তি হচ্ছে সময় – প্রচুর সময় নষ্ট। তবে ভরা বর্ষায় চয়েস থাকে না, কারণ তখন সমুদ্র এত বেশি উত্তাল থাকে, যে কেবলমাত্র হেলিকপ্টার করেই যাওয়া যায়। আমি যাওয়া এড়াবার জন্য চেষ্টা চালালাম, “তোমার যা কাজ বলছ, ওটা তো ঠিক আমার দায়িত্বের মধ্যে আসে না।” দাদা উত্তর দিল, “এমন করে না ভাই – যে এখন অফশোরে আছে, এই কাজটার জন্য সে একেবারে কোনো কর্মের নয় – তুই একটু চল আমার সাথে, এই বিদেশ-ভুঁয়ে এক বাঙালি আরেক বাঙালিকে না দেখলে কে আর দেখবে বল!”
খুব সেন্টিমেন্ট খেয়ে আমি রাজি হয়ে গেলাম - “কিন্তু তুমি আজ সকালে এসে বলছ কাল যাবার কথা, হেলিকপ্টার বুকিং পাবে নাকি?” উত্তর এল, “ও সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, এমারজেন্সি বুকিং করে দিয়েছি – জানতাম তুই রাজি হবি – দাদার কথা আর কি ফেলতে পারবি!” দেখলাম বাহ্ – আমার প্রতি অগাধ আস্থা! এবার অন্য শর্ত দিলাম, “ঠিক আছে যাবো, কিন্তু রাতে আমি ওই বাঙ্ক-বেড বা শেয়ার করা ডর্মিটরিতে থাকতে পারব না – তুমি স্পেশাল কেবিনের ব্যবস্থা কর।” দাদা বলল, “তুই না, খুব সাহেব টাইপের হয়ে গেছিস। হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইন লোকালে ঝুলতে ঝুলতে যাতায়াত করে মানুষ হলি আর এখন বলছিস স্পেশাল কেবিন চাই! তবে চিন্তা করিস না, সেও ব্যবস্থা করে রেখেছি – আমরা দু’জনে একটা কেবিনে থাকব। ঘরে একা থেকে পুরো বোর হবি, তার থেকে রাতে গল্পগুজব করা যাবে একসাথে থাকলে।” আমি দেখলাম ভালো প্রস্তাব – রাজি হয়ে গেলাম। কাল সকালে সাড়ে ছ’টায় ফ্লাইট।
এবার অফশোর প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কিছু বলে রাখি – বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় কি, একদম বিশাল বড় বা খুব গভীর জলে না হলে, বেশ কয়েকটা করে প্ল্যাটফর্ম থাকে এক জায়গায়। কেন, সেই নিয়ে আর ডিটেলসে ঢুকছি না – কেউ জানতে চাইলে পরে একদিন লেখা যাবে। বেশ কয়েকটা অফশোর প্ল্যাটফর্ম নিয়ে গড়ে ওঠে একটা ‘হাব’ টাইপের – যেমন শক্তিগড়ের ল্যাঙচা হাব বা ইকো পার্কের ‘মিষ্টি হাব’। বুঝতেই পারছেন, মাঝ-সমুদ্রে মানুষের থাকার ব্যবস্থা করা কী ঝামেলার এবং খরচার। তাই করা হয় কি, এক একটা হাবে একটা করে প্ল্যাটফর্ম বানানো হয়, যাতে থাকে ‘লিভিং কোয়ার্টার’।
এই লিভিং কোয়ার্টার একটু দূরে থাকে, বাকি যে প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে তেল তোলা হয় তাদের থেকে – এর মূল কারণ সেফটি। যদি কোনো কারণে আগুন ধরে যায় অন্য প্ল্যাটফর্মে, তাহলে যেন লিভিং কোয়ার্টার থেকে লোকেরা সেই স্থান পরিত্যাগ করার সময় পায়। ১৯৮৭ সালে ইংল্যান্ডের সমুদ্রকূল থেকে কিছু দূরে, এক অফশোর প্ল্যাটফর্মে আগুন লেগে ২৮৭ জন মারা যান – সেই থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেককিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা আগে ছিল না। ঠিক যেমন ভাবে টাইটানিক ডুবে যাবার পর, সেই থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়া হয়েছে জাহাজ বানানোয় বা জাহাজের যাত্রায়। এটা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় – এমনকি এই নিয়ে রিসার্চ পেপারও আছে, যার মূল প্রতিপাদ্য হল – টাইটানিক না ডুবলে কোন কোন জিনিস আমরা এখনও শিখতাম না! এটা নিয়েও লেখা যায় একদিন।
তো যাই হোক, আমাদের কোম্পানির অফশোর লিভিং কোয়ার্টারে প্রায় তিনশ’ মতন লোক থাকত। আমাকেও মাঝে মাঝে কাজে যেতে হত – ডর্মিটারি-মতন থাকলেও, অনেক ঘরে ব্যবস্থা ছিল দুটো করে বেড। আর এই দু’জনা শিফটিং ডিউটি করত – অফশোরে ডিউটি হচ্ছে ১২ ঘন্টা। মানে বুঝতেই পারছেন, একটা ঘরে একজনার বেশি থাকতে হত না কোনো এক সময় – একজন ডিউটি দিচ্ছে, আর একজন ঘুমাচ্ছে – এমন ব্যাপার আর কি। আর যাতাযাত-ইত্যাদি সুবিধার জন্য অফশোর ডিউটি হত ২৮ দিন টানা – এর পরের ২৮ দিন ছুটি, এটাকে বলা হত ২৮×২৮ ডিউটি। আগেই বলেছি, দু’ভাবে পৌঁছানো যেত এই লিভিং কোয়ার্টারে – এক তো জাহাজে করে, অন্যটা হেলিকপ্টার। সব লিভিং কোয়ার্টার প্ল্যাটফর্মেই হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং থাকত। কম সময় লাগার কারণে তীর থেকে সাধারণত হেলিকপ্টারে করেই যাওয়া হত। কিন্তু লিভিং প্ল্যাটফর্ম থেকে আশেপাশের প্ল্যাটফর্মে কাজে গেলে, বলাই বাহুল্য, বোটে করে যেতে হত। ফলে প্রত্যেক প্ল্যাটফর্মেই বোট ল্যান্ডিং থাকত – একটা নিয়মিত ব্যবহারের জন্য, অন্যটা এমারজেন্সিতে ব্যবহৃত হত। দূর থেকে বুঝতে পারবেন না – কিন্তু এক একটা লিভিং কোয়ার্টার বিশাল উঁচু হয় – আমাদেরটা ছিল যেমন প্রায় ১২তলা বাড়ির সমান উঁচু। হেলিকপ্টারে করে গেলে ঠিক আছে, টুক করে উপরে নেমে ঢুকে পড়লেন থাকার জায়গায় – কিন্তু নৌকা করে গেলে অনেক সময় বাইরের দিক থেকে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ৬-৭তলা হেঁটে উঠতে হত। অফশোরে যাবার পোষাক আলাদা – লাইফ জ্যাকেট ইত্যাদি পরে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে, ৭তলা হেঁটে উঠতে কালঘাম ছুটে যাবে গরমে।
তবে একবার ভিতরে ঢুকে গেলে অন্য জগৎ – এখনকার নতুন লিভিং কোয়ার্টারগুলো প্রায় ফাইভ স্টার হোটেলের মতন অনেকটা – সব আছে, সুন্দর সব রুম, রেস্টুরান্ট, বসার জায়গা, অফিস, লাইব্রেরি, ডাইনিং, জিম, ক্লাব রুম ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং দিব্যি থাকা যেত – খাওয়া দাওয়া ফ্রি এবং জবরদস্ত (কুকের উপর নির্ভর করে)। অনেক সময় হয় কি, অফশোর প্ল্যাটফর্মগুলিকে একসাথে শাট-ডাউন করে মেনটেন করা হয় – তখন আরো অনেক অনেক বেশি লোককে থাকতে হয় রাতে সেখানে। কিন্তু থাকবে কোথায়? তাই ভাড়া করা হত তখন ‘ফ্লোটেল’ এর মত – মানে ভাসমান হোটেল। আমাদের কোম্পানি অনেক সময় চারশ’ সিটের ফ্লোটেলও ভাড়া করত। বুঝতেই পারছেন প্রচণ্ড প্ল্যানমাফিক কাজ করতে হত – তাই চাইলেও তখন বেড বা হেলিকপ্টার বুকিং পাওয়া যেত না।
ওই বাঙালি দাদার সাথে সেবার গিয়ে আমরা উঠলাম অন্য একটা বড় জাহাজে – সে বড় জাহাজটা কাজ করছে প্ল্যাটফর্মের কাছে নোঙর করে। আর হয় কি, এমন জাহাজে আমাদের খাতিরই আলাদা থাকে – কারণ ওদের কাছে আমরা কোম্পানির বড় কর্তার মত। সকালে সাড়ে ছ’টায় হেলিকপ্টার ফ্লাইট, মানে ৪৫ মিনিট আগে এয়ারপোর্টে পোঁছাতে হবে চেকিং-এর জন্য। হেলিকপ্টার ছাড়ার জন্য এক স্পেশাল এয়ারপোর্ট আছে আমাদের কোম্পানির, যেটা আমাদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়। তাই সকালে পাঁচটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে পার্কিং করে চেক-ইন করলাম। চেক-ইন করা খুব একটা বেশি কিছু ঝামেলার নয় – সময় লাগে সেফটি ভিডিও দেখতে। আপনারা যেমন ফ্লাইট চড়লে ভিডিওতে দেখেন প্লেনে বিপদ হলে কেমন করে আচরণ বা ব্যবস্থা করতে হবে – ঠিক তেমনি আমাদের দেখতে হয় হেলিকপ্টারে বিপদ হলে বা ক্র্যাশ করলে কি করণীয় – এর পর নানা এটা-ওটা জিনিস চড়াতে হয় গায়ে নিজেদের সুরক্ষার জন্য। আমাদের কোম্পানিতে দু’জন মেয়ে পাইলট আছে – সেদিন দেখলাম আমাদের পাইলট ওই দু’জনার একজন (মুখ-চেনা হলেও নামটা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না)।
এই অফশোরে কাজ করতে গেলে দুটো জরুরী সার্টিফিকেশন দরকার – একটা হল ‘অফশোর হেলথ সার্টিফিকেট’ আর একটা হল ‘অফশোর সারভাইভ্যাল ট্রেনিং’। এই দুটো ঠিক না থাকলে আপনি বুকিং-ই করতে পারবেন না হেলিকপ্টার সিট। আমাদের হাতে করে নিয়ে ঘুরতে হয় না – কম্পিউটার সিস্টেমে আপডেট করা থাকে – দুটো সার্টিফিকেট থাকলেই বুকিং ওকে হবে। হেলথ চেক করাতে হত প্রতি বছর – সে নানাবিধ টেস্ট, মানে চোখ, কান, নাক থেকে শুরু করে রক্ত, হার্ট আর যা কিছু সম্ভব। আর ‘অফশোর সারভাইভ্যাল ট্রেনিং’ প্রতি চার বছর রিনিউ করতে হত – এই ট্রেনিংটা খুব জটিল আর খরচাসাপেক্ষও বটে।
প্রথমবার অফশোর সারভাইভ্যাল ট্রেনিং করতে যাচ্ছি – আমাকে ঠিকানা দিয়ে দেওয়া হল ট্রেনিং সেন্টারের – ম্যাপ দেখে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। শেষে গিয়ে পোঁছলাম – এখানে আমাদের কোম্পানির হাজারো কিসিমের ট্রেনিং হয় – জঙ্গলের মধ্যে একটা নদীর পাশে। এই ট্রেনিং নিয়েই আলাদা করে লেখা যায় – তবে আজকের লেখা প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি অফশোর সারভাইভ্যাল ট্রেনিং এক সপ্তাহের হয়। থিওরি থেকে শুরু করে প্রচুর প্র্যাক্টিক্যাল – পাশ করলে তবেই সার্টিফিকেট। অনেক কিছু শিখতে হত – আগুন কেমন করে নেভাবেন, ফার্স্ট-এড, এক বোট থেকে অন্য বোটে কি ভাবে দড়ি দিয়ে ঝুলে ট্রান্সফার করবেন নিজেকে, প্ল্যাটফর্মে বিপদ হলে জলে কেমনভাবে ঝাঁপ মারবেন, লাইফ-বোট কি ভাবে অপারেট করবেন – ইত্যাদি। পাঁচ দিনের মধ্যে দুই দিন প্রায় জলেই কাটাতে হত – বিশাল সুইমিং পুলের মত ব্যবস্থা আছে, যদিও গভীরতা সাধারণ সুইমিং পুলের থেকে অনেক বেশি। সেখানে শেখানো হত জলে বেঁচে থাকার পদ্ধতি – লাইফবোট না থাকলে কতক্ষণ জলে ভেসে থাকা যায় গ্রুপ করে ইত্যাদি।
সব ঠিক আছে, কিন্তু মানুষের সমস্যা হত দুটো টেস্টে প্রধানত – একটা হচ্ছে অন্ধকারে আগুন লেগে গেলে কিভাবে প্ল্যাটফর্মের অলিগলি দিয়ে সুরক্ষিত জায়গায় পোঁছাবেন। একটা বিশাল বাঙ্কারের মতন ছিল – পুরো অফশোর প্ল্যাটফর্মের গলিঘুঁজির মত করে বানানো – মূল দরজা বন্ধ করে দিলে এত অন্ধকার, যে আপনি নিজের হাত-পর্যন্ত দেখতে পাবেন না। প্রথমে আপনাকে সেই বাঙ্কারের প্ল্যান দেখিয়ে দেওয়া হল ক্লাসরুমের স্ক্রিনে বা কাগজে, আঁকায়। এবার আপনাকে বুঝে নিতে হবে কোথায় দরজা আছে, কোনদিকে বেঁকতে হবে ইত্যাদি – আপনি অবশ্যই ততকিছু মনে রাখতে পারবেন না – তাই টেকনিক আছে, একটা হাত সবসময় দেওয়ালের সাথে ঠেকিয়ে একটা হাত সামনে বাড়িয়ে কানামাছি খেলার মতন নাড়াতে নাড়াতে যেতে হবে। একটা নির্দিষ্ট টাইমের মধ্যে আপনাকে সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরোতে হবে পরীক্ষায় পাশ করার জন্য। যতটা সহজ ভাবছেন, ততটা সহজ নয় ব্যাপারটা – যদি অন্ধকারে ভয় থাকে – তবে এই জায়গায় না ঢোকাই ভালো! এই টেস্টটা দু’বার দিতে হত – একবার খালি অন্ধকার ঘরে – আর একবার প্রচুর ধোঁয়া ভর্তি ঘরে। এমনিতেই যেহেতু প্রবল অন্ধকার, তাই ধোঁয়া আলাদা করে অন্ধকার সৃষ্টি করতে পারত না – কিন্তু দম নেবার সমস্যার সৃষ্টি করত। মানে আপনাকে এক বুক দম নিয়ে ঢুকতে হবে – যতক্ষন পারেন, না দম নিয়ে বেরোতে হবে অন্যদিক দিয়ে।
এ-ও ঠিক আছে – প্রায় সবাই পাশ করে যেত। সব থেকে বেশি ফেল করত ছেলেপুলে যে ট্রেনিং-এ এবং যার জন্য অনেকে কোনোদিনই অফশোর যাবার সার্টিফিকেট পায়নি, তা হল “হেলিকপ্টার আন্ডারওয়াটার এস্কেপ ট্রেনিং”, বা সংক্ষেপে HUET। সত্যিকারের হেলিকপ্টার দিয়ে তো আর সুইমিং পুলে নামানো যায় না – তাই একটা মডেল হেলিকপ্টার বানানো ছিল, যার ভিতরে সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট ঠিক তেমনটাই, যেমনটা আসল হেলিকপ্টারে। আপনাকে পরে থাকতে হবে ঠিক সেই সবই, যা আপনি পরে থাকবেন আসল যাত্রায় – অর্থাৎ সারা শরীর জুড়ে কভার-অল (এখন করোনা যোদ্ধাদের যেমন পুরো সাদা পিপিই দেখেন, অনেকটা তেমন – জাম্পস্যুট টাইপের), লাইফ-জ্যাকেট, হেলমেট ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে আপনি ঠিকভাবে নড়াচড়া করবেন তার উপায় নেই –
হেলিকপ্টার আন্ডারওয়াটার এস্কেপ ট্রেনিং-এ চার ধরণের সিচ্যুয়েশনে আপনাকে ট্রেনিং এবং পরে পরীক্ষা দিতে হবে – একটা ক্রেনে করে সেই মডেল হেলিকপ্টারকে জলে অপারেট করা হয় – আর মনে রাখবেন, সব ক্ষেত্রেই আপনাকে সিটবেল্ট পরে থাকতে হবে। আর হেলিকপ্টারের সিটবেল্ট আপনি কেবল এক স্পেশাল পদ্ধতিতেই খুলতে পারবেন –
১) হেলিকপ্টার জলে ঠিকঠাক ল্যান্ড করল – শুধু পায়ের পাতা পর্যন্ত জল পেলেন। আপনি সিটবেল্ট খুলে আস্তে আস্তে হেলিকপ্টার থেকে বেরিয়ে গেলেন মূল দরজা দিয়ে।
২) হেলিকপ্টার জলে মোটামুটি ল্যান্ড করল – কোমর পর্যন্ত জল। আপনি সিটবেল্ট খুলে আস্তে আস্তে হেলিকপ্টার থেকে বেরিয়ে গেলেন মূল দরজা দিয়ে।
৩) হেলিকপ্টার জলে ল্যান্ড করে ডুবে গেল – মানে আপনি পুরোপুরি জলের তলায়। নিঃশ্বাসের সমস্যা – সিটবেল্ট খুলে বেশ কষ্টে বেরোলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার হাতে সময় কম – তাই দরজা পর্যন্ত আপনি যেতে পারবেন না – আপনাকে বেরুতে হবে আপনার সবচেয়ে কাছের জানালা দিয়ে। হেলিকপ্টারের জানালা ভিতর থেকে এক বিশেষ ভাবে চাপ দিয়ে খোলা যায় – জলের তলায় থেকেও আপনি সেটা খুলতে পারবেন।
এটাই সবচেয়ে শক্ত, আর এটাতেই অনেকে ফেল করে। সবচেয়ে বেশি ফেল করে কারা জানেন? ছেলেরা! কারণ ছেলেদের মধ্যে একটা ম্যাচো ভাব আছে – ট্রেনিং-এর সময় ইনস্ট্রাকশন ঠিকমত শোনে না – ভাবে, এ আর এমন কী ব্যাপার! বিশেষ করে ওই জানালা খোলার ব্যাপারটা – হাতের কুনুই দিয়ে এক বিশেষভাবে জানালার কাচে এক কোণে চাপ দিলে তবেই ওটা খুলবে। আর তা না হলে, ওটা খুলবেই না – যতই গায়ের জোর দেন না কেন! ট্রেনিং-এ দেখা গেছে, মেয়েরা সেটা ফলো করে টুক করে জানালা খুলে ফেলে খুব তাড়াতাড়ি – আর ওদিকে ছেলেরা বিশাল শক্তিপ্রয়োগ করে ব্যর্থ হয়!
৪) হেলিকপ্টার জলে ল্যান্ড করে ডুবে গেল – আপনি পুরোপুরি জলের তলায়। এবার জলের তলায় গিয়ে হেলিকপ্টার গেল উলটে – মানে এবার আপনার মাথা নীচের দিকে, পা উপরের দিকে! বুঝতে পারছেন অবস্থা? ভাবছেন সোজা, এটা এমনকি ব্যাপার! সবচেয়ে মূল সমস্যা হল, এইভাবে উলটে গেলে প্রথমেই আপনার ওরিয়েন্টেশন-জ্ঞান লোপ পায় প্রায় – কোন দিকে জানালা আছে, সেটাই ঠিক করতে পারবেন না! প্রথম কাজ হচ্ছে আপনাকে সিটবেল্টের বিশেষ বাঁধন খোলা – উলটো অবস্থাতেই আপনাকে কুনুই এর চাপ দিয়ে জানালা খুলতে হবে – জানালা দিয়ে বেরিয়ে তবেই আপনি সোজা হতে পারবেন। মনে রাখবেন, এখানে আপনার কাছে কোনো কৃত্রিম অক্সিজেন নেই – যে ব্রিথিং হেল্পটা দেওয়া আছে, তাতে করে ৩০ সেকেন্ড মত চলবে। বুঝতেই পারছেন, এর মধ্যে আপনাকে জলের তলা থেকে বেরিয়ে মুখটা বের করতে হবে বাতাসে! আমি অনেকবার এই ট্রেনিং করেছি এবং প্রত্যেকবারই বেশ চাপের লেগেছে। অনেকে প্যানিকড হয়ে যায় – আর শেষ করতে পারে না ট্রেনিং।
যাই হোক – সেদিন হেলিকপ্টারে করে গিয়ে অফশোর প্ল্যাটফর্মে পোঁছলাম প্রথমে। তারপর সেখানে চেক-আউট করে আবার বোট নিয়ে গেলাম আমাদের যে জাহাজে যাবার কথা, সেখানে। সেই জাহাজের মূল রাঁধুনির সাথে আলাপ হয়ে গেল রাতে খেতে গিয়ে – আমি আর দাদা নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলছি দেখে সে এগিয়ে এল – বাংলাদেশের ছেলে। কিচেনে দু’জন বাঙালি কাজ করে – বেশ কিছু ভারতীয় শ্রমিক দেখলাম – বেশির ভাগ ছিল ফিলিপিনো, থাইল্যাণ্ড বা ইন্দোনেশিয়ান। বাংলাদেশের রাঁধুনি-ভাই আমাদের খুব রিকোয়েস্ট করতে লাগল, কি খেতে চাই স্পেশাল, সেই নিয়ে – লজ্জা লাগছিল একটু, কারণ সবাই এক খাবার খাচ্ছে, আর আমরা কি করে অন্য স্পেশাল খাবার খাই! কিন্তু শুনলে তো! বানিয়ে দিল স্পেশাল ‘চিকেন ৬৫’ এবং তার সাথে আরো নানাবিধ কিছু। তার পর থেকে বেশ কিছু স্পেশাল ডিস খাওয়াল সে আমাদের।
ভালোই কাটল ক’টা দিন – আমাদের জাহাজে রাতের শিফট ছিল না যে ক’টা দিন ছিলাম আমরা – তাই সন্ধের পর অখণ্ড সময় – বাইরের ডেকে বসে অনন্ত সমুদ্র দেখছি, কি মনোমুগ্ধকর রঙ। এই অতল জলের একদিকে সাউথ চায়না সি আর আরো অনেক দূরে কোনো একজায়গায় তা মিলিত হচ্ছে আন্দামান সি-এর সাথে। সূর্য, সমুদ্র বা আকাশ – কেউই নিজেদের নামের তোয়াক্কা করে না – নিজেদের মনে খেলা করে রঙ, গোধূলি, রাতের আঁধার, ঢেউয়ের শব্দ নিয়ে।
সে | 2001:1711:fa42:f421:7cf8:24d9:59b4:***:*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ১৪:১৪502129
জয় | 82.***.*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ১৫:২১502131
Amit | 202.16.***.*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ১৮:২৯502133
dc | 171.49.***.*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ১৮:৩৯502134
Abhyu | 47.39.***.*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:২৭502141
সম্বিৎ | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:৫১502142
kk | 68.184.***.*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ২২:১৬502143
kc | 188.7.***.*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:৪৬502151
4z | 136.23.***.*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:৫৪502152
aranya | 2601:84:4600:5410:e007:389a:5bc7:***:*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:৫৮502153
politician | 76.174.***.*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:৪৯502161
একক | ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ ১৭:৪৪502180
kaktarua | 192.82.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০১:৩৯502187
সুকি | 49.207.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:৪৯502188
সুকি | 49.207.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:৫৬502189
সুকি | 49.207.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:২৫502192
গোপীনাথ মন্ডল | 2409:4061:8d:4529:fd9f:ee7a:5a40:***:*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:১৪502199
ফাইসাল হোসেন | 157.43.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ২৩:০৪502206
aranya | 2600:1001:b021:4af7:c03c:780d:b2f6:***:*** | ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০২:০৬502209
Mrinmoy Laha | 58.182.***.*** | ০২ মে ২০২২ ১৭:১৬507115