আশা করি প্রথম পর্বে আপনারা সমগ্র কেল্লা নিজামত সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা লাভ করেছেন। পরবর্তী পর্বগুলিতে কেল্লা নিজামতের খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়গুলি সম্পর্কে নানান গল্পকথা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব। এই পর্বে কেল্লার আমির মহল নিয়ে বলব। নবাবি আমলে কেল্লার ভেতরের নবাব ও তার আত্মীয়-স্বজনদের বসবাসের জন্য নির্মিত হয়েছিল বহু সুরম্য প্রাসাদ। কিন্তু সেই সব প্রাসাদের সিংহভাগই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যে কয়েকটি প্রাসাদ এখনও রয়েছে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই পর্বের আলোচ্য আমির মহল। প্রাসাদের নাম আমির মহল হলেও কেল্লাবাসীদের কাছে কিন্তু প্রাসাদটি বালাখানা নামেই অধিক পরিচিত। প্রায় চোদ্দ বছর ধরে আমার কেল্লায় যাতায়াত। কিন্তু আমি নিজেও আমির মহলের খোঁজ পেয়েছি মাত্র বছর ছয়েক আগে। এই খোঁজ পাওয়ার গল্পটাও একটু অদ্ভুত। চলুন সেটাই আগে শুনে নেওয়া যাক –
খুব সম্ভবত ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের কোনো এক দুপুর বেলা। গুগল-ম্যাপে কেল্লা নিজামতের বিভিন্ন এলাকাগুলি খুঁটিয়ে দেখছিলাম। এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই আমার চোখ গিয়ে পড়ল ওয়াসিফ মঞ্জিল প্রাসাদের ঠিক পিছন দিকে গভীর জঙ্গলের ভিতর। প্রথমে বুঝতে না পারলেও, ভালো করে জুম করে দেখতেই দেখা গেল – জঙ্গলের ভেতরে প্রাসাদ আকৃতির কিছু একটা দেখা যাচ্ছে, যার বর্ণনায় ম্যাপে লেখা রয়েছে ‘নবাব মুর্শিদকুলি খানের প্রাসাদ’। এটা দেখে, ঠিক তারপর দিনই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম সেই প্রাসাদের খোঁজে কেল্লার উদ্দেশ্যে, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি ম্যাপে দেখানো সেই প্রাসাদের কোনো অস্তিত্বই বোঝা যাচ্ছেনা। স্থানীয় বহু মানুষকে জিজ্ঞেস করেও কোনো কিনারা করতে পারলাম না। ম্যাপ যে দিকে যেতে নির্দেশ করছে, সেদিক বড় বড় প্রাচীরে ঘেরা একটা লোহার দরজা আছে বটে, কিন্তু সেটাও লাগানো। সেই দরজার ভিতরে দেখা যাচ্ছে সবুজ ঘাসে ও আগাছায় মোড়া ফাঁকা স্থান এবং দূরে লম্বা ও উঁচু প্রাচীর দেখা যাচ্ছে, কিন্তু প্রাচীরের ওই পার দেখা যাচ্ছে না, ভেতরে যাওয়ার অন্য কোন পথও খুঁজে পেলাম না।
এভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেল। কেল্লায় আসি, মুর্শিদকুলি খানের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ সম্পর্কে সবাইকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু কেউই আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। আসলে তাদেরও জানা নেই এই বিষয়ে হয়তো। অনেকে ম্যাপ দেখেও প্রাসাদের সঠিক অবস্থানের কোনো খোঁজ আমাকে দিতে পারেনি, ফলে বারবার ব্যর্থ হতে হতে আমারও যেন একটা জেদ চেপে গেল। ভাবলাম যে ভাবেই হোক, নবাব মুর্শিদকুলি খানের সেই প্রাসাদে আমাকে যেতেই হবে। অবশেষে একদিন কেল্লা চত্বরেই খুঁজে পেলাম নিজামত পরিবারের এক প্রবীণ সদস্যকে। জানলাম ভদ্রলোকের নাম রেজা আলি মির্জা, কিন্তু সবাই তাকে ছোটে নবাব নামেই ডাকছে। আমি প্রথমে সেই ছোট নবাবের সাথে পরিচয় করলাম, দেখলাম ছোটে নবাব সাহেব বড্ড খোশ মেজাজের মানুষ। তাঁর সাথে নবাবি আমলের নানান কথা হতে লাগল। কথার ফাঁকেই আমি তাঁকে আমার উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ে দিয়েছি। মোবাইল ফোনে ম্যাপ দেখিয়ে লোকেশনটা একটু বুঝিয়ে দিতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আরে ইয়ে তো বেগম মহল হে, চলিয়ে মেরে সাথ, হাম আপকো বেগম মহলভি দিখায়েঙ্গে আউর বালাখানা ভি’।
নবাব সাহেবের কথা শুনে আমার মন ততক্ষণে বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। কিন্তু মনে একটা নতুন প্রশ্নেরও উদয় হয়েছে – ম্যাপে মুর্শিদকুলি খানের প্রাসাদ দেখালেও, নবাব সাহেব এই প্রাসাদটিকে বেগম মহল বলছেন কেন? তবে কি তিনি কোথাও ভুল করছেন? নাকি ম্যাপেই ভুল তথ্য দেওয়া আছে? আবার এর মধ্যেই মন বলে উঠল, ছোটে নবাব হয়ত ভুল বলবেন না, কারণ তাঁরা বংশপরম্পরায় কেল্লার ভিতরেই বসবাস করছেন। আমি থাকতে না পেরে নবাব সাহেবকে প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেই বসলাম। তিনি বললেন, এই বেগম মহল তাঁর নানা-র তৈরি। আর বালাখানা আরও পুরনো, এটা নবাব হুমায়ুন জা-র আমলে তৈরি। তিনি আরও জানালেন, নবাব মুর্শিদকুলি খানের কোনো প্রাসাদ নাকি এই চত্বরে কোনোদিনই ছিল না। নানান কথায় ইতিমধ্যেই কিছুটা সময় পার হয়ে গেছে। এবার আমাদের সেই প্রাসাদটি দেখতে যাওয়ার পালা। আমি ভাবছি, সবই তো বন্ধ, উনি আমাকে কোন দিক দিয়ে নিয়ে যান দেখব। ভাবতে ভাবতেই দেখি সেই পুরনো লোহার গেট খুলে তিনি এগিয়ে চললেন। আমিও তাঁকে অনুসরণ করে চলতে থাকলাম। ভেতরে প্রবেশ করতে দেখি – অন্য এক জগত। নবাব সাহেব সমগ্র এলাকাটি দেখিয়ে বললেন, এটি তাঁর নানা নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জার মহল সেরা এলাকা ছিল, যেখানে বেগমরা তাদের সন্তানদের নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে বসবাস করতেন।
কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়ল, একটি বিরাট আকৃতির জরাজীর্ণ দোতলা প্রাসাদ। আমি সেই প্রাসাদ দেখে ততক্ষণে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছি। নবাব সাহেব বললেন এটি নবাব হুমায়ুন জা-র বালাখানা প্রাসাদ (আমির মহল)। এই প্রাসাদটির ঠিক সামনেই জঙ্গলে ঢাকা ছিল সেই বেগম মহল যা আমি ম্যাপে দেখেছিলাম নবাব মুর্শিদকুলি খানের প্রাসাদ হিসেবে।
ছোটে নবাব সাহেবের সাথে বিশাল আকৃতির জরাজীর্ণ বালাখানার সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রাসাদের ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার সময় নবাব সাহেব জানালেন, বর্তমানে এই বালাখানাই নাকি কেল্লা নিজামতের সব থেকে পুরনো প্রাসাদ। এই প্রাসাদ নিয়ে একটি গল্পও শোনালেন, বালাখানা প্রাসাদের নির্মাণকাজ চলাকালীন, কোনো এক জরুরি কাজে নবাব হুমায়ুন জা-কে নাকি ইংল্যান্ড যেতে হয়েছিল। ইংল্যান্ডে তিনি উঠেছিলেন মহারাণী ভিক্টোরিয়ার বাকিংহাম প্যালেসে। অল্পবয়সী নবাব প্যালেস দেখে মুগ্ধ হয়ে যান, এবং মুর্শিদাবাদে বাকিংহাম প্যালেসের মত একটি প্রাসাদ নির্মাণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হুমায়ুন জা তাঁর সেই ইচ্ছের কথা একদিন সময় সুযোগ বুঝে রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছেও প্রকাশ করেন, এবং সেই মর্মে মহারাণীর কাছ থেকে একটি লিখিত অনুমতিও চেয়ে নিয়ে আসেন। মুর্শিদাবাদে ফিরেই তিনি বালাখানা প্রাসাদের নির্মাণকার্য বন্ধ করে, বাকিংহাম প্যালেসের আদলে একটি নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করার আদেশ দেন। সেদিনের সেই প্রাসাদটিই নাকি আজকের হাজারদুয়ারি।
ছোটে নবাবের এই গল্প আমি সেই মুহূর্তে বিশ্বাস করি, কিন্তু পরে এই গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে। কেন, কি প্রশ্ন জাগে, সে কথায় পরে আসছি। সেদিন গল্প বলার পর ছোটে নবাব সম্পূর্ণ প্রাসাদ ঘুরিয়ে দেখিয়ে প্রাসাদ সংক্রান্ত নানান কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। সেদিনের মতো বালাখানা প্রাসাদ ঘুরে, ছোটে নবাবকে বিদায় জানিয়ে বাড়ি ফিরে আসি, তারপর এই প্রাসাদ নিয়ে নানান খোঁজখবর শুরু করি। আসলে ইতিপূর্বে তো এই প্রাসাদের অস্তিত্বের কথাই জানতাম না, অথচ এই বিশাল প্রাসাদের প্রতি কৌতূহল জাগাটাই স্বাভাবিক। সেদিনের পর আমার মাথায় সব সময় বালাখানা ঘুরতে থাকল। মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত বহু অথেনটিক বই খুঁজেও এই প্রাসাদের কোনো সন্ধান পেলাম না। আশা করেছিলাম ১৯০৫ সালে প্রকাশিত পূর্ণ চন্দ্র মজুমদারের ‘মসনদ অফ মুর্শিদাবাদ’-এ অন্তত এই প্রাসাদের খোঁজ থাকবে, কারণ তাঁর বইতে মুর্শিদাবাদের সমস্ত ঐতিহাসিক স্থান সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন, কিন্তু সেখানেও এই প্রাসাদ সম্পর্কে কোনো তথ্যই নেই, ফলে কয়েকদিনের মধ্যে আবার বেরোলাম কেল্লার উদ্দেশ্যে।
এবার আগে থেকেই নিজামত পরিবারের বেশ কিছু প্রবীণ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে গিয়েছিলাম। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সৈয়দ মুহাম্মদ আব্বাস আলি মির্জা (সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী তিনি মুর্শিদাবাদের নবাব পদের যোগ্য উত্তরাধিকারী), ডাঃ সৈয়দ রেজা আলি খান, সৈয়দ বাকের আলি মির্জা প্রমুখরা। সবার সাথে কথা বলে সেদিন বালাখানা প্রাসাদ সম্পর্কে বহু তথ্য জানতে পারি। এখানে একটা কথা না বললেই নয় – নবাব সৈয়দ মুহাম্মদ আব্বাস আলি মির্জা সাহেবের সাথে কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন যে, লোকমুখে বালাখানা নামে পরিচিত হলেও এই প্রাসাদের আসল নাম ‘আমির মহল’। বেশ কিছু পুরনো কাগজপত্র দেখিয়ে সেকথা তিনি প্রমাণও করলেন আমার সামনে।
আমাকে ছোটে নবাব জানিয়েছিলেন, এই প্রাসাদ অসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু বাকিদের সাথে কথা বলে বুঝলাম, ছোটে নবাবের সেই কথার কোনো ভিত্তি নেই। এর মধ্যে আরও একটা মজার বিষয় ঘটল – নবাব পরিবারের এক সদস্য, সৈয়দ শাখাওয়াত মির্জা আমাকে তাঁর বাড়ি নিয়ে গিয়ে বালাখানা বা আমির মহলের একটি ছবি দেখালেন। খুব সম্ভবত সেই ছবি ষাটের দশকের হবে। ছবিতে দূর থেকে আমির মহল দেখা যাচ্ছে, দেখেই মনে হচ্ছে যেন নতুন প্রাসাদ। এছাড়াও বহু খুঁজে আমি ১৯৬৩ সালের মুর্শিদাবাদ অ্যাক্ট উদ্ধার করি। সেই অ্যাক্টের এক পাতায় এই আমির মহল প্রাসাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের সাথে কথা বলে এই প্রাসাদের ইতিহাস সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি এবার সেই গল্পে আসা যাক –
নাজাফি বংশের নবাবদের সময়, বিশেষ করে নবাব বাবর জং-এর সময় থেকে নবাবদের বসবাসের উপযোগী প্রাসাদের অভাব দেখা দেয়। নবাব যে প্রাসাদে থাকতেন, তা বয়সের ভারে জর্জরিত হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। একটা সময় ছিল, যখন প্রায় প্রতি বছর বন্যার জলে কেল্লা নিজামত প্লাবিত হত। পুরানো জরাজীর্ণ প্রাসাদগুলি বন্যার জলে ডুবে দুর্বল হয়ে পড়ত। কথিত রয়েছে, নবাব বাবর জং-এর আমলে একবার প্রবল বর্ষায় নবাবের প্রাসাদ জলমগ্ন হয়ে তা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়লে, নবাব বাধ্য হয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য কেল্লা ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদ নগরীর অন্যত্র বাড়িভাড়া নিয়ে থাকতে।
মিরজাফর-পরবর্তী নবাবদের সাধ থাকলেও, সাধ্য ছিল না নতুন প্রাসাদ নির্মাণের। এমনিতেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নানান বাহানায় নবাবদের বেতন কমিয়ে আনছিল। ফলে নবাবরা যা বেতন পেতেন, তা দিয়ে নবাবি ঠাটবাট বজায় রাখায় ছিল কষ্টকর। এই অবস্থায় তাঁদের পক্ষে নতুন প্রাসাদ নির্মাণ ছিল বিলাসিতার নামান্তর। কিন্তু পরিবার-পরিজন নিয়ে এভাবে বসবাস করাও ছিল খুব কষ্টসাধ্য। নিজামত পরিবারের পক্ষ থেকে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে তাঁদের পুরানো প্রাসাদের দৈন্যদশার কথা উল্লেখ করে, নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রচুর চিঠি লেখা হয়। চিঠি পেয়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আসে। নতুন প্রাসাদ তৈরির স্থান নির্বাচন, মাপ এবং খরচের হিসেব করেও, শেষ পর্যন্ত কাজ আটকে যেত টাকার জন্য। কারণ কোম্পানি চাইত না এই খাতে খরচ করতে। যাই হোক, মিরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগমের মৃত্যু হলে, তাঁর প্রাপ্ত বকেয়া ভাতা দিয়ে নিজামত তহবিল গঠিত হয়। স্থির হয়, এই তহবিলের একটা বড় অংশ খরচ করা হবে নিজামত পরিবারের উন্নতিকল্পে। নিজামত তহবিলের টাকা থেকে কয়েকটি প্রাসাদ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল। নিজামত তহবিলের টাকার একটা অংশ দিয়ে নবাব হুমায়ুন জাঁর আমলে কেল্লা নিজামতের ভেতরে নির্মিত হয় আমির মহল বা বালাখানা নামক এই বিরাট প্রাসাদটি। যদিও এই প্রাসাদটি নির্মাণের আগে নবাব হুমায়ুন জা-র পিতা কেল্লার দক্ষিণ দিকে মাত্র ১৫ হাজার টাকায় একটি ছোট প্রাসাদ কিনেছিলেন বলে নিজামত রেকর্ড থেকে জানা যায়, তবে সেই প্রাসাদও নবাবদের বসবাস করার পক্ষে উপযুক্ত ছিল না, আর দুঃখের বিষয় নবাব ওয়ালা জা’র আর্থিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল, যে প্রাসাদ কেনার মাত্র ১৫ হাজার টাকাও তিনি পরিশোধ করতে পারেননি।
হাজারদুয়ারির থেকেও আকারে বড় এই দ্বিতল প্রাসাদটির নিচ ও উপরতল মিলিয়ে প্রায় ৪০টিরও অধিক ঘর ছিল। প্রাসাদের নিচের তলার জানালাবিহীন ঘরগুলি প্রথমদিকে স্টোর-রুম হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, পরবর্তীতে সেগুলিতে প্রাসাদের পরিচারিকা ও নবাব-বেগমদের ভৃত্যরা থাকতেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে দোতলার ঘরগুলি ছিল নবাব, বেগম ও তাঁদের সন্তানদের বসবাসের জন্য। দোতলার ঘরগুলির সামনে রয়েছে কারুকার্য-খচিত স্তম্ভ-বিশিষ্ট লম্বা বারান্দা। প্রাসাদের দোতলায় প্রবেশ করার জন্য, প্রাসাদের মাঝামাঝি অংশে বাইরের দিক থেকে দু’টি প্যাঁচানো সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথমেই পড়বে বড় হলঘর বা অডিয়েন্স-রুম। এই অডিয়েন্স রুমের দুই পাশে রয়েছে প্রাসাদের বাকি ঘরগুলি।
নবাবি আমলে আমির মহল-এর জৌলুশ ছিল দেখার মত। ভাগীরথী নদীতীরে, মনোরম পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছিল এই প্রাসাদ। সিঁড়ি থেকে মেঝে – সব কিছুই মোড়া ছিল বিদেশি টাইলসে। ঘরগুলি সাজানো ছিল বহুমূল্য আসবাবপত্রে। এই প্রাসাদে প্রায়-সন্ধ্যায় বসত নাচ গানের আসর। সমগ্র এলাকা মেতে উঠত সারেঙ্গির মিষ্টি সুরে।
কথিত রয়েছে, বড় কোঠি বা হাজারদুয়ারি প্রাসাদ, নবাব হুমায়ুন জা আমির মহল নির্মাণের পর তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেই নতুন প্রাসাদ নবাবের মনোমতো হয়নি। সেই প্রাসাদে বেগমদের যথেষ্ট আব্রু রক্ষিত হবে না মনে করেই হয়তো নবাব তাঁর পরিবার সমেত এক রাতের বেশি এই প্রাসাদ থাকেননি। অবশেষে তিনি নাকি আমির মহলেই ফিরে আসেন, এবং বাকি জীবন সেখানেই অতিবাহিত করেন। তবে এর মধ্যে তিনি অবশ্য কেল্লা নিজামত থেকে কয়েক কিমি দূরে ফিন্ডেলবাগে একটি বাগানবাড়ি কিনেছিলেন। নবাব হুমায়ুন জা সেখানে মাঝে মধ্যে থাকলেও, আমির মহলই ছিল নবাবের আসল বাসস্থান।
শুধুমাত্র নবাব হুমায়ুন জা নন, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের নবাব, যেমন নবাব ফেরাদুন জা, হাসান আলি মির্জা, এবং নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জাও এই প্রাসাদে বসবাস করেছেন। আজও হাজারদুয়ারিতে গেলে দেখা যায় আমির মহলের দোতলার কোনো এক ঘরে দাঁড়িয়ে নবাব ফেরাদুন জা-র বিশাল আকৃতির ছবি। তবে বিলেত থেকে ফিরে নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জার রুচি অনেকটাই বদলে যায়। এছাড়া ১৮৯৭ সালের অসম ভূমিকম্পের তীব্র প্রভাব পড়েছিল মুর্শিদাবাদে। ভূমিকম্পের প্রকোপে মুর্শিদাবাদের নবাবি আমলের বহু স্থাপত্য ধুলোয় মিশে গিয়েছিল। এবং যেগুলি ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল, সেগুলিও নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। এই ভূমিকম্পে আমির মহলের একটি অংশ ভেঙে পড়েছিল। পরবর্তীতে নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জা আমির মহলের ভেঙে যাওয়া অংশটিতে নিজের বসবাসের জন্য নতুন করে একটি ছোট প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা ‘ওয়াসিফ মঞ্জিল’ নামে পরিচিতি পায়।
ওয়াসিফ আলি মির্জা নবাব হওয়ার পর, বহু অর্থ কষ্ট থাকা সত্ত্বেও, বেশ কিছু প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাসাদ ছিল বেগম মহল, সোনামহল প্রভৃতি। অন্যদিকে বয়সের ভারে জর্জরিত আমির মহল তখন বসবাসের যোগ্য ছিল না। তাছাড়া নতুন প্রাসাদ নির্মাণ হওয়ার ফলে কেউই আমির মহল সংস্কার করে সেখানে বসবাস করার কথা ভাবেনি। ফলে তখন থেকেই আমির মহল ক্রমশ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতে থাকে। এদিকে নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জার নির্দেশে বিংশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে কেল্লায় অবস্থিত অন্যান্য প্রাসাদগুলি দেখাশোনা করার জন্য আমির মহলে একটি দপ্তর খোলা হয়েছিল বলে কথিত রয়েছে। আরও পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে বিংশ শতকের ষাটের দশকে, আমির মহলটি পুনরায় সংস্কার করে নিজামত পরিবারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের বসবাসের জন্য দেওয়া হয়। এবং এই মহলে তাঁরা প্রায় দুই দশক বসবাস করেন। নবাব ওয়াসিফ আলির পর এই মহলটি নানান আইনি জটিলতায় জড়িয়ে জনশূন্য হয়ে পড়ে।
আজ, এতদিন পরেও, আমির মহলের আইনি জটিলতা দূর হয়নি। সেই সাথে এলাকাবাসীর ইতিহাস সচেতনতার অভাবে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে আমির মহল ধ্বংসের প্রহর গুনছে। বহু পূর্বেই এই বিশাল প্রাসাদটির ছাদের সিংহভাগই ভেঙে পড়েছে। বর্তমানে প্রতিনিয়তই প্রাসাদটির নানান অংশ একটু, একটু ভেঙে পড়ছে। কয়েকমাস আগে প্রাসাদের দোতলায় ওঠার কারুকার্যময় রেলিংটি ভেঙে পড়েছে। কিন্তু তাতে অবশ্য কারোরই কিছু এসে যায়নি। এভাবেই একদিন হয়ত সমগ্র প্রাসাদটিই ভেঙে পড়বে।
যেদিন থেকে আমির মহল চিনেছি, সেদিন থেকে কেল্লায় গিয়ে আমির মহলে না গেলে মনখারাপ করে। সেই ২০১৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কতবার যে আমির মহলে গিয়েছি, তার কোনো হিসেব নেই। কিন্তু যতবারই যাই, নতুন লাগে। আমির মহলের নিচের ঘরগুলিতে বর্তমানে কিছু অসহায় মানুষ বসবাস করেন। অজস্রবার এই প্রাসাদে যাওয়ার ফলে, সেইসব মানুষদের সাথেও আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। আজও আমির মহলের ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে, কিংবা ছাদহীন শত-জীর্ণ ঘরগুলিতে ঘোরার সময়, গা ছমছম করে ওঠে। মহলের লম্বা বারান্দা থেকে যখন সামনের জঙ্গলে ঢাকা বেগম মহল কিম্বা ধ্বংসস্তূপে পরিপূর্ণ, উঁচু প্রাচীর দিয়ে চারদিক ঘেরা সমগ্র মহলসারার দিকে চোখ পড়ে, তখন মন হারিয়ে যায় সেই নবাবি আমলে। চোখের সামনের সেই জঙ্গল পরিণত হয় নবাবি আমলে দেশি বিদেশি নানান সুগন্ধি ফুলের বাগানে, জরাজীর্ণ প্রাসাদ গুলিও সব নতুন হয়ে ওঠে, নিস্তব্ধ চারিদিক যেন মুহূর্তেই কোলাহলে পূর্ণ হয়ে যায়। দূর থেকে কানে ভেসে আসে আজানের সুর, কিন্তু হঠাৎ সম্বিৎ ফিরতেই দেখি আমির মহলে সন্ধ্যা নেমেছে। গভীর জঙ্গল যেন আরও রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে।