দুটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস, একটি মগ কবলিত লুন্ঠনক্লান্ত বাংলার রক্তাক্ত হৃদয়কে করপুটে রেখেছে, অন্যটি এঁকেছে মানুষ মানুষীর মধ্যে সেই আকস্মিক অপ্রতিরোধ্য টান, যার নাম প্রেম, এবং সে সংক্রান্ত জটিলতা, অসহায়তা। প্রথমটি যদি ইতিহাসআশ্রিত, দ্বিতীয়টির আধার মানুষের মন, বিচিত্র আর অপ্রত্যাশিত বাঁক নিতে যে সদাই প্রস্তুত।
কে না জানে, ইতিহাস তো শুধু ইমারত বা অস্ত্রের ঝনঝন নয়, মানুষই সেখানে মূল, সেই-ই ইমারতের পাথর টানে, অস্ত্র চালায় আবার ঘরবসত বসায়, সন্তানের মুখচুম্বন করে। ফলে মগ-আক্রান্ত বাংলার আখ্যানটিতেও শেষ অব্দি সব্যসাচী মানুষই থাকলো কেন্দ্রে, তার হরেক হাসিকান্না মারিমড়ক নিয়ে।
তাহলে অভিজিৎ সেনের এই দুটি উপন্যাসই মানুষকে তার নানা সম্পর্ক, নানা পরিপ্রেক্ষিতের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। রোদে সেদ্ধ চাল শুকোনোর মতো কলম দিয়ে উল্টেপাল্টে আউলা ঝাউলা করে ছাড়ে তার প্রতিটি প্রতিক্রিয়াকে। আদর্শ বা পূর্ণ মানবের দেহরেখা আঁকার কোনো চেষ্টাই করে না, অপূর্ণতা আর অসহায়তার রঙে চুবিয়ে তোলে আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব। শেষ করে পাঠক ফুঁপিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু সেজন্য তার লজ্জা হবে না। এই অপূর্ণতার অশ্রুই আমাদের ভবিতব্য !
মৌসুমি সমুদ্রের উপকূলের প্রারম্ভে যে দীর্ঘ কথামুখ তা গোটা উপন্যাসের সুর বেঁধে দেয়। ক্ষেমংকর, শর্মিষ্ঠা, আউলাকেশী ডি সিলভা, প্রমথনাথ, মাধবীর জীবনের সঙ্গে অদৃশ্য যোগাযোগের সুতোয় উপন্যাসের প্রেক্ষিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আরাকান রাজবংশ, চার শ্বেতহস্তী, সুশাসক শায়েস্তা খাঁ-য়ের মগ দস্যু দমনের সমস্ত প্রচেষ্টা, ওলন্দাজ ও পর্তুগীজ নৌবহরের দাপট।
তারপর একের পর এক পটচিত্রের মতো সামনে আসতে থাকে ভাগ্যনির্ভর পলায়নপর বাঙালির সংগ্রাম বিমুখতা, হিন্দু ধর্মের জগদ্দল অনড়তা এবং নানা অমানবিক আচার, সেইকারণে নির্যাতিত মানুষের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, খ্রীষ্ট ধর্মে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা, গরু-ছাগলের মতো লুন্ঠিত মানুষকে দাস হিসেবে বিক্রি করা। কোনো গ্রাম লুঠ হলে লাঞ্ছনা বলাৎকারের মধ্যে কোনও প্রতিরোধের চিনহ দেখতে পাওয়া যেত না। "মগ জানে এই হিন্দুরা বিচিত্র মানসিকতার মানুষ। শুধুমাত্র মগ স্পর্শেই এদের জাত যাবে।" তাই প্রতিরোধ করবে কী, সবাই জাত বাঁচাতেই ব্যস্ত।
ক্ষেমঙ্কর সুচিকিৎসক, প্রমথনাথের দ্বিতীয় বিবাহের পুত্র, কিন্তু তার মা ছিলেন মগলাঞ্ছিত নারী, সেই দোষে হিন্দু সমাজ তাকে চিরকাল নিচু নজরে দেখেছে। তখন প্রথাই ছিল এই যে আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও কোনো অসহায় নারীকে ফিরিঙ্গিরা তুলে নিয়ে গেলে পরের বহু প্রজন্মকে সেই কলঙ্ক বহন করতে হতো। বহিরাগত দস্যুরা অন্যান্যদের সঙ্গে ক্ষেমঙ্করের ব্রাহ্মণ পন্ডিত সখা বিষ্ণুপ্রিয়ের স্ত্রী এবং কন্যাদের লুঠ করে নিয়ে নানা অকথ্য যৌনাচারে বাধ্য করে, তাদের হাতের তালুতে বেত ঢুকিয়ে পশুর মতো একসঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। মোটা পণ দিয়ে তাদের কিনে না আনলে দস্যুরা তাদের নিয়ে যে কী করবে কেউ জানে না। ক্ষেমঙ্কর পণ দিতে প্রস্তুত, কিন্তু সমাজপতিরা মগস্পৃষ্ট নারীকে বাঁচতে দিতেও রাজি নয়। স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়া এবং অর্ধমৃত বন্ধুকন্যাকে বিবাহ করা ছাড়া ক্ষেমঙ্করের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।
এই উপন্যাসটির বয়নসৌকর্ষ অতুলনীয়, কিন্তু এতো চরিত্রের ভিড়ে পাঠক যেন কখনো কখনো কোনো মুখকে ভুলে যান!
বালা লখিন্দরের আখ্যানে অতো অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই, ইতিহাসের আড়ম্বর অনুপস্থিত, কিন্তু পুরো মাত্রায় রয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার নানা বিড়ম্বনা, মনস্তাত্ত্বিক মোচড় এবং ভালবাসার নানা রঙ। রয়েছে লুকোনো অদৃশ্য অস্ত্রের ধার, বার বার যা বিদ্যাকে ধ্বস্ত করে। মানত করা ছেলে বালার যে মৃত্যু কামনা করে মায়নো, কবিরাজ যে নিজের সব সম্পত্তি দিয়ে দেবার পরও বিদ্যাকে যাকে মনে ধরে তাকে বিয়ে করতে বলে যায় বা চৌকাঠে এক পা, আরেক পা বাইরে বালা যে তার মাকে বলে, "মঁয় তোক দুঃখ দিয়া নিজে সুখী হবা চাঁও না। কিন্তু তোর মোর সুখ দুঃখের বাইরে আরও কিছু থাকে" এসবের উৎস যদি ভালবাসা নামের অব্যাখ্যাত অনুভূতিটি না হয়, তাহলে আর কী !
আশ্চর্য চরিত্রচিত্রণ মূল চরিত্র বিদ্যার। লম্পট বাবা, রুগ্ন মা আর তার নিজের সৌন্দর্য নিয়ে চির বিব্রত পথের মেয়েটিকে কতোবার ধর্ষিতা হতে হলো। তবু গেল না তার অন্তরের লালিত্য, হৃদয়ের শুভবোধ। তার জীবনেই প্রেম আর সুস্থতার আশ্বাস নিয়ে এলো মহাকায় কিন্তু শিশুসরল বালা লখিন্দর। পারবে কি তারা সামাজিক পারিবারিক বাধা পেরোতে?
আখ্যানটি পাঠককে কাঁদায়, তার অনুভবের ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দেয় !
সুপ্রকাশের তরুণ কর্ণধাররা শুরু থেকেই বইপাড়ায় সুনামের ভাগী হয়েছেন। চমৎকার প্রচ্ছদ, বাঁধাই, নির্বাচন, সবই তাদের পক্ষে যায়। অভিজিৎ সেনের এই ভুলে যাওয়া উপন্যাসদুটির পুনর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করে তারা পাঠকের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। কিন্তু এই দুটি উপন্যাস ছাপার ভুলমুক্ত হলে আরও ভালো লাগতো। দুটো উদাহরণ দিই। পৃষ্ঠা ১৬, পদ্মপুরাণে বুদ্ধের প্রশংসা প্রসঙ্গে লেখা হলো, "তুমি যজ্ঞনিন্দা করেছে, তোমাকে নমস্কার।" বলা বাহুল্য, করেছে নয় করেছ হবে। ৯৩ পাতায় নিমসানি পরের লাইনেই হয়ে গেল মিনসানি, নরপতিগি হল রনপতিগি।
প্রিয় লেখক, পড়ার ইচ্ছে রইলো।
রিভিউ পড়ে খুব ভালো লাগল। বইটা এখনো পড়া হয়নি। এবার পড়ে ফেলব। ❤️
মনে হচ্ছে বই দুটো এখুনি পড়ে ফেলি। তোমার বর্ণনাতেই মন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। পড়তেই হবে!
রহু চন্ডালের হাড় ও পরে আরো কিছু ছোটগল্প দুর্দান্ত লেগেছিল। কিন্তু তারপরে বিভিন্ন শারদীয়ায় বেরোন লেখা পড়ে বেশ খানিকটা হতাশ হয়েছিলাম, ফলে এই বইটার প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখেও খুব একটা আগ্রহ পাই নি পড়ার। এই রিভিউ পড়ে মনে হল এ বইটা পড়ে দেখলেও হয়।
এই মগ ছুঁলে জাত যাওয়া এরই আরেক অধ্যায় ছিল দেশভাগ পরবর্তী দাঙ্গার সময়। বাড়ির মেয়েদের লুঠ করেছে দুই ধর্মেরই লোকজন। কিন্তু মুসলমান মেয়েদের ফিরিয়ে আনলে তাদের বাড়ি নিতে তত আপত্তি দেখা যায় নি যতটা হিন্দু মেয়েদের ফিরিয়ে আনলে দেখা গেছে। ইন ফ্যাক্ট মিলখা সিঙ্এর আত্মজীবনীতেও আছে না ওঁর বোনকে তাঁর দাদার শ্বশুরবাড়িতে অপমানকরত ঐ দাঙ্গার সময়কার জন্য।
আবার অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে এই অপাংক্তেয় হয়ে যাওয়া নেই এমনও না। মুক্তিযুদ্ধের পরে সমস্ত ধর্ষিতা মহিলাকে শেখ মুজিব 'বীরাঙ্গনা' খেতাব দেন। কিন্তু তাদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন নি, ঐ খেতাব নিয়ে খুব কিছু লাভও হয় নি। বরং সংসারে অ্যাকসেপ্টেবিলিটি বাড়ানোর ব্যপারে উদ্যোগ নিলে ভাল হত।
পাঠ-প্রতিক্রিয়া পঠনের আগ্রহ জাগায়। বইটি লিস্টিতে তুলে নেওয়া গেলো।
চমৎকার ভাবে বই পড়তে আগ্রহী করে তুলেছেন /