মানছি, খাওয়াটা একটা মোচ্ছোব। কিন্তু খাওয়া মানে তো শুধুই রসনাতৃপ্তিই নয়, এটা একটা সংস্কৃতি। একটা সামাজিক অনুষ্ঠানও। তাই খাওয়ার একটা আচার (আরে রিচুয়াল, রিচুয়াল। খাবার আচার নয়) আছে, রয়েছে ব্যাকরণও।
দিশি আইটি কোম্পানিগুলি যখন হুলিয়ে ছেলেপুলেদের বিলেতে, আমেরিকাতে পাঠাতে শুরু করলেন তখন বিদেশে নানান অনুষ্ঠানে প্রচুর, ওই যে যে, আপনারা কী একটা বলেন না—‘ফোপা’ না কী একটা, আমরা যাকে বলি কেলোর কীর্তি—সেই সব করে আসতেন। এখন তো শুনি পেশাদার মানুষেরা রীতিমতন ইস্কুল খুলে আদবকায়দা শিখিয়ে দেন।
প্রথমে ধরুন টাইমিং। আমাদের নেই। নেই তো নেই। সন্ধ্যাবেলা ডিনারে ডাকলে রাত নটা, সাড়ে নটার আগে কেউ আসে না। ততক্ষণে ভাজাগুলো মিইয়ে গেছে, রুটিগুলো ঠান্ডা। অসুবিধে কিছু নেই, ড্রিংক যদি থাকে তো লোকে নানান হাবিজাবি (স্টার্টার) দিয়ে হুলিয়ে খাওয়া শুরু করেন ও নাগাড়ে ড্রিংক করে যেতে থাকেন। তারপরে রাত বারোটা নাগাদ, ‘‘ও হো, ডিনার খাবে না?’’ বলে হুড়মুড়িয়ে যাহোক একটা পেটে চালান করে দিলেন। সেটা চিকেন ল্যাবরাডর না ঢ্যাঁঢ়শের বনগুগলি, তা বুঝবার আর ক্ষমতা নেই। আর আপনি যদি মদ না খান বা কড়া ধাঁচের NRI হন, তো খুবই আতান্তরে (গাড্ডা, অসুবিধা) পড়বেন।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল—বছর আট দশ আগে—এই গুরুচন্ডা৯-র এক মহামিলন হল ব্যাঙ্গালোরের এক রেস্তোরাঁয়। উপলক্ষ এক সদ্য আমেরিকা-ফেরৎ মহানের আগমন। লাঞ্চের নেমন্তন্ন শুনে তিনি হাসি হাসি মুখে বেলা বারোটা নাগাদ দরজায় বেল দিলে আমি তো হেসেই কুরুক্ষেত্র। বলি, কদ্দিন NRI হয়েছ হে? এখন তো দাঁত মাজার সময়। বেলা তিনটের আগে লাঞ্চ শুরুই হবে না। সেরকমই হল। অবশেষে বেলা পাঁচটা নাগাদ শেষপাতের মিষ্টিটুকুও খেয়ে যখন বাড়ির পথে তখনও দেখি কিছু লাঞ্চপ্রত্যাশী মানুষ সবে ঢুকছেন।
ভালো কথা। আমার অল্পবয়সে পেট ভরে খেয়ে ঢেকুর তোলাটা মোটেই অভব্যতা ছিল না। হোস্টও খুব খুশি হতেন। আমার দাদার কাছে শুনেছি, (আমেরিকাতে) দুজন নাইজেরিয়ান বন্ধুকে ডিনারে ডাকলে তারা খাবার দেওয়ামাত্র দু-এক চামচ মুখে দিয়ে বাঘ্রগর্জনের মতন উদ্গার শুরু করলেন। খুব অল্পই খেলেন। বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়ায়, পরে জানিয়েছিলেন লোকের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেলে বাড়ির থেকেই প্রচুর সাঁটিয়ে যেতে হয়। তারপর সামান্য খেয়েই ‘পেট ভরে গেছে’ বলে সশব্দ প্রমাণ দিয়ে জানান দিতে হয় আমি কিন্তু হ্যাংলা নই।
সেই বাতাপি ও ইল্বল রাক্ষসের কথা তো জানেনই, তাও একটু ধরতাই দিই। এঁনারা ঋষিদের খেতে ডাকতেন আর বাতাপি তখন ভেড়ার রূপ ধরত। তাকে কেটেকুটে রান্না করে ঋষিকে খাইয়ে দিয়ে ইল্বল ‘বাতাপি বাতাপি’ বলে ডাকলেই, সেই রাক্ষস ঋষির পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসত। এই প্ল্যান করে একদিন অগস্ত্য মুনিকেও ডেকে খাইয়ে দিয়ে ইল্বল যখন ‘বাতাপি ও বাতাপি’ করে ডেকেছেন তখন অগস্ত্যের সে কী হাসি। বলেন, ওরে রাক্ষস ব্যাটা। সে আর নাই রে নাই। আমার পেটে ঢুকে সে বেবাক হজম হয়ে গিয়েছে, বলে ‘তাঁর অধোদেশ হইতে মহামেঘের ন্যায় গর্জন করিয়া বায়ু নিঃসারিত’ করিয়া অকাট্য প্রমাণ দিয়েদিলেন। আরে ছ্যা ছ্যা। একটু ঢেকুর তুলেও তো প্রমাণ দেওয়া যেত।
তো সেই দিন আর নেই। লোকে বিয়েবাড়িতে খেতে গেলে মাছ-মাংস-মিষ্টি নিয়ে লোকদেখানো হ্যাংলামি করত। সেটাই দস্তুর ছিল। গৃহকর্তাও ভীষণ জোরাজুরি করে আরও খাও আরও খাও করে স্নেহের অত্যাচার করতেন। বিদ্যাসাগর মশাই লিখেছিলেন ‘‘হাঁ হাঁ দেয়ং, দেয়ংচ করকম্পনে। শিরশ্চালনে দেয়ং, ন দেয়ং ব্যাঘ্রঝম্পনে।’’ মানে, আরে না না, হাঁ হাঁ করেন কী, ব্যাস ব্যাস—এইসব করলেও জোর করে খাবার দিয়ে দেবেন, তবে বাঘের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে কলাপাতাকে আগলে রাখলে তখন বুঝবেন সত্যিই বাড়াবাড়িটা বেশি হয়ে গেছে। তখন থামবেন।
এখন তো আর পাত পেড়ে পরিবেশন হয় না, বুফেতে খাবার থাকে। নিজের মতন ঢেলেঢুলে খেতে হয়। বাড়ি ফেরার সময় স্মিত হেসে গৃহকর্তা ‘‘পেট ভরে ইয়ে করেছেন তো’’ প্রশ্ন করলে হেঁহেঁ করে হেসে, “ওফ, বাবারে। খুব খুব” বলে দিলেই দু-পক্ষ থেকেই শিষ্টতা বজায় থাকে।
আর এসব তো এটিকেটের ব্যাপার। টেবল ম্যানার্স। বিলেতে নাকি টেবলে বসে মুচমুচে টোস্টে মাখন লাগিয়ে কচরমচর শব্দ করে খেলে লোকে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। ভব্যতা হচ্ছে টোস্টটিকে ভেঙে ছোটো ছোটো পিস করে প্রায় নিজের কোলের কাছে এনে মাখনটা মাখিয়ে প্রায় নিঃশব্দে খাওয়া। সর্বজনসমক্ষে মাখন লাগানো দেখলেও অনেকের গা রি রি করে। শোনা কথা।
তবে ব্যাকরণও তো আছে। কীসের সাথে কী খাবেন না জেনেই দড়াম করে তো যাচ্ছেতাই খেতে পারেন না। লুচি দিয়ে কেউ আলুপোস্তো খায়? বা পাবদা মাছের ঝাল দিয়ে পরোটা? রবি ঠাকুর পষ্টই লিখেছেন বিলাতের কথা—মৎস্যর সহিত রাই না খাইয়া কেহ টমাটো কেচাপ দিয়া খাইলে বাকী অভ্যাগতেরা এমনই বিস্মিত হইয়া লোকদেখানো ঢং করিতে থাকেন যে ইচ্ছা হয় কানের গোড়ায় ঠাটাইয়া দু’ঘা দিয়া দি। (অনেকদিন আগে পড়া, স্মৃতি থেকে লিখছি—এক-আট্টু ভুলভাল হতেই পারে)।
ঠাকুরও কইতেন, ওরে পোদো, আম খেতে এইচিস, আম খে-নে। কার আম, কী দিয়ে তৈরি, কত কিলোওয়াট ক্যালোরি আছে এইসব জেনে কী হবে বল? এর মধ্যেই যে বেদান্তের মূলকথা ঘাপটি মেরে বসে আছে—সেটা খেয়াল করেছেন তো?
তবে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা টেঁটিয়া লোক, ঘাগু লোক। যাকে বলে সর্বজ্ঞ। আমজনতা যে কদ্দূর অসভ্য হয় বলতে আপনি গোল গোল চোখ করে খুব ইন্টেরেস্টিং গল্প শুরু করলেন, বললেন ‘‘আরে আমার শ্বশুরমশাই, যেমন কিপটে তেমনি গেঁয়ো। জানেন, গরম চা দিলে হুউউউশ হুউউউশ করে বিশ্রী আওয়াজ করে এমনি করেন যে খুব এমবেরাসিং মশাই।’’ প্রাজ্ঞ ব্যক্তি চোখ দুটো ছুঁচোলো করে বলেন, ‘‘ওটা কিন্তু বেশ জাপানি ভব্যতা। নুডল স্যুপ দিলে ওরা ভয়ংকর অ্যানাকোন্ডা সাপের মতন গর্জন করে খায়। রেস্টুরেন্টেও। এইত্তো সেবার কোবেতে... ।’’ আপনি মুষড়ে পড়েন। আপনি না গিয়েছেন কোবেতে না দেখেছেন অ্যানাকোন্ডা সাপ। তাও আমতা আমতা করে বলেন ‘‘তায় চায়ের সাথে বিসকুট দিলে সেগুলো আবার চায়ে ডুবিয়ে ল্যাতপ্যাতে করে খায়। লোকের বাড়িতেও। সে যা... ।’’ আপনাকে থামিয়ে দিয়ে প্রাজ্ঞ মানুষটি বলেন, ‘‘বিস্কিট চায়ে ডুবিয়ে খাওয়ার সম্ভ্রান্ত এগজাম্পল তো আছেই। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে কুইন ভিক্টোরিয়া চা পানে নিমন্ত্রণ করেছেন। চা আর বিস্কিট দিলে দ্বারকানাথ টপাস করে চায়ে ডুবিয়ে খেতে থাকলে বাকি সব নিমন্ত্রিত হোমড়াচোমড়রা একেবারে নাক সিঁটকে অস্থির। তখন ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে কুইন ভিক্টোরিয়াও চায়ে বিস্কিট ডুবিয়ে খেতে শুরু করলেন। ব্যাস। পাত্র মিত্র ডাক্তার মোক্তার তখন সবাই ওইরকম চায়ে ভেজানো বিস্কিট খেতে শুরু করল। ক্রমে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাবে ওই ট্র্যাডিশন।’’
আপনি এতই ডিপ্রেসড হয়ে পড়লেন যে আপনার শ্বশুরমশাই যে চা দিলে সেটা প্লেটের ওপর ঢেলে খান, তার জামায় যে টুথপেস্ট লেগে থাকে, এইসব গল্প আর করতেই পারলেন না। ভেরি স্যাড।
এইসব গল্প ছাড়াও আমিষের ছোঁয়া, এঁটো—হ্যানত্যান এইসব কায়দাকানুন না জানলেও অনেকক্ষেত্রেই খুব মুশকিল হয়। আমার খুড়শ্বশুরের বাড়িতে তো... আচ্ছা, সেটা না হয় আর-একবার বলব।
খাবেন কিছু? চিকেন টিকেন?
এইটা ট্রাই করতে পারেন। চিকেন হোলকারি।
১. শুনুন, ব্রয়লার চিকেনই খাচ্ছেন তো? তো প্রথমেই অল্প করে একটু ভেজে নিন। জাস্ট ওলটপালট। ওতে নাকি মুরগিটা ভালো করে seal হয়ে যায়। ফ্লেভারটা জমজমাট হয়।
২. তারপরে একটা মিহি পেস্ট করুন। পেঁয়াজ, আদা, রসুন। কসুরি মেথি, আস্ত গরমমশলা, কাজুবাদাম, পোস্তো, কাঁচালঙ্কা। আর দই।
৩. এবারে ওই পেস্টটা ভাজুন।
৪. ওতে চিকেন দিয়ে দিন। ভাজুন।
৫. আরে রাম রাম। জল দেবেন না। দুধ দিয়ে সেদ্ধ করুন। ব্যাস।
মোটেই ক্যালোরি গুনবেন না। ওজন কমিয়ে সংসারের কোন্ উপকারে আসবেন শুনি?
ওইসব ছেলেছোকরাদের কথায় ভুলবেন না। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ওমনি রুবেনসের হৃষ্টপুষ্ট মডেলদের গল্প শুনিয়ে আপনাকে বোকা বানিয়ে দেবে।
টুউউ গুড
আহা, আহা। কোথায় লাগে যশ নুসরত!!
হায় রুবেনসের মডেল! তোমার দিন গিয়াছে!
এইটের নাম করে সেষে চিকেনের হোলকারি খাওয়ানো হল - ইটি কি নাইজেরিয়ান রীতি? (জিজ্ঞাসু ইমোজি)
নট দ্যাট ইট ওয়াজ এনি লেস অসাম
৫নং স্টেপটা পড়তে গিয়ে প্রথমেই মনে হলো আরে রাম রাম জল দিয়ে না রাম দিয়ে সেদ্ধ করুন। ভাবছি -- দুধের বদলে রাম দিয়ে সেদ্ধ করা কি লুচি দিয়ে পোস্ত খাবার মতো কিছু হতো?
ফুচকার মধ্যে তেঁতুলজলের বদলে রাম দিয়ে খেত। এটা একটা সিনেমায় ছিল। ঃ-)
সেরাম হইছে!
দুপুর বারোটায় যে NRI খেতে গেছিল,সে আমি নই।
- অনুমত্যানুসারে
ঠাকুরঘরে কে রে??
:-)))))
ডিডি-দার এই সিরিজ ব্যাপক হচ্ছে :)
ন্যাড়াদা তো হাটখোলার বাসিন্দে . আপনি আবার NRI হলেন কোদ্দিয়ে ?
দুরন্ত সিরিজ। কোনো কথা হবে না।
প্রতিটি পর্বের শেষে আমাদের ভরা মন, এক গাল হাসি-
এসব আজকাল সুলভ নয়।
দুধ দিয়ে মাংস বানানো দেখেছি এবং খেয়েছিও ।..এটাএকবার করে দেখবো ।...নাম দেব ""চিকেন দুধ রেসত্ত ""
আহা বড্ড ভালো। ঐ হাঁ হাঁ দেয়ং-টা মুজতবা আলীতে পড়েছিলুম। ওতে আর একটা হুঁ হুঁ দেয়ং ছিল মনে হচ্ছে। বাকি সব এক্কেবারে টইটম্বুর। হোলকারিটা একদিন করে দেখতে হচ্ছে
আরিব্বাস, এ তো দুর্দান্ত সিরিজ ! ফাটাফাটি !