বৈঠকখানা -- নামের মধ্যেই বেশ একটা ব্যাপার আছে, বলুন? শীতসকালের নরম রোদে চায়ের আমেজ আছে তাতে, বন্ধুবান্ধবদের ভিড় করে আসা আছে, মধ্যবিত্তের অতিথিবাৎসল্য ছুঁয়ে আছে সেই শব্দ, আছে আড্ডার আভাস, আর ছুটির, বিশ্রামের আনন্দ!
বেশ, তবে তাই হোক না হয়! বৌ-বাজারের নিতান্তই ফাঁকা তল্লাট থেকে যদ্দূর চোখ যায়, দেখা যায় পড়শি শিয়ালদহকে। আর শিয়ালদহের প্রতিবেশী বৈঠকখানা। আশ্চর্য ব্যাপার এইটে যে সেকালে বাঙালি বাবুর চা-জলযোগান্তে আড্ডা মশকরার তেমন একটা ইতিহাস না পাওয়া গেলেও বৈঠকখানার সঙ্গে অদ্ভুত এক বিশ্রামের গল্প, ইতিহাস জড়িয়ে আছে। বৈঠকখানা চত্বরে অন্যান্য গাছপালার দঙ্গলে ছিল এক বিরাট, বুড়ো গাছ। ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছিল সে চারপাশে, পাখিদের আশায়। আর তার ছায়ায় বসে দু'দণ্ড জিরিয়ে নিত কাজে চলা কোনো পথিক। এমনই এক পথিকের নাম ছিল জোব চার্নক! ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে যখনই চার্নকমশায় আসতেন সুতানুটি পেরিয়ে কলকাতা গ্রামে, নিয়ম করে বসতেন এই গাছের তলায়। নানা ব্যবসায়ী আসতো তাঁর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে; আর সেই সব কাজের ফাঁকে ফাঁকে চার্নক চোখ মেলে দিতেন দূরে, ভাবতেন, একদিন ওই দিগন্তকে সীমানা করেই গড়বেন তাঁর সাধের এক নতুন শহর, নাম দেবেন কলকাতা।
দৃষ্টি ফিরে আসে বৌ-বাজারে। একটু এগিয়ে ঢুকে পড়ি মিশন রো-য়ে। এই রাস্তার কথা বলতে গেলেই উঠে আসে ড্যানিশ মিশনারি কিয়েরন্যান্ডারের নাম -- ১৭৭০ নাগাদ পার্ক স্ট্রিট কবরখানা তৈরির পাশাপাশি ভদ্রলোক হাত লাগিয়েছিলেন এই রাস্তায় একটি চার্চ গড়ার কাজে। দানধ্যান করা ভক্ত মানুষ, টাকার টান ছিল না একদমই। এই চার্চ তৈরিতে সেকালের হিসাবে খরচ হয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। অনুমান করা হয়, পুরো খরচই দিয়েছিলেন কিয়েরন্যান্ডার। বুঝতেই পারছেন, মিশনারির এই কাজকম্মের জোরেই রাস্তার নাম হয়ে ওঠে মিশন রো, কিন্তু তার আগে জায়গাটার নাম কী ছিল জানেন? 'রোপ-ওয়াক'। কেন, কে জানে! ইতিহাস লিখে রাখেনি এসব। হয়তো এই এলাকায় 'রোপ-ওয়াক' খেলা দেখানো হতো, হয়তো সে খেলার বিরাট নামডাক ছিল, হয়তো অন্নসংস্থানের পথ ছিল সে খেলা অনেকের। কোথায় সেই খেলা, কোথায় খেলোয়াড়েরা, কোথায় হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতারা!
লালবাজার স্ট্রিটের দক্ষিণ-পশ্চিমে যে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ গির্জা আছে, তার ঠিক উল্টোদিকে, লালবাজার আর মিশন রোয়ের সঙ্গমে ১৭৫৬ সালের জুন মাস নাগাদ দাঁড়ালে দেখা যায় নবাব সিরাজের বাহিনী প্রায় এসে পড়েছে কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো নাট্যশালা ‘ওল্ড প্লে হাউস’-এর কাছে। এখুনি রঙ্গালয়ে ঢুকে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে সব, একেবারে মুড়িয়ে দেওয়া হবে সাহেবসুবোদের নাটক করার শখ। সত্যিই তাই। কোনও চিহ্নই আর পড়ে নেই সেই সময়ের। মার্টিন বার্ন কোম্পানির অফিস হয়েছে সেখানে। শুধু ১৭৫৩ সালে আঁকা উইল সাহেবের কলকাতা মানচিত্রে এই থিয়েটার ও লাগোয়া নাচঘর আজও দেখা যায়।
বরং রয়ে গেছে লালবাজারের আরেক দিকে ডালহৌসি স্কোয়ার বা লালদীঘি (সেকালে ট্যাঙ্ক স্কোয়ারও বলা হতো নাকি)। আজকের চেয়েও আকারে আরও অনেক বড় লালদীঘি খনন করে সাহেবরাই, শহরে ভালো পানীয় জলের রিজার্ভার হিসেবে। দীঘির চারপাশ ঘিরে দিয়ে সাজানো হয়েছিল হাঁটাচলার পথটুকু; ফি-সন্ধেয় বাবুরা আসতেন সব, সান্ধ্যভ্রমণের নেশায়। অত পুরোনো দিন হলে কী হবে, খেয়াল করেছেন কেমন শখের পরিচর্যা আদরে আব্দারে বেড়ে উঠছে আমাদের শহরে? ওদিকে গাছতলায় বসে চার্নকমশায়ের উদাসীন চেয়ে থাকা দিগন্তে, এদিকে দীঘিপারে হাওয়া খেতে খেতে ভ্রমণ! শুধু এযুগের আলসেমিকে দোষ দিলে হবে? লালদীঘিকে ঘিরে সায়েবদের তো নাকি কত স্বপ্ন ছিল যে খাল কেটে গঙ্গার সঙ্গে জুড়ে এই জায়গাকে ডক বানিয়ে দেওয়া হবে। সে আর হয়নি অবশ্য। হলে যে আজ কলকাতার চেহারা আদ্যন্ত আলাদা হতো, সে আর বলার কী!
হার্ট সায়েবের বই জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নামের রকমারি ইতিহাসে গা ভাসিয়ে দিতে ভারি ভালো লাগে। এখনকার রাস্তায় মোড়ে মোড়ে যে কর্পোরেশনের ফলকে রাস্তার নাম লেখা দেখি, সে যে কত ঘাটের জল খেয়ে, কত সমুদ্রের ঢেউ সামলে এসেছিল, ভাবলেও 'থ্রিলিং লাগে মশাই'! এই যেমন ধরুন না, টাউন হল। ১৭২৭-এ তৈরি, কী হিসেবে? না চ্যারিটি স্কুল। কাজেই, অনতিদূরে ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের নাম কোত্থেকে এল, নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়? টাউন হলের বিরাট অ্যাসেম্বলি হলে, কিছুর মধ্যে কিছু না, তাজ্জব ব্যাপার, ফ্রান্সের রাজা-রানির ইয়াব্বড় দু'খান ছবি টাঙানো! ইংরেজদের স্থাপত্যে ফরাসিদের ছবি?! এ তো অনেকটা চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের সেই উক্তির মতো, যে পারভেজ মোশারফ নিজের পোষা বেড়ালের নাম রাখবেন 'পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভূখণ্ড যা অক্টোবরে পুনর্বিবেচনাসাপেক্ষ', বেচারির লেজের চেয়েও বড়! যাক গে, ব্রিটিশদের এ হেন বিজাতীয় উদারতার মুখে কালি। উদারতা-ফুদারতা কিসুই না। আরে, চন্দননগর ফ্রেঞ্চ কলোনি ছিল না? সেই চন্দননগর ইংরেজরা লুঠ করার সময় এই ছবি দুখানও নিয়ে এসেছিল। তারপর জায়গা না পেয়ে স্ট্রেট টাউন হলের দেওয়ালে! বাজারি কারবার আর কি!
যাওয়ার পথে একটা বাজারের গপ্পো দিয়েই শেষ করি। সালটা ২০১১ কি ১২, আমরা ক'জন বন্ধু মিলে প্ল্যান ফেঁদেছি, গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপো থেকে ভোরের প্রথম ট্রাম ধরে যাবো বিবাদী বাগ। সেখান থেকে সামান্য এগিয়েই টিরেটি বাজারে সাত-তাড়াতাড়ি গরম-গরম চাইনিজ ব্রেকফাস্ট। তবে টিরেটির ব্রেকফাস্ট যে আমাদের কচুরি-জিলিপির কাঁটায় চলে না, কে জানতো! পৌঁছে দেখি, ততক্ষণেই বাজার প্রায় খালি। চেয়েচিন্তে পর্ক চপ, মোমো, রাইস বল এসব পাওয়া গিয়েছিল যদিও!
এবার শুনুন, খুব মন দিয়ে শুনুন। সময়টা ১৭৮০-র দশকের শুরুর দিক। ইতালির ভেনিসের কাছে ট্রেভিসো থেকে এক যুবক পা রাখেন কলকাতায়। বিখ্যাত কাসানোভার ডান হাত তিনি; তাহলে কী মনে করে এ তল্লাটে? ওদেশে কীসব রাষ্ট্রদ্রোহ ঘটিয়েছেন নাকি তিনি, তাই সব সম্পর্ক চুকিয়ে ফেরার হয়েছেন। এর চেয়ে বেশি ইতিহাস জানা যায় না সেই যুবকের -- নাম এদুয়ার্দ তিরেত্তে। এ শহরে ঠাঁই পান তিনি; শুধু ঠাঁই পান বলা ভুল, ইংরেজদের হয়ে সড়ক ও নির্মাণের সুপারিনটেনডেন্ট হয়ে থেকে যান। প্রভাবশালী এই মানুষটিই গড়ে তোলেন নিজের হাতে 'তিরেত্তে'র বাজার'। ১৭৮৪ সালের কলকাতার মানচিত্রে সেই বাজার দেখতে পাওয়া যায়। আর আশ্চর্যজনক ভাবে ১৭৮৮-র ডিসেম্বরে প্রকাশিত Calcutta Gazette-এ একটি বিজ্ঞাপন আসে, 'তিরেত্তে লটারি'র। প্রথম পুরস্কার হিসেবে ঘোষিত প্রায় দু'লাখ টাকা মূল্যের তাঁর সেই প্রিয় বাজার!
হঠাৎ কী হলো এমন তিরেত্তের, যে বাজার লটারিতে বেচে দিতে হলো? আর্থিক অনটন? ব্যাঙ্করাপ্ট? আবার কোনো জালিয়াতি, আর ফেরার? কিচ্ছু জানা যায় না আর। চার্লস ওয়েস্টন বাজারটি পেয়েছিলেন পুরস্কারে। কালক্রমে নাম হয় টিরেটি বাজার, আমাদের ব্রেকফাস্টের ঠেক। তিরেত্তে হারিয়ে যান সময়ে, স্মৃতিতে। শুধু লেখা থাকে, কলকাতা এক ফেরার, (হয়তো বা) দুশ্চরিত্র বিদেশীকে আশ্রয় দিয়েছিল। ফিরিয়ে দেয় নি। এমন অহৈতুকী গ্রহণের ইতিহাস আরও কত পাওয়া যাবে খুঁজলে, কে জানে...
জোফানির 'জুডাস', এবং ১৭৩৭-এর সেই সাইক্লোন
সে অনেকদিন আগের কথা। ১৭৫৬ সন, জুন মাসের কুড়ি তারিখ। সিরাজ তাঁর বাহিনী নিয়ে হানা দিয়েছেন ফোর্ট উইলিয়ামে। ফোর্টের পতন ও ব্রিটিশদের পরাজয় সময়ের অপেক্ষা কেবল। যুদ্ধবন্দীরা তখন নবাবের কব্জায়, বিশাল এই দুর্গে তাদের ঠাঁই কোথায় হবে, সে-ই দেখার।
১৭৫৬-র বহু বছর পরে মাটি খুঁড়ে সেই আদি ফোর্ট উইলিয়ামের যে সীমানার আন্দাজ পাওয়া যায়, তার হিসেব দিতে গেলে বলতে হয়, ফেয়ারলি প্লেস থেকে শুরু করে জিপিও অব্দি ছড়িয়েছিল তার পুবের প্রাচীর। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব কোনেই সেই ছোট্ট একখান ঘুপচি ঘর, ১৪/১৮ ফিটের। কে জানতো, ওইটুকু ঘরেই সিরাজ ঠুসে দেবেন ভারতীয়-ইংরেজ মিলিয়ে ১২৩ জন বন্দীকে, সন্ধে আটটা নাগাদ বন্ধ করে দেওয়া হবে দরজা। ভিতর থেকে দমবন্ধ হয়ে আসা, গরমে হাঁসফাঁস করা চিৎকার শোনা যাচ্ছে কেবল। সাদা চামড়া, কালো চামড়া -- সবাই আর্তনাদ করছে একফোঁটা জলের, শ্বাসবায়ুর জন্য। কিন্তু কে কোথায়! সে ঘরের দরজা সিরাজ খোলার আদেশ দিলেন পরদিন ভোর ছটায়। খুলে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গেল মাত্র ২৩ জনকে। সেই বন্দিদেরই একজন, জন হলয়েলের বর্ণনায়, সেই রাতে গরমে, শ্বাস নিতে না পেরে, জলের কষ্টে মারা যান ১০০ জন বন্দি। আজ স্কুলের ইতিহাস বইতে আমরা তাকে অন্ধকূপ হত্যা বলে পড়ি। দক্ষিণ-পূর্ব কোণের এই ছোট্ট নিরীহ ঘরটিই সেই অন্ধকূপ।
সায়েবদের এ দেশে রাজত্ব করার একটি চরম কষ্টের ও ভুলে যাওয়ার মতো অধ্যায় এই হত্যাকাণ্ড। বহুদিন অব্দি এই ট্র্যাজেডির স্মৃতিতে একটি সৌধ শোভা পেত সেই দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। কিন্তু, সেই রাত স্মরণ করাও এতটাই লজ্জার মনে হয়েছিল ইংরেজদের, যে একসময় সেই স্মৃতিসৌধও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় তারা। "It's presence too humbling for British pride", হার্ট তাঁর বইতে লিখছেন। ১৬৯২-তে কলকাতা শহরের পত্তনের প্রায় পরপরই তৈরি এই আদি ফোর্টের শেষ দিকের ইতিহাস ব্রিটিশদের নজরে এমনই কালিমালিপ্ত, যে সময়ের ভার আরো অনেক স্থাপত্য কাটিয়ে উঠলেও, ১৮১৯-এ ফোর্ট উইলিয়াম পরিণত হয় এক ধ্বংসাবশেষে। সাম্রাজ্যবাদের কলঙ্কিত দুয়োরানি সে; তার স্রষ্টার দাক্ষিণ্য সে পায় না। পোস্টাপিসের পিছনে কয়লাঘাট স্ট্রিটে ছন্নছাড়া পড়ে থাকে তার বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া পুরোনো দেওয়ালের অংশ, ভাঙাচোরা খিলান। তবে এর মধ্যেও একফালি মজা হলো, এই পুরোনো দুর্গের চেহারা-ছবি সম্বন্ধে ধারণা করা যায় ১৭৭০-সনের 'ইউনিভার্সাল ম্যাগাজিন'-এ প্রকাশিত ফোর্টের যে স্কেচটি দেখে, সেখানে দুর্গের পিছনে আবার ছোট ছোট পাহাড় এঁকে দিয়েছিলেন শিল্পী! হার্ট সায়েব তো সেসব দেখে বিলকুল থ! রীতিমতো আজ্ঞে-মানে করে হাত কচলে বলেই চলেছেন, "মানে, বাংলার এই অঞ্চলে তো তেমন পাহাড় ছিল বলে জানি না ... থাকলে, মানে, বলতেই হয়, জিওগ্রাফি বদলে গ্যাছে, আর নাহলে, ইয়ে ... শিল্পীটির কল্পনা খুবই পোক্ত..."
আরে, আরও শুনুন! মজা কী শুধু ওটুকুই নাকি! জোফানির সাপারের গপ্পো শুনবেন না? ১৭৫৬ সনে ফোর্টের মুখে একটা ছোট চ্যাপেল তৈরি করা হয়েছিল; তার মেয়াদ অবশ্য বেশিদিনের ছিল না। ১৭৮৭ নাগাদ শহরের তৎকালীন মূল ক্যাথেড্রাল সেন্ট জনের চার্চ তৈরি হলো। প্রথম ধাক্কায় এই চার্চ তৈরির পিছনে গেল প্রায় ৩৫০০০ টাকা, তারপর আবার লটারিতে আরও প্রায় ২৫০০০ টাকা মতো ফান্ড রেইজ করা হলো। বোহেমিয়ান পেন্টার জন জোফানিকে দিয়ে আঁকানো হলো চার্চের বিখ্যাত অল্টার-পিস, 'দ্য লাস্ট সাপার'। এই বিখ্যাত সিনটি আঁকতে গিয়ে এক কীর্তি করেছিলেন জোফানি। যিশুর আশেপাশের বারোজন শিষ্যের মুখের আঁকলেন কলকাতার মানুষদের মুখ। রইল বাকি জুডাস। কার মুখ বসবে সেখানে? জোফানির সঙ্গে তখন তুমুল মন-কষাকষি চলছে অকশনিয়ার টুললো সাহেবের। অতএব, নিজের অজান্তেই টুললো হয়ে উঠলেন জোফানির 'জুডাস'!
পুরোনো কলকাতার স্থান-কাল-পাত্রের আশ্চর্য, আলো-আঁধারি গল্পেরা শতাব্দীকাল পেরিয়ে মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। এই সেন্ট জনের চার্চ গড়ে উঠেছিল নাকি এক পুরোনো কবরখানায়, যার একটি সমাধি চার্নক ও তাঁর স্ত্রীর। স্ত্রীর মৃত্যুর পর যত বছর চার্নক জীবিত ছিলেন, শোনা যায় ফি-বছর মিসেস চার্নকের মৃত্যুদিনে তাঁর সমাধিতে একটা করে মোরগ বলি দিতেন ভদ্রলোক।
রাস্তা এঁকেবেঁকে আরও এগিয়ে যেতে থাকে গঙ্গার দিকে, জাহাজ তৈরির ইয়ার্ডের দিকে। আজকের স্ট্র্যান্ড রোডের কোনো চিহ্নই নেই তখন! সেই জায়গা প্রায় পুরোটাই পরে উদ্ধার করা হয়েছিল নদীগর্ভ থেকে।
এবার আরও এগোলে কলকাতার সীমা ছাড়িয়ে চলে যাবো। হার্ট সাহেব আমাকে সেই অনুমতি দেন নি। তাই পথ হাঁটা শেষ করে এবার ফেরার পালা। পরদিন থেকে এই শহরের মানুষ-জন, আচার-বিচার, স্বভাব নিয়ে ক'দিন আরও গল্প চলবে না হয়। এখন, ফেরার পথে হঠাৎই কী মনে করে দাঁড়িয়ে যাই রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পশ্চিম প্রান্তের মুখে। কোন এক উড়ে-পুড়ে যাওয়া ইতিহাস যেন ফিরে আসছে, আসতে চাইছে বারবার। এত যে চার্চ-ক্যাথেড্রালের গল্প করলাম, এদেরও এক হোতা ছিল! কলকাতার প্রথম খ্রিস্টান ধর্মের স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল এখানেই, ১৭০৯-সনে। নাম ছিল Saint Anne's Church! আজ আর তার কোনো নিশান নেই, সেন্ট জনের ইয়ার-বুকে এই নাম আর তারিখটুকুর উল্লেখ পাওয়া যায় মাত্র। সিরাজ-বাহিনী ১৭৫৬-এ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এই চার্চ। অবশ্য তার আগে থেকেই এর ইতিহাস অবলুপ্তির। ১৭৩৭-এর সাংঘাতিক ভূমিকম্পে গির্জা-বুরুজটি ভেঙে পড়ে, এবং প্রায় ওই অক্ষত অবস্থাতেই মাটির ভিতর ঢুকে যায়। সেই ভূমিকম্পের রাতে বিধ্বংসী এক ঘূর্ণিঝড় এসেছিল শহরে। তছনছ করে দিয়ে চলে গিয়েছিল। গঙ্গায় হাওয়া উঠেছিল ভয়াল। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ন'টা ইংরেজ জাহাজের আটটাই নিখোঁজ হয়ে যায় সেই ঘূর্ণিতে, চিরতরে...
পথের গল্পে বরাবরই এক আলগা স্রোত থাকে; সে কোথাও ঘাঁটি বাঁধতে দেয় না, কেবলই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত নিয়ে চলে। তাই, পথগুলির আমার প্রতি বা আমার তাদের প্রতি কোনো বিশেষ অধিকার নেই জেনেই তাদের আরও বেশি ভালোবাসা যায়; মায়া লাগে ছেড়ে যেতে।
কলকাতার পথের গল্প তেমনই। কিন্তু শহরের পথ তো একদিন শেষ হয়; মানুষ তখন মুখ তুলে আশেপাশে তাকায়। পথের নাম থেকে আর যার নাম, সেই পথিককে দেখতে চায় মানুষ। হার্ট সায়েবের বইতে পুরোনো কলকাতার মানুষ বা সমাজের ছবি কিছুটা অন্ধকার, ঘোলাটে।
স্ট্র্যান্ড রোড অব্দি গিয়ে গঙ্গার মুখে যে হাঁটা শেষ করেছিলাম আমরা, সেই নদীর ধারে দিয়েই ঘাটে ঘাটে বসে থাকে অঘোরী সাধুরা; ইউরোপীয় 'সভ্য'রা অবাক চোখে দেখে, মড়ার গা থেকে মাংস খুবলে খাচ্ছে অঘোরীরা দিনের পর দিন। প্রায় প্রতি সন্ধেতেই শহরের পুরোনো শ্মশান বা নদীঘাটের আশপাশ দিয়ে যাওয়ার পথে ভেসে আসতো ঢাক-ঢোল-হইচইয়ের ফাঁকে বিকট কান্না, আর্তনাদ -- কোনও সতী পুড়ছে চিতায়। আর একটি ব্যাপারে মানুষ ভারি বিরক্ত হতো -- রাস্তা জুড়ে ঘুরে বেড়াতো ইয়াব্বড় বেপরোয়া সব ষাঁড়। একদম বারাণসীর মতোই! পথমধ্যে বসে আছে, বা তেড়ে আসছে; তাড়াতে গেলে পাত্তা দিচ্ছে না একদমই।
সেকালে জীবনের মেয়াদ ছিল ছোট। মৃত্যু ঘুরেই বেড়াতো সারা শহর জুড়ে, এ দরজায় সে দরজায়। একা মানুষ মরলে, বা দাহ করার সামর্থ না থাকলে সেই দেহ ফেলে দেওয়া হতো রাস্তার ধারের অগুনতি ডোবার কোনও একটির পাঁকে, অন্য পশুপাখির দেহের মতোই। নর্দমা বলে কোনো বস্তু কলকাতায় ছিল না তখন; সব আবর্জনা, বর্জ্য জল জমা হতো এই ডোবাগুলোয়, আর এরকম কিছু কিছু ডোবার দল গিয়ে পড়তো কোনো ক্যানালে। তাতে পড়ে পড়ে পচতো মৃতদেহ; শেয়াল কুকুরের ভোজ বসতো প্রায়ই। গ্রীষ্মবর্ষায় কঠিন অসুখের প্রকোপে বেঁচে থাকা নাকি এমনই দুষ্কর হয়ে উঠেছিল, যে যারা এই দুই কাল কাটিয়ে দিতে পারতো, গরম-বৃষ্টি কমলে অক্টোবর-শেষে নাকি পার্বণ করতো বেঁচে থাকার আনন্দে।
সমাজে বাস করতে গেলে অনুমতি নিতে হতো কোম্পানির! আর সে যেমন-তেমন করে নয়; এক্কেবারে বিরাট বড় এক দলিলে, আইনি ফর্মে সইসাবুদ করিয়ে নিতে হতো। মাঝেমাঝে অফিশিয়ালরা তাদের সেই দলিল দেখতে চাইতেন, বিশেষ করে কলকাতা শহর থেকে ১০ মাইলের বেশি দূর কেউ গেলে। তখন অবশ্য যদি "কাগজ আমি দেখাবো না" বলা হতো, তল্পিতলপা সমেত তাকে পত্রপাঠ তুলে দেওয়া হতো দ্বীপান্তরে, বা ভিনদেশের জাহাজে।
মিল পাচ্ছেন অল্পবিস্তর? তবে আরও বলি, শুনুন -- সবচেয়ে কঠিন জীবন ছিল সংবাদপত্রের সম্পাদকদের। সরকার বাহাদুরের প্রশংসা করতে একটু গাফিলতি হয়েছে কি হয়নি, নেমে আসতো খাঁড়ার ঘা। যেমন ধরুন না, বাংলার প্রথম খবরের কাগজ হিকি'র 'বেঙ্গল গ্যাজেট'। মুচমুচে স্ক্যান্ডাল, পরনিন্দা-পরচর্চার আখড়া ছিল হিকি সাহেবের এই কাগজ (বলতেই হয়, বাঙালির নাড়িটা বেশ বুঝেছিলেন তিনি!)। শেষে কোম্পানিকে বেইজ্জত করতে গিয়ে এমন গেরোয় পড়তে হয় ভদ্রলোককে যে কাগজটি শুরু হওয়ার মাত্র দেড় বছরের মাথায় ১৭৮১-সনের জুনে মোটা টাকার জরিমানা করে জেলে পাঠানো হয় হিকি সাহেবকে। তারপর তাঁর বাকি জীবনের কী হয়েছিল, সে অন্য প্রসঙ্গ; তবে 'বেঙ্গল গ্যাজেট' চলেছিল আর মাত্র নমাস। জেল থেকেই সম্পাদনা চালাতেন সাহেব; তাঁর যত শ্লেষ, রাগ সব উগরে দিতেন প্রতিটা দিন। বাস্তবের চেয়ে রংচং বেশি থাকতো সে' সবে।
তুলনায় আরামের চাকরি ছিল ডাক্তার আর উকিলদের। বড়সড় সিভিল কেস লড়ে জিতলে উকিলেরা পেতেন একটা করে সোনার মোহর, আর যদি স্বল্প কথায় সাজিয়ে তুলতে পারতেন কেস, বা আইনি চিঠিপত্র লিখে দিতে পারতেন গুছিয়ে, কম কথায়, প্রতি চিঠি বাবদ পেতেন আঠাশ টাকা করে! ডাক্তার-বদ্যিরা পালকি চেপে যেতেন রুগি দেখতে। প্রতি বাড়ি থেকে একটা করে সোনার মোহর পকেটস্থ হতো অন্ততঃ; ধনী বাড়ি বা জন্ডিস কেস হলে তো কথাই নেই!
কিন্তু সবচেয়ে মোটা মাইনের চাকরি কাদের ছিল জানেন? আন্দাজে ঢিল ছুঁড়তে বলবো না, কারণ এটা না জানলে সত্যিই অনুমান করা মুশকিল, jaw-dropping যাকে বলে! চাকরির বাজারে শেষ রাতের ওস্তাদ ছিল শব-বাহকেরা। আগেই বলেছি, সেকালের কলকাতায় মৃত্যুর যাওয়া-আসা লেগেই থাকতো হামেশা, অন্ততপক্ষে গ্রীষ্মে-বর্ষায়। ওই এক বর্ষায় যদি কেউ জান লড়িয়ে মড়া বয়ে নিয়ে যেতে পারতো, বৃষ্টি গেলে হাফ বছরেই তার হাতে থাকতো প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা, কি তারও বেশি!
তবে শেষপাতে বলতেই হয়, কলকাতার পথঘাটের আনাচে কানাচে যতটা স্বচ্ছন্দে বিহার করেছেন হার্ট, লোক বা সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর ধারণা ততটাই অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট এবং নেড়াতথ্যের ভারে জর্জরিত। কাহিনি উঠে আসে না সেই থেকে; বড়জোর কিছু কিছু টুকরো ছবি দেখতে পাওয়া যায় বড়জোর। যেমন জানা যায়, ইংরেজদের আসারও আগে পর্তুগিজদের শুরু করা ক্রীতদাস প্রথা কিভাবে কোম্পানির শাসনকালেও বহাল তবিয়তে ছিল, ১৭৮৯ সন অব্দি। দাসপ্রথার সঙ্গে জড়িত বর্বরতার প্রতীক বা অমানবিকতার ইতিহাস, কোনোকিছুই মান্য হয় নি সেকালে। দিব্যি চলেছে দৈনিকে দাস কেনাবেচার, বা পালিয়ে গেলে সেই কারণে দেওয়া বিজ্ঞাপন। কেউ দাস কিনলে কাছারিতে রেজিস্ট্রেশন করাতে হতো সেই দাসের। তারপর নিংড়ানো শুরু।
এইসব তথ্য ছাঁকনিতে ছেঁকে নিতে নিতে আরো একখান মজার গপ্পো পেয়ে গেলাম। সেকালের বড় বাবুরা যখন ততোধিক বড় পার্টিতে যেতেন, বা আত্মীয়ের বাড়ি যেতেন নৈশভোজে, আরো হাজার জুড়িদারের মধ্যে প্রত্যেক বাবুর পিছন পিছন চলতো একজন 'আব্দার', হার্ট যাকে বলছেন "walking refrigerator"! মাঝে মাঝে বাবুর জন্য শরাব বানিয়ে দেওয়া, বা সেই শরাবে বরফ ফেলে বাবুর মেজাজ ঠাণ্ডা করার দায়িত্ব ছিল তাদের। এতদিনে 'আব্দার' কথাটার একটা যথাযোগ্য উৎস পেলাম! আব্দারই বটে!
বাঙালির খাদ্যাভ্যাস নিয়ে মিতভাষী হার্ট সায়েব যে একটি লাইন লিখেছেন, আমার কাছে তা কালজয়ী। এই জাতের খিদে ও খাওয়ার সময়, কোনোটাই সায়েবের ইংরেজ-মনে সয় নি। লিখছেন, "The most unsuitable food was largely eaten, and often at the most ill-chosen hours." পিছনে আবহে দাঁত-কিড়মিড় শোনা যায় প্রায়, কান পাতলে। আজকের দিনেও রাত নটায় চায়ের জটলা, ভাজার গরম তেলের আওয়াজ -- সবের প্রত্যুত্তর ওই উপরের লাইনটি। রাত আটটার মধ্যে 'ডিনার' করে ফেলা ইংরেজ জাতি ২০০ কেন, জিএসটি যোগ করে আরো ৩৭৭ বছর বেশি থাকলেও এটি পাল্টাতে পারতো না।
নরম-গরম মিলিয়ে এ'ই মোটামুটি রেভারেন্ড হার্টের জবানি। এতদিন পর এই ইতিহাস চর্চার কারণ দুটি -
১. কলকাতা নিয়ে আমাদের মায়া, অভিমান, অহংকার প্রচুর। সে ভালো। কিন্তু শহরটিকে গড়পড়তা নস্টালজিয়ার ঘোলাজলে না চুবিয়ে তার সত্যিকারের পুরোনো দিনের ইতিহাসের রোমাঞ্চিকতায় অবগাহন করা শ্রেয়।
২. চর্চার কোনো বয়স হয় না।
হার্ট সায়েবের দৌড় আপাতত এতটাই। কাজেই, আমার কথা ফুরোলো। যদিও, কলকাতার নটেগাছ সহজে মুড়োয় না।
সমাপ্ত
এ লেখাও প্রথম পাতায় পড়াবই বিভাগে দেখা যাচ্ছে না।
ঠিক করলাম। এইটা বুঝতে পারছিলাম না কেন হচ্ছে, পরে দেখি একটা ভুল ট্যাগ পড়েছে কী করে!
বেশ লেখা। হেব্বি! বইটি কোথায় পাব?
আব্দার!
আব+ দার= জলবাহক।
আব--এ-ডমজম= জমজমের পবিত্র জল।
গঙ্গা যমুনার দোয়াব= দুই জলধারা।