দুর্গানবমীর প্রায় সব শব্দই বিয়োগান্তক। যে শব্দগুলো এতদিন উল্লাসের বাতাসে ভর করে আসছিল, এখন তারাই বিষাদের বাহন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। আজ দুপুরে নিয়োগী বাড়িতে মহাভোজ; সে উপলক্ষে সকাল থেকেই ঠাকুরদের কড়ায় ছ্যাঁকছোঁক – মাছের কালিয়া আর পাবদা-সর্ষে নামিয়ে বাড়ন্ত বেলায় বেগুনি আর ঝুরি আলুভাজার তোড়জোড়, খাবারের পাতে গরম গরম দেওয়া হবে। আরেকটা বড় কড়ায় মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল সাঁতলানো, আর পাশের বড় ডেকচিতে কিছুটা কম গুরুত্ব পাওয়া ফুলকপির তরকারি। মশলার গন্ধে ঢেকে যাচ্ছে বাড়ি, পাড়া। তবু সেই সব গন্ধ, শব্দ, রঙ আজ যেন ফুরানের আগের উজ্জ্বলতা নিয়ে আসছে। তাতে আনন্দের চেয়ে বিষাদের ভার বেশি। সমর নিয়োগীর রান্নাবান্নার তদারকি করতে করতে মনে পড়ে, ছোটবেলায় – বয়স তখন নয় বা দশ হবে – বাবা প্রথম এই কাজের ভার দিয়েছিলেন তাকে। সঙ্গে অবশ্যই মেজদা ছিলেন। আজ বড়দা’র ভূমিকা যা, সে সময়ে তার জায়গায় থাকতেন বাবা, আর আজকের মেজদা’র ভূমিকায় বড়দা। সমরের স্পষ্ট মনে পড়ে এই সবকিছু; বরং যত নিকটের অতীতে আসেন তিনি, স্মৃতিগুলো কেমন লাইব্রেরির তাকের অগোছালো বইয়ের মতো লাগে। সবই আছে, কিন্তু ঠিক সাজানো নেই। কোন বছর প্রতিমার মুখ কেমন, কোন রান্নাটা খুব সুনাম কুড়িয়েছিল, ঠাকুরদের চার্জ বছর-বছর কেমন বাড়ছে, এইসব আর অতো ঠাহর হয় না। মনেও রাখতে চান না সমর। এক এক সময় এই তেল-হাতা-খুন্তির আলোড়ন সামলাতে সামলাতে খুব একা লাগে তার। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, কোনোদিন যদি বাড়ির পুজো থেমে যায়? আর না হয়? তখনও যদি তিনি থাকেন? কী করবেন এই সময়টা? তিনি আগে যাবেন বরং... পুজো থামার যদি হয়, তার আগে চলে যাওয়া ভালো।
অবিবাহিত সমরের চিন্তায় হেমন্তের মেঘ এক একবার ভিড় করে, আবার কেটে যায়, আবার আসে। নিচের ছোটো ছাদে রঙ্গিত আর অস্মিতা দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সমর এমন কারুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন কি কখনও? অনেকদিন আগে, কলেজ, বা কলেজের ঠিক পরে পরে ... মুখ মনে পড়ে না সমরের। যে মুখ ভাসে, সে দিয়ে এ বয়সে আর যোগাযোগ করতে পারেন না সেই মানুষটিকে। হয়তো এখন তার কাঁচাপাকা চুল, বা পুরোটাই পাকা? নাকি রঙ করে? কলকাতায় থাকে? না বাইরে? না পাশের পাড়াতেই? সমর তার একার শরীরে আরও একা হয়ে মনে করার চেষ্টা করেন। একটি নারীর অবয়ব আসে শুধু। এটুকুই।
দোতলার টানাবারান্দার রেলিঙের মাঝে মাঝে যে লম্বাটে থামগুলো, জমাট বাঁধা ঘোলাটে রোদের মাঝে মাঝে ওরা ছায়া তৈরি করেছে। দুপুরের ভোজপর্ব শেষে এখন বিকেল গড়াতে খানিক দেরি। নিচে, মণ্ডপে মায়ের দ্বিপ্রাহরিক শয়ন চলছে; নবমীর তুলনায় সবই যেন অস্বাভাবিক শুনশান। দূরে, পাশের পাড়ার পুজোর ঢাক বাজছে – একটানা, এক তালে। ঘুঘুর ডাকে যেমন ঘুম পায়, এই ঢাকের তালেও তেমনই। বড় বড় দুটো থামের ছায়ায় বসে আছে ঋক আর পিউ। মাসতুতো ভাই-বোন ওরা, রঙ্গিতের চেয়ে বয়সে বেশ কিছুটা বড়। ঋক থাকে ব্যাঙ্গালোরে, পুজোর সময়ে এসেছে এই বছর। অনেকবার তাও পারে না। এবার ওর আসার মূল কারণ অবশ্য পিউয়ের সঙ্গে দেখা করা। ছোটো থেকে এই বাড়িতে পুজো, আরও হাজারো অনুষ্ঠান ঘিরে ওদের বড় হয়ে ওঠা। বয়সে পিঠোপিঠি, তাই স্মৃতির বন্দরে দুজনের জাহাজই কিছুটা এক রঙের, এক স্বভাবের। এবারের পুজোর শেষে, কালীপুজোর আগেই পিউ চলে যাচ্ছে লন্ডনে, রিসার্চের সুযোগ পেয়ে। পরের বছর আসার সম্ভাবনা কম, একপ্রকার ধরেই রাখা যায়।
“তুই তো অনেকদিন ধরেই চাইছিলি এরকম একটা ব্রেক ...”
“হুঁ, গত বছরের শুরু থেকেই চেষ্টা করছিলাম। অবশেষে!”
“প্রপার লন্ডনেই তো তোর ইউনিভার্সিটি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অলমোস্ট মিডল অফ দ্য সিটি বলতে পারিস।”
“গ্রেট। সামনের বছর তাহলে তোর নো দেখা-পাওয়া?”
অল্প হাসে পিউ। “দেখি, যদি কোনোভাবে ...”
“থাক! আমাকে আর গুল খাওয়াস না! আমি নিজে ব্যাঙ্গালোর থেকে বছরে দু’বার আসতে পারি কি পারি না, আর তুই লন্ডন থেকে আসবি এক বছরের মধ্যে! থাক না একটা বছর বাইরে, দ্যাখ না কেমন লাগে!”
“ভালো লাগছে না রে ...”
হেসে ওঠে ঋক। “ও কী! এর মধ্যেই ফুস? এই দেড় বছরের চেষ্টা এক নবমীতেই এসে মনকেমনে ঠেকে গেল?”
“তুই তো শেষ ক’ বছর ব্যাঙ্গালোরে আছিস। তোর এই সময়টায় অসুবিধা হয় না, আসতে না পারলে?”
“হয় তো ... অপেক্ষা করছিলাম, তুই এটা বোঝার জায়গায় যাবি, তবে বলবো।”
“It’s easier said than done, ঋক দা। To leave this city ... and to even think that I won’t be around next time ...”
পিউয়ের অস্থির মুখ ছায়া থেকে রোদে আসে, আবার ছায়ায় ফিরে যায়। ঋক স্থির হয়ে বোনকে দেখে। হয়তো তেমন কিছুই নয়, এই দুপুরটাও হারাবে অন্য সব দিনের মতোই, তবু শহর ছাড়া দুই ভাইবোন নিজেদের শৈশবের স্মৃতির কাছে নতজানু হয়ে বারবার আওড়ে নিচ্ছে, হাজার হোক, ঘরই কাছের, পর নয় – এ কী সবার জীবনে আসে?
নবমীর সন্ধেও এসে যায় গুটি গুটি পায়ে। চাতালের ঝাড়বাতির আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে মায়ের মুখ, জ্বলতে থাকে শানিয়ে নেওয়া অস্ত্রের অলঙ্কার। পুরুতমশাই পুজো শেষে সন্ধ্যারতির তোড়জোড় করেন, পাশে বসে থাকেন সুদর্শন নিয়োগী। মায়ের মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন সুদর্শন। সোনা গলে পড়ছে সে অবয়ব থেকে। কাল দশমীর দুপুরে নিরঞ্জন হবে যখন, এই মুখই মলিন লাগবে আবার, জল যেন ম্লান করে দেবে মায়ের রূপ। বাপের বাড়ি ছেড়ে যাওয়া মেয়ের মন শোভা পাবে মৃন্ময়ী মূর্তির মুখে। দোতলায় নিজের ছোট্ট ঠাকুরের বেদিতে রাত বাড়লে গোপালকে শয়ন দেন সারদা। তিনিও এক মা; তাঁর তিন ছেলে পুজো সামলাচ্ছে, আর এই চতুর্থ ছেলে যেন ঘরে থেকেই সব দেখছে, সব শুনছে। সারদার মনে হয়। হিমপড়া রাতে লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ান বুড়িমা। আকাশের দিকে দেখেন; চোখও স্পষ্ট নয়, আকাশও। তারার আভাস পাওয়া যায় কেবল। বিষাদ লেখা সেখানে। সদরের আধ-নেভা আলোয় বিষাদ। এই নীরবতায় বিষাদ। দশমী আসছে। যৌবনের মতোই অসহায় লাগে তাঁর। হু-হু করে বুকে এসে ভিড় করে ছাতিমের গন্ধ।
(আগামীকাল সমাপ্য)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।