গৃহস্থবাড়ির পুজোয় অতিথি নিয়ে আসে কলা-বউয়ের আগমন। বড়মামার সঙ্গে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়েছিল রঙ্গিত বাবুঘাটের পথে; সঙ্গে ছিল ছোটমাসি, আর দেশপ্রিয়র কাছ থেকে ওদের গাড়িতে উঠলো বুধো দা। আরও অনেক ছোটবেলায়, বুধো দা নামটা শুনলেই রঙ্গিতের পেট থেকে সোডার মতো হাসি উঠে আসত, ওর মনে পড়ে যেত হ-য-ব-র-ল; মনে হতো, বুধো দার আগে নিশ্চয়ই কোনও উধো দা-ও আছে কোনও গাছের কোটরে।
বুধোর কপাল নিতান্তই খারাপ বলতে হয়। তার ভালো নাম বুধাদিত্য রাখার পিছনে মানুষে যত উৎসাহ ও পরিশ্রম দেখিয়েছিল, ভালোনাম ভাঙিয়ে ডাকনামটি বুধো রাখা অনেকটা ফিক্সড ডিপোসিট ভাঙিয়ে সুপুরি কেনার মতো হয়ে গেছে। চেহারা-ছবি, হাবেভাবে সে যথার্থই বুধাদিত্য নামের যোগ্য। সে মেঘলা দিনে সানগ্লাস পরলেও তাকে দেখে মনে হয়, রোদ হওয়া বা না হওয়ার সঙ্গে সানগ্লাস পরা বা না পরার বিশেষ যোগ নেই। বছর ছয়েকের বড় বুধাদিত্যর সঙ্গে কোনও সরস্বতী পুজোয় বেরনো মানে নিজেকে হাড়বঞ্চিত অনুভব করা, জানে রঙ্গিত। ওইসব দিনে ওর মাঝারি মাঞ্জায় কোনও জ্যান্ত সরস্বতীর ঘুড়ি কাটবে না, লিখে দিতে পারে ও। কিন্তু অ্যাকিলিসেরও গোড়ালি থাকে, যেমন বুধাদিত্যের থাকে বুধো, এবং ওই আদরের নামে ডাকার অসংখ্য লোক, অবিশ্বাস্য সব মুহূর্তে। বছর দুই আগে, নিজের পাড়ার পুজো ম্যাডক্স স্কোয়ার, অষ্টমীর সন্ধে। ধুনুচি নাচ করতে করতে সময়, ক্লান্তি কিছুই খেয়াল নেই বুধাদিত্যর। তুমুল বেজে চলেছে ঢাক, এতক্ষণ আশেপাশে যতজন ধুনুচি নিয়ে নাচছিল, ক্লাইম্যাক্সের দায়িত্ব বুধাদিত্যর হাতেই ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে দেখছে। ভিড় জমে উঠেছে – সে প্রায় শুটিং দেখার মতো ভিড়। রঙ্গিতের চোখ চলে যাচ্ছে বারবার ওর উল্টোদিকে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি মেয়ের দিকে। আরও অনেকেই তাকিয়ে আছে বুধাদিত্যর দিকে, কিন্তু এদের দুজনের তাকানো – আহা! এমন দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হলে তবে না মনুষ্যজন্ম, মা!
ধুনুচি নাচ শেষের পরে মেয়েদুটি যথারীতি এগিয়ে এল আলাপের ভঙ্গীতে। পাড়ার ছেলে তখন ম্যাডক্সে অষ্টমীসন্ধের নায়ক। আশেপাশে কান পাতলে বহু ক্রাশ ভাঙার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বুধাদিত্য তখন সপ্তম স্বর্গে উঠেও বলতে পারে, “স্বর্গ কম পড়িয়াছে!” মাঝেমধ্যে এইসবকিছুর ফাঁকে রঙ্গিতের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিচ্ছে, রঙ্গিত বুঝতে পারছে না এর মধ্যে কোন ভাবটা প্রকট – “তোর জুটলো না” নাকি “আমার জুটলো”! তবে জোটার আখ্যান বিধাতা সাজিয়েছিলেন একটু অন্যভাবে, এবং বরাবরের মতোই, কারুর সঙ্গে আলোচনা না করে। মেয়েদুটির সঙ্গে আলাপ মাঝপথে, নবমীতেও বুধাদিত্য ম্যাডক্সে থাকবে কিনা এই নিয়েও কথা চলছে, এমন সময় পিছন থেকে এসে রাঙামাসি হাতে চিমটি কেটে, “বুধো! হ্যাঁ রে বুধো! তুই তো ছুপা রুস্তম! এখানে এরকম নাচিস, আর বাড়ির পুজোয় তো কিচ্ছুটি দেখি না! হ্যাঁ রে! এই বুধো, কাল নাচবি, কেমন?”
ফ্রম অষ্টমীর বুধাদিত্য টু নবমীর বুধো! “কাল নাচবি”! ফ্রম ক্রাশ-ভাঙা ধুনুচি নাচ টু অনুরোধের মাদারি কা খেল! মধ্যিখানে তিনবার “বুধো”!
শেষে বিদায়বেলায় মেয়েদুটির সঙ্গে পুনঃপরিচয় করালেন রাঙামাসি, “আমাদের বাড়ির সবেধন নীলমণি।” এক্সিট রাঙামাসি।
সেটানও বোধ হয় স্বর্গ থেকে নরকে এত জোরে এসে আছাড় খায়নি।
বাবুঘাটে কত মানুষের ভিড় কলা-বৌ স্নান করাতে। জলে রোদ পড়ে হাজারটা সূর্য যেন ছুটে আসছে ঘাটের দিকে, আবার খেলার ছলে পিছিয়ে যাচ্ছে। বড়মামার সঙ্গে হাঁটুজল অব্দি নামলো রঙ্গিত আর বুধো। আঁট হয়ে থাকা কাদায় পা গেঁথে নিচু হয়ে আঁজলায় জল তুলে স্নান করানো হয়। জলের উপরের তলটা রোদ পড়ে কিছুটা গরম, আর যত নিচে নামা যায়, ঠাণ্ডা। গা শিরশির করে ওঠে রঙ্গিতের। আজ, এই মুহূর্ত থেকে যেন পুজো শুরু হল। ঘটে গঙ্গাজল ভরে, গঙ্গামাটি তুলে একটা ছোট্ট একলামতো কাঁসর বাজাতে বাজাতে ওরা ফিরে এল গণেশের গৃহিণীকে নিয়ে। সকালের পুজোবাড়ি তখন একটু একটু জমে উঠেছে আলাপে, আড্ডায়। চাতালে পেতে দেওয়া হয়েছে রোজকার সেই লাল চেয়ার, তোশক-আঁটা তক্তা। কিন্তু ষষ্ঠীর ফাঁকা, নবীন প্রাঙ্গন সপ্তমীর সকালেই ভরে উঠছে বেশ। উপরে ঠাকুরদের কড়াইতে জলখাবারের ঘিয়ে ভাজা লুচি আর আলুর তরকারি তৈরি হচ্ছে।
দুপুর না পেরোতে কোত্থেকে একরাশ ছেঁড়াখোড়া মেঘ ভিড় করে আসে নিয়োগীবাড়ির উপরে। বোধ হয় পাশে গলিতেও রোদ, কিন্তু এই রাস্তায় ঘনঘটা, তর্জন গর্জন শেষে এক পশলা বৃষ্টি নামে। তুড়ি মেরে হাই কাটিয়ে স্বপ্নময় একে একে উল্টে যান মিনতির আলমারি থেকে খুঁজে পাওয়া পুরোনো এলবাম। এ বাড়ির জামাই স্বপ্নময়, তা হলো প্রায় ত্রিশ বছর। সরকারি বদলির চাকরি থেকে বছর দুয়েক হলো অবসর নিয়েছেন। চাপা গায়ের রং, পাক ধরা চুল, মান্যবরের কুর্তার নীচে হলদেটে স্যান্ডো গেঞ্জি আর বেমানান সোনালী ফ্রেমের চশমায় স্বপ্নময় স্বচ্ছলতার পোস্টার বয়। বিয়ের পর প্রথম এই বাড়িতে আসার ছবি চোখে পড়ে। ছিপছিপে নবদম্পতি। সুগার নেই, প্রেশার নেই, প্রস্ট্রেট নেই। উপরন্তু তার এই বেয়াদব ভুঁড়ি জুটেছে শেষ কিছু বছরে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফ্যামিলি whatsapp গ্রূপে সকালের পুজোমণ্ডপে তোলা ছবিগুলো মন ভরে দেখতে থাকা মিনতির গায়ে গা লাগিয়ে ঠেস দিয়ে বসেন স্বপ্নময়।
"আহ! কী হচ্ছে!", বুকের অসংলগ্ন আঁচলটুকু ঠিক করে নিতে নিতে মিনতি বলেন।
"কেন? 'পাশের ঘরের থেকে কেউ এসে দেখে নিলে' বলবে তো? প্লিজ, নট এনিমোর! ত্রিশ বছর পেরিয়ে এসব চিন্তা বরং পরের জেনারেশনের জন্যই রাখো। এই দ্যাখো, কাদের খুঁজে পেয়েছি।"
এলবামে নিজেদের সেই তিন দশক দিকে তাকিয়ে নিরুত্তাপ মুখে মিনতি বলেন, "এখানে তো তবু দুজন", বলে স্বপ্নময়ের ভুঁড়িতে টোকা মেরে বলেন, "এখন তো এর জন্য আলাদা জায়গা লাগে বিছানায়। সত্যি! ঊর্মির ৯ মাসেও আমার পেট এই জায়গায় যায়নি অন্তত!"
সশব্দ ঢেঁকুরে দুপুরের ট্যাংরা কষার তৃপ্তি ব্যক্ত করেন স্বপ্নময়। ভুঁড়িতে হাত রেখেই মিনতি বলেন, "আচ্ছা বেশ, আট মাস।"
পুজোবাড়িতে সপ্তমীসন্ধে এলেই এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে শুরু করেন, "এই তো সপ্তমীও কেটে গেল, অষ্টমী-নবমী দুটো দিন কেটে গেলেই ভাসান! ব্যাস! এত আনন্দ-আয়োজন সব শেষ!" এটুকু শেষ করে তারপর অপেক্ষাকৃত ছোটদের দিকে তাকিয়ে জগতের এই প্রবহমানতার রহস্য ভেদ করার আনন্দে হ্যা হ্যা করেন।
তেমনই, সপ্তমীর সন্ধ্যারতির শেষে বরণ মেসো প্রসাদের নরম পাকের সন্দেশে দই মাখিয়ে খেতে খেতে বললেন, "হোয় বুধো!"
ধোঁয়া-সেবনার্থে সবার চোখ এড়িয়ে বেরোতে যাওয়ার পথে বুধো আর রঙ্গিত দাঁড়িয়ে পড়ে।
"হ্যাঁ মেসো!"
"আয়, আয়। এখন কী বড় হয়ে গেছিস বলে আর তাকাবিই না।"
"না না, বলো।"
"ঠাকুর-ফাকুর দেখলি?"
"না গো, এখনও তো..."
"সে কী! দেগিস নি? বাদমতলার পুজোয় তো গাঙ্গুলি নিজে ..."
"অসুর?"
"উদ্বোধন।"
"আচ্ছা। হ্যাঁ, শুধু এটুকুর জন্যই যাওয়া যায়, বলো?"
“আর ঝাড়বাতি! ইয়াব্বড়! ঝোলা!”
“বাহ। কী সুন্দর! যাবো।”
"কী কব্বি গিয়ে? এই তো সপ্তমীও কেটে গেল, অষ্টমী-নবমী দুটো দিন কেটে গেলেই ভাসান! ব্যাস! এত আনন্দ-আয়োজন সব শেষ!"
"ও। হুঁ।"
"হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা।"
"হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা। ঠিক আছে, আমরা তাহলে..."
"আরে শোন না! ভালো খবরটা কবে পাচ্ছি?"
"ভালো খবর?"
"আরে চব্বিশ বছর বয়স হলো তোর, কাউকে একটা ঠিক করে রেকেচিস তো?"
"কী আর হবে ঠিক করে?"
"উইদ্দ্যা, আমাদের বুড়োদের হাঁটু গুলো ঠিক থাকতে থাকতে বিয়েটা কব্বি তো? চলে ফিরে গিয়ে তোর বিয়েতে খেয়ে আসবো। তোর আগের উইকেটগুলো তো পড়ে গেছে! হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা। এবার তো লিস্টে তুই!"
"কী লাভ বিয়েতে! আজ বিয়ে, কাল বাচ্চা, পরশু বানপ্রস্থ! ব্যাস সব শেষ। তোমাদেরও আজ হাঁটু, কাল হার্ট, পরশু ভাসান। ব্যাস, সব শেষ। হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা। আসি মেসো।"
গলির মুখে ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সুখটান দেয় বুধো, রঙ্গিত। “কি রে, রঙাই? চোখ খুব ও’ বাড়ির দিকে যাচ্ছে দেখছি! কেউ অপেক্ষায় নাকি!”
একটু আড়ষ্ট হয়ে বোকা-বোকা হেসে চোখ সরিয়ে নেয় রঙ্গিত। অপেক্ষায়? কেউ? বলা যায় কি? এখনও নয়। মিনিট পনেরো আগে অস্মিতা বাইরে থেকে ফেরার পথে ওদের দেখেছে এই ছাতিমগাছের তলায়, সেই তাকানো রঙ্গিতের আড়চোখ এড়িয়ে যেতে পারে নি। দেখে এক মুহূর্ত থমকেছে কি অস্মিতা? নাহ, ধুস! যতসব! ছাতিমতলায় দুটো ছেলে সিগারেট খাচ্ছে, এ দেখে থমকানোর কী আছে! ভুল, ভুল। আদ্যোপান্ত মনের ভুল।
অস্মিতার দৃষ্টি আর অদৃষ্টের মাঝে দোল খায় রঙ্গিত মনের এলোমেলো দোলনায়। ছাতিম বোঝে হয়তো সে মনের ভার, তাই বাতাস ভারি হয়ে আসে কিছুটা। ছাতিম বোঝে হয়তো এই মনের আকাশ-কুসুম, তাই সে নিজে তার কিছু ফুল ঝরিয়ে দেয়। অনতিদূরে পুজোবাড়ির সপ্তমীর ঢাক, আড্ডার চাপা গুঞ্জন ভেসে আসে। রাত হলে সে’ সব কিছুটা কমবে, কিন্তু এই ক্ষণে এদের সবাইকে নিয়ে যে উৎসবপ্রকৃতি, সে প্রকৃতিতে রঙ্গিতের জন্য কি কোনও কাব্য রাখা থাকে?
(পরের পর্ব আগামীকাল)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।