বরণের সিঁদুর বড় কলঙ্কিনী, মনে হয় সুদর্শন নিয়োগীর। এ এমন এক খেলা, যে অসহায়ভাবে আপ্রাণ ঢাকা-চাপা দিতে চায় খেলাশেষের বিদায়কে – যেন তেমন কিছুই নয়, এই তো মাত্র চলে যাওয়া। কিন্তু বাড়ির মেয়েদের বরণ ফুরোলে পুজো-চাতাল জুড়ে যে অবিন্যস্ত সিঁদুর ছড়িয়ে থাকে, মৃন্ময়ী মায়ের মুখে লেগে থাকা সন্দেশ, লাল আভা তাঁর কপালে, তাঁর মেয়েদের মুখে, এমনকি কে যেন অসুরকেও ভীমনাগের সন্দেশ খাইয়ে দিয়েছে – ভারি মায়া হয় সুদর্শনের। উৎসবের শেষে, পুজোর শেষে যাকে দমন করতে এমন বাদ্যি, অর্চনা, প্রার্থনা, সে’ও মিষ্টির অল্প ভাগ পায়। সে ছিল বলেই না এই উৎসবের এমন সার্থকতা! তাই, সব শেষে, দশমীর বেলায় নিরঞ্জনের শেষে আর দুষ্টকে দুষ্ট মানা হয় না। সবই ভেসে যাবে জলে। বাংলার এই পুজোয়, ঘরের মেয়ে উমার বিসর্জনের আগে তাঁর চিরশত্রুকেও বাড়ির মা-বউয়েরা আদর করে বিদায় দেন। করুণার এমন ছিন্ন মেঘ খেলা করে মানুষের মনে, সুদর্শনের চোখ জলে ভরে আসে।
একটা ছোটো ছিমছাম ট্রাক বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায় দুপুর না পেরোতে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে মা অপেক্ষা করেন তাঁর এ বাড়ির বড়ছেলের জন্য। ভিতরঘরে সবাই কিছুটা নীরবে সেরে নেয় দুপুরের খাওয়া-দাওয়া। দিন ছয়েক আগে মহা শোরগোল ফেলে ঠাকুরেরা যে বাসন-কোসন এনে ছাদে তুলেছিল, আজ দুপুরের রান্নার শেষে সে-সব একে একে নিচে নেমে আসে আবার। ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসা ছাদে, ত্রিপল খুলে ফেলা ছাইরঙের ছাদে সমর দাঁড়িয়ে থাকেন। মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তাঁর ইচ্ছে করে না। অভিমান হয়। যদি মা চলেই যাবে, এত ঘটা করে সব করালো কেন, আনালো কেন? কিসের এত আয়োজন, এত রান্না-বান্না, লোক সমাগম, হাসি, আনন্দ, হই-চই, ছোটদের চিৎকার, সবই যদি পাঁচদিনের মাথায় এভাবে এক ফুঁয়ে প্রদীপ নিভে যাওয়ার মতো নিভে যাবে, তাহলে কিসের কী প্রয়োজন ছিল? প্রতি বছর সমরের এই প্রশ্ন মাথায় তোলপাড় করে, আর উত্তরের খোঁজে আরও এক বছর কাটিয়ে দেন সমর।
ভাঙা মণ্ডপে ঢাকি আর তার কাঁসর-বাদক বসে থাকে বাকি পাওনার আশায়। বাড়ির বড়-মা কিছু পুরোনো কাপড় দেন তাদের, গেলবারের। সে নিয়ে তারা এবার চটজলদি শেয়ালদা’য় গিয়ে ট্রেন ধরবে বাড়ির। যাওয়ার পথে পাড়ায় আশেপাশের দু-এক বাড়ি থেকেও একটু বকশিস চাইবে ওরা। পুরুতমশাই তাঁর নারায়ণকে রেখেই বাড়ি গেছেন আপাতত; ভাসানের পর সন্ধেয় এসে শান্তির জল আর আশীর্বাদ পর্ব সেরে এবারের মতো ইতি টানবেন সবে।
বিকেল নাগাদ একদম ঝিম মেরে যাওয়া বাড়িটায় রব ওঠে, “দুগগা মাইকি জয়!” একচালার ছোটো সংসার উঠে পড়ে ট্রাকে। প্রচণ্ড ক্লান্ত, অবসন্ন বাড়িটা, শরীরগুলো জানে কাজ এখনও শেষ হয়নি। গঙ্গায় গিয়ে আবার ভিড়, আবার নাম লেখানো, আবার অপেক্ষা। আরও একবার ধ্বনি ওঠে, “দুগগা মাইকি জয়!” ট্রাকে উঠে পড়েন সুদর্শন, সমর, সলিল, আরও কয়েকজন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাকিরা দেখে। কাঁসর বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে শুরু করা হয় যাত্রা। মিতভাষী রাস্তাটা পেরিয়ে দূরের বাঁক থেকে ট্রাক অন্যদিকে ঘুরে গেলে সবাই ফিরে আসে ঘরে। মুহূর্তেই মায়ের এই চলে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী থেকে বাস্তব হয়ে ওঠে। নিজের ঘর থেকে সারদা ট্রাকের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে শোনেন, তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ান নি, জানালাতেও না। শব্দ একেবারে আর কানে না এলে সারদা নিজের গোপালের সামনে দাঁড়িয়েই একবার কাঁপা হাতদুটো জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বলেন, “সব তোমার থেকে এসেছিল, তোমাতেই ফিরে গেল কিন্তু। দেখো।” নব্বই বছর অতিক্রান্ত করেও এই শেষ “দেখো” বলতে গিয়ে তাঁর গলা বুজে আসে।
সকালের সেই বরণ, সিঁদুরখেলাকে মিথ্যে করে, ভালো আর মন্দকে এক আসনে বসিয়ে যখন সব কিছু বিসর্জন, সমাপিকার খেলায় মেতে ওঠে, তখনই দোতলার বারান্দায় আলাপে মগ্ন রঙ্গিত আর অস্মিতার হঠাৎই চোখে পড়ে, সামনের চাঁপা গাছটায় কুঁড়ি – আগামীকাল ফুটবে। তার কোনও দশমী নেই, ভাসান নেই, বিসর্জন নেই। কোনও সমাপন নেই তার কোথাও। মানুষের বাঁধা এসব তিথি-পঞ্জী পেরিয়ে সে পঞ্চমীতেও যেমন ফুল ভরিয়ে দিয়েছিল শাখায়, তেমনই একাদশীতেও দেবে। দশমী তার কাছে লক্ষ্য তো দূরস্থান, উপলক্ষ্যও নয়। তার উদ্দেশ্য একমাত্র প্রবহমানতা, একমাত্র ফুল ফুটিয়ে যাওয়া – যতদিন শিকড়ে জোর আছে, শাখায়, পাতায় রস আছে, ততদিন। প্রতিদিনই ভোরে তার বোধন, আর সন্ধায় বরণ। আবার পরদিন আরেক বোধন। কেবল এই ফুলগাছটি আমাদের গল্পের সদ্য আলাপচারী এই দুই মানুষকে বলতে চায়, শেষ নেই, শেষ নেই, শেষ হয় না। প্রকাশ বদলায়, অপ্রকাশ আসে, মুছে যায় অনেক কিছুই। কিন্তু উদ্দেশ্য বদলায় না, পথ থামে না। যা হারালো, তা আসলে সবই প্রকাশিত হতে থাকলো যা কিছু রইল, তার মধ্যে। এর অন্যথা নেই। চাঁপাগাছের এই গভীর দোলা রঙ্গিত আর অস্মিতার গায়ে লাগলো কিনা, সে সময়ই বলবে।
বাবুঘাটের গঙ্গায় বহু মানুষের ভিড়েও যখন একাকী এই মৃন্ময়ী ভেসে যান গঙ্গায়, তাঁর সামান্য সন্তানেরা তাকিয়ে থাকে অসহায়তায়। সে রূপ গঙ্গায় একবার ডোবে, আবার ভেসে ওঠে, আবার ডুবে যায়। অপ্রকাশে। কিন্তু সেই যে সে একবার ভেসে উঠেছিল মাঝে, সেই যে সে বলে গেল আবার ভেসে ওঠাই আমাদের সকলের পরম ধর্ম, তাঁর সেই আলোটুকু ছড়িয়ে পড়ে আমাদের শহরে, শহর থেকে তারও বাইরে, প্রকৃতিতে, সন্ধের গাছে গাছে, রাত্রের নক্ষত্রে। সে আলো ছড়িয়ে পড়ে কত মানুষের ঘরে যারা কত শত কারণে পুজোর এই উৎসব থেকে কিছুটা দূরে আজ – হয়তো দূরে থেকে, বা বাড়িতে থেকেও তাদের মনে পড়ছে কেবলই বাড়ির কথা। সেই আলো তাদের সকলের ঘর হয়ে, তাদের পাশে মলিন বিছানার চাদরে একরত্তি সন্তানের মতো শুয়ে আশ্বাস দেয়, আর মাত্র চারদিন পর ভরা পূর্ণিমা।
(শেষ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।