একটা সাংঘাতিক শব্দে ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় রঙ্গিত বুঝতে পারছিল না শব্দটা বাইরে থেকে ওর কানে এল, নাকি ঘুমের মধ্যেই কোনও স্বপ্নে শুনল! চমকের চোটে এখনও বুক-পেটের ভিতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। একগাদা রোদ পূবের জানলা দিয়ে এসে পড়েছে দোতলার এই ঘরটায়। ঘরের ওইদিকের খাট থেকে মা কখন উঠে বেরিয়ে গেছে! মোবাইল ফোনের ঘড়িতে পৌনে আটটা দেখে ধড়মড় করে মশারি সরিয়ে বেরিয়ে আসে রঙ্গিত।
"মা! মা-আ!"
মা বেশিদূর যায় নি। পাশের ঘরে বসে খবরের কাগজ দেখতে দেখতে রীতা বলেন, "যা মুখ ধুয়ে নে। সবাই তো কখন উঠে পড়েছে!"
আচ্ছা, মা কি একেবারেই বোঝে না যে এই ‘সবাই তো কখন উঠে পড়েছে’-ডায়ালগটা শাহ রুখের ‘নাম তো সুনা হি হোগা’-র চেয়েও বেশি পুরনো হয়ে গেছে? এই বাক্যটা ব্যবহার করে রঙ্গিতের দেরি করে ঘুম ভাঙার পাপে আর আঘাত করা সম্ভব নয়! শুনে নিয়েছে ও লক্ষবার যে পৃথিবী ওর কত আগে উঠে পড়ে, আর ও পারে না! বয়েই গেল!
আবার কি মশারির ভিতর সেঁধিয়ে আরও কিছুক্ষণ মটকা মেরে পড়ে থাকবে ও? এই সোয়া আটটা অব্দি? নাহ, আটটা দশ। আচ্ছা, পাঁচ। ব্যাস, কুড়ি মিনিটই তো! প্লিজ? নিজের মনে নিজের সঙ্গেই দর কষছিল রঙ্গিত, এমন সময় আবার সেই শব্দটা! ঘুম ভেঙে গিয়েছিল যেটা শুনে ওর। এক ছুটে লাগোয়া টানাবারান্দায় গিয়ে তড়িঘড়ি দক্ষিণে রাস্তার দিকে এগিয়ে আসে ও। একটু এগোতেই – হা ঈশ্বর! ভ্যান থেকে বিরাট বড় বড় কড়াই নামানো হচ্ছে ঠাকুরদের। গতকাল বিকেলে কিছু বাসন-কোসন ওরা রেখে গেছে, সমর মামার কাছে শুনছিল রঙ্গিত। আজ সকালে এসে বড় বাসন রাখার কথা। সেই আওয়াজেই ঘুম চটকেছিল ওর। এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে, নিচের দিকে তাকিয়ে ভারি মজা লাগলো রঙ্গিতের। যে শব্দে বুক ধড়ফড়ানির চোটে মিনিট দশ আগে কেঁপে উঠেছিল ও, এখন সেই শব্দের কারণ বুঝে ওর নাকে কোত্থেকে যেন পুজো পুজো গন্ধটা এসে লাগছে। শিউলি গাছটা ফাঁকা প্রায়, ভোরে নিশ্চয়ই সব ফুল তুলে নেওয়া হয়েছে ওর গোড়া থেকে, পুজোর কাজে। ওর সামনের রাস্তাতে দাঁড়িয়েই সমর মামা হিসেব বুঝে নিচ্ছেন ভ্যানওয়ালার সঙ্গে। আজ থেকে পুজো…! এভাবে আগে মনে হয় নি রঙ্গিতের। ইশ! মা যে কেন আরেকটু আগে ডেকে দিল না! ভোরে তাহলে ও’ও যেত নিচে ফুল তুলতে।
এইসব হেমন্তের মিঠে বাতাসের মতো বিলম্বিত, দীর্ঘশ্বাস-ছাড়া চিন্তায় যে মানুষ একটু উদাসী হয়ে পড়ে, কাল ওইখানেই! তিরিশ সেকেন্ডের ঔদাসীন্য কাটিয়ে রঙ্গিত যখন সামনে তাকাল, উলটোদিকের বাড়ির জানালায় এসে কখন যেন দাঁড়িয়েছে অস্মিতা।
এখন কথা হচ্ছে, যে মানুষকে আপনি মনে মনে তুমুল জড়িয়ে ধরে বসে আছেন অথচ মুখে “কেমন আছিস” টুকু বলতে গেলে “কেমন”-এর পর বাকি কথাটা ঢোঁকের আড়ালে কোথায় হারিয়ে যায়, সে যদি আপনাকে অসতর্ক মুহূর্তে একবার খেয়াল করে, পরমুহূর্তে আপনার সতর্কতার ভারে দক্ষিণ গোলার্ধ উত্তরে চলে যেতে পারে।
কাজেই, রঙ্গিত। ঘুম থেকে উঠেছে, আধঘণ্টাও হয়নি। অসতর্কভাবে দিবাস্বপ্নে ব্যস্ত। নিচে ভ্যান, বাসন, মামা। উল্টোদিকের জানালায় অস্মিতা। কখন থেকে কে জানে! এর মধ্যে কী রঙ্গিত একবারও আলটাকরা দেখিয়ে হাই তুলেছে? কুলকুল করে ঘামছে ও! হেমন্তের বাতাস গেছে হাওয়া খেতে! স্যানডো গেঞ্জি তুলে পেট চুলকেছে কি ও? মা গো! এ কেমন শারদীয়া! হাফপ্যান্টের নিচে খোলা হাঁটু! হাফপ্যান্টের নিচে হাঁটুর থাকাটা জীবনে প্রথমবার রঙ্গিতকে এতটা ভাবাচ্ছে। হায় হায়! স্যানডো গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট! সাড়া না পাওয়া প্রেয়সীর সামনে এ তো নো লেস দ্যান বিইং হ্যাশট্যাগ উলঙ্গ! হায় হায়, ওর মাথায় কী সকালের এলোমেলো না-আঁচড়ানো চুল! রঙ্গিত, না বকাসুর! নিশ্চয়ই ওকেই দেখছে এখন অস্মিতা, নিশ্চয়ই ওকেই দেখছিল এতক্ষণ! কেমন বেঁকেচুরে নিজেকে, পরিস্থিতিকে, প্রেমকে বাঁচাতে রঙ্গিত হঠাৎ চরম ব্যস্ততায় “এই তো, আসছি ছোটমামা” বলে উদ্যত পদক্ষেপে বারান্দা থেকে সিঁড়ির পথ ধরল স্যট করে।
“কই, আমি তো তোকে ডাকি নি রে রঙাই!”, মামার উত্তর কানে আসে।
“যুধিষ্ঠির আমার!” দাঁতে দাঁত চেপে বলতে বলতে প্রায় পাতালে ঢুকে যায় রঙ্গিত।
শুভ মহাষষ্ঠী!
পুজোর পাঁচদিনে সুদর্শন নিয়োগীর মেজাজ দিয়ে মানুষটিকে যদি বিচার করা হয়, মস্ত ভুল হবে। এমন নয় যে তিনি খুব হাহা-হিহি করা মানুষ বাকি বছরটা; কিন্তু হাসিখুশি, জমাটি চরিত্র আমাদের এই সুদর্শন বাবু। তবে পুজোর এই কদিন কাজের চাপে, এবং তার চেয়েও বেশি বংশের ঐতিহ্যের চাপে ভদ্রলোকের সবকিছুই একটু তিরিক্ষি, উচ্চগ্রাম হয়ে থাকে। যে অতিথিপরায়নতা নিয়ে তিনি বাকি দিনগুলোতে মানুষদের আপ্যায়ন করেন, এই কদিনও উদ্দেশ্য তাইই থাকে, কিন্তু বিষয়টি পৌঁছয় অনেকটা “খাবি না মানে? তোর ঘাড় খাবে!”- এই মর্মে। এমনকি অঞ্জলির সময়ে “নমো নমহ” মন্ত্রটি যেভাবে তিনি গর্জে উঠে “নামো নামাঃ” বলেন, সিংহের গরাস আলগা হয়ে আসে; পুজোর সময়ে কারুর নৈবেদ্যের থাল সাজিয়ে আনতে দেরি হলে তিনি যেমন যত্নে জিজ্ঞেস করেন “নৈবেদ্য আসেনি এখনও?”, দেবতারাই পারলে সেই মানুষটিকে বাঁচানোর জন্য বলে ওঠেন, “না না, আমরা ম্যানেজ করে নেব, কোনও ব্যাপার না!”
নিয়োগীবাড়ির বুড়োপুরুত আসবেন সন্ধেয়, বোধনের সময়ে। তার আগে, দুপুরের দিকে নারায়ণের পুজো, ভোগ হবে একবার। সেই কাজে এসে উপস্থিত হয়েছেন বুড়োপুরুত লম্বোদর চক্কোত্তির নয়া হেল্পিং হ্যান্ড, বাসু। সুদর্শন নিয়োগী এবং লম্বোদর বাবুর সামনে এ নিতান্তই সেদিনের ছোঁড়া। বয়স তিরিশের উপরের কোঠায়, উচ্চতায় টেনেটুনে পাঁচ। সাধারনভাবে তিনি ঘরে এসে ঢুকলেও মনে হয়, কি যেন একটা সাংঘাতিক গতিতে গুড়গুড় করে হয়ে চলেছে। বাসু ‘ছোঁড়া’র একেবারেই পরিচয় ছিল না বোধ করি সুদর্শন বাবুর সঙ্গে। তিনি ওরকমই গুড়গুড়ে স্পীডে ঘরে ঢুকে খুব প্রফেশনাল একটা চাঁছা কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “তা-তিড়ি লাগান, তা-তিড়ি লাগান, এখনও তিন বাড়ি ডিউ পড়ে আছে।”
নারায়ণের সামনে ফলের থালা নিজেই সাজিয়ে রাখছিলেন সুদর্শন নিয়োগী। ফর্সা মুখে ঈষৎ লাল আভা এল, তিনি কেবল মুখ তুলে বললেন “তাড়াতাড়ি বললে কি আর তাড়াতাড়ি হয়, ঠাকুর? কত যে কাজ…”
প্রথমবার বড় বাড়ির পুজোয় যুক্ত থাকার উত্তেজনায় লাফাতে লাফাতে এর মধ্যেই দু বার বাথরুম ঘুরে এসেছেন ঠাকুরমশাই। আর তর সইছে না। এবার নিজেই আসনে বসে বললেন “ঝপাঝপ, কপাকপ!” বলে সুদর্শন বাবুর হাত থেকে একপ্রকার থালা ছিনিয়ে নিয়ে সাজাতে লাগলেন। অপরপক্ষে গভীর নীরবতা।
বাঁকা সলতে, এবড়োখেবড়ো ফলের টুকরোয় সেজে উঠলো ঘর। জল পড়ল কোঁসায়, হরতুকি ডুবল সে জলে, কুসিও। বলার কথা ছিল, “ওঁ বিষ্ণু”, শোনা গেল শুধু “ওঁষ্ণু”, তিনবার। তাতে অর্চনার নিবেদন নেই, আছে সজোর ধমকানি বিষ্ণুকে। কুসিতে জল তুলে “ওঁ তদবিষ্ণুং পরমং পদং” বলে বিষ্ণুর পরমপদে সে কী জলের ঝাপটা! অনন্তশয্যায় কেঁপে উঠছেন ঈশ্বর।
বহুক্ষণের ঝড়ঝাপটা শেষে যখন ক্লান্ত বিষ্ণু ফলারের অবকাশ পেয়েছেন, নীরবতা ভাঙলেন সুদর্শন নিয়োগী। “আপনি কি এভাবেই পুজো করেন?”
“এঁ? এঁ। হেঁ হেঁ।”
“হাসতে বলিনি। এভাবেই পুজো করেন?”
“আইজ্ঞা এর চেয়েও তা-তিড়ি পারি।”
ছোট পাড়ার এই রাস্তাটা আজ সন্ধেয় আলোয় সাজলো সম্পূর্ণ। দুটো গলি পেরিয়ে পাড়ার পুজো। আবছা সুরে সে পুজোর সূচনা ভেসে আসছে এত পথ। নিঝুম, হৈমন্তী রাস্তার উপর আলোর ঝালর, তারও উপরে কিছু বাড়ির বারান্দায় শৌখিন জ্বলা-নেভা আলো, আমাদের এই নিয়োগী বাড়ির গায়ে আলোর মালা, আর তারও অনেক, অনেক উপরে, হাল্কা হিমধরা আকাশে ইতস্তত তারাদের সংলাপ। বোধনের সময় হল। এসেছেন বুড়োপুরুত লম্বোদর মশাই। চাতালে এসে ভিড় করেছে সবাই প্রায়। ছোট্ট বুয়া কাঁসর ধরবে বলে বায়না করেছিল, এখন কাঁসরের ভারে প্রায় পড়ে যায় সে। ঢাকি তুলে নিয়েছে ঢাক। বুড়োপুরুতের পুজোশেষে বেজে উঠবে সব। কে একজন বলল, যা গিয়ে দিম্মাকে খবর দে, বোধনের সময় নিচে আসবে তো?
সারদা দেবীকে খবর দিতে ছুটল কেউ দোতলায় তাঁর পশ্চিমের ঘরে। সে ঘরে সারদা আজ বিকেল থেকেই বসে বসে ভাবছেন তাঁর মেয়েবেলার ময়মনসিংহের কথা। খোলামেলা পাড়ায় একটা পুজো হতো সরোজিনীদের বাড়িতে। এমন ষষ্ঠীর দিনগুলো তখন ভোর থেকে কুয়াশায় মেখে থাকতো? নাকি এতদিন পর স্মৃতির কুয়াশায় বেশি ঝাপসা লাগে তাদের? নিজের বাড়ি থেকে ছুটে বেরোলেই এক বিরাট খোলা আকাশ পেত সারদা, আর অনেক দূর থেকে কানে আসত পুজোবাড়ির হইচই। এখন আকাশ দেখাই দায়! নিজের বাড়ির পুজোর আহ্লাদ তাকে প্রতিবারই ফিরিয়ে নিয়ে যায় ওপার বাংলায়। সরোজিনীর দিদিমা, থুত্থুড়ে, বয়স প্রায় নব্বই, হাতে একটা ঘটি ধরে সাদা থান জড়িয়ে পুজোর ভোরবেলা স্নান করতে আসতেন ওদের ক্ষীরদিঘীতে। সবাই বলতো ক্ষীরদি’, সেই থেকে খিদ্দি। দিদিমা খিদ্দির এক পারে দাঁড়িয়ে নাইতেন। তখন ঘড়িতে বোধ হয় সাড়ে পাঁচটা। প্রথম সূর্যের আলোয় দিঘীর জল তিরতির করে কাঁপত; বুড়ো অশ্বত্থের পাতা নড়তো বুড়িমার মাথার উপর। স্নান সেরে, তাঁর আসনের দেবতার ছোট্ট ঘটিতে জল ভরে দিদিমা মাঠের, ঘাসের হিম ঠেলে, কুয়াশা ভেঙে ফিরে যেতেন বাড়িতে। যেতে যেতে পাড়ার সকলকে বলে যেতেন, “আইসো।” বহুদূরে, শান্তিনিকেতনে হয়তো কোনও রবীন্দ্রনাথ শরতের গান লিখছেন তখন। আজ, নিজের নব্বইয়ে, সারদার কেবল প্রশ্ন জাগে, কোন গান লিখেছিলেন সে সময় কবি? কোন গান?
(পরের পর্ব আগামীকাল)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।