কথায় আছে, “অষ্টমীর পূজায় ফলে বিদায়ের আশ/ নবমী দশমী বাঁধে আর বারো মাস”। অষ্টমীর পুজোয় নাকি বিদায়ের আশা ফলে গেরস্থের বুকে – সে কেমন? অষ্টমীর পুজো-শেষে নবমীর দিকে পা দিলেই বিদায় বাদ্য বাজতে থাকে কোথাও, আর মাত্র দু’ দিন। এই ‘মাত্র দু’ দিন’-এর প্রহেলিকায় গেরস্থ-কন্যা গৌরীর আগের তিনটে আলো-ঝলমল দিন কোথায় যেন পালায়! তারা এসেছিল যেন এটুকু বোঝাতেই যে তারা থাকবে না। ষষ্ঠীর যে লাবণ্যময়ী, কিশোরী মৃন্ময়ী কন্যা গেরস্থের, অষ্টমী পেরিয়ে সে যেন গৃহিণীর রূপ নেয়, অকারণেই উদ্যত হয়, বলতে থাকে “যাওয়ার সময় হল, আসি ... আসি”, আর এই করে জল নবমীর নিশুতি গা বেয়ে দশমী ছুঁয়ে ফেলে। বাড়ির মায়েরা ভাবে, মেয়ে বিদায় নেবে; আর মেয়েরা ভাবে, মা চলে যাচ্ছে। মৃন্ময়ী রূপটি ঠেলে কোন চিন্ময়ী ভাব শেষে এই বিদায়ের অঙ্কটি সাজিয়ে আসলে কোথাও পালায় না, কেবল মেয়েদের বুকে মা হয়ে, আর মায়েদের বুকে মেয়ে হয়ে থেকে যায়, কেউ বলতে পারে না। কেবল যে জগত বিদায়ের ধ্রুব সূত্রে বাঁধা, তাতে গেরস্থ প্রতি বছর এই অষ্টমীর পুজো শেষ করতে করতে বিদায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়, এমনকি এক সময়ের পর তার মনে হয়তো বা বিদায়ের আশ ফলে – সে অনুভব করে, মেয়েকে, মা’কে বাধাহীন যেতে দেওয়ায় কোথাও তারও মুক্তি লেখা আছে।
ছোটবেলা থেকেই অষ্টমী পুজোর ঢাক বেজে উঠলেই গলার কাছটা ভার হয়ে আসতো সলিলের। কেন, তিনি বুঝতেন না। এমন আনন্দের দিন, এমন আনন্দ-আয়োজন, এত মানুষ বাড়ির দালানে জড়ো, তবু এই এক পোঁচ শ্যামলা রঙ কেন? দাদার দিকে তাকাতেন সলিল। দাদার মুখ দেখে মন বোঝা খুব মুশকিল। ছোটো থেকেই কাজে মশগুল মানুষটিকে দেখলে মনে হবে যেন ষষ্ঠী, অষ্টমী, দশমী – সবই সমান তার কাছে। এখনও, আজও, সকালের পুজো শুরু হওয়ার পর অভ্যেসবশে সলিল তাকান সুদর্শনের দিকে। তেমনই নির্লিপ্ত মুখে ঠাকুরমশাইয়ের পাশে বসে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তবু, অভিজ্ঞতার জোরে সলিল যেন সুদর্শনের চোখেও ইদানীং সেই শ্যামলা পোঁচটা দেখতে পান। কোনও কোনও গভীর রৌদ্রের দিনে যখন আকাশে মেঘের কোনও লেশমাত্র নেই, হঠাৎ কখনও সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায় অতর্কিতে। বৃষ্টির আগমন ঘোষিত হয়, রোদ পালিয়ে মেঘ আসে আরও কিছুক্ষণ পর। তেমনই এক গন্ধ সলিল এতদিন পর, ষাট পেরিয়ে খুঁজে পান।
নিয়োগী বাড়ির চাতালে আজ সকাল থেকেই অঢেল লোক। লোকারণ্য বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হবে, কারণ ভিড় কখনই দলা পাকিয়ে চাতালে থাকছে না। ইতস্তত দুয়েকটা জটলা হয়েছে বটে – একদিকে দাদু-দিদাদের একটা টিম, অন্য মাথায় ক্যাপ-বন্দুক হাতে কিছু অশান্তির হাড়-হাভাতে শিশু, বন্দুক ফাটিয়ে শান্তি না হলে মুখ দিয়ে বুম বুম শব্দ করছে। বাদবাকি মানুষেরা আসা-যাওয়ার স্রোতে আছে। পাড়ার পথচলতি ভিড়ের অনেকেই ঢুকে চার-পাঁচ মিনিট দাঁড়াচ্ছেন। ফলপ্রসাদ এনে দিচ্ছেন তাদের হাতে বাড়ির মেয়েরা, গৃহিণীরা, ভিতরে প্রসাদের ঘর থেকে। সে ঘরে এখন তুলকালাম। কোনও সরল, অনবগত মানুষ সেখানে গিয়ে পড়লে উদ্দেশ্যহীন কিছু প্রশ্নবাণে তিনি আহত হতে পারেন। প্রশ্নগুলি কারুরই উদ্দেশ্যে নয়, উত্তরও ঘরময় চারিদিকে ছড়িয়েই আছে, কিন্তু ব্যস্ততার সময় প্রশ্ন আর উত্তর সাধারণত একে অন্যের উল্টোদিকে হাঁটা দেয় বলে এই ঘরে এখন --
“নাড়ু কোথায়? নাড়ু?”
“সুখী হারামজাদা জানে, ডাক তো ওকে!”
“হারাম --”
“আস্তে! আস্তে! মামা শুনলে শেষ!”
“আস্তে আস্তে কি করে মানুষ হারামজাদা বলে?”
“সুখীকে কি নাড়ুর ব্যাপারে ডাকা হচ্ছে?”
“নাড়ু?!”
“আমাকে কেউ বলবে, নাড়ুপ্রসাদ কোথায়!!”
“যাও চাতালে গিয়ে একবার হেঁকে এসো। খান দুই বছর সত্তরের মানুষ পেয়ে যাবে ওই নামে!”
“তুই শ্লা –”
“উঁহু, উঁহু। ব্যাস ওইখানেই থেমে যাও। মামা শুনলে সাড়ে সর্বনাশ!”
“আর দুটো পানিফল হবে?”
“না না, চাল-কলা মাখা আছে, দেব?”
“আমাকে কি এতটাই ইয়ে মনে হয়?”
“দই! দই! দই চাই!”
“এখানে কোনও অমল নেই, ভাগ!”
“আহা, খাবি না দিবি?”
“মান্তু মেসো চাইছে। খুব স্বাদ লেগেছে।”
“ওঃ! এখন কেন? পুজোর নেমন্তন্ন করতে গেলাম যে, বাসি কালোজাম খাইয়েছিল! সে কী আমি মনে রাখিনি?”
“ফ্রীজে সপ্তমীর বাসি দই আছে। চালিয়ে দেব তাহলে?”
এমন কলকাকলির ঘেরাটোপ ছেড়ে আজ রঙ্গিতের ঠাঁই হয়েছে খোদ পুজোর বেদীর সামনে, অঞ্জলির ফুল দেওয়ার দায়িত্বে। অষ্টমীতে অঞ্জলির ভিড় বড় বাধা। রাউণ্ডের পর রাউণ্ড অঞ্জলি হয়েই যায় নিয়োগী বাড়িতে। বাড়ির সকলে, কাছে ও দূরের আত্মীয়, বন্ধুমহল, পাড়ার প্রতিবেশী-অনাত্মীয়, সকলেই আসছে।
“অঞ্জলি হয়েছে?”
“হয়েছে।”
“আবার হবে?”
“আসছে বছর” বলার প্রবল বাসনা চেপে রঙ্গিত বলে, “এই তো আর পাঁচ মিনিট পরেই নেক্সট রাউণ্ড। একটু দাঁড়িয়ে যান।” এ তো কিছুই না। অষ্টমীর অঞ্জলিতে মানুষ ফুল চায়, যেন ভোটাধিকার চাইছে। বেলপাতা গোনে, যেন সরকার গঠন হচ্ছে। বড় গাঁদা পাওয়ার জন্য রিঙ্কি মাসি আদুরেপনা আদিখ্যেতা করছে, “বাবুলি, বাবুলি, এইদিকে ফুল একটু দে মনা! এই তো!” একজন অপরিচিত বললেন, “বিল্বপত্রাঞ্জলি বলার সময় হাতে বিল্বপত্র ছিল না। এতে কি বিপদের কোনও সম্ভাবনা আছে, ঠাকুরমশাই?” ঠাকুরমশাই জড়বৎ, বললেন “উঁ।” গোলমালে হারিয়ে যাওয়া “হুঁ”টা “উঁ”-এর আগে ছিল না পরে কে জানে! “দুর্গাদেব্যৈঃ নমঃ” বলে দেওয়ার পর কার কি হল না হল, থোরাই কেয়ার। বড়মামা একবার শুধু রঙ্গিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠিকভাবে দাও ফুল।” এ’সব সময়ে সিংহটা বেঁচে উঠলে বেশ হতো, মনে হয় রঙ্গিতের।
অঞ্জলির শেষ দফায় যে গুঁড়োগাড়া ফুল, সবার মধ্যে ভাগ করে দিয়ে, নিজে বাকি সামান্য ফুলটুকু হাতে নিল রঙ্গিত। অঞ্জলির এই ভিড়ে কেউই প্রায় ওর চেনা নয়। বেশির ভাগই দূরের আত্মীয় আর এই পাড়ার লোক (নাকি পাড়ার লোকের দূরের আত্মীয়)! বাকি বাড়ি প্রায় ঝেঁটিয়ে খেতে গেছে তিনতলায়, বা প্রসাদের বাটোয়ারা শেষে একটু গা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। এমন সময় –
“ঠাকুরমশাই, আমি ফুল পাইনি।” কথাটা পিছন থেকে এসেছে। কার গলার স্বর কে জানে, তবু রঙ্গিতের মনে হল, এ সেই স্বর ...
পিছনে তাকালো ও।
“একটু ফুল নেওয়া যাবে?”
প্রশ্নটা রঙ্গিতকে করা হয়েছে। ততক্ষণে ঠাকুরমশাই প্রথমবারের “শরণ্যে ত্রম্” পেরিয়ে গেছেন, গৌরী এবার হিসেবমতো তেড়ে বকাবকি করছে। ফুলের থালাও অনেক দূরে, হাতে পাওয়া যাবে না।
“হাত পাত, আমি দিচ্ছি ... হ্যাঁ, জড়ো করে পাত ...”
চারদিক থেকে ইতস্তত চুকচাক আওয়াজ হল, রঙ্গিত অন্য ‘অঞ্জলি’র মন্ত্র পড়ছে দেখে। নিজের হাতের প্রায় সব ফুলই ঢেলে দিল রঙ্গিত। নিজের ভাগ্যে একটা মাথা-ছেঁড়া বেলপাতা আর দু-তিনটে কুচো ফুল। এই না হল ভালোবাসার স্যাক্রিফাইস! নিজেকে কী হাল্কা লাগছে রঙ্গিতের।
“এমা, আমার এত ফুল লাগবে না। তুই একটু নে”, কিছুটা ফুল ফিরিয়ে দেওয়া হল হাতে। ইত্যাদি আদান-প্রদান মিটিয়ে সামনে ফিরতেই “দুর্গাদেব্যৈঃ নমঃ”! হাতের ফুলগুলো সামনে ছুঁড়ে দিতে হবে, প্রথা তাই বলে। সে ছুঁড়েছে এর মধ্যেই, দেখেছে রঙ্গিত। আহা, শেল এসে বিঁধেছে ওর বুকে! নিজের হাতে দেওয়া ফুল, ওরকম ছুঁড়তে আছে? লক্ষ্য ভালো নয়, অসুরের মাথার জট পড়া চুলে আটকে গেছে। উঁচু ক্লাসে নিমাই স্যর বলতেন, “মর্নিং শোজ দ্য ডে!” কেন এ’সব মনে পড়ছে কে জানে! ও কী ফুল ছুঁড়বে? অফ কোর্স! ছোঁড়েনি দেখে লোকজন এরই মধ্যে তাকাচ্ছে। ছুঁড়তে তো হবেই। হায়, আলোড়নের প্রথম ফুল ফেলে দিতে হবে! কোথায় যেন পড়েছিল ও, ‘এই ডিলেমা কেন দিলে, মা?’
এমন অনেক প্রথম সখ্যের প্রকাশে শব্দ যখন অসংকুলান, পৃথিবী সেই দুটি মানুষের জন্য যেন কিছুটা সময় পাতে বেড়ে রেখে দেয় মায়ের মতো। এমনই এক অষ্টমীর দুপুর-বিকেল কেটে যায় রঙ্গিতের, অস্মিতার সঙ্গে আলাপের ভনিতায়। খুচরো কথা এর আগেও হয়েছে কয়েকবার, মামাবাড়ি আসার দৌলতে। কিন্তু যে সখ্যে এক ভালোবাসাও কোথাও প্রচ্ছন্ন, সেখানে কথা নিতান্তই সামান্য, রাস্তার মোড়ে ঝরে পড়ে থাকা ছাতিম ফুলগুলোর মতো। আজ, দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার শেষে অস্মিতার সঙ্গে রঙ্গিত ভিড় কমে আসা অলস চাতালে বসে কথা বলে, অবারিত বয়ে আসা বাতাসের গন্ধ নেয় বারবার। কে বলে হেমন্ত শুধু মনে পড়ার কাল? ছেড়ে যাওয়ার ঋতু? এই বিসর্জনের ডুবের মতো ফুরিয়ে আসা বিকেলে ওরা বাড়ির পুরোনো ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলে। মাঝে একবার বিরতি নিয়ে অস্মিতা ফিরে যায় বাড়িতে, সন্ধিপুজোয় আসবে কথা দিয়ে। গভীর সন্ধেতে ঢাকের আর কাঁসরের আওয়াজে চাতাল সেজে ওঠে ধুনুচির ধোঁয়ায়। ভিড় ঘন হয়ে আসে, নাচ হয়। তারপর সে’সব স্তিমিত হয়ে যায়। রঙ্গিত এসবে থেকেও থাকে না। এইসব ঘটনা ওর অনিঃশেষ অপেক্ষার মাঝে ছোটো ছোটো ঢেউ কেবল। সন্ধিক্ষণ আসে। আসে অস্মিতা। আরও অনেকে। চাতালের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। জ্বলে ওঠে ১০৮ প্রদীপ। চিন্ময়ীর অলঙ্কৃত রূপ জোছনা ঝরায় চতুর্দিকে; সেই এক রূপ অন্য কোনও মানুষে খুঁজে পায় আরেকজন। আঁধারে, আলোয় এক জগৎ দেখে আরেক জগতকে।
সময় বয়ে যায়। সেইসব ঢেউও বহুক্ষণ হল ভেঙেছে পারে এসে। খাতায় কলমে নবমী, কিন্তু রাত না পেরোলে মন মানে না। ভোররাতে নিঃশব্দ ঠাকুরদালান। ফুলেমালায় মা রয়েছেন ভারি পর্দার আড়ালে, শয়নে। আলো ফোটেনি এখনও। শুধু বাড়ির পিছনের দো'তলার বারান্দায় টিমটিমে হলুদ আলো জ্বলছে। লাল মেঝে, কালো সরু টাইলস্ ধার দিয়ে। জানলার সবুজ খড়খড়ি। ও' মাথায় ডাঁই করে রাখা আছে ঠাকুরের বাসন, পিতলের বাসনের ওপর জলের টুপটাপ ব্যারিটোন বাজছে। আর আধঘন্টার মধ্যে বাড়িতে সবার আগে জাগবে এই বারান্দা।
ভোর হয়েছে। শয়ন ভেঙেছে মায়ের। পাড়ার ছিমছাম গলি ধরে এগিয়ে আসছেন পুরুতমশাই। ভারি লোহার গেট ঠেলে খুলে দিচ্ছেন গৃহকর্তা।
(পরের পর্ব আগামীকাল)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।