ফ্ল্যাট আর্থ থিওরির সোনামুখেরা আজকাল খুবই উদ্বিগ্ন -- সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নিয়ে আমরা নাকি একটু বাড়াবাড়িই করছি। কারণ পরস্পরের থেকে (ভারতসরকারদ্বারাজনস্বার্থেপ্রচারিত) ন্যূনতম ১ মিটারের দূরত্ব রাখতে গেলে শেষ অব্দি বহু মানুষ পৃথিবীর কোণে পৌঁছে মহাশূন্যে পড়ে যাবেন, এ কথা তো সত্যিই তাঁরা বাদে আর কেউ ভেবেই দেখেন নি! এমন উমদা চিন্তার উন্মেষ নতুন নয় অবশ্য; অন্যান্য ক্ষেত্রে একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখা যায়। যেমন এককালে বাঙালিদের বিশ্বাস ছিল, কলকাতার নাম এসেছে 'খাল-কাটা' থেকে। কিন্তু বলাই বাহুল্য, এ'সব চিন্তায় কলকাতা আসুক না আসুক, কুমীর প্রচুর আসে।
খালের প্রসঙ্গ ধরে কলকাতার ইতিহাসে প্রবেশ করার গুস্তাখি মাফ; আমি নিরুপায়। যা পড়েছি, তাই বলছি: সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন মারাঠা বর্গিরা বারবার বাংলায় হানা দিচ্ছে, গঙ্গাপ্রান্তের এই শহরকে বাঁচানোর জন্য শহরের মাঝবরাবর একটা বিরাট খাল কাটা হয় (যাকে বুজিয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের সার্কুলার রোড)। বৃথাই খাল-কাটা! বর্গি এল না কলকাতা ঘুরতে, উল্টে সেই পরাক্রমশালী খাল ডিঙিয়ে সিরাজের সৈন্যদল হাহা করে এসে শহরের সবচেয়ে পুরোনো নাট্যশালা 'ওল্ড প্লে হাউজ' ভাঙচুর করে চলে গেল ১৭৫৬ নাগাদ। এতকিছুর পর বোধ হয় অনেকের মনে হয়েছিল, এতবড় একটা খাল কাটলাম, একেবারে কোনোই কাজে আসবে না? সে থেকেই অনুবর্তী নবজাগরণ -- 'খাল-কাটা' টু ‘ক্যালকাটা’।
এখন, এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়, জোব চার্নক বা তাঁর সমসাময়িকরা কলকাতাকে তাহলে "হ্যাঁগো শুনছো"/ "এই"/ "বলছিলাম কি" ইত্যাদি বলে ডাকতেন কিনা। কিন্তু সে আলোচনা পরে; বস্তুত, কলকাতার নামসন্ধানে আমাদের চার্নক অব্দিও এগোতে হয় না। তিনি হাল ধরারও প্রায় ১০৮ বছর আগে, ১৫৮২- সনে 'ক্যালকাটা' নামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এক মুসলিম বাড়িওয়ালার পুরোনো জাবদা খাতায় ভাড়াটেদের নামপরিচয়ের ভিড়েই কালি দিয়ে লেখা ছিল, 'Calcutta'। এটি বিদেশীদের দেওয়া নাম, কাজেই অনুমান করা যায় সে সময়ে থেকেই কোম্পানির নেকনজরে ছিল এ' দেশের সম্পদ, আসা-যাওয়া লেগে থাকতো নিশ্চয়ই। যদিও ১৬৬০-এ ইংলন্ডে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরেই দ্বিতীয় চার্লস কোম্পানির ক্ষমতা বাড়ান, এবং ভারতের পূর্ব উপকূল বরাবর তাদের যাতায়াত, প্রতিপত্তি বাড়ে; তবু ১৫৮২ শেক্সপিয়রের 'হয়ে-ওঠা'র যুগ, রেনেসাঁ'র যুগ, কাজেই তখনও যে বাণিজ্যসূত্রে বিদেশভ্রমণ হবে, ধরে নেওয়াই যায়।
খালতত্ত্ববিদদের দমনে আরো বলা যায়, সেই 'মারাঠা' খাল কাটার কিছু বছর আগেই, ১৭১৭ নাগাদ দিল্লির সম্রাট ফারুখশিয়ারের একটি ফরমানে কলকাতার নামোল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও নামের উৎস স্পষ্ট হয় না কিছুতে।
হার্ট সাহেব এবং আরো অনেকের মতেই, কলকাতা নামের আসল ইতিহাস লুকিয়ে আছে আজকের দিনের কালীঘাট মন্দিরে। এখনকার এই মন্দিরগৃহটি সবে ২০০ বছর পেরোলেও সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের বহু, বহু আগে উল্লেখ পাওয়া যায় এই পীঠস্থানের। পনেরোশ শতাব্দীর মনসা ভাসান পালা বলি, কি সতেরোশ শতাব্দীর কবিকঙ্কন চণ্ডীর কথাই বলি, কালীঘাট উপস্থিত তৎকালীন সাহিত্যে। অবশ্য একটু অন্য নামে। কালীঘাটের আদি নাম 'কালী ঘাট্টা'। ঐতিহাসিকদের মতে, ভাষাগত দিক দিয়ে 'কলিকাতা' এবং তৎপরবর্তী Calcutta এর সবচেয়ে কাছাকাছি।
তবে এতসব বাদ দিলে, কাটছাঁট করে সাধারণ জনমানসে কলকাতার ইতিহাস শুরু ১৬৯০ সনের অগাস্ট মাসে। বাকিটা তো সবার জানা। হুগলিতে অবস্থিত প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো একটি কারখানা নানা অসুবিধার জন্য ছেড়ে দিয়ে কোম্পানি আসে এদিকে, চার্নকের হাত ধরে। কারখানা গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ১৬৯৮ সন নাগাদ কোম্পানি কিনে নেয় পাশাপাশি বেঁচে থাকা তিনটি গ্রাম -- তৈরি হয় এক নতুন শহরের প্রাথমিক রূপরেখা। দক্ষিণে তার সীমান্ত গোবিন্দপুর গ্রাম (এখন ফোর্ট উইলিয়াম যেখানে) ছাড়িয়ে খিদিরপুর; সুতানুটি থেকে চিৎপুর অবধি বিস্তৃত তার উত্তর সীমানা। আর কলকাতা কোথায়?
হার্ট সাহেব তাঁর 'Old Calcutta' বইতে বোধ হয় নিজের অজান্তেই ভারি আলগোছে বেঁধেছেন কলকাতাকে। গোবিন্দপুর আর সুতানুটির মাঝমধ্যিখানে কলকাতা, "unexactly defined, lying between the two"! কুর্নিশ, রেভারেন্ড হার্ট! কলকাতা আজও এমনই অসংজ্ঞায়িত আমাদের অনেকের চোখে। তার পরিচয়, পরিসর অনির্দিষ্ট। সে কেবল দুই সীমার মাঝে অসীম, লক্ষ কোটি প্রলাপের মধ্যবর্তী নীরবতা। সে জন্যই না এমন ভালোবাসি তাকে...
কালীঘাট পেরিয়ে, চিড়িয়াখানা পেরিয়ে বয়ে চলে আদিগঙ্গা। অবশ্য আদিগঙ্গার সঙ্গে 'বয়ে চলা'কে আমরা সেভাবে পাশাপাশি রাখতে পারি না আজকাল। হরিশ মুখার্জী রোড ধরে গদাধর আশ্রমের দিকে এগোলে, বা ক্যাওড়াতলা বা চেতলার দিকে এগোলে তার হেজে-মজে যাওয়া রূপই দৃশ্যমান। দিনে একবার জোয়ার এসে কালো, ভারী, ঘোলা জলকে কিছুটা যেন ঠেলে দেয়; আবার সব স্থির হয়ে যায়। পুরোনো প্রতিমা, সরায় ভাত রেখে যায় কেউ কেউ।
এই দৈন্যদশা আজকের নয় কিন্তু! ১৭৭৫-এর আগেও আদিগঙ্গার রূপ কিছুটা এমনই ছিল। সেই অচল, জীর্ণ নদীকেও মনে করা হতো বড়গঙ্গার অতীতের গতিপথ। প্রজাদের এমন পুণ্যিনদীকে (পুণ্যিনালা বললেও চলে) কি ফেলে রাখা চলে? অবশেষে তার সংস্কারে হাত দিলেন সায়েব এঞ্জিনিয়ার কর্নেল উইলিয়াম টলি। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন -- যাঁর নামে টলিগঞ্জ। ১৭৭৫-এ তাঁর উদ্যোগেই বাড়ল নালার গভীরতা, গতি এল জলে। নতুন নাম হলো তার টলির নালা। ১৮৯৫-তে রেভারেন্ড হার্ট যখন কলকাতা-কথা লিখছেন, তখনও এই নালা প্রবহমান। তাঁর বইতে উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে সুদূর দক্ষিণে বারুইপুর এবং অন্যত্র গড়ে ওঠা শ্মশানের, এই পুণ্যিনালাকে ঘিরে। এমনকি সে সময় তুলনামূলক আধুনিক হুগলি নদীকেও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না পুণ্যতার মাপকাঠিতে, যতটা টিআরপি পেত টলি সায়েবের নালা।
অথচ ১৮৯৫ থেকে মাত্র ২৮ বছরের ব্যবধানে রবীন্দ্রনাথ ১৯২৩-সনের একটি প্রবন্ধে লিখছেন, "অল্প কিছুকাল হল কালিঘাটে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমাদের পুরোনো আদিগঙ্গাকে দেখলাম। তার মস্ত দুর্গতি হয়েছে। সমুদ্রে আনাগোনার পথ তার চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। যখন এই নদীটির ধারা সজীব ছিল ... এ যেন মৈত্রীর ধারার মতো মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের বাধাকে দূর করেছিল। তাই এই নদী পুণ্যনদী বলে গণ্য হয়েছিল।" ('বিশ্বভারতী') অর্থাৎ তদ্দিনে কোনো কারণে টলির প্রিয় নালা আবার পুনর্মুষিক ভবঃ!
আরও দক্ষিণে গড়ে উঠছে খিদিরপুর। ১৭৮১ নাগাদ তৈরি হচ্ছে খিদিরপুরের ডক; সেই সময়ে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা ঢেলে তৈরি হচ্ছে বিরাট দুই যুদ্ধজাহাজ খিদিরপুর ইয়ার্ডে -- Nonsuch আর Surprize! ইতিহাস ঝাপসা এ সময়ের, স্পষ্ট বোঝা যায় না কেন এত খরচাপাতির পর হঠাৎ কোম্পানির এই সংস্থা লাটে উঠে গেল। সেখানকার চিফ এঞ্জিনিয়ার কর্নেল রবার্ট কিডের টান পড়ে গেছিলো জায়গাটার প্রতি, প্রজাদের প্রতি। তাই নবাবের গলার হার উপহারে দেওয়ার মতো কিড সাহেব নিজের নামটি উপহার দেন স্থানটিকে; চলে যান শিবপুরে তাঁর নিজের তৈরি কান্ট্রি হাউজে, মৃত্যুর পর সমাধিস্থ হন বোটানিকাল গার্ডেনের কোনো এক ছিমছাম কোণে। আর এদিকে তার নামে পরিচিত হয় কিড-এর পুর, অর্থাৎ কিডের পুর। মানে, খিদিরপুর!
আদিগঙ্গার এই একই পারে, বর্তমান বেলভেডিয়ারের কাছে ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রাসাদোপম বাড়ি। খিদিরপুর থেকে বেলভেডিয়ারের মধ্যেকার এই পথেই হেস্টিংসের সঙ্গে ফ্রান্সিসের সেই বিখ্যাত যুদ্ধ, বা আরেকটু পূর্বদিকে এগোলে কুলি-বাজার, যেখানে ১৭৭৫ সনে তৈরি হয়েছিল ভারতের প্রথম ফাঁসিকাঠ, দুর্ভাগা মহারাজ নন্দকুমারের জন্য, হেস্টিংসের বিরুদ্ধে যাওয়ার দোষে। এই সবের শেষে হেস্টিংস ফিরে আসতেন তাঁর আদরের প্রাসাদে, বিশ্রামকালে। ১৭৮০ নাগাদ এক লেখকের কলমে প্রাসাদের মুগ্ধকারী বর্ণনা পাচ্ছেন আমাদের হার্ট সাহেব। মজার ব্যাপার হলো, তিনি নিজে যখন ১৮৯৫-নাগাদ কলম ধরছেন, তখন কিন্তু প্রাসাদটি পুরোদস্তুর ভূতুড়ে: "chiefly known as the abode of ghosts and curious apparitions."
শোনা যায়, সে সময় হেস্টিংস নাকি হাতির পিঠে চড়ে শিকারে বেরুতেন! কলকাতায় শিকার! অবাক হচ্ছেন? জানতে চাইছেন, কোথায় যেতেন? ওর পাশ দিয়েই তো যাতায়াত করেন লক্ষ অফিসবাবুরা! সেন্ট পল'স ক্যাথেড্রাল! জে আজ্ঞে। তখন ক্যাথেড্রাল বলে কিছু ছিল না, ময়দান চত্বর ছিল ঘন জঙ্গল। ও'পথে যেতে আসতে বাঘের ডাক কানে আসতো; সন্ধের পর হাতে রাখতে হতো বন্দুক, ডাকাতের ভয়ে। নির্বিঘ্নে যারা ওটুকু পথ পেরিয়ে আসতে পারতেন, তাদের রীতিমতো 'adventurer' তকমা দেওয়া হতো!
এ'কালে যে রাস্তা ময়দান, চৌরঙ্গি, পেরিয়ে সোজা চলে যাচ্ছে ধর্মতলা চাঁদনি ছুঁয়ে ক্রমশই আরো উত্তরে, সেই সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের সেকালের নামে 'সেন্ট্রাল' ব্যাপারটি ছিল না। যেমন ছিল না আরও অনেক কিছুই। চৌরঙ্গি এলাকার দাম আজকের দিনের তুলনায় কিছুই ছিল না; নিতান্তই ফাঁকা এই চত্বরে সায়েবসুবোরা বানিয়েছিলেন নিজেদের শখের কিছু 'কান্ট্রি হাউজ', আর একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল স্যর এলিজা ইম্পে'র প্রিয় পার্ক।
স্যর এলিজা ইম্পে। সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে তিনি ওয়েস্টমিনস্টারে ওয়ারেন হেস্টিংসের ক্লাসমেট, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম চিফ জাস্টিস, জাত বজ্জাত। গত পর্বে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির কথা যে বলছিলাম, সে সাজার রায় দিয়েছিলেন জাস্টিস ইম্পে। তার নিজের দেশের স্বয়ং হার্ট সাহেবের বয়ানে, "Impey was long regarded as one of the ogres of Indian history, a traditional monster of inequity" -- অসাম্যের জাঁদরেল এক দানো!
সেই ইম্পে'র বিরাট পার্কের এক দিক দিয়ে চলে যায় তার যাওয়া-আসার মূল পথ মিডলটন রো (আজ্ঞে, আমাদের 'জীবনদীপের মোড়')। অন্য দু'দিক দিয়ে পার্ককে ঘিরে আছে সার্কুলার রোড (আজকের মল্লিকবাজার চত্বর) আর 'বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড'! অতএব, গোরস্থানে সাবধান!
পরে এই 'বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড'-এর নাম পাল্টে কী হয়ে যায় সে না হয় ফ্লুরিজের সম্মানরক্ষার্থে নাই বললাম, আর আজকাল এই কবরখানাতেই ফটোশুট করতে ঢুকি আমরা। সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেটারি -- তখন, ১৭-শতকের শেষ দিকে সে জায়গা রীতিমতো ব্যস্ত। বিখ্যাত উইলিয়াম জোন্স থেকে শুরু করে কর্নেল স্টুয়ার্ট থেকে ডিরোজিও, সবাই শায়িত এখানে। জোন্স আর ডিরোজিও তো সেকালের সেলেব্রিটি, বরং কর্নেল স্টুয়ার্টকে নিয়ে দু'কথা বলা যায় -- এটুকুই, যে মানুষটি বড় ভক্তি করে ফেলেছিলেন এদেশের দেবদেবীতে, নিজের জাতরক্ত বিসর্জন দিয়ে উপাসক হয়ে উঠেছিলেন হিন্দু উপাচারের। উড স্ট্রিটে তাঁর বাড়িতে রাখা থাকতো নানা বিগ্রহ, তাঁকে বাঁকা সুরে ডাকা হতো 'হিন্দু স্টুয়ার্ট' বলে। এমনকি, মৃত্যুর পরে তাঁর গোরটুকুও বাঁকাচোরা ভাবে, নানা ধর্মের চিহ্ন দিয়ে সাজিয়ে তাঁকে একহাত নিতে ছাড়েনি স্বজাতিরা।
একটু এগিয়ে গেলেই জনবহুল ধর্মতলা। দোকান-বাড়ি-আপিস সরিয়ে দিন, সেপিয়া চড়িয়ে দিন ফ্রেমে; ঝালিয়ে নিন সেই ছেলেবেলার প্রশ্নটা, "ধর্মতলায় ধর্মটা কোথায়?!" বুঝতে পারি যে পরবর্তীতে গ্র্যান্ডের ফুটে "কত করে দিলে?" আর "মাক্কালি দাদা, কেনা দাম বলছি" বাঙালির ধর্মই হয়ে উঠবে, কিন্তু ব্রিটিশদের মতো বেরসিক শাসক বোধ হয় এসব ভেবে ধর্মতলা নামটা রাখেন নি। অনেকে বলেন, কাছাকাছি এক মসজিদে কারবালা পালন হতো, সেই ধর্মযোগেই বোধ হয় জায়গার নাম এমন। অবশ্য ১৮৯৫ নাগাদ হার্ট সাহেব লিখছেন যখন, তখনই ধর্মতলা থেকে ধর্ম পগার পার। তার দু'পাশে তখন মাটি-খোঁড়া ডোবা, আর মাঝমধ্যিখান দিয়ে ছুটে চলেছে সায়েবদের শখের চৌরঙ্গি-পার্ক স্ট্রিটের জল খেয়ে আসা 'এভিনিউ'; চলতে চলতে পুবদিকে বাঁক নিয়ে কিছুটা এগোলে নোনা জলের কিছু হ্রদও পাওয়া যেত। সল্ট লেক! তা-ই বটে!
আশপাশে আরো ইতিহাস ঘোরাফেরা করে অদৃশ্য সত্যের মতো। আজকে যা বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, পলাশীতে যুদ্ধ চলছে যখন, সে সময়ের কলকাতায় চারধারে জঙ্গলঘেরা এই পথের নাম কাসীটোলা। ভুল ভাবছেন! একেবারেই কাশী-বারাণসীর ব্যাপার নয়! 'কাসী'টোলা নামটা আসে 'কসাই' থেকে। আদ্দিকালের কলকাতার এই ছিল কসাইপাড়া। সারি দিয়ে ছাগ ও গোমাংসের দোকান; চিৎপুর থেকে কালীঘাটের দিকে আসার পথে হিন্দুরা নমো-নমো করে এ তল্লাট পেরোতে পারলে হাঁপ ছাড়ত। তবে 'নিচু' হিন্দু বা মুসলমানই যে শুধু মাংস কাটতো এ পাড়ায়, এমন নয়। ১৮৩৫-সনের মেডিক্যাল সায়েন্সের এক জার্নালে দেখতে পাই, মিস্টার পিটম্যান ছিলেন কলকাতার প্রথম সাহেব কসাই।
আরো কত টুকরো টাকরা, অপ্রতুল, আবছা তথ্য, মুছে যাওয়া ইতিহাস পড়ে থাকে এদিক ওদিক। জানতে পারি, সে সময়ে শহরের সেরা রাস্তার তকমা পেয়েছিল লালবাজার। লালবাজারের ইতিহাস বরাবরই 'শুধরে দেওয়ার', তাই শহরের পুরোনো জেলখানা ছিল আজকের থানার ঠিক উল্টোদিকে। শোনা যায়, লোক ডেকে জনসমক্ষে দোষীকে মুচমুচে, রগরগে 'শিক্ষা' দেওয়ার জন্য একটা শাস্তিমঞ্চও ছিল -- এখান থেকে চাবুক মারা শুরু করে ঘোরানো হতো পুরো শহর, পিছন পিছন ঘন হয়ে আসতো দর্শককুল। এই বিনোদনের জন্য ১৮৫০ অব্দি কোম্পানি রীতিমতো ভাড়া দিয়ে প্রফেশনাল whipper রাখতো!
আর কী! চলুন, অনেক তো ধম্মতলায় কম্মখালি দেখলেন! এবার বৌ-বাজারের দিকটায় একবার ঢুঁ মারি, নাকি? হ্যাঁ, বেশ তো, ক্রিক রো দিয়ে শর্টকাট মেরে দেবো; বইপাড়াও তো ওভাবেই যাই! ভালো কথা, জানেন তো, এই যে হাঁটছেন, এই ক্রিক রো কিন্তু সে সময়ে সত্যিকারের ক্রিকই ছিল। হ্যাঁ রে বাবা, একেবারে পুরোদস্তুর নৌকো-বাওয়া খাঁড়ি -- ওয়েলিংটন পেরিয়ে সোজা চাঁদপাল ঘাটে গিয়ে গঙ্গায় পড়তো। দু'বেলা জোয়ার-ভাটা খেলতো, বললে হবে! গঙ্গা থেকে জোয়ারের টানে এক মাঝারি সাইজের জাহাজ একবার এই ক্রিকে ঢুকে ফেঁসে গেছিলো, সে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার! আরে মশাই নাহলে আর বলছি কী! চাট্টিখানি কথা?
ক্রমশ...
দারুন !! বিস্ময়কর !!কি ভাবে একটা শহর তার জন্ম নেয়া থেকে শুরু করে আজ অবধি বিদ্যমান ।...অবাক লাগছে!! অপেখ্য়ায় আছি আরো জানবো বলে !!আপনাকে ধন্যবাদ !!!
বাঃ শুরুটা তো দিব্বি!
আদিগঙ্গা নিয়ে দুচার কথা।
তিরপুর্ণি ঘাটের নাম জানা অনেকেরই। কিন্তু জায়গাটি তিরপুর্ণি বা ত্রিবেনী কেন ? গঙ্গা এখানে এসে তিন ধারায় বিভক্ত হয়। গঙ্গা এখানে দক্ষিণবাহিনী। তার ডানদিকে অর্থাৎ হুগলীর দিকে যে শাখাটি যায় তাকে সরস্বতী ও বামদিকে অর্থাৎ ২৪ পরগানার দিকে যে ধারাটি যায় তাকে যমুনা নামে ডাকা হতো। বাঙ্গালী বিশ্বাস করত এলাহাবাদের ত্রিবেনীতে গঙ্গার যুক্তবেণী মুক্ত হয়েছে বাংলার ত্রিবেণী তিরপুর্নিতে এসে। তাই সত্যন দত্তও তার খেই ধরে লিখেছেন, "আমরা বাঙ্গালী বাস করি সেই মুক্ত বেণীর বঙ্গে"। এই যে সরস্বতী নদী, এটির পাড়েই ছিলো সপ্তগ্রাম বন্দর, যা পর্তুগিজদের ঘাঁটি ছিল। সরস্বতী নদী হুগলীর ভিতর দিয়ে বয়ে শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান দেবানন্দপুর হয়ে হাওড়ার শিবপুরের পাশ দিয়ে বজবজ, ডায়মন্ডহারবার, হলদিয়া হয়ে সাগরে পড়তো, আজও যেখানে মিশেছে, সেখানেই। প্রসঙ্গতঃ যমুনা ২৪পরগনার ভিতর দিয়ে এসে পড়তো কলকাতার পূর্বপ্রান্ত শিয়ালদহে। এই দহটি তখন আজকের সল্টলেক জুড়েই ছিলো। এই দহের অতরিক্ত জল বেরিয়ে যেতো বিদ্যাধরী নদী বেয়ে।
গঙ্গার মূলধারা আজ যেখানে বিদ্যাসাগর সেতু, সেখান থেকে বামদিকে ঘুরে কালিঘাট, গড়িয়া, সোনারপুর, মজিলপুর, হয়ে কপিলমুনির আশ্রমের ধার দিয়ে সাগরে মিশতো। এই গঙ্গার পাড় দিয়ে হেঁটে শ্রীচৈতন্য পুরী যারাব জন্য রওনা হন। বৈষ্ণবঘাটায় বিশ্রাম করে (তাই জায়গাটির নাম বৈষ্ণবঘাটা), গঙ্গা পেরিয়ে মেদিনীপুর হয়ে পদব্রজে পুরী যান।
রাজমহলের পর গঙ্গার মালদহের ধারা গতি পরিবর্তন করে ১৫ শতকে। ফলে সরস্বতী ও যমুনা ক্ষীণস্রোতা হয়ে উৎস থেকে শুকিয়ে যেতে থাকে। সপ্তগ্রাম বন্দর হিসাবে পতিত হয়। পর্তুগিজেরা ব্যান্ডেলে সরে আসে। এতো দিন তারা সরস্বতি নদী ধরেই যাতায়াত করতো। কিন্তু শিবপুর থেকে সরস্বতী নদী হুগলীর দিকে নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় তারা সমস্যায় পড়ে ও তৎকালীন বাংলার শাসক আলিবর্দীর কাছে একটি খাল কাটার অনুমতি চায়। খালটি আজকের বিদ্যাসাগর সেতুর জায়গা থেকে, যেখানে গঙ্গা বামদিকে বেঁকেছে সেখান থেকে, আজকের খিদিরপুর হয়ে শিবপুরের পাশে বয়ে যাওয়া সরস্বতীর খাতের সাথে জুড়ে দেয়। সরস্বতীর এই খাতটি তখনো শিবপুর অবধি নাব্য ছিলো জোয়ার আসার কারনে।
এবার জল তার নিয়ম অনুযায়ী, বামদিকের পুরানো খাতের চেয়ে নতুন কাটা সোজা খাতেই বেশী বইতে লাগলো, ও আদিগঙ্গা শুখাতেশুরু করলো।
উইলিয়াম টলিসায়েব আদিগঙ্গার খাতটি সংস্কার করেন গড়িয়া অবধি। তারপর তিনি আর দক্ষিণে না গিয়ে ওটি পূব দিকে নিয়ে যান ও গড়িয়া পার হয়ে শামুখপোঁতার কাছে বিদ্যাধরীতে গিয়ে ফেলেন, যাতে দক্ষিণবাংলার, বিশেষ করে যশোর, খুলনা, বরিশালের পণ্য এই জলপথটি ধরে কলকাতায় আসতে পারে। তার জন্য তিনি পণ্যমূল্যের ১শতাংশ কুঁৎ অর্থাৎ টোলট্যাক্স নিতেন। যেখানে তার টোল নেবার জায়াগাটি ছিলো, সেটি কুঁৎঘাট ও পরে কুদঘাট নামে পরিচিত।
উৎসাহীদের জন্য যতসামান্য।
কলকাতা নামের উৎস নিয়ে কলিকাতা দর্পণ বইয়ে রাধারমন মিত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বহু বিতর্কিত এই নামের উৎস।
সুতানুটি (এখনকার বড়বাজার,বিবাদি বাগ ধর্মতলা ইত্যাদি),গোবিন্দপুর (সুতানুটির দক্ষিণে, এখনকার ফোর্ট উইলিয়াম মাটিয়াবুরুজ,খিদিরপুর,গার্ডেনরিচ ইত্যাদি)। কলিকাতা বা কলকেতা (সুতানুটির উত্তরে, চিৎপুর, জোড়াসাঁকো, আহেরীটোলা কুমোরটুলি ইত্যাদি) - এ তো আগে থেকেই ছিলো। কালীঘাট এই চৌহদ্দীর বাইরেই ছিলো। চন্ডীমঙ্গলে তো কলিকাতার কথা উল্লেখ আছে। কোন কারনে এই নামটিই প্রাধান্য পেলো তার নথি এখনো পাওয়া যায় নি। সম্ভবতঃ জোব চার্ণক কলিকাতাতেই প্রথম নোঙ্গর করেন। ও ওনার সেই সতীদাহ ভন্ডুল করার কাহিনীটি এই অঞ্চলেরই শ্মশানের (হয়তো নিমতলা)। তাই কলকাতা নাম ইংরাজদের পছন্দ হলো। আর একটা কারণ কালিকট ও কলকাতা নামের সাযুজ্য। এর ফাঁক দিয়ে ইংরাজরা রাজস্ব ফাঁকি দিতো। যার ফলে সিরাজ কলকাতার নাম পালটে সরকারীভাবে আলিনগর করে দেন যাতে এই কাওচুপি করা না যায়।
শুভংকর বাবুকে অনেক ধন্যবাদ এই সিরিজটির জন্যে। কল্লোলও চমৎকার ধরতাই দিচ্ছে।
আলোচনা জমে ক্ষীর হচ্ছে।