খবরের কাগজে বা টিভির বিতর্কে ‘ফ্রি মার্কেট’ শব্দবন্ধটি বহুলপ্রচারিত। ‘ফ্রি’ বা ‘পার্ফেক্টলি কম্পিটিটিভ মার্কেট’-কে বাংলায় বলা হয় পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার। কলেজের অর্থনীতির শিক্ষকেরা ‘পূর্ণ প্রতিযোগিতা’ বস্তুটি কী, তা বোঝাতে গিয়ে যে পণ্যটির উদাহরণ প্রথমেই টেনে আনেন, তা হল সবজি। বিক্রেতা এবং ক্রেতার সংখ্যা অগণন। বাজারটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রয়েছে দু-পক্ষেরই। তবে ক্রেতা হোন বা বিক্রেতা, দাম নির্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণ করার ছিটেফোঁটা সাধ্যিও নেই কোনো একক ব্যক্তিমানুষের। ‘বাজারমূল্য’-র নীচে আলু কিনতে চাইলে ফিরতে হবে ফাঁকা থলি নিয়ে। আবার কোনো দোকানি তার উপরে দাম চড়ালে মাছি তাড়াতে হবে তাঁকে। বাজারের শাশ্বত নিয়মে খানিক ওঠানামার পরে দাম স্থির হয় ততটাই, যার ফলে চাহিদা আর জোগান মিলে যায়। অর্থাৎ স্থির হওয়া দামে যতখানি সবজি কিনতে চান ক্রেতারা, ঠিক ততখানিই জোগান দিতে চান বিক্রেতারা। এ হল ‘ইক্যুইলিব্রিয়াম’ বা ভারসাম্য মূল্য। এর পরে কোনো কারণে দাম বাড়লে বা কমলে, স্বয়ংক্রিয় ভাবেই আবার তা ফিরে আসে ভারসাম্য-দামে। সরকার বা অন্য কোনো সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হয় না চাহিদা-জোগানের অমোঘ মিলনবিন্দুতে দামকে টেনে আনতে। সেই কাজটি করে, অ্যাডাম স্মিথের ভাষায়, বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’।
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কয়েকটি নির্দিষ্ট চরিত্র রয়েছে, যার উপরে ষোলো নম্বরের প্রশ্নের উত্তর লেখা যায় অনায়াসেই। বোঝাই যাচ্ছে, অতগুলি বৈশিষ্ট্য অক্ষরে অক্ষরে মিলবে এমন পণ্য বাস্তবে পাওয়া দুষ্কর। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতা কতখানি ‘অপূর্ণ’ হয়ে ওঠে, তখন পণ্যের মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হয়, সেই আলোচনাও থাকে কলেজপাঠ্য অর্থনীতির সিলেবাসের অনেকটা জুড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পূর্ণ প্রতিযোগিতার উলটোদিকে রয়েছে একচেটিয়া বাজার, যেখানে থাকেন একজন বিক্রেতা এবং অসংখ্য ক্রেতা। সেই বিক্রেতার অনেকখানি নিয়ন্ত্রণও থাকে পণ্যটির দামের উপরে।
বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে, দাম নির্ধারিত হতে পারে বিভিন্ন উপায়ে। তারই একটি নিয়ে সুদীর্ঘ গবেষণার ফলে অর্থনীতিতে এ বছরের নোবেল পুরস্কার পেলেন পল মিলগ্রম এবং রবার্ট উইলসন। তাঁদের চর্চার বিষয় নিলামের অর্থনীতি। ১৬৬৪ সালে স্থাপিত হয় পৃথিবীর আদিতম অকশন হাউস বা নিলামকেন্দ্র স্টকহোমস অকশনস্ভার্ক। আজও, প্রতিদিন বিশ্ব জুড়ে বিপুল অর্থের আদানপ্রদান হয় নিলামের মাধ্যমে। ‘নিলাম’ শব্দটি শুনলেই চোখে ভাসে ফেলুদার গল্পের খ্যাপাটে শিল্পসংগ্রাহকের ছবি। বা খবরেরকাগজের রোমহর্ষক ‘স্টোরি’—দেড় লক্ষ ব্রিটিশ পাউন্ডে নিলাম হয়েছে ১৯৪৩-এ লেখা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির একটি চিঠি। এইসব দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য বস্তু ছাড়াও অনেক সাদামাঠা জিনিসও কিন্তু নিত্যি হাত বদলায় নিলামের মাধ্যমে। ইন্টারনেটে বেচাকেনার ক্ষেত্রে নিলাম এখন অত্যন্ত চালু একটি প্রক্রিয়া। এদেশে ক-দিন আগেও ‘বিডিং’ বা দর হাঁকাহাঁকি করে প্লেনের টিকিট কাটা যেত। সরকারি অফিসে দরপত্র বা টেন্ডার ডাকার পরে সব চেয়ে কম দর যিনি হাঁকেন, বরাত মেলে তাঁর। আবার বিশ্ব উষ্ণায়ন কমাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিলাম ডেকেই ঠিক করে কলকারখানার দূষণের জন্য কতখানি ক্ষতিপূরণ দিতে হবে শিল্পপতিদের। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কের সীমা নির্ভর করে যে রেডিও ফ্রিক্যুয়েন্সির উপর, তার বিকিকিনিও হয় ‘স্পেক্ট্রাম’ নিলামের মাধ্যমে। স্পেকট্রাম দুর্নীতির হিসেবের বহর দেখলেই মালুম হয় আধুনিক জগতে নিলামের গুরুত্ব কতখানি।
প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গেই বেড়েছে নিলাম-প্রক্রিয়ার জটিলতা। এখানেই মিলগ্রম এবং উইলসনের কাজের গুরুত্ব। এক দিকে দর হাঁকিয়েদের আচরণ বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখিয়েছেন কীভাবে নিলামে দর ঠিক হয়। অন্য দিকে, তত্ত্বের ভিত্তিতে নিলামের নতুন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছেন তাঁরা। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই নতুন প্রক্রিয়ায় নিলাম ডাকাও শুরু হয়েছে।
নিলামের তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি নিলামের ফলাফল নির্ভর করে তিনটি জিনিসের উপরে। এক, নিলামের নিয়মাবলি বা ‘ফরম্যাট’। একজনের হাঁকা দর কি অন্য দর-হাঁকিয়েরা দেখতে পান? উত্তর হ্যাঁ হলে সেটি ‘খোলা দর’ বা ‘ওপেন বিড’। না হলে ‘ক্লোজড’ বা বন্ধ। একজন অংশগ্রহণকারী কতবার দর হাঁকতে পারেন? যিনি নিলামে জেতেন, তাঁকে কি সর্বোচ্চ দরটাই দিতে হয়? নাকি তার ঠিক নীচের দরটা? দুনম্বর যে বিষয়টির উপরে নিলামের ফল নির্ভর করে, তা হল পণ্যটির আপেক্ষিক মূল্য। সমস্ত দর-হাঁকিয়ের কাছে কি পণ্যটির মূল্য সমান, নাকি তা এক-একজনের কাছে এক-একরকম? তৃতীয় বিষয়টি হল কার কাছে কতখানি তথ্য আছে নিলামে চড়ানো পণ্যটির বিষয়ে।
বিশ্ব-জুড়ে বিভিন্ন ধরনের নিয়মে নিলাম ডাকা হয়। বহুলপ্রচলিত একটি ধরন হল ‘ইংলিশ অকশন’। এ ক্ষেত্রে নীচের দর থেকে শুরু করা হয়। সকলের দর শুনে নিয়ে প্রতিযোগীরা ঠিক করেন আরও উঁচু দর হাঁকবেন কি না। হযবরল-য় যেমনটা হাঁকছিল কাক্কেশ্বর আর বুড়ো। সর্বোচ্চ দর যিনি হাঁকেন, তিনিই নিলামে জেতেন। তাঁকে সেই দরটিই দিতে হবে, নাকি তার ঠিক নীচের দরটি, তাও ঠিক হয় নিলামের নিয়মাবলি অনুযায়ী। ‘ডাচ অকশন’-এর ক্ষেত্রে আবার ঠিক উলটোটা ঘটে। সবচেয়ে উঁচু দর থেকে শুরু করা হয়, এবং পরবর্তী হাঁকগুলিতে বিক্রেতা দর নামাতে থাকেন। হাঁকাহাঁকি চলতে থাকে যতক্ষণ না কোনো ক্রেতা জিনিসটি কিনতে চান। ‘ইংলিশ’ এবং ‘ডাচ’, দুটি নিয়মেই খোলা দর হাঁকা হয়। অর্থাৎ খেলায় দান দেওয়ার সময়ে প্রত্যেকেই দেখতে পান অন্যদের দেওয়া আগের চাল। সব নিলামে কিন্তু এমনটা হয় না। মনে করুন সরকারি অফিসে মুখবন্ধ খামে দরপত্র জমা দেওয়ার দস্তুর।
গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক প্রশ্নটি হচ্ছে, নিলামের এত রকম চালু প্রক্রিয়ার মধ্যে সেরা কোন্টি। যে-কোনো গূঢ় দার্শনিক প্রশ্নের মতো এর উত্তরও সহজ ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এ দেওয়া যাবে না। আগে দেখতে হবে নিলামের কোন্ ফলাফলটির নিরিখে আমরা বিচার করতে চাইছি। তারপরে দেখতে হবে ‘সেরা’ বলতে আমরা কী বুঝছি। বলাই বাহুল্য, একজন বেসরকারি বিক্রেতার অভীষ্ট হল সর্বোচ্চ দর পাওয়া। সরকার যদি নিলাম হাঁকে, আমরা আশা করব, তার মাথায় থাকবে পণ্যটি ব্যবহারের ফলে ভবিষ্যতে সমাজের কী ধরনের ক্ষতিবৃদ্ধি হতে পারে তা-ও। এ দেশে খনিজ সম্পদ নিলামের ক্ষেত্রে সরকার সেসব চিন্তাভাবনা কতখানি করছে, তা নিয়ে যেমন আরও অনেক লেখালিখির প্রয়োজন আছে।
দেখে বোঝা কঠিন, জাপানের একটি বাজারে চলছে ফুলের নিলাম
অন্যান্য বিকিকিনির সঙ্গে নিলামের মূল তফাত হল, একজন ক্রেতা সব সময়েই অন্য ক্রেতা কত দর হাঁকবেন, তা অনুমান করার চেষ্টা করেন। কে কত দর হাঁকবেন, তা কতখানি নির্ভর করে পণ্যটির গুণাগুণ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের উপরে? দর-হাঁকিয়েরা কি নিজেদের মধ্যে কোনো সমঝোতায় এসে সর্বোচ্চ দরটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? নিলামের তত্ত্ব এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।
১৯৯৬ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান উইলিয়াম ভিকরে। তাঁর কাজও নিলামের অর্থনীতি নিয়ে। একটি বিশেষ ধরনের নিলাম নিয়ে তাঁর তত্ত্ব। সেখানে নিলামে চড়ানো পণ্যটির মূল্য এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-একরকম। এই মূল্যকে বলা হয় ব্যক্তিগত মূল্য। পণ্যটি, ধরা যাক একজন নাম করা মানুষের সঙ্গে ডিনার করতে যাওয়ার সুযোগ। ভিকরে দেখান, ইংলিশ অকশন বা ডাচ অকশন, দুই ক্ষেত্রেই শেষ দর এক হবে, যদি দর-হাঁকিয়েরা সকলেই যুক্তিসংগত এবং ঝুঁকি-নিরপেক্ষ আচরণ করেন।
অন্যদিকে নিলামে চড়ানো বেশির ভাগ পণ্যেরই একটা ‘সাধারণ মূল্য’ থাকে। ভূসম্পত্তি বা খনিজ পদার্থ নিষ্কাশনের অধিকারের ক্ষেত্রে মূল্যের খানিকটা অংশ সকলের কাছেই সমান। সেই মূল্যের উপরে কে কতখানি দর হাঁকবেন, সেটা নির্ভর করে পণ্যটি সম্পর্কে তাঁর কতখানি ব্যক্তিগত তথ্য আছে তার উপরে। কাজেই এই সব ক্ষেত্রে কম দর হাঁকার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দর-হাঁকিয়েরা প্রত্যেকেই ভাবেন, অন্যেরা কম দর হাঁকছেন কারণ পণ্যটির আসল মূল্য কত তাঁরা জানেন। ভয় থাকে, বেশি দর হেঁকে নিলামে জিতলে আসলে হয়তো তা হারের শামিল হবে। এটিই নিলামের অর্থনীতির সুবিখ্যাত ‘উইনার্স কার্স’। উইলসনের কাজ সেই নিলাম নিয়ে যেখানে পণ্যটির সাধারণ মূল্য আছে। তাঁর ছাত্র মিলগ্রমের কাজ আবার এমন পণ্যের নিলাম নিয়ে, যেগুলির সাধারণ এবং ব্যক্তিগত, দু-রকম মূল্যই আছে।
শুধু তাত্ত্বিক কাজ নয়, এই জুটি নিলামের নতুন এবং উন্নততর প্রক্রিয়াও আবিষ্কার করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেই প্রক্রিয়ায় নিলাম হয়েছে রেডিও ফ্রিক্যুয়েন্সি, তাতে দর হেঁকেছে বিভিন্ন টেলিকম সংস্থা। তাঁদের প্রক্রিয়ায় যে শুধুমাত্র রেডিও ফ্রিক্যুন্সির বণ্টন দক্ষ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে তা-ই নয়, করদাতাদের স্বার্থও রক্ষিত হয়েছে।
নোবেল প্রাইজের ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিলগ্রম জানিয়েছেন পিএইচডির বিষয় হিসেবে নিলামের তত্ত্বে আগ্রহ বোধ করার আগেই তিনি ঠিক করেছিলেন উইলসনের কাছে কাজ করবেন। কারণ সকলেই বলেছিলেন উইলসনের কাছে কাজ করা উচিত। “নিজেকে বলেছিলাম, ওঁর আগ্রহের একটা বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে দেখি আমাকে কাজ করাতে উনি আগ্রহ বোধ করেন কিনা।” অচিরেই অবশ্য মিলগ্রমেরও ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে নিলামের তত্ত্ব।
Khub bhalo laglo. Sahoj bhasha jatil jinish bojhano janyo dhanyavaad.
দারুণ লেগেছে।
এই লেখাটা পরে আরো তিনটে শাখার কথা মাথায় এলো যে গুলো অর্থনীতির সাথে ভীষণভাবে সম্পৃক্ত |
১। অপারেশন রিসার্চ- ক্রেতা আর বিক্রেতার দুজনেরই অবজেক্টিভ ফাঙ্কশন আছে| ক্রেতার কাছে সব থেকে কম মূল্য আর বিক্রেতার কাছে সব থেকে বেশি মূল্য কিভাবে নির্ধারিত হবে সেখানে অপারেশন রিসার্চ এর ভূমিকা থাকতে পারে |
২। এনালিটিক্স - তৃতীয় নির্ধারক বিষয় তথ্য যেখানে এনালিটিক্স এর ব্যবহার করে ক্রেতা নিলামে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে দর হাঁকতে পারে |
৩। গেম থিওরী - ক্রেতা - বিক্রেতা আর ক্রেতা - ক্রেতা এর মধ্যে জেতা -হারা আছে তার সাথে আছে স্ট্রাটেজি আর প্রত্যেক স্টার্টেজির একটা নিজস্ব লাভ - ক্ষতির হিসাব বা পে -অফ ম্যাট্রিক্স অতএব গেম থিওরির আদর্শ আলোচনাক্ষেত্র |