এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  শিক্ষা

  • চমচম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | শিক্ষা | ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১০৬৭ বার পঠিত
  • আজকাল "organic education" বলে যে মিথের মতো একটি ধারণা হা-হা বাতাসে মাঝেমধ্যে লাট খায়, বেশিরভাগ সময়ই হতাশায় ("organic education দেবে, এমন সেন্টার কোথায়?", "আগেকার দিনে ছিল organic education! এখন তো সেমেস্টার!", প্রভৃতি), আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, এই organic education ব্যাপারটা কী? কোথাও স্পষ্ট ধারণা পাইনি। এবং সেমেস্টার মানেই organic নয়, আর পার্ট ওয়ান টু থ্রি মানেই organic (সেদিক থেকে যুক্তি দিতে গেলে আগেকার দিনের পার্ট টু ফাইনাল, বা ইলেভেনের স্কুল ফাইনাল তো প্রায় বেদজ্ঞানের পর্যায়ে পড়বে), এ আমার মানতে বেশ অস্বস্তি হয়। 
      
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিশ্বভারতী' পড়তে গিয়ে কিছু আলোচনা, ধ্যানধারণা সম্বন্ধে পরিচিত হলাম। তেমন কিছুই নয়, ভদ্রলোক বিশ্বভারতীর সুপ্তি থেকে বিকাশে যাওয়ার পথগুলি বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন ১৩২৮-এর বসন্তকালে। যেমন বুঝেছি, কয়েকটি ধাপে লেখার চেষ্টা করছি। ধাপগুলির নাম আমারই দেওয়া, নিজের বোঝবার সুবিধার জন্য:
      
    ১। আরম্ভকাল: বেশিটাই রহস্যাবৃত, তাঁর মতে। কোনো চিন্তা ঠিক কবে/ কেন শুরু হলো, ওভাবে লেবেল সেঁটে বলা যায় না। যেমন, উনি বলতে পারলেন না, পদ্মার বোটে বসে সাহিত্য লিখতে লিখতে কেন উনার ভাবজগৎ ছেড়ে কর্মজগতে ঢোকার ইচ্ছে জাগলো। সম্ভবতঃ ছেলেবেলায় কাঠখোট্টা ইস্কুলের যে দুঃসহ অভিজ্ঞতা, তার থেকে ভাবী প্রজন্মকে মুক্তি দেওয়ার তাগিদে। "প্রাণের সম্বন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই-যে বিদ্যালাভ করা যায় এটা কখনও জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারে না।"
      
    ২। অবতারণা: এই বিশেষ শিক্ষা-চিন্তা নিয়ে তিনি নানা জায়গায় বক্তৃতা দেন, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কথাগুলিকে গ্রহণ করা হয় "শ্রুতিমধুর কবিত্ব" হিসেবে। কাজেই, কিছুটা নিরুপায় হয়েই "ভাবকে কর্মের মধ্যে আকার দান করবার জন্য" কবি নিজেই উদ্যোগী হলেন। 
    "আমার আকাঙ্খা হল, আমি ছেলেদের খুশি করব, প্রকৃতির গাছপালাই তাদের অন্যতম শিক্ষক হবে, জীবনের সহচর হবে"। এই কথাটি খেয়াল রাখুন, ফিরে আসবো।
      
    ৩। শুরু: পাঁচ-ছ'জন ছেলেকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পড়ানো শুরু জামতলায়, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সাহচর্যে। "আমার নিজের বেশি বিদ্যে ছিল না। কিন্তু আমি যা পারি তা করেছি। ... রস দিয়ে ভাব দিয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়িয়েছি -- তাদের কাঁদিয়েছি হাসিয়েছি, ঘনিষ্ঠভাবে তাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের মানুষ করেছি।"

    ৪। হেডমাস্টার: ভারী মজার পর্ব এটি। কবির মনে হয়েছিল, একজন হেডমাস্টার দরকার। পাওয়াও গেল একজনকে। তিনি "ম্যাট্রিকের কর্ণধার"। কিন্তু ক'দিন যেতেই কবির কাছে তাঁর নালিশ -- ছেলেরা গাছে চড়ে, চেঁচায়, দৌড়োয়। কবির উত্তর: "দেখুন, আপনার বয়সে তো কখনও তারা গাছে চড়বে না। এখন একটু চড়তেই দিন না। গাছ যখন ডালপালা মেলেছে, তখন সে মানুষকে ডাক দিচ্ছে। ওরা ওতে চ'ড়ে পা ঝুলিয়ে থাকলই-বা।" বিদায় নিলেন হেডমাস্টার। প্রসঙ্গতঃ, তাঁর পড়ানোর ধরণ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তিনি পড়াতেন তাল গোল, বেল গোল, মানুষের মাথা গোল।
      
    ৫। Method in Madness: মাস্টারদের সঙ্গে লড়াই করে প্রায়শই রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের পক্ষ নিয়েছেন। তারা আশ্রম সম্মিলনী করে, গাছে চড়ে, ছবি আঁকে। একপ্রকার বাধামুক্ত। কিন্তু এর মধ্যেই একটু একটু করে তাদের কি শেখানো হচ্ছে? সকালে ও সন্ধ্যায় একবার করে জড়ো হয়ে সবাই বসে "প্রাচীন তপোবনের মহৎ কোনো বাণী" উচ্চারণ করা। হঠাৎ সব ছেড়ে এটা কেন, প্রশ্ন করুন ভদ্রলোককে। "এখানকার শিশুশিক্ষার আর-একটা দিক আছে। সেটা হচ্ছে -- জীবনের গভীর ও মহৎ তাৎপর্য ছোটো ছেলেদের বুঝতে দেওয়া।" বোঝে এই বাণী তারা? "...একটা বড়ো জিনিসের ইশারা পায়। হয়তো তারা উপাসনায় বসে হাত-পা নাড়ছে, চঞ্চল হয়ে উঠছে, কিন্তু এই আসনে বসবার একটা গভীর তাৎপর্য দিনে দিনে তাদের মনের মধ্যে গিয়ে পৌঁছয়।" অভ্যাস, আমরা খেয়াল করি। কিন্তু তফাৎ এখানেই যে এটা অভ্যাসের জবরদস্তি নয়। সারাদিন তাদের মুক্তি দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা সামান্য একটি অভ্যাস (একটিই, কিন্তু ধীর, গুরুত্বপূর্ণ) instil করা। 
      
    ৬। বিশ্ব-বরণ: এর মাঝে আরও কিছু ধাপ থাকতেই পারে, এভাবেই method এবং madness-এর মাঝে তাদের গড়ে তোলার। কিন্তু এই সব পূর্ণতা পাচ্ছে তথাকথিত শেষ ধাপে গিয়ে, যেখানে পূর্ণ বিকাশ দেখা না গেলেও তার আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে। নিজমধ্যে প্রাণের সঞ্চারের আভাস পূর্ণভাবে পেলে, বৈপরীত্যের মিশেলকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারলে তবেই বিশ্বের আঙিনায় উপযুক্ত হয়ে উঠছে ছাত্ররা, বা বিশ্বকে আহ্বান জানাচ্ছে তারা এই বিশেষ বিদ্যাভ্যাসে, চর্চায় তাদের সঙ্গী হতে।
       
    এর পর আলোচনা আরও নানাদিকে বাঁক নিচ্ছে। পরে এগোনো যাবে। আপাতত ফিরে আসা যাক ২ নং ধাপের যে কথাটি খেয়াল রাখতে বলেছিলাম, সেখানে। গাছপালা হবে শিক্ষক, জীবনের সহচর। এবং তার ঠিক আগের ধাপে উল্লেখ করা হচ্ছে প্রাণ থেকে বিচ্ছিন্ন শিক্ষার কথা। কাজেই, প্রথম কাজ তাঁর মতে, শিক্ষাপ্রণালীতে প্রাণসঞ্চার। সে কাজ কে করছে? প্রকৃতি। পড়তে পড়তে কিছুটা আভাস পাই, প্রকৃত শিক্ষার সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথের কাছে বইয়ের পাতায় নয়; গাছের পাতায়, মাটির কাছে। প্রসঙ্গতঃ, আগের একটি অধ্যায়ে বলছেন, জীবিকার লক্ষ্য প্রয়োজন, আর জীবনের লক্ষ্য পরিপূর্ণতা। এ থেকে হয়তো কিছুটা অনুমেয়, একবার প্রয়োজনে বাঁধা পড়ে গেলে পরিপূর্ণতায় ফেরা কঠিন। তাই পরিপূর্ণতার আভাস দিয়ে এই সূচনা। Organic education কথাটি ব্যবহৃত হয়নি কোথাও তাঁর লেখায়, তবে মনে হলো, একেই বুঝি বলা যায় organic হওয়ার শুরু। প্রকৃতির উন্মুক্ততা আর বইপত্রের অভ্যাসের মিলন। প্রকৃতি থেকে প্রাণের সঞ্চার প্রণালীকে জীবন দেয়, এবং সেই প্রণালী ওই একই প্রাণ দেয় ছাত্রদের, সেই ছাত্ররা সেই একই প্রাণ পাঠায় বিশ্বে; বিশ্বে, প্রকৃতিতেই ফিরে যায় প্রাণ।
      
    আর একটা কথা বলে শেষ করি আপাতত। বইটির প্রথম অধ্যায়ে লেখক বলছেন, নিজেকে জানতে হবে কেমন করে? "বিস্তীর্ণ এবং সংশ্লিষ্ট করিয়া না জানিলে, যে শিক্ষা সে গ্রহণ করিবে তাহা ভিক্ষার মতো গ্রহণ করিবে।" বিস্তীর্ণ এবং সংশ্লিষ্ট।
    বিস্তীর্ণ (বিস্তার)। expansion। বহির্মুখী।
    সংশ্লিষ্ট (সংশ্লেষ)। synthesis। অন্তর্মুখী।
    শুনতে পাচ্ছেন হৃদপিণ্ডের আওয়াজ? 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১০৬৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    অদ-ভূত!.. - Kasturi Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন