আর্থিক মন্দা, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, তার ওপর মহামারী ও সেই অজুহাতে দেশজোড়া লকডাউন এবং দক্ষিণবঙ্গে বিধ্বংসী ঝড় আমফানের ত্র্যহস্পর্শে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী তা ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই কাজে নেমে পড়তে হয়েছিল। বর্তমানের বহুমাত্রিক সংকট আমদের সামনে বেশ কয়েকটা চ্যালেঞ্জ যেমন হাজির করেছে তেমনই ভাবনার আর কাজের বেশ কয়েকটা দিক খুলে দিয়েছে। হাতে ছিল শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের জন্য সংঘর্ষ আর সংঘর্ষের জন্যে নির্মাণের ধারণা, আর অভিজ্ঞতায় বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত কিছু গল্প। সাধারণভাবে সারা বছর আমরা যারা সংঘর্ষেই থাকি তারাই নেমে পড়লাম মানুষের পাশে দাঁড়াতে, নানাভাবে সাহায্য করতে, প্রয়োজনে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজে; মানুষের থেকে অর্থ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ করে আবার মানুষের কাছেই পৌঁছে দেওয়ার কাজে। আপাত অর্থে এ কাজ আমাদের দৈনন্দিন কর্মসূচী আর চলার সাথে মানানসই না হলেও নির্মানের কাজ যে পুরোদস্তুর একটি রাজনৈতিক কাজ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ত্রাণের কাজ কীভাবে করছি, কী উদ্দেশ্যে করছি তার ওপর নির্ভর করছে কাজটাকে আমরা কীভাবে দেখছি; আবার আমাদের রাজনৈতিক চেতনার ওপরও নির্ভর করছে কাজটাকে আমরা কীভাবে সম্পন্ন করবো।
এই সংকটকালে আমরা আশপাশে এরকম বহু সংগঠিত উদ্যোগ দেখতে পেয়েছি, পারস্পরিক মত বিনিময় করেছি, সম্মিলিতভাবে সজাগ থেকেছি স্রেফ এনজিও ধরনের কাজের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি কিনা সে সম্পর্কেও। এই সংকটকালেও মানুষের প্রাপ্তি আসলে নির্বাচিত সরকারগুলোর কাছে। আর সরকারগুলোই সাধারণ মানুষের অধিকার, প্রাপ্যগুলোকে অস্বীকার করতে চায়, তার প্রতিক্রিয়ায় অপ্রাপ্তির বোধ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে, সেই ক্ষোভকে প্রশমনের কাজ করে এনজিওরা আপাতভাবে তাকে কিছু সাহায্য ক'রে। আর এই আপাতভাবে পেয়ে যাওয়ার মাধ্যমে মানুষকে চুপ করিয়ে রাখা যায়, অধিকার সম্পর্কে সচেতন না করে রেখে দেওয়া যায়।
এ পর্বে আমাদের সংগঠিত উদ্যোগ তিনটি আলাদা ধরনের কাজে নিজেদের সংগঠিতভাবে নিয়োগ করার জন্যে আলাদা আলাদা রকমের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আমি নিশ্চিত এ পোড়া সময়ে সে অভিজ্ঞতা আরও অন্যান্য সংগঠিত উদ্যোগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে পুষ্ট হবে; আগামীর রাজনীতি সম্মিলিতভাবে পরিপুষ্ট হবে।
তিনটি আলাদা ধরন: প্রথমটা কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন মফঃস্বল অঞ্চলের বস্তি, শ্রমজীবী অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কাজ। যদিও কলকাতার বাইরেও অন্যান্য জেলায়, সুদূর উত্তরে চা বাগানেও প্রায় একই রকম উদ্যোগের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ থেকেছে। দ্বিতীয়টা দেশ জুড়ে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে; আর তৃতীয়টা আমফান অধ্যুষিত উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ত্রাণের কাজ।
বস্তিতে বসবাসকারী অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে কাজের একদশকের অভিজ্ঞতা এই কাজটাকে খানিক হলেও সহজ করে দিয়েছিল। সচেতন প্রয়াস ছিল বস্তিবাসী মানুষদের নিজেদের উদ্যোগকে আরও বিকশিত করা এবং বিভিন্ন বস্তিতে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের পারস্পরিক ঐক্যের ভাবনা। অতীতে তৈরি হওয়া বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটির তরফ থেকেই কাজটা করা হয়। একসময় বস্তি উচ্ছেদ-বিরোধী লড়াই থেকে শুরু করে নাগরিক পরিসরে, কর্মক্ষেত্রে বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই - মাঠে-ময়দানে-আদালতে চালিয়ে যাওয়ার জন্যই আমরা গড়ে তুলেছিলাম এই সংগঠন।
দলমতনির্বিশেষে বস্তিবাসী মানুষের নিজস্ব শ্রেণিগত স্বার্থে কাজ করবে এই সংগঠন, হয়ে উঠবে তাদের নিজেদের সংগঠন - এই ছিল ভাবনা। আজ কোভিড আসার পর সেই লড়াই আরো অনেক কঠিন হয়েছে। সহ-নাগরিকদের দিক থেকে সংহতির প্রয়োজনীয়তা অনেক গুণ বেড়েছে। নিজেদের সাংগঠনিক পরিচিতি আর ভাবনাকে সঙ্গে নিয়েই নতুন নতুন বস্তি অঞ্চলগুলোতে এই কাজ চলতে থাকে। সংগঠনের উদ্যোগে শ্রমজীবী পরিবারগুলোতে রেশন পৌঁছে দেওয়ার সাথেই চালানো গিয়েছে বস্তিবাসীর অধিকার নিয়ে প্রচার, রেশনকার্ড আর প্রাপ্য সরকারি রেশন নিয়ে বারবার সরকারের দপ্তর, কাউন্সিলার, মেয়রের দপ্তরে ডেপুটেশন; নিজেদের কাজের জায়গায় বেতন পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে সমস্যা, কাজ থেকে ছাঁটাই হয়ে যাওয়া নিয়ে সমস্যায় তাঁর পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি। আর এ সবই করা গিয়েছে যতটা সম্ভব বস্তিবাসী শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করিয়ে। নিজেরাই এক বস্তি থেকে অন্য বস্তিতে যোগাযোগ তৈরি করেছে, পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি অর্থ সংগ্রহের কাজেও তারা উদ্যোগ দেখিয়েছে। গত ২৫শে মার্চ থেকে ৩১ শে জুলাই অবধি সময়ের মধ্যে ১৫০০ পরিবারকে নিয়মিত রেশন (প্রতি দু'সপ্তাহ অন্তর) ও ৩৫৩৩ পরিবারকে এককালীন রেশন, আমফান পরবর্তী সময়ে ১৫০ পরিবারকে শুকনো খাবার, ২০৯ পরিবারকে ত্রিপল দেওয়া হয়। ১০০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য খাতা ও কলম কেনা হয়।
পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর কাজটা একদম অন্যভাবে করা হয়েছে। মূলত একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছিল, বিভিন্ন রাজ্যে কোথাও আমাদেরই পূর্বপরিচিত, কোথাও নতুন খোঁজ পাওয়া স্বউদ্যোগী, ব্যক্তি, কোথাও স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন বা ছোটখাটো এনজিওদের সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতে বানানো হয়েছিল এই নেটওয়ার্ক। বেঙ্গালুরু, কেরালা, চেন্নাই, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, হরিয়ানা, আসাম এবং বাংলার বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পেরেছি। জমিতে কাজ এবং কেন্দ্রীয়ভাবে কাজটাকে মনিটারিং করার ব্যপারে বহু চেনা-অচেনা মানুষ উদ্যোগী হয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন। প্রথম এবং দ্বিতীয় লকডাউন পর্বে কাজ ছিল বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়া শ্রমিকদের সমস্যা মেটানোর জন্যে বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে যোগাযোগ করা, চাপ দেওয়া। তার পরের দফায় নেটওয়ার্ক আরও মজবুত হওয়ার সাথে সাথে গ্রাউন্ডে থাকা কর্মীরা রেশন পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। তৃতীয় দফায় যখন বোঝা যাচ্ছিল এতেও সমস্যা মিটছে না তখন অবস্থা বুঝে শ্রমিকদের গ্রুপগুলোর কাছে সরাসরি টাকা পাঠানোর কাজ করতে হয়েছে। এমনকি বাইরে আটকে পড়া বেশ কিছু পরিযায়ী শ্রমিকের গ্রামে থাকা পরিবারগুলোকে সাহায্য করা হয়েছে। একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালু হল তখন বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করার জন্যে একদিকে আর্থিক সাহায্য আর অন্যদিকে ‘নেতাকে বলো’ নামে একটা রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে জনপ্রতিনিধিদের চাপ দেওয়ার কাজে ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। গোটা পর্বে কয়েকশো মানুষ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছে আর তিন হাজারেরও বেশি গ্রুপ মারফৎ প্রায় সত্তর হাজার শ্রমিককে নানাভাবে সহায়তা করা গিয়েছে এই নেটওয়ার্ক মারফৎ।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে আমফান ঝড় দক্ষিণবঙ্গে নতুন সংকট এনে উপস্থিত করে। এক, কেন্দ্র সরকারের বাংলা বঞ্চনার নীতি আর দুই রাজ্যে সরকারি ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল দলটার স্থানীয় নেতা, জনপ্রতিনিধি, লুম্পেনদের সম্মিলিত দুর্নীতির ফলে প্রয়োজনীয় সরকারি ত্রাণ মানুষের হাতে পৌঁছয়নি। এক্ষেত্রে খাদ্য সামগ্রী আর ত্রিপল নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা নিছকই একদম সংকটের সময়ে পাশে দাঁড়ানোটুকুই। কিন্তু ওতে দায় মিটে যায় না, যায়নি। মানুষ তার সরকারি প্রাপ্য নিয়ে সচেতন নয়, আমরা সচেতন করতে গেলাম এ ধারণাটা ভুল। বরং অন্য জায়গায় ভূমিকা নেওয়ার আছে-- একজোট করা, শাসকদের নজরদারি এড়িয়ে, রক্তচক্ষু এড়িয়ে সংগঠিত হওয়া যায় কিংবা শাসকদলগুলোর ধামা না ধরেও কিছু করা যায় তার সাহসটুকু জোগানো, অত্মবিশ্বাস তৈরি হতে সাহায্য করা। ত্রাণ দিয়ে কিংবা সরকারি ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে আমরাই ত্রাতা, শুধু এই হিসেবে উপস্থিত হলে তা সমস্যাজনক।
উত্তর আর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ জায়গায় আমফান রিলিফ নেটওয়ার্ক নামে একটা তাৎক্ষণিক নেটওয়ার্ক ধরণের মঞ্চ বানিয়ে ত্রাণের কাজ চলতে থাকে গোটা মে-জুন মাস ধরে। পাথরপ্রতিমা, নামখানা, মথুরাপুর, রায়দিঘী, কুলতলি, জয়নগর, ক্যানিং, বাসন্তী, গোসাবা, মিনাখা, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, বসিরহাট, হাড়োয়া, মিনাখাঁর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দফায় দফায় এই কাজ এগোনো গিয়েছে। সঙ্গে WBDF এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের আয়োজনে বহু স্বাস্থ্য ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা করা হয়।
বাম আন্দোলনের ঐতিহ্য ব্যতিরেকেই বলতে পারি সংকটের সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইতিহাস বাংলার সমাজে আছে এবং তা পাপপুণ্যের ভাবনার বদলে সামাজিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করার বিষয়টাই বাঙালির মনে ঢুকে আছে। অতীতেও দেখেছি হরেক কিসিমের সামাজিক সংগঠন, বিদ্যালয়, ক্লাব, রাজনৈতিক দল কিংবা গণসংগঠন এই কাজে নেমে পড়ে, হয়তো বা কোনো রাজনৈতিক দিশা ছাড়াই। বামপন্থীদের তো অন্তত শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব মাথায় নিয়েই নামা উচিত। নিছক সংগঠন গোছানো কিংবা সরকারি ত্রাণ না পাওয়া নিয়ে মানুষের ক্ষোভকে তড়িঘড়ি বিক্ষোভে-বিদ্রোহে রূপ দিয়ে চটজলদি রাজনৈতিক তৃপ্তির বদলে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কাজটাকে যথাযথভাবে নির্মাণ করতে পারলে আগামীদিনের রাজনীতি, সংঘর্ষ আর সংগঠন তৈরি করার কাজটা স্বাভাবিকভাবেই সহজ হয়ে যায়।
বড় নেটওয়ার্ক বানিয়ে অনেক জায়গায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়াই কী নির্মাণ? তাহলে তো ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ বা রামকৃষ্ণ মিশন, এবং এইরকম আরও অনেক এন জি ও এই কাজ অনেকদিন ধরে করে আসছে। তাদের কী আমরা শঙ্কর গুহনিয়োগীর ধারায় নির্মাণ করছে বলব? এই লেখায় ত্রাণ বিলির পর ঠিক কী নির্মিত হল, বিকল্প "প্রতিষ্ঠান" বা বিকল্প "মানসিকতা" কী গঠিত হল সেটা পরিষ্কার নয়। আর দাবী সম্বন্ধে সচেতন করা, দাবী আদায়ে সাহায্য করা - এটা তো সঙ্ঘর্ষের ধারণা।সব রাজনৈতিক দলই এই কাজ করে থাক। অন্তত এটা করে থাকে বলে দাবী করে।
আপনাদের উদ্যোগ ভীষণ জরুরী, এবং অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু এখানে একে জোর করে "নির্মাণের" ধারণার সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে বলে আমার মনে হয়েছে।