নেপাল এখনো প্রতিদিন কাঁপছে, মূল ভুমিকম্পের ২০ দিন পরেও। ১২ তারিখ রক্সৌলে নেমেই একটা বড়সড় ভূমিকম্পে সামনের দিনগুলোর মানসিক প্রস্তুতি আপনে আপসেই হয়ে গিয়েছিল। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা; একটা অচেনা অনুভুতি; নিজেদের জন্য ভয়, অপরের জন্য দুঃখ, প্রাকৃতিক নিয়ম-হওয়ারই কথা গোছের সচেতনতা-বলা ভাল উদাসীনতা আর 'যাবই' গোছের প্রত্যয় মিলেমিশে গেলে যা হয়, সেরকমই।
ভূমিকম্প যা না কাঁপিয়েছে তার থেকেও বুক কেঁপে উঠেছে এক একটা গোটা গ্রাম ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়ে গেছে দেখে। পাহাড়ের ওপর খাদের ধারের গ্রামগুলোর একটা বাড়িও আস্ত নেই। মাটির গাঁথনির পাথরের বাড়িগুলো তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছে। কাটমান্ডু শহরের ওপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে গেলে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে খুঁজতে হয় কোথায় বাড়ি ভেঙেছে- পাহাড়ি গ্রামের চিত্রটা একদন অন্য। শহরে মূলত ট্র্যাডিশনাল, পুরনো, নতুনদের মধ্যে ডিফেকটিভ কিছু বাড়ি ভেঙেছে বটে। তবে কি গ্রাম কি শহর, কি ধন কি বড়লোক, ঘর আছে-ভেঙ্গে গেছে যে দিক থেকেই দেখা হোক না কেন সবাই আতঙ্কে ফুতপাথবাসী- খোলা আকাশের নিচে ত্রিপল খাটিয়ে।
আমরা কলকাতা থেকে Friends of west Bengal in Solidarity with Nepal নামে রক্সৌল হয়ে নেপাল ঢুকেছিলাম। সঙ্গে ছিল প্রত্যারপনের আমিনুল দা আর সঙ্ঘমিত্রা দি। প্লিউম অ্যাডভেঞ্চার, অতএব, নক্ষত্র-র বন্ধুরাও যাওয়ার দিন সঙ্গে থেকেছে। নেপালি ভারতীয় একতা মঞ্চের লক্ষ্মণ পন্থের সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ রেখেছিলাম। অদিকে কাঁকরভিটা হয়ে শমীকদার নেতৃত্বে লালিগুরাস পত্রিকার থেকে চার জন এসে কাটমান্ডুতে আমাদের সাথে যোগ দেয়। CPNM এর সাথীদের সহযোগিতাও পাই প্রচুর।
আমরা দুটো টিমে ভাগ হয়ে গিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুটো জেলায় কাজ করেছি। একটা গোর্খা অন্যটা কাব্রে। দ্বিতীয় দলের কাজের জায়গাটা ভুমিকম্পের উপকেন্দ্র সিন্ধুপালচকের কাছাকাছি, চিনের সীমান্তে। আর প্রথম দলের কাজের জায়গাটা ঘ্যাচক নামে একটা দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম। ট্র্যাক্টরে করে পাহাড়ি রাস্তায় মাল নিয়ে উঠতে হল। নিকটবর্তী শহর থেকে ৪০ কিমি দূরে। নিয়মিত কোনও গাড়ি চলে না। গ্রামের লোক খাড়াই ঢাল বেয়ে নদীর চর আবধি ওঠানামা করে। নদির চরে বালুয়া গ্রাম থেকে দিনে তিনটে বাস চলে। ব্যাস! কমিউনিকেশন বলতে ওটুকুই। দরদি নদীর তিন হাজার ফুট ওপরে মানাসালু পিক এর দক্ষিন পুবে তিনদিক পাহাড় ঘেরা একটা প্রায় ঝুলন্ত উপত্যকা; উত্তর দিকটা উন্মুক্ত; পুব দিকে দেওয়ালের মত যেটা উঠে গেছে সেটাকে পাহাড় না বলাই ভাল- নাম দেওয়া যেতে পারে বিভাজিকা। তাও তাতে যত ফাটল আর স্কার তৈরি হয়েছে কদিন থাকবে সেটাই সন্দেহের। আমরা যেখানেই যাই কচিকাঁচারা জুটে যায়; তারাই টেনে নিয়ে গেলো তাদের স্কুলটায়, ঐ বিভাজিকার ওপর। স্কুল নয়, স্তূপীকৃত পাথরের চাঁই এর মধ্যে থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কিছু দরজা আর জানালার ফ্রেম। 'এটা ক্লাস এইট', 'এটা ফাইভ', 'এখানে মাস্টাররা বসতো'-প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছিল। আমাদের ঘিরে একদঙ্গল বাচ্চা ছেলে মেয়ে, আর সামনে ভেঙ্গে পরা স্কুলটা। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল-' কি হত এদের ভুমিকম্পের দিনটা যদি শনিবার(ছুটির দিন) না হত.........।' নাঃ, ভাবতে পারছি না।
স্কুলের উঠোনটার কিনারে দাঁড়ালে গ্রামটা দেখা যায় অন্তত তিনশো ফুট নিচে। শ্মশান হয়ে যাওয়া গ্রামটা মনে মনে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছিলাম। উত্তর দিকে খাদের নিচে নদী, উত্তর পশ্চিমে একফালি বরফ শৃঙ্গ, তিনদিকে পাহাড়ে ধাপ কেটে চাসবাস। আর পরিপাটি করে সাজানো একটা (সম্ভবত শতাব্দি প্রাচীন) মনোরম সুন্দর একটা পাহাড়ি গ্রাম। উত্তর দক্ষিনে বিস্তৃত মূল রাস্তার দুদিকে সার দেওয়া রংচঙে- নকশা আঁকা বাড়ি। রাস্তার ওপর পাথরের স্তুপ হয়ে থাকলেও রাস্তাটা চেনা যায়। ইতস্তত পড়ে আছে গাছের পাতা দিয়ে বানানো কৃষকের টুপি, কাঠের পুরনো ভাঙা পিপে, অজস্র লোহার ট্রাঙ্ক, চিনা মাটির বাসনের টুকরো, পুরনো খাতা, ভাঙা হারিকেনের ফ্রেম। বান্ডিল বাঁধা অসংখ্য ভুট্টা সমেত টিনের চাল গোঁত্তা খেয়ে পড়েছে। ত্রিপলের অস্থায়ী ঘর থেকেও চা খাওয়ার আমন্ত্রন এসেছে একাধিকবার। গ্রামের তলার দিকে খাড়াই পাহাড়টায় নাকি একাধিক ধ্বস নেমেছে। নদীর উল্টোদিকের পাহাড়টাতে অন্তত ২০ টা নতুন ধ্বস দেখা যায়। ঐ পাহাড়ের গ্রামটায় নাকি ৬৮ জন মারা গেছে, এখনো লাশ বেরোচ্ছে, এ গ্রামে ১৮ জন। আসার পথে ভাঙা গ্রামগুলো দেখিয়ে আমাদের ড্রাইভার মৃত্যুর কথাই বলছিল, এগ্রামে ১১, ওগ্রামে ৯, এই গ্রামটায় ২৫- এটাই যেন এখন গ্রামগুলোর পরিচিতির মানদণ্ড।
বাচ্চাগুলোর হাতে খেলনা সামগ্রী তুলে দিতেই গোটা উপত্যকাটা নানা রকম বাঁশির আওয়াজে ভরে গেলো। পাহাড়ের বিভিন্ন দিকের ঢালে ছড়িয়ে থাকা গ্রামটার ৯ টা ওয়ার্ডে ত্রাণের সামগ্রী বণ্টনের একটা মেকানিসম নিজেরাই ডেভেলপ করিয়েছে। লিস্ট সমেত মাল এক জায়গায় করা হল, সমিতির তত্তাবধানে তা বিতরণ হবে বলে। স্কুলটার পুনর্নির্মাণ আর হেলথ সেন্টারটার জন্যে ৫০০০০ টাকা তাদের হাতে তুলে দেওয়া হল।
আর একটা টীম কাল করেছে কাব্রে জেলার সেপিং গ্রামের দেওরালিতে। কোশী নদীকে ডান দিকে রেখে সজা ওপরে উঠে যেতে হয়। এ রাস্তায় বাস চলতে পারে এ ধারনাই অবিশ্বাস্য। ঢেউয়ে নৌকা যেমন দোলে সেরকম নাচতে নাচতে বাসে করে উঠতে হয়। এখানে অনিয়মত ভাবে নিয়মিত বাস চলে। অনেকগুলো ল্যান্ডস্লাইড জোন পেরিয়ে তবে পৌঁছনো। গ্রামটার ৮ টা ওয়ার্ড, প্রায় পুরটাই ধুলিস্যাত, ১৯ জন মারা গেছে। গ্রামটায় বেশিরভাগই দলিত আর আদিবাসিদের বাস, তাই স্বাভাবিকভাবেই ত্রাণ যায়নি। স্কুলটাও গেছে। দুদিনে রোগি দেখা হয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশো। মৃতদের পরিবার আর দলিত পরিবারগুলোতে হাতে করে ত্রাণ দিয়ে আসা গেছে। গ্রামগুলোয় বাইকে করে ঘুরে আসা গেছে দুজন করে। ঘটনা ঘটে যায়, দলিতরা নির্বাক দর্শকের মত থেকে যায়, ত্রাণ যায় না, নিদেনপক্ষে হাত পেতে চাইতেও পারে না- তাদের এমনটাই শিখিয়েছে সমাজ। আমরা অন্তত তাদের কাছে যেতে পেরেছি।
বিরাটনগর থেকে ওদিনই একটা ৪০ জনের টীম এলো ওখানে। তাদের পরিকল্পনা অভিনব। ত্রাণের কাজে নতুন মাত্রা যোগ করলো। তাঁরা এসেছেন যে সব বাড়ি ধুলিস্যাত হয়ে গেছে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সেগুলো পুনর্নির্মাণ করতে। অতি উৎসাহে আমরাও নেমে গেলাম সে কাজে। আগামী ১০ দিন থাকবেন তাঁরা, ওখানেই একটা যৌথ রান্নাঘর চালাবেন, মেডিকেল ক্যাম্প চলবে। একটা সুসম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর গ্রামবাসীদের প্রয়োজনমত ত্রাণও দেবে।
দীর্ঘদিন রাজতন্ত্র চলা নেপালে সংবিধানসভার নির্বাচন হলেও স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচন গত কয়েক দশক হয়নি। আমলাতন্ত্রও নড়বড়ে। আমলাতন্ত্রের লাল সুতোর গেঁড়োয় ত্রাণ বণ্টন, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব, পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সবই অধুরা। যেটুকু যা হচ্ছে টা মূলত কমিউনিটির শ্রমদানের মারফৎ। সরকারি দলগুলোও আন্তর্জাতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে এই সুযোগে। ভারত সরকার, ভারতের সেনাবাহিনী এটা করেছি ওটা করেছি বলে বাংলা ভাট বকে গেছে,যা করেছে শহর কাটমান্ডুতে, গ্রামে যায়নি; অভিযোগ আছে তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল নেপালে আটকে পড়া ভারতীয়দের দিকে বেশি পক্ষপাতিত্ব করার। গ্রামাঞ্চলে, অন্তত লোক দেখানো হলেও কাজ করেছে অস্ত্রেলিয়া, ডেনমার্ক আর চীন। কি জানি তারাও হয়তো নিজেদের দেশে আরও বেশি ভাট বকছে।